একটা নদী ছিল। পাহাড়ী নদীর মত উচ্ছ্বল। তার সেই খরস্রোতা নদীর নাম দিয়েছিল হৃদয়। কে? সে একটা লোক। নদীটার অনেক স্বপ্ন, পাথরের বুকে নুড়ির মত গড়িয়ে গড়িয়ে ছুটত। এখানে ওখানে ছোটো বড়ো পাথরে ঘা খেয়ে দিক বদলাতো, তবু হার মানত না। ছুটেই যেত, এগিয়েই যেত, গড়িয়েই যেত। কখনো ধীরে, কখনো বিদ্যুৎ গতিতে।
সমতলে এসে পড়ল। কিছু নুড়ি হারিয়ে গেল। কিছু রয়ে গেল। যেগুলো হারালো, সেগুলোও আসলে রয়ে গেল, জলে মিশে, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে। কেউ জানত না, নদী জানত। চিনতে পারত। সজল স্নেহে আগলে রেখে নিয়ে চলত। ধীরে ধীরে সূর্যের তাপ উঠল বেড়ে, ধীরে ধীরে আশেপাশের চেহারা গেল বদলে। আগে ছিল জঙ্গল, পরে এলো ঝাউবন, তারপর এলো লোকালয়। এলো লোভ, এলো ঈর্ষা। স্বপ্নরা ধীরে ধীরে বদলে হল আকাঙ্ক্ষা। আকাঙ্ক্ষারা বদলে হল উচ্চাকাঙ্ক্ষা। নদীর বুকের তলায় তৈরী হতে লাগল ঘূর্ণী। প্রথমে ছোটো ঘূর্ণী, তারপর ধীরে ধীরে তৈরী হল বড় ঘূর্ণী। নুড়ি ভেঙে পলির সাথে মিশে হল পাঁক। নদীটা পথ হারালো। গতি হারালো। নদীটার নাম ছিল হৃদয়। শুকিয়ে যেতে লাগল ধীরে ধীরে। একদিন সত্যি সত্যিই শুকিয়ে গেল।
নদীটার এখানে ওখানে এখন জমা জল। একটা বড় জমাজলের হ্রদ আছে। ওর নাম এখন হৃদয়। আসল না, নকল। যে লোকটার গল্প এটা, সে রোজ এখন কয়েক মাইল হেঁটে অন্য নদী থেকে জল বয়ে নিয়ে আসে। দিনের বেলায় যায় না। যায় রাতের অন্ধকারে একা, চোরের মত। জল চুরি করে নিয়ে আসে। এনে ঘড়া ঘড়া জল ঢালে হ্রদটার বুকে। সারাটা দিন চলে সূর্যের সাতটা ঘোড়ার সাথে অসম্ভব লড়াই। পারবে কেন? ঘোড়াদের অসীম তৃষ্ণা! সে তৃষ্ণা মেটাবে কি করে চুরি করে আনা জল? পারে না। বেলা বাড়লেই জল যায় শুকিয়ে। থাকে শুধু ফাটা অববাহিকা জুড়ে মরীচিকার প্রেতনৃত্য। লোকটা বৃষ্টির অপেক্ষা করে। মেঘ আসে না। মেঘের বুকে তার শুকানো নদীর জল। সে জল আসতে চায় না এইদিকে আর। সে ফিরে গেছে পাহাড়ের মাথায় আবার, নতুন নদীর খোঁজে।
লোকটার এখন হ্রদ ভরা কৃত্রিম ঢেউ। তাতে আন্দোলন আছে, সুখ নেই। প্রেমের মত পদ্ম ফোটে, কিন্তু তাতে গন্ধ নেই। ফলে কোনো ভ্রমর আসে না এদিকে। ফুলগুলো ঝরে যায় অবেলায়। লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। একা বসে থাকে। হারানো নদীটার স্বপ্ন দেখে, চোখের পাতা ভেজে, কিন্তু নদীর বুক ভেজে না।
লোকটা ভাবে, কাকে চাইবে সে? ভগীরথকে না মৃত্যুকে? তার হ্রদের নাম হৃদয়। আসল না, নকল। নকল হৃদয়ে ভয় হয় না, তার বদলে আসে বিষাদ। লোকটা ভাবে, ভাঙাবে কি করে মেঘের অভিমান? মেঘ কি দেবে - বৃষ্টিপাত না বজ্রপাত?
সৌরভ ভট্টাচার্য
9 February 2017