Skip to main content

জয়দেব ভিজছেন। আষাঢ়ের প্রথম বর্ষা। চারদিক ঝাপসা হয়ে আছে। জয়দেব স্থির দাঁড়িয়ে। হাতদুটো বুকের কাছে জড়ো করা। জয়দেব তাকিয়ে শ্রীমন্দিরের দিকে। পতাকাটা আষাঢ়ের সজল বাতাসের দাপটে যেন সব ছিন্ন করে উড়ে যেতে চাইছে। জয়দেবের বুকের মধ্যেও যেন এক অবস্থা। জয়দেবের চোখের জল বর্ষার জলের সঙ্গে মিশে একাকার। যেমন নীলাচলে গলছে আষাঢ়ের আকাশ।

    জয়দেব বালিতে দাঁড়িয়ে আছেন। যে বালি মাত্র গতকালই এমন তেতে ছিল যে সেখানে পা ফেলা দায়। আর এখন দেখো, পা যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে বর্ষার ধারা। এমনই হয়। এও যেন জয়দেবের চিত্তেরই অবস্থা। অদর্শনে এমন তেতে থাকে সহ্য করা দায়। আবার দর্শনেই সব জুড়ায়। জয়দেব বোঝে না, তার বুকের মধ্যে কবে জন্ম নিলেন শ্রীরাধিকা!

    জয়দেব আজ মন্দিরে যাবেন না। তার ইচ্ছা এই বর্ষাঘেরা নির্জনে সে আসুক এই নীলাচলের কূলে। কেন আসবে না? তুমি তো নির্জনতা চাও! এই দেখো, এই তো আমার কান্নাঘেরা নির্জনতা। এসো, প্রভু, এসো। আজ তুমি এসো অভিসারে। আজ আমি যাব না। তুমি এসো।

    সত্যিই সমুদ্রের তীরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। চারদিক শুধু জলের ধারা। দিনের আলো যেন ভিজে যাচ্ছে বর্ষাধারায়। কিন্তু সত্যিই কি তিনি আসবেন না? তা হতে পারে না। তা হয় না। জয়দেবের অন্তরের শ্রীরাধিকার মনে জমছে অভিমান।

    জয়দেব হঠাৎ দেখলেন, আপাদমস্তক শাড়ি জড়িয়ে কোনো এক নারী ধীর পায়ে এগিয়ে আসছেন এদিকে, বর্ষার জল আর বাতাসের দাপটের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে। তিনি এগোচ্ছেন যেন বিবশ হয়ে। কেউ যেন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জয়দেবের দিকেই এগিয়ে আসছেন। জয়দেব মহিলাকে চেনেন মনে হল। যেন মন্দিরে দেখেছেন। জয়দেবের কাছাকাছি এসে মাথাটা নীচু করেই তিনি বললেন, আপনি মন্দিরে যাননি আজ?

    জয়দেব বললেন, না।

    মহিলা বললেন, আমি সকাল থেকে অপেক্ষা করে আছি, দুপুর গড়িয়ে গেল দেখে মনে দুশ্চিন্তা জন্মালো। মনে হল অসুস্থ হন যদি। তাই আমি এই আপনার বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম, প্রভু বললেন, আপনি বাড়িতে নেই, এই নীলাচলের ধারে দাঁড়িয়ে আপনি প্রভুর জন্যে অপেক্ষা করছেন।

    জয়দেবের প্রথমে বিস্ময় লাগল, অভিভূত হলেন, বললেন, প্রভু নিজে বললেন এ কথা?

    মহিলা বললেন, নইলে আমি জানব কি করে দেব, আমি সামান্য নটী, আমার মানই বা কি, বোধই বা কি। তিনি না জানালে আমি কি কিছুই জানতে পারি?

    জয়দেবের অভিমান হল। তিনি বললেন, তিনি আসবেন না?

    মহিলা আরো সঙ্কুচিত, লজ্জিত হয়ে উঠে বললেন, তিনি কি আপনি ছাড়া প্রভু?

    জয়দেবের বুক মুচড়ে উঠল। নিজেকে সামলে বললেন, আপনার আমার কাছে কি দরকার? কেন অপেক্ষা করছিলেন আমার জন্য মন্দিরে?

    মহিলা বললেন, শুধু আমি না, আমি অতি নগণ্য দীনহীন একজন। মন্দিরের প্রতিটা শিলা আপনার গানের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। তারা চলতে পারলে সমস্ত মন্দির এসে দাঁড়াত এখানে প্রভু... কিন্তু আমার পরমানন্দ মাধবকে ছেড়ে তারা আসতে পারে না তাই…. নইলে তাকে রোদে জলে ভিজতে হবে যে…

    পরমানন্দ মাধবকে রক্ষা করে ওই জড় শিলা? জয়দেবের গলায় যেন ব্যঙ্গ উষ্মার সুর।

    মহিলা সঙ্কুচিত হয়ে বললেন, প্রভুকে কে রক্ষা করে দেব? আর প্রভু ছাড়া কেই বা চেতন? তিনি রক্ষণীয় নিজেকে করে তোলেন তাই আমাদের নাগালে তাঁকে রক্ষা করার সুখ, তাঁকে ভালোবাসার সুখ। রক্ষা করার অধিকার না দিলে ভালোবাসার সুখ যে পূর্ণতা পায় না দেব, এতো আপনার অজানা নয়! কেন আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন নাথ…

    জয়দেব মন্দিরের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলেন। তবে কি মনের মধ্যে অভিমান জন্মেছিল? তবে কি নিজেকে পরমানন্দ মাধবের অনুগত না ভেবে সেই জগদীশকে নিজের অনুগত ভেবেছিলেন?

    মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। জয়দেব বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে পিছনে ফিরে চাইলেন। কাউকে দেখতে পেলেন না। নীলাচলের নীল জলের অস্পষ্ট রেখাটুকু দেখা যাচ্ছে কেবল। মহিলা কোথায় গেলেন তবে?

    মন্দিরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। মহিলা এগিয়ে এসে বললেন, আসুন।

    জয়দেব বললেন, আপনি কোন পথে এলেন?

    মহিলা হেসে বললেন, যে পথে আমার মাধব পরমানন্দ আনলেন…. পথ কি আমি চিনি প্রভু... আমি শুধু বাঁশির তান চিনি…. যে তান শুনি আপনার কণ্ঠে….