সৌরভ ভট্টাচার্য
23 January 2019
বুদ্ধ ধ্যানমগ্ন। শিষ্যেরা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বসে, ধ্যানমগ্ন। চতুর্মাস্যের কাল। সদ্য শ্রাবণের মেঘরাজি সপ্তসাগর সংগৃহীত জলরাশিপূর্ণ ঘট উপুড় করে ধরিত্রীকে ভাসিয়ে গেল।
বুদ্ধ চোখ মেললেন। মুহূর্তে কীটপতঙ্গ, তরুদল, পশুপাখির সাথে মানবকূল করুণাপ্লাবিত হল, শ্রাবণের বর্ষণকে লজ্জিত করে। বুদ্ধ দেখলেন আনন্দ দাঁড়িয়ে সামনে, যেন কিছুর প্রতীক্ষায়।
বুদ্ধ স্মিত হেসে বললেন, কি বার্তা আনন্দ?
আনন্দ বললেন, বঙ্গদেশ হতে আগত কোনো এক কবি, জয়দেব নাম, দর্শনার্থী প্রভু।
তথাগত মস্তকের মৃদু আন্দোলনে সম্মতি জানালেন।
কবি জয়দেব, সাদা উত্তরীয় আবৃত দেহ, ধীরে ধীরে এসে আভূমি লুণ্ঠিত হয়ে প্রণাম জানালেন বুদ্ধের পায়ে।
বুদ্ধ দক্ষিণহস্ত ঊর্দ্ধে তুলে, জ্ঞানমুদ্রায় দিলেন আশীর্বাদ। বললেন, আলোকিত হোক চিত্ত, যুগান্তরের অজ্ঞানতা নাশি বোধের জ্যোতিতে, হও বুদ্ধ বৎস।
জয়দেব করজোড়ে বললেন, হে করুণাময়, যদি শোনেন এ দীনের কাব্য, করেন করুণাকণা দান, ধন্য হয় তবে এ প্রাণ, এই ক্ষুদ্র মনস্কাম।
বুদ্ধ স্মিত হেসে বললেন, তথাস্তু।
শুরু হল কাব্যপাঠ - গীতগোবিন্দ উচ্চারিত হল মধুরকণ্ঠে, বীণাসম ঝংকৃত সে তান।
দেখতে দেখতে শ্রাবণের মেঘ সারা আকাশ পুনরায় ঘিরে দাঁড়াল। যেন কি এক উৎসবের আয়োজনের ভার তাদের ওপর। ময়ুর পেখম মেলল সবুজ প্রান্তরের দিকে দিকে। যে কদম্বদল এতক্ষণ কি এক লজ্জায় নিজের শোভা গোপনের প্রয়াসে ছিল, তারা হল মুখর, আত্মহারা প্রায়। কোথা থেকে সহস্র মধুমক্ষিকা জুড়ল তান, বৃষ্টির ধারাপাতের সাথে সাথে। কবিকণ্ঠের তান ছুঁলো স্বর্গলোকের সুর।
বুদ্ধের আঁখিপল্লব অবরুদ্ধ। তার কোনায় ঈষৎ সিক্ততার আভাস। বুদ্ধের মানসলোক আলোকিত করে উদ্ভাসিত যশোধরা। কতযুগ পরে জয়দেবের কণ্ঠের স্বরে ভেসে এলো যশোধরার কণ্ঠের সুর। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল যশোধরা। যশোধরার স্থির শান্ত দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে বুদ্ধের অন্তঃশ্চক্ষুদ্বয়। সে কি করুণা? নয় তো। সে তো কামও নয়। কোনো আসব নয় এ। তবু বুদ্ধের প্রাণের কোনায় যে জাগছে সে কি? জয়দেবের সুরে যা বাজল সে কি? বেদনা। এ বেদনার অনুভূতি এই প্রথম বুদ্ধের। নির্বাণের সাথে এর যেন কোনো বিরোধ নেই। নির্বাণ তার শুদ্ধ স্নিগ্ধ আলোকিত শরীরে তাঁর সামনে দাঁড়ালো এসে। তার পায়ে নূপুর। তার আয়তনেত্রে কাজলরেখা। তার একদিকে দাঁড়ালো ঊষা, আরেকদিকে দাঁড়ালো সন্ধ্যা। মাথার উপর ঘনিয়ে এলো শ্রাবণের মেঘ। সেই শ্রাবণের মেঘের উপর ফুটে উঠল একে একে তারা। সেই অজানা নারীর কেশরাশি মিশে সেই মেঘে। সমস্ত বাধা-বন্ধন একে একে শাখান্বিত লতা হয়ে সেই নারীর অঙ্গকে আলিঙ্গন করে কি এক অপূর্ব শোভা সৃষ্টি করল। তাতে ফুটল ফুল। মধুকরের গুঞ্জন, কোকিলের কূজন সে শাখাকে ঘিরে ঘিরে সুরের আবরণ তৈরি করল। যা কিছু অসুন্দর, যা কিছু পাপের মত ঘোর কালো, বৃষ্টির জলের সাথে মিশে কোথায় ভেসে গেল।
বুদ্ধের মনে শঙ্কা জাগল। এ কি মার তবে? তার সাধনকালে সে নানা ছলে তাকে বিপথগামী করতে তো চেয়েছিল। সে ভাবনাটা একটা কাকের কর্কশ স্বরের মত সেই শাখারাজির দিকে ধাবমান হল। সে নারী মৃদু হাসল। একবার কটাক্ষে চাইল আকাশের দিকে। গগনভেদী রোল তুলে পড়ল বাজ। চারদিকের আলো আলো। চোখ গেল ধাঁধিয়ে। বুদ্ধ চেয়ে দেখলেন কোথায় সে নারী? কোথায় তাঁর নির্বাণের প্রশান্তি। এ যে পরম শূন্যতা! বুদ্ধ ব্যাকুল হয়ে মেললেন চোখ। জয়দেবের পাঠ ততক্ষণে সমাপন হয়েছে। তিনি উদগ্রীব হয়ে বুদ্ধের মুখের দিকে তাকিয়ে। বুদ্ধ কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
চারদিক নিস্তব্ধ। ধীর বাদল হাওয়া কোমল স্পর্শে ধরিত্রীর ক্লান্তি, শ্রান্তি অপনোদন করছে। আকাশ মেঘমুক্ত। বুদ্ধ আবার তাকালেন জয়দেবের দিকে। জয়দেব নতনেত্রে মাটির দিকে তাকিয়ে অধোবদনে বসে। বুদ্ধ বললেন, বৎস, মুখ তোলো।
জয়দেব তাকালেন বুদ্ধের দিকে।
বুদ্ধ বললেন, তোমার কাব্য অপূর্ব, তবে তা আমার পথ নয়, তুমি জানো।
জয়দেব বললেন, জানি প্রভু, তবে সব পথের গন্তব্য কি এক নয়? আপনি তো পথিক নন। পথিকের হয় পথের ভ্রান্তি, আপনি তো বুদ্ধ, সমস্ত পথের শেষে আপনার আসন।
বুদ্ধ বললেন, আমার পথ যে ত্যাগের, তুমি তো জানো।
জয়দেব বললেন, এও কি ত্যাগ নয়? যে মেঘ বাদলধারা বুকে করে ভেসে বেড়ায় সেকি নিজেকে নিঃস্ব করেই পৃথিবীর প্রেমের মূল্য দেয় না? যে মুকুল পুষ্পের আবরণ, সেকি নিজেকে ফুরিয়ে ফেলে ফুলকে বিকশিত করে না?
বুদ্ধ বললেন, শুধু এ ত্যাগ, সে ত্যাগ তো নয়? তুমি দেখোনি, আগ্নেয়গিরি সর্বাগ্রে নিজে নিজের তপ্ত লাভায় দগ্ধ হয় তবেই সে তাকে ত্যাগ করে। ত্যাগ এমনই দাহ্য। সংসার যে তৃষাগ্নিতে দগ্ধ হচ্ছে তাকে শান্ত করতে ত্যাগের শান্তিবারি আনতেই হবে। তবে তা মাধুর্যের পথে না, সে আত্মদহনের মাধ্যমে।
জয়দেব বললেন, মার্জনা করবেন প্রভু, মাতা যশোধরা কি সেই দহনে দগ্ধা নন?
বুদ্ধ মৃদু হাসলেন। বললেন, তাপকে স্থুল পার্থিব মায়া বলি না। কিন্তু দেহের ঊর্দ্ধে চৈতন্যকে উঠতে গেলে নিঃসঙ্গ হতেই হয়। বাইরের ত্যাগ জড়ের আবরণকে ছিন্ন করে নিজেকে ভিতরে পায় পরম মাধুর্যে - স্বমহিমায়, স্বলোকে, স্ব-আনন্দে। কিন্তু সে দহন দানের পর। তাই বাইরে আমাদের যে দূরত্ব জয়দেব সে শুধুমাত্র বাইরের। তুমি তো জানো ভিতরে যাকে নিবিড় করে পাওয়া যায় তাকেই বাইরে ত্যাগ করা যায়। তুমি বোঝো তা। কিন্তু মূঢ় মানুষ চায় চাষের শ্রমকে মিথ্যা বলে, এড়িয়ে, ফসলের পরিপূর্ণতার আনন্দ। সে ভোগের মোহ। নিজেকে নিজে অর্জন করতে হয় জয়দেব, উপার্জন নয়। উপার্জনের ফল মানুষ যা পায় সে পায় তার বাহ্যিক সত্তায়, অর্জনে নিজেকে লাভ করে অন্তরাত্মায়, স্বচৈতন্যে। কিন্তু সে পথের মূল্য যে দিতেই হবে।
জয়দেব নীরব রইলেন। বুদ্ধও ধ্যানমগ্ন হলেন। তাঁর চেতনার সামনে নির্বাণ এই মুহূর্তে আটপৌরে যশোধরার বেশে। যে যশোধরা এই মুহূর্তে শ্রমণ সজ্জায়, অন্য শিবিরে। বুদ্ধ চোখ মেললেন।
জয়দেব চলে যাচ্ছেন। বুদ্ধ ডাকলেন, জয়দেব?
জয়দেব ফিরে তাকালেন।
বুদ্ধ বললেন, তোমার এ কাব্য যশোধরা শুনবে, তবে এ জন্মে নয়, সে জন্মাবে নদীয়ায়।