Skip to main content
 
 
 
---
        আসলে কি দেখতে চাই? নদী, পাহাড়, জঙ্গলে কেন শুধু শুধু ঘুরে মরা? কি দেখতে চাই, মুগ্ধ হতে চাই কি? না, আসলে শুনতে চাই। নিজের ভিতরের কথা নির্জনে, নিঃশব্দে, নিজের চারদিকে একটু নিরিবিলি গড়ে। তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে বেরিয়ে পড়া। কাজ এটা এমন একটা মস্ত বড় শব্দ, ওর মোহ যেমন, ওজনও কিছু কম নয়। সেই মোহের ওজনে কিম্বা ওজনের মোহেতে যাই বলি, মোদ্দা কথাটা হল গিয়ে আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে। এর থেকে নিস্তার চাই, যে করেই হোক। অন্তত কয়েকটা শ্বাস বুকের গভীর অবধি পৌঁছাক - আহা, শান্তি। অন্তরের অন্তর যে সে বাঁচুক। বাঁচাটা খাঁচা ছাড়া হোক। শুধুই নিয়ম আর নিয়ম। কর্তব্য আর কর্তব্য। আরে ভাইরে আমার নিজের সেই অন্তর্বাসীটির উপরেও আমার একটা কর্তব্য আছে তো না কি?
 
        কথা উঠল, চলো মুরাডি যাওয়া যাক। মানে বরান্টি। বারন্টি না বরান্তি? যাই হোক এরই মধ্যে ঘুরে ফিরে কিছু একটা। প্রচুর পলাশ নাকি ফুটে আছে, শুধুমাত্র পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যেই নাকি তাদের ধরাধামে আবির্ভাব। আমরা না গেলে তারা যদিও আত্মহত্যা করবে না, তবু আমার বসন্ত আর তাদের আগমন --- দুইকেই অর্থহীন করে তোলার কি মানে... তাই চলো, যাওয়া যাক।
 
        নৈহাটি থেকে রাতে ট্রেন। কলকাতা-চিত্তরঞ্জন প্যাসেঞ্জার। কথা হল আমরা আট বন্ধু মিলে তাতে চড়ে আসানসোল অবধি যাব। তারপর ভোরের গাড়ি ধরে মুরাডি। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ওঠা গেল ট্রেনে। তেমন ভিড় নেই। বসার শোয়ার কোনো সমস্যা নেই। আর তো কয়েক ঘন্টা। ট্রেন ছাড়ল নৈহাটি থেকে প্রায় পৌনে বারোটা। আসানসোল পৌঁছিয়ে দেবে রাত সাড়ে তিনটে, টাইম টেবিল তাই বলে। অগত্যা শরীর টানটান করে ঘুমের মত করে পড়ে থাকা। শরীরকে ফাঁকি দিয়ে বলা, এই তো ঘুমালাম। শরীর যদি ব্যাগোড়বাই করে পরের দিন? তখন কৈফিয়ৎ কি দেব? তাই ঘুম ঘুম ভাণ করে শুয়ে থাকা। হঠাৎ দেবাশিষ এলো ভগ্নদূত হয়ে, হোটেল নাই। হোটেল পেতে পরের দিন বেলা হয়ে যাবে।
        বোঝো, কি কাণ্ড, এবার কি করা? আরে আমরা যে সকাল ছ'টায় পৌঁছে যাব, তারপর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব নাকি? তায় পুরুলিয়ার গরম। পলাশের জন্য পথবাসী হব, এটা কোনো কাজের কথা না বাপু! তবে চলো যশিডি চলে যাই। এই ট্রেনটা তো ওই অবধি যাবেই। টিটি কত্তাবাবাকে পাকড়াও করা হল। গাঁইগুঁই করা হল, দ্যান দিকিনি আমাদের যশিডি অবধি যাতি... যদিও আমাদের টিকিট আসানসোল অবধি। টিটি'র বয়েই গেছে। তার মুখের ভাবখানা এমন, কি আপদ রে, এমন একটা দুর্নীতিমূলক কাজ করাবার জন্য আমার কাঁচা ঘুম ভাঙানো? মধুর স্বরে বললেন, “যান যান... আসানসোলে গাড়ি দাঁড়াবে বেশিক্ষণ, টিকিট কেটে আবার চড়ে বসবেন... যান..."
       ওদিকে ট্রেনের গতি ক্রমে শম্বুক থেকে কেন্নো, কেন্নো থেকে ঘড়ির ঘন্টার কাঁটা প্রায় হয়ে পড়ছে। চলতে ফিরতে থমকে দাঁড়াচ্ছে। মাঝরাত? ওরে জয় কদ্দূর এলো...? মেমারি...। ওরে কদ্দূর এলো...? নিমো...। এবার...? বর্ধমান...। আহা বর্ধমান ছাড়ল? না গো... কি রে ছাড়ল...? ন্যাঃ...
 
 
        আসানসোল এলো যখন চারটে। ভোর চারটে ঘড়ি অনুযায়ী আর রাত চারটে আমার ইন্দ্রিয় অনুযায়ী। দৌড় লাগা... ও দাদা টিকিট কাউণ্টার কোন দিকে?
 
        "হেই উ---ই দিকে..."
        দাদা শীগগির আটটা যশিডি দিন, ট্রেন খাঁড়া হ্যায়... প্ল্যাটফর্ম পর নেহি, পাটরি পর নেহি, দিল পর মেরে লাল... থোড়ি জলদি ভাইসাব... আরে উয়ো ট্রেন ছুট জায়েগি তো হামার ভুল জায়গা মে এত্তবড় বাঁশ... আরে হাত চালা নারে বাবা একটু তাড়াতাড়ি...
        টিকিট পাওয়া গেল। ফের ঊর্দ্ধশ্বাসে পুরুলিয়াভিমুখীদের দিগভ্রান্ত ছুট যশিডি উদ্দেশ্যে.. 
        হুশ... ট্রেন চলে গেল... চোখের সামনে দিয়ে... এবার? কই যাই? ওই যারা শুয়ে আছে ওদের পাশে শুই? আসানসোলে প্রাতঃভ্রমণ করি? মাইথন ড্যাম নাকি এদিকে, সেই জলে মুখ হাত ধুয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকি যতক্ষণ না মুরাডি'র হোটেল মেলে? 
        ওভারব্রীজে দাঁড়িয়ে আমরা এইসব ভেবে হাউমাউ করছি, হঠাৎ সুমন নেট অন্ করে বলল, উঁহু, মোকামো প্যাসেঞ্জার তো আছে এখনই...
        ওটা কি গাড়ি দাঁড়িয়ে? আমরা নামা ইস্তক দাঁড়িয়ে। ট্রেনটার মুখটা কোনদিকে রে? কলকাতা না বিহার? পাশ থেকে একজন বললে, আরে উয়ো টেরেন তো যশিডি যায়েগি... আপলোগ উধারই তো যানা চাহতে হ্যায়ঁ...। 
        চাই তো রে... এতক্ষণ কই ছিলি বাপ! তোর মুখে ফুলচন্দন-ঘি-শক্কর সব পড়ুক... দৌড় ফের দৌড়...
 
 
 
---
        ট্রেন হাওড়া-মোকামো প্যাসেঞ্জার। জশিডি যায়েগি, সচ বাত, পর কব তক্‌ শায়েদ ইয়ে খুদা কো ভি নেহি পাতা... রাম জানে...
        চড়ে বসলাম। সাইডে একটা করে মুখোমুখি সিঙ্গল বসার সিট আর বিপরীত দিকে বড় লম্বা বেঞ্চের মত সিট। ওপরে কাঠের ফাঁক ফাঁক খাটিয়া'র মত কিছু। তাতে মাল রাখতে ভয় পাছে কারোর মাথা ভাঙে মালশুদ্ধু ভেঙে নীচে পড়ে। আবার নিজেকে নিয়েও ভয় পাছে পড়ে কোমর ভাঙে। 
        চারদিকে অবাঙালী। বেশিরভাগই বিহারি। অস্বস্তি একটা হতে শুরু করছে। মানুষগুলো গরীব, অপরিষ্কার, অমার্জিত - বৈষম্য। ভাষার পার্থক্য, আদবকায়দার পার্থক্য। তাদের চোখেমুখে ভ্রুকুটি - এগুলো আবার কোত্থেকে চড়ে বসল? বড্ড বেমানান! আমাদের চোখেমুখে - হামলোগ ভদ্দরলোক টাইপের কৈফিয়ত।
        চারদিকে বাচ্চাগুলো এদিক ওদিক কেন্নোর তালের মত এ ওর ঘাড়ে গায়ে জড়াজড়ি করে শুয়ে। স্থানাভাব তা বলব না, তবে গরম পোশকের অভাব তো বটেই। বাচ্চাবুড়ো সবাই কাশছে।কাশবেই, বেজায় ঠাণ্ডা-গরম চারদিকে, ঋতুপরিবর্তনের সময়। হতেই পারে। কিন্তু চিকিৎসা? তাও প্রকৃতির হাতেই। ওদিকে মেঝেতে শুয়ে কে? এক বৈষ্ণবী। বয়স্কা, পৃথুলা শরীরটাকে গুটিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। উপরে ঝুলছে তার হরিনামের থলি। গায়ে পা লাগছে চলতে ফিরতে সবার। তার অসুবিধা হচ্ছে না। হতে নেই।
 
 
        আমি কি করুণা করছি? নাকি নিজের তথাকথিত ভালো থাকাটা, সুরক্ষিত থাকার থেকে একটা আহা বেচারা" বেরোচ্ছে? গায়ের দুর্গন্ধ, অপরিষ্কার পোশাক, মুখে হাত না দিয়ে কাশা আমার ইনফেকশান হয়ে যাবে না তো? আমাদের শহুরে শিক্ষিত লোকেদের কাছে নিজের চাইতে মূল্যবান বলে যদি কিছু থাকে, সে তো এক এবং একমাত্র আমার ইমেজ কাম আমার শরীর.. বলি তাতে কোনো ক্ষতি হবে না তো? বড্ড ছেলেমানুষী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে, আরে এভাবে রাত জেগে, এদের সাথে এইভাবে যাওয়া যায়? কি আনহাইজিনিক না ব্যাপারটা? কি এলো? সীতারামপুর। ক'টা বাজে? সাড়ে চারটে... কি এলো? সীতারামপুর... হাই কাণ্ড! ছাড়েনি এখনও?... না... না... না...
        বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বেশ বড় প্ল্যাটফর্ম। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে পেল্লায় একটা গাছ। কি গাছ দেখার আগেই গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল চাঁদ - হাই। একটু টাল খাওয়া। সদ্য পূর্ণিমা গেল না। সে যা হোক, মনে মনে বললুম, তা বাপু তোমার রূপের এলেম আছে। যুগযুগান্ত ধরে সেই আদিম, অবৈজ্ঞানিক যুগ থেকে আজ এই বৈজ্ঞানিক যুগ অবধি মানুষকে কি দোলাচালই না দিতে জানো! বলি ক্ষণজ্ঞানও তো মারাত্মক ভাই তোমার। ঘুম নেই, গন্তব্যের স্থিরতা নেই, আশপাশে এত অপরিচিত, এত অজানিতের মধ্যে কেমন অতিপরিচিতের মত এসে দাঁড়ালে.অবশ্যি আমার চেনা জগতে তোমার কদর করার সময় কই বলো.. বলি ও মন, কাব্যিই করবি না সিগন্যালটা একবার দেখবি বাপ আমার? সত্যিই তো খেয়াল ছিল না... হ্যাঁ... ওই যে সবুজ বিন্দু অন্ধকারে ফুটে উঠেছে বটে... সে কি আমাদের উদ্দেশ্যেই? ভাবতে ভাবতেই ঘুমন্ত অজগরের মত ট্রেনটা দুলে উঠল...
 
        আবার এসে কামরার মধ্যে। যাত্রীরা কেউ ঘুমন্ত, কেউ ঢুলন্ত, কেউ জাগন্ত... আমার মনের মধ্যে সেই আগের ভাবটা নেই। এত তাড়াতাড়ি মেনে গেলে মন? মন বলল, হাঁ। কি জানো জীবনের কেন্দ্রে একটা মন্ত্র আছে শ্রদ্ধা। এ ঠিক দেবদ্বিজে, অলৌকিকে, গেরুয়া বা তন্ত্রে-মন্ত্রে শ্রদ্ধা না। শ্রদ্ধা গোটা জীবনটার উপর। সে শ্রদ্ধা আশপাশ বাদ দিয়ে হয় কি? সে একটা পজিটিভ ওয়েভ নিজের মধ্যে। সন্তোষ? না ঠিক সন্তোষ না। সন্তুষ্ট থাকতে রাজী হওয়া। হিসাব মিলিয়ে নয়। হিসাবের মিল-অমিল উপেক্ষা করেই।
        আমার ঘুমে চোখ জোড়াচ্ছে... আবছা হচ্ছে চারদিক... বুকের কাছে ব্যাগ... তার মধ্যেই টাকার থলে থেকে শুরু করে জামাকাপড় ইত্যাদি... রাখি কোথায়? যা হোক, ব্যাগ আঁকড়ে তার উপরে রাখলাম মাথা... কানের মধ্যে হিন্দী গানের সুর... হিন্দী শব্দের আনাগোনা... আলগোছ মন অন্যের শব্দকে নিজের মত শব্দ বানিয়ে রূপ দিয়ে নেয়। যেমন কেউ বলল পানি... আমার চোখে ভেসে এলো কোনো এক পড়ন্ত বিকালের পুকুর... রোদ পড়েছে যার উপর ছেঁড়া কাপড়ের টুকরোর ভাসা ভাসা হয়ে... আসলে আমি আধা ঘুমন্ত... মন কিত্ কিত্ খেলছে... একবার জাগার ঘরে, একবার ঘুমের ঘরে... ট্রেন ছুটছে যশিডি... আমি নামছি জাগার তলে, ঘুমের দেশে...
 
 
 
---
 
        একটা ধাক্কায় ঘুম ভাঙল। কে ধাক্কা দিল তাকিয়ে দেখার থেকে চোখে পড়ল বাইরে ভোরের আলো ফুটেছে। একটা মিহি নীল আলোর বুনটে যেন সব কিছু জাগছে। ভোরের আকাশ সবসময় নতুন। ক'টা বাজে? পাঁচটা পনেরো। কতক্ষণ চোখ লেগেছিল তবে? আধঘন্টা হবে। একে একে স্টেশান পেরোয়, ধীরে ধীরে ঘুমভাব কাটে। বঙ্গ ছেড়ে ঝাড়খণ্ডের সীমানা শুরু। ভাষা বদলানো, পোশাক বদলানো দেখতে দেখতে কত কি মাথার মধ্যে ঘুরছে। সেই কবে থেকে ট্রেনে যাচ্ছি। এ পরিবর্তন দেখছি আজ তো প্রথম না। তাও নতুন লাগে, উত্তেজনা জাগায়। তবু মনটা একটু যেন কোথাও দমে গেল। কোথাও কি আমার চেনা ভারতের রূপরেখা পাল্টাচ্ছে? কোথাও কি একটা সুস্পষ্ট বিভাজন রেখা কাটতে চাইছে কেউ? ঠিক কাটতে চাইছে বলা যায় না, বরং স্পষ্ট করে তুলতে চাইছে যেন কারা। যেটা আত্ম-মর্যাদার সীমারেখা, সেটাকে যদি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কেউ আত্ম-বিপন্নতার রেখা বানিয়ে তুলতে চায়, তখন সে পার্শ্ববর্তীকে আর প্রতিবেশী দেখে না, স্পর্ধাকারী দেখে। তার অস্তিত্বের পাশাপাশি যে নানা অস্তিত্বের সহাবস্থান অনায়াসে হতে পারে এ সহজ কথাটা সে তখন আর বুঝতে পারে না। তার কাছে 'বৈচিত্র‍্য' শব্দটা একটা থ্রেট, একটা চক্ষুশূল। কিন্তু কেন?
        এ কেন'র উত্তর কে দেবে? স্বয়ং ইতিহাস নিজের বিচিত্র গতিপথে নিজেই বিস্মিত হয়। মহাকালের কাছে প্রশ্ন করে, কেন? এর কি কোনো দরকার ছিল? মহাকাল নিরুত্তর থাকেন। মহাকাল তো আর সময় শুধু নয়, ধ্বংসও। কিন্তু কেন ধ্বংস? তাই কালচক্র। তবে তাই হোক। আমি আর প্রশ্ন করব না। সূর্য ততক্ষণে লাল বলের মত আকাশের পূর্ব সীমান্তে দাঁড়িয়েছে। ট্রেন চলছে ভালো গতিতে। মিষ্টি পাঁউরুটি”... কে ডাকে? দেখি একটা প্লাস্টিকে কয়েকটা গোল গোল পাউরুটি বিক্রি করছে একজন। অনেকেই কিনছে। বাঙালী অথচ গ্যাস-অম্বলের কথা ভাবব না, এতো রীতিমত জাতিদ্রোহিতা। ভাবলাম। কিনলাম। খেলাম। গ্যাস হওয়ার অপেক্ষায় থাকলাম। মনে মনে ফরদাপুরের হোটেলের সেই বাচ্চা ছেলেটার কথা মনে পড়ল। অজন্তার পাশে ফরদাপুরে একটা হোটেলে উঠেছি। ছেলেটা --- মানে বয়ের কাজ করে যে, সে পরেরদিন সকালে বলল, আচ্ছা দাদা এক বাত পুঁছে? পুঁছো? আপ বাঙালী লোগোঁকে সাথ হর বখ্ত ইতনা বড়া বড়া গোলি কি ডিব্বা কিঁউ হোতা?... ওউর ভি লোঁগ আতে হেঁ, পর অ্যায়সা ডিব্বা কিসিকে পাস নেহি হোতা”...
        কথাটা মিথ্যা খুব একটা বলেনি ছোঁড়া সেদিন। হেসেছিলাম হো হো করে। এখন হাসলাম না। ওদিকে বৈষ্ণবী জেগে উঠেছে। তার হাতমুখ ধোয়া হয়ে গেছে। তার পেটিকা খুলে কি বেরিয়েছে দেখো, এটা চন্দন না খড়িমাটি? তা ঘষে ঘষে রূপ আনছে বৈষ্ণবী। কপাল ছুঁয়ে নাকের ডগা অবধি এলো একটা দাগ। দুই হাতের কব্জীতে লাগল আরো দুটো। বৈষ্ণবী এ রসকলির দাম কত দিলে গো সংসারে? সারা চোখমুখে যে পোড়ামোড়া দাগ। হ্যাঁ গো বোষ্টুমি জ্বলেছ প্রচুর না? কান্নাগুলো থমকে আছে তোমার চন্দনের দাগে। এ বেশ। তোমার এ সাজে কাকে ভোলাও গো? তোমার চোখদুটো তো সংসার ছাড়েনি। তোমায় সংসার ছেড়েছে। তোমায় দিল হরিনামের ঝুলি। কেঁদো না বৈষ্ণবী। দেখো, পারো যদি কাঁদাও তোমার ঠাকুরকে। 
        যশিডি এলো। স্টেশানে নামতেই অটো চালকেরা ছেঁকে ধরল... সৎসঙ্গ যাওগে... বাবাধাম?... বঢ়া অটো হ্যায়... চলো বাবাধাম...

 
 
 
 
 
        একটা ডরমিটরি নিয়ে স্নানধান করে রওনা হওয়া গেল বাবাধাম। চড়া রোদ। সাড়ে ন'টা বাজে। চারদিক দোকানপাট তেমন খোলা নেই। কেন? এরা আরো বেলায় ওঠে? রাস্তাঘাট এত শুনশান কেন? কেমন ধন্ধ লাগছে। বনধ্ না তো? সেরকম হলে তো অটোচালক, বা হোটেল মালিক কিছু বলত...
 
        "বাবা মন্দির যাওগে?"
        একজন মাঝবয়েসী মানুষ। ফর্সা, বেশ শক্তসামর্থ্য চেহারা বয়েসের তুলনায়। বুঝলাম, হয় পুরোহিত নয় পাণ্ডা। সে আমাদের 'হ্যাঁ' বা 'না' বলার তোয়াক্কা না করেই আমাদের সাথে হাঁটতে লাগল। এখন সে মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার পথপ্রদর্শক মাত্র। মন্দিরে গিয়ে প্রথমে পুরোহিত, তারপর ডাকাত। এ অভিজ্ঞতা বহুবার। তবু চলুক। খোলস ছাড়াক। দেখি কতটা রঙ পাকা, কতটা কাঁচা। মন্দির যেতে যেতে রাবণের গল্প। রাবণের হিসির গল্প। যে হিসিজাত নদীর জলে স্নান করলে নাকি চর্মঘটিত সব রোগ সেরে যায়। শিবলিঙ্গের গল্প, গল্প বলতে বলতে পাণ্ডার রোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা ইত্যাদি যাই হোক না কেন, রাস্তায় এত কম লোক কেন?
        "আজ বাসি দোল হ্যায় না"
        অ্যাঁ! ও আচ্ছা, কাল ছিল হোলি। তাতেও মন ভরেনি, তাই হল বাসি দোল। বুঝলাম। আমাদের যেমন আজকাল পঞ্চমী থেকে দশমী গড়িয়ে একাদশী ইত্যাদি। মন ভরে না। মন যে দাদা ফুটো কলসী। যতই ঢালো খানিক পর সেই মন ভালো নেই... মন ভালো নেই”...
        জুতো রাখুন। বেশ কাশীর মত গলিতে এতক্ষণে এসে পড়েছি। মাথায় ত্রিপুণ্ড আঁকা পাণ্ডা-ভক্ত-পুরোহিতের দল। মন্দিরে প্রবেশ করতেই ঢাকঢোলের ঢক্কানিনাদ। কেউ মাথা কামাচ্ছে; কেউ পুরোহিতের সামনে আরতি করছে; পুরোহিত ওয়াটস্ অ্যাপে আর কাউকে উত্তর দিতে দিতে, কিম্বা জোক্স পড়ে হাসির ফাঁকে ফাঁকে মন্ত্র পড়ছে। পাণ্ডা দেখালো শিবমন্দির থেকে মায়ের মন্দির টানা লম্বা লম্বা লাল কাপড়ের সেতু। বাঁধুন, মঙ্গল হবে। যত দামি কাপড় তত মঙ্গলের ঘটা। ন্যূনতম পূজার ডালা এলো। এক ঘটি জল। তাতে সিঁদুর, চাল, বেলপাতা আর ধুতুরাফুল। পুরোহিত মন্ত্র আওড়াচ্ছেন আর আমি চারপাশে চোখ আওড়াচ্ছি। আর একদিকে হনুমানজি --- দলে দলে ভক্ত গিয়ে জড়িয়ে জাপটিয়ে, মাথায় গঙ্গাজল ঢেলে একাক্কার করছেন! ওদিকে বগলাদেবী, সরস্বতীদেবী, কমলাদেবী ইত্যাদি সব দেবীরা মহাদেবের মন্দির ঘিরে।
        "চলিয়ে অব লাইন মে..."

        লাইনে দাঁড়ানো গেল। বেজায় বড় না হলেও মাঝারি ধরণের লাইন। পুরোহিত বারবার সাবধান করছেন, পকেট সাবধান, পকেটমার প্রচুর... লাইনে বেজায় ধাক্কাধাক্কি। সবাই ফাঁক পেলেই আগে যেতে চায়। হঠাৎ একজন সরকারি উচ্চ পদাধারিক মহাশয় সস্ত্রীক এসে পড়লেন। পূজো দেবেন। লাইন আটকে গেল। সরু গলির মধ্যে শয়ে শয়ে লোক। সব্বার তাড়া। সব্বাই অধৈর্য্য। মাথা উঁচু করে দেখি দেওয়ালে সার দিয়ে এসি মেশিন লাগানো। গরমের জন্য বোঝা গেল। এবার লাইন এগোচ্ছে। পিছনে সামনে প্রবল হুড়োহুড়ি। গর্ভমন্দিরে ঢোকা গেল। সেই এক ছবি। সব বিখ্যাত শিবমন্দিরে যা দেখেছি। কাশী, ত্র্যম্বকেশ্বর, কৃষ্ণেশ্বর, লিঙ্গরাজ ইত্যদিতে। পাণ্ডারা কেউ বাবু হয়ে বসে, কেউ হাঁটু গেড়ে, কেউ দাঁড়িয়ে। রীতিমত মারামারি হচ্ছে। আমি দেওয়ালের দিকে সরে দাঁড়ালাম। মহাদেবকে দেখব বলে নয়, মহাদেবের ভারতকে দেখব বলে।

        স্বচ্ছতা আছে? নেই। অত্যন্ত নোংরা। সংযম আছে? নেই। চূড়ান্ত বিশৃঙ্ক্ষলা। এমনকি গায়ে ধাক্কা দিয়ে, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে বার করছে সুরক্ষা কর্মীরা। আমার মনে পড়ল একটা ঘটনা। তখন আমার বেলুড় মঠে যাতায়াত বেশ ভালো রকমের। একবার সারদাদেবীর জন্মতিথিতে সেই মন্দিরের দ্বারপালের কাজ করেছিলাম। আমার উপর দায়িত্ব ছিল কেউ যেন বসে না প্রণাম করেন। না শুনলে বারবার 'উঠুন উঠুন' বলা যেতে পারে, কিন্তু গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। কিন্তু ভক্তদের অবিবেচনা দেখে বুঝতে পারছিলাম, আমাদের ধর্মে যত উচ্চদর্শনের কথাই থাক না কেন, ধর্মেও আমাদের আমি’-ই আগে। তারপর ওরা'। যে স্বার্থবোধ ক্ষণিক না কমলে নিজের সত্যিকারের মানবিক মুখটা অধরা থেকে যায়, সেই স্বার্থবোধের আরো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আশাপূরণের আশ্বাস দেন আমাদের দেবতারা। তবে আমাদের দেবদেবী কে? যারা ক্ষমতাশালী হলেও নৈতিক দিক থেকে আমাদের থেকে খুব একটা উচ্চমানের নন, তাই কি? যদি তা না হবে, তাঁর সামনে এমন উগ্র, অসহিষ্ণু, হিংস্র হয়ে ওঠা যায় কি করে? ‘আগে নিজের আখেরটা গুছিয়ে নিই’ – এমন ভক্তের নমুনা আমি আমার খুব ঘনিষ্ঠ কাছের মহলেও দেখেছি। জগন্নাথ মন্দিরে, কাশী মন্দিরে তাদের সেই স্বার্থান্ধ নির্লজ্জ ব্যবহারে মনে মনে লজ্জা পেয়েছি। 
 
        সবার সাধ টিপ করে শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢালে। কিন্তু জল পৌঁছাচ্ছে এর মাথায়, ওর মাথায় - যারা বসে শিবের উপাসনার প্রবল চেষ্টায় মত্ত। ধর্ম নাকি মানুষের অন্তঃকরণের পরিবর্তন আনে। দস্যু রত্নাকরকে বাল্মীকি করে। অস্বীকার করি না। কিন্তু ভায়া সে হৃদয়ের ধর্ম, ক্ষমার ধর্ম, প্রেমের ধর্ম। এটা কি? এ আচার, অনুষ্ঠান, ছোটো আমির ভক্ত সাজের তীব্র আস্ফালন। এতে হৃদয়ের পরিবর্তন? স্বয়ং বাবাজীরই না হৃদয়ের পরিবর্তন হয়ে যায় ভক্তদের চরিত্রের নমুনা দেখে। 
        আমি ঘটশুদ্ধ জল অর্থলোভী পাণ্ডার হাতে ধরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বাইরে মানুষের ঢল আরো বেড়েছে। কি অনায়াসে মানুষ নিজেকে ঠকতে দেয় এই সব জায়গায় না এলে সত্যিই টের পাওয়া দায়। বিষন্ন লাগে। এদেশে মহাপুরুষের সংখ্যা পৃথিবীতে যে কোনো দেশের তুলনায় কম নয়। সেটা গর্বের না লজ্জার বুঝিনি যদিও এখনও। একটা সহজ সরল মনুষ্যত্বের পাঠ পড়াতে কতজন মহাপুরুষ লাগে একটা জাতের? 

     পাণ্ডা আমাদের নিয়ে মন্দিরের চাতালে বসল। "টাকা দাও"। কেন দেব? মন্দিরে যে ১০০ টাকার পূজো দিল প্রত্যেকে? "তবু দাও। আরে ওতো শিবজী', আমার কই? এই যে পেট" - ফতুয়ার ভেতরে পেট বার করে দেখানো হল। খোলস খুলে ফালাফালা হয়ে গেল। পৌরাণিক গল্প, ভক্তির ঘনঘটা সব পেটের সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়ালো। আমাদেরও দাঁড়ায়। আমাদের সব নীতি, শিক্ষা, সহবত লোভের কাছে, অহং-এর কাছে, শখের কাছে মাথা নীচু করে দাঁড়ায় না? এতো তবু খিদের জ্বালা। 
        দিলাম কিছু আমরা। ঠকছি মনে হল না। আসলকে দেখছি মনে হল। এই ভালো। সে পাণ্ডা আমাদের বসিয়ে হাওয়া। ফিরলেন হাতে প্রত্যেকের জন্য প্রসাদ নিয়ে।
এবার আমাদের বাবাধাম থেকে বেরোতে হবে, বেজায় খিদে পেয়েছে। পাণ্ডাও এগিয়ে গেল, তারও আরো ভক্ত চাই যে। ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে কলকাতার কোথায় যেন। টাকা দেবে কে?
 
 
 
 
---
        "সৎসঙ্গ যাওগে?"
        চলো। যশিডি থেকে ট্রেন তো এখোনো দেরি আছে। তা সৎসঙ্গ'তে এলাম। রাজকীয় কাণ্ড। এলাহি ব্যাপার সব। বিশাল বিশাল বিল্ডিং। অনুকূল ঠাকুর যেখানে যেখানে থাকতেন, বসতেন সে সব সুন্দরভাবে সাজানো গোছানো। এখানে দুপুরে প্রসাদের ব্যাপার নেই শুনলাম। যদি খেতে চাও তবে তোমায় এখানকার দীক্ষিত হতে হবে। ইষ্টভৃতি', মানে মাসিক টাকা পাঠানোর রসিদ দিলে তবে প্রসাদ পাবা, নয়ত ভাগো। এ বড় অদ্ভুত ঠেকল। ভারতের এত মঠ মিশন দেখেছি, অন্তত কুপন কেটে খেতে দেয়, মায় আমাদের হালিশহরের রামপ্রসাদের ভিটেতে অবধি, এদের এমন সংকীর্ণতা কেন বুঝলাম না। ভাগ্যে আমরা হোটেলে খেয়ে এসেছিলাম। যা হোক যস্মিন দেশে যদাচার।
 
        আমার বরাবর বইয়ের বাতিক। দেখি কি বই আছে। বইয়ের স্টলে ঢুকে আরেক বিপত্তি। অমন বিশাল সব কাণ্ড-কারখানা অথচ কার্ডে পেমেন্টের ব্যবস্থা নেই। একজন আসামী ভক্ত বেজায় বিপদে পড়ে গেলেন। তিনি অত টাকা সাথে করে আনেননি। কি করা যায়। বাইরে যান, ATM থেকে টাকা তুলে আনুন।" অগত্যা সেই ঠাঁঠা রোদে তিনি বাইরে গেলেন। আমি বললুম, তা এতবড় কাণ্ড করছেন আর একটা সামান্য ক্যাশলেশ পেমেন্টের ব্যবস্থা করতে পারেন না?
        "বিজেপি আপনি? আপনি জানেন, ত্রিপুরাতে পর্যন্ত্য এবার বিজেপি... কি হে আপনারাই তো আসাম থেকে এসেছেন (যিনি বেরোলেন টাকা আনতে তার স্ত্রী কাচুমাচু মুখ করে বসেছিলেন) তা আপনাদের ওদিকে বিজেপি হচ্ছে না কেন? বাকি তো সব হয়ে গেল আশপাশে..."
        যিনি বলছেন তিনি ক্যাশে বসে টাকা গুনছেন বই দিতে দিতে। যেই না বলা অমনি 'রে রে' করে কাউণ্টারের বাকি কর্মীদের সাথে লেগে গেল ধুন্ধুমার। কেউ কংগ্রেস, কেউ তৃণমূল। বুঝলাম, পরম ভক্তিমার্গের আলোচনা। এর মধ্যে না থাকাই ভালো। বেরিয়ে এলাম।
 
        অন্য সৎসঙ্গে যাবেন?”
        সেটা কি? অন্য ঠাকুরের?
 
        "আরে না, অনুকূলজীরই, অন্য ছেলেরা আলাদা আলাদা সৎসঙ্গ করেছেন।"
বুঝলাম। আমাদের কোনো শাখা নেইপ্রথা। বললাম, চলো।
        চর্যাশ্রম। আরেক ছেলের আশ্রম। বেশ। দারুণ লাগল বাড়িটা। সাবেক কালের জমিদার বাড়ির মত। পায়রা উড়ছে । বেশ নিরিবিলি পরিবেশ। ভালো লাগল।
 
        "দাদা তপোবন চলুন।"
        অটোচালকের বায়না। আরে ছাড় বাবা ট্রেনের সময় হয়ে যাবে যে। ওদিক পলাশ, বরান্টি হাঁ করে আমাদের পথ চেয়ে বসে। যশিডি স্টেশানে এলাম। গন্তব্য আসানসোল। বরান্টিতে হোটেলের ব্যবস্থা হয়েছে।
        যশিডি স্টেশান। ট্রেন দেড় ঘন্টা লেট। ভারতের এক-একটা ছোটো মডেল আমাদের স্টেশানগুলো। সব আছে। এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। অর্থনৈতিক নির্লজ্জ বৈষম্য, আচার আচরণের বৈষম্য, বিশ্বাসের সুমেরু-কুমেরু অবস্থান সব পাশাপাশি। তবু সব মিলেমিশে কোথায় যেন একাকার হতে চাওয়ার প্রবল তাগিদ একটা। কিন্তু ওরা কারা যারা এটা যেন হতে দিতে চাইছে না, কারা ওরা? স্টেশানের মেঝেতে, বাথরুমের পাশে, উচ্চশ্রেণীর প্রতীক্ষালয়ে, বেঞ্চের ধারে সার দিয়ে দিয়ে ভারতবর্ষ শুয়ে। ট্রেনের পর ট্রেন আসছে, যাচ্ছে। কেউ যাচ্ছে মুজফ্ফরপুর, কেউ দিল্লী, কেউ হরিদ্বার, আরো কত কত জায়গা। চিনি, তবে জানি না। গেরুয়া পরা সাধু, বোরখা ঢাকা রমণী, ছেঁড়া ফুটোফাটা কোনোরকমে লজ্জা ঢাকা মানুষ, দামী, স্টাইলিশ পোশাক পরা মানুষ --- সবাই অপেক্ষা করছে। চোখ পড়ল স্টেশানের নামে উর্দু, হিন্দী, ইংরাজী তিনটে ভাষায় লেখা ভারতের বহু স্টেশান দেখেছি। অক্ষর মুছতে নেই। অক্ষর মুছলে মানুষ মুছতে চাওয়ার মত অপরাধ হয়। মন যত পারিস অক্ষর চেন। অক্ষরেই জীবন্ত, একদা জীবন্ত আর ভবিষ্যতে আসা মানুষগুলোর ঘর রে। মন অক্ষর চেন। ভারতকে চেন। মন মানুষকে চেন।
        ট্রেন আসছে। ঝাঁঝাঁ-আসানসোল ডেমু। ওই দেখা যাচ্ছে...


 
 
 
---
        ট্রেন ছাড়ল যশিডি থেকে। বেজায় ক্লান্ত শরীর। একটা বাচ্চা ছেলে ডিগবাজি খেলা দেখাচ্ছে। অল্পবয়েসী মা তার কোলের আরেকটা বাচ্চা সামলাতে সামলাতে তাকে সাহায্য করছে। বাচ্চা মেয়েটা হঠাৎ হুড়মুড় করে কোল থেকে নেমে পড়ে কান্না জুড়ল। মা গালে একটা ঠাস্ করে চড় লাগিয়ে দিল। পাশে মেঝেতেই বসা এক বৃদ্ধা, হাইপাওয়ারের চশমা চোখে, বললেন, হাঁ রে মারতি কিঁউ হ্যায় রে...? মা'টা ঝাঁঝিয়ে উঠল, আভি আভি খায়া হ্যায়... ফির ক্যায়সে ভুখ লাগতি হ্যায় ইসকো...? আপহি বাতাইয়ে...
        ছেলেটা খেলা দেখিয়ে, পয়সা চেয়ে, ক্লান্ত শরীরে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল। এইসব খেলা অনেক পুরোনো, তেমন আগ্রহ নিয়ে দেখে না এখন কেউ। তাছাড়া স্মার্টফোনের জামানায় মাথা তুলে দেখবই বা কেন পাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে...
স্টেশান আসছে, যাচ্ছে। আসানসোল পৌঁছাবে ছ'টা দশ-পনেরো নাগাদ। বিকালের পড়ন্ত রোদ ট্রেনের মেঝেতে বসা বাচ্চা মেয়েটার ফ্রকে এসে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরেছে যেন। ওর মা কখন ওকে একটা শোনপাপড়ি কিনে দিয়েছে। সে সেটা তার মায়ের মুখে গুঁজে দিচ্ছে। মা কপট বিরক্তি দেখিয়ে তার গালে আলতো করে মেরে খাচ্ছে, আবার নিজের মুখেরটা বার করে বাচ্চাটার মুখে তুলে দিচ্ছে। মায়ের আরেকটা হাত কোলের ঘুমন্ত রোজগেরে শিশুটার মাথার চুলের মধ্যে বিলি কেটে যাচ্ছে।
 
 
 
     বাইরে শিমূল, পলাশের সার সার গাছ। বসন্ত মানে কি বিলাসিতা? তবে কি বাড়ি ছেড়ে একটা বিলাসিতার পিছনে ছুটে এসেছি এতগুলো বন্ধু মিলে? আসলে তা না। পলাশ তো একটা ছুতো। প্রথম কথা বাইরে বেরোনো, দ্বিতীয় কথা নিজেদের সাথে নিরবিচ্ছিন্ন সময় কাটানো।
        আসানসোল এলো ছ'টা পনেরো নাগাদ। বেজায় খিদে পেয়েছে। মেলা ঘোরাফেরা করার পর একটা ডিমটোস্টের দোকান মিলল স্টেশানের বাইরের চত্ত্বরে। বাবা দুই ছেলেকে নিয়ে দোকান দিয়েছে। বড়টা সাত-আট বছরের, ছোটোটা তিন-চার বছরের হবে। বড় ছেলে ডিম ফাটাচ্ছে, বাবা ভাজছে। ছোটোজন বাবা আর দাদাকে জড়িয়ে ঘুরছে। কুকুরের সাথে ছুটছে। ধুলোর মধ্যে বসে পাউরুটির ফেলে দেওয়া প্যাকেটে ধুলো ভরছে। মাঝে মাঝে বড় বড় চোখ করে খদ্দেরদের দিকে হাঁ করে তাকাচ্ছে। একজন ভিখারিনী এলো। তার পাউরুটি চাই। বাবা ঝাঁঝিয়ে উঠল, “মুফত মে খানা ওউর নেহি শালি”... বাচ্চা ছেলেটা মুখে মুখে আওড়ালো... 'শালি’... ভিখারিনীটা চলে যাচ্ছে, ছোটো বাচ্চাটা পিছনে পিছনে দৌড়ালো তার পাউরুটির প্যাকেটে ভরা ধুলো নিয়ে। ভিখারিনী'র হাতে দিল। ভিখারিনী সে প্যাকেটটা খুলে শুঁকলো, তারপর ছুঁড়ে ফেলল দূরে। বাচ্চাটা হাঁ করে একবার ভিখারিনী'র মুখের দিকে তাকালো, আরেকবার তাকালো দূরে অন্ধকারে যেখানে প্যাকেটটা গিয়ে পড়ল। তারপর এক দৌড়ে ফিরে এলো বাবা'র পিছনে। তার সামনে তখন আবার অন্য খরিদ্দার।
 
        আসানসোল থেকে মুরাডি'র ট্রেন ছাড়ার কথা তো আটটায়। ট্রেন ছাড়ল সাড়ে আটটায়। আমার সামনে একজন পঞ্চাশোত্তর মানুষ। আমায় বললেন, “আপনারা শহর থেকে এসেছেন?" 
- হ্যাঁ, কলকাতা। 
- জানতাম। কই যাবেন?
- মুরাডি।
 
- অ... আপনি ওখানকার নন। যদি হতেন তবে আমার শালার দোকান ঠিক চিনতেন, ওষুধের দোকান। তা আপনি রিটায়ার করে গেছেন তো?
        বুঝলাম আমার সাদা চুলের কেরামতি। হেসে বললাম, হ্যাঁ তো। এই একটু বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে বেরোলাম আর কি। তিনি প্রচুর সাধুবাদ জানালেন যে আমি আমার অবসর নেওয়ার পর দেশের এত বিখ্যাত সব যায়গা ছেড়ে তার গ্রাম দেখতে এসেছি বলে।
 
 
 
        হোটেল লেকের ধারে। স্নান সেরে বাইরে এসে লনে দাঁড়ালাম। সামনে লেক। তার ওদিকে পাহাড়। পিছনে মদের আসর। দু'জোড়া অল্পবয়েসী স্বামী-স্ত্রী, সাথে বাচ্চারা। উচ্চৈস্বরে সাংসারিক কোন্দল চলছে। পাশে পার্ক করা তাদের গাড়িতে বাজছে অরিজিতের গান। কে কাকে কবে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছে, কে কার বরের সাথে কি আশালীন আচরণ করেছে তার হিসাব নিকাশ হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনোরম ভাষাবিন্যাস। কান্নাকাটি অবিশ্যি নেই। মাঝে মাঝে সুনীল, শক্তি আসছে। আবার ফোক-টোক ইত্যাদি। আমরা সুমনকে পাকড়াও করলাম, তারা চেনা বাপ। সুমন খুব ভালো তারা চেনাতে পারে। আমি অবশ্য কালপুরুষের বেল্ট আর সপ্তর্ষিমণ্ডল ছাড়া কিছুই চিনে উঠতে পারি না। তবে আজ ভালো করে চিনতেই হবে কারণ ওদিকে কারণবারি সুনীল-শক্তি পার করে সবে শান্তিনিকেতনের আঙিনায় পা রেখেছে... আর নেওয়া যাচ্ছে না বস্... থামবি শালারা...
 
        সকালবেলা চা খেয়ে আমরা হাঁটতে বেরোলাম। সুন্দর টানা পথ। একধারে জঙ্গল। আরেকধারে মাঠ। মাঝে মাঝে কয়লা নিয়ে সাইকেল, স্কুটার বোঝাই করা স্থানীয় মানুষের ঢল। পলাশ ফুটেছে এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তার থেকে সুন্দর পরিবেশটা। খুব শান্ত, ছিমছাম। এক জায়গায় দেখলাম বেশ কয়েকটা বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে। কলকাতা থেকে আগত টুরিস্ট'রা দল বেঁধে পলাশের ছবি তুলছে, সেলফি তুলছে। আমরা একটু দূরে দাঁড়ালাম। এক ভদ্রলোক হঠাৎ করে এগিয়ে এলেন, "আসলে কি জানেন কলকাতাতেও পলাশ আছে, কেউ তোলে না।" ওনার এক বন্ধু ধাঁ করে আমাদের সামনে দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেলেন। সকলেরই বেশ বয়েস হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। ওনার স্ত্রী একটা আলখাল্লা টাইপের কিছু একটা পরে পায়ে ধুলো বাঁচিয়ে পা টিপে টিপে এদিকে এলেন। মুখে একরাশ বিরক্তি। আরো বিরক্তি ভদ্রলোক নিজের থেকে আমাদের সাথে কথা বলছেন দেখে। আমরা একটু সৌজন্য দেখিয়ে পলাশবাড়ি'র দিকে এগোলাম। তারাও খানিক পর এলেন। মহিলা একটা চেয়ারে এলিয়ে বসে কত্তাকে ইঙ্গিত করলেন। কত্তা ইঙ্গিত বুঝে ধাঁ করে কয়েকটা ছবি তুলে ফেললেন মহিলার। তারপর দিদিমণির কাছে হোমওয়ার্কের খাতা নিয়ে যাওয়ার মত গুটিগুটি পায়ে এগোলেন। দিদিমণি ছবি দেখে নাক সিঁটকে বললেন, ওক্কে। 
 
 
 
 
 
 
---
        আদিবাসী গ্রাম। এর কথাটা কিভাবে বলি। এত পরিষ্কার যা সত্যিই অবাক করে দেয়। মেঘালয়ে গিয়েছিলাম কোন গ্রাম পরিষ্কারতম গ্রামে ভূষিত হয়েছে দেখতে। কিন্তু সেখানে অনেকটা কৃত্রিম লেগেছিল গ্রামটা। এ গ্রাম তো সেরকম না। এ যেন স্বাভাবিকভাবে এক পল্লীরমণী স্নান সেরে পরিপাটি করে দাঁড়িয়েছে তপ্ত রোদের নীচে। তার আভরণ নেই, কিন্তু এমন একটা আত্মবিশ্বাস আছে যা অনেক দামী আভরণের জ্যোতিকে ম্লান করে দিতে পারে। ওদের উপাসনাস্থল দেখলাম। কি যত্নে, কি গর্বের সাথে বানিয়েছে। বারবার আমাদের সে কথাই বোঝাতে লাগল।
- এটা কিসের মন্দির?
- শিবের। মোদের শিব। আমাদের আদিবাসীদের শিব। মারাং বুরু। নিজেরা বানাইছি। কেমন হল?
- দারুণ।
- তুরা শহর থাকিস, তুরা ভালো বললে তবে সেই আরো ভালো।
- ছবি নেব?
- এ আমাদের নিজের হাতে তৈরি। তোরা যাকে মহাদেব বলিস আমাদের সে এই। প্রণাম করে ছবি তুলিস।
 
        আমরা তাই করলাম। 
- ঘরে যাবো তোমার? কি সুন্দর কুঁড়েঘর।
- আয়।
- দারুণ...
- তোদের তো পাকা বাড়ি।
- কিন্তু ভূমিকম্প হলে কে মরবে বলো তো?
 
        একগাল হাসি। 
- ছেলেমেয়েরা পড়ে কোথায়?
- ওই ইস্কুলে।
 
- কি ভাষায়?
- আমাদের অল চিকি...
 
        "আমাদের ছবি নিবি না। কুয়োর তুলবি তো তোল", মেয়েরা বলল, "আজকাল কলকাতা থেকে বাবুরা আসে আর পটপট করে আমাদের ছবি ল্যায়... এ মুরা সহ্য করবনি... ঘরবাড়ি তুল... মোদের কেনে?... আমরা পিটাইছি গতকালই এক বাবুকে, ক্যামেরাও কেড়ে লিয়েছিলাম... তারপর কান্নাকাটি করল তো ছাড়ি দিলাম..."
আমার মাথায় উঁকি দিয়ে গেল কয়েক মাস আগে আলোড়ন তোলা সেই বিজ্ঞাপন, পুরুলিয়া'র আদিবাসী মেয়েদের নিয়ে। আসলে এখন সব কিছু একটা object
তুমি কিভাবে নেবে তার উপর। আমার কাছে পুরো লাইফটাই একটা objectified existenceবিবেক, শালীনতা, মাত্রাজ্ঞান, অনুভব, দরদ এগুলো সিনেমায়, লেখায় objectified হলে বুঝতে পারি। নয়ত পাতি লাইফ থেকে ওগুলো ছেঁকে বার করা কি আর আমাদের কম্ম? 
        আমার বন্ধু বলল, না গো কুয়োর ছবিই তুলব, তবে এত নীচে জল?
- এটা কি নীচে দেখছিস, বোশেখ-জোষ্ঠিতে একঘটি জলও মেলে না।
 
 
 
 
 
 
        দুপুরে বিশ্রাম। বিকালে চললাম sunset point-এ । আমাদের হোটেল থেকে দশ মিনিটের দূরত্ব। গিয়ে দেখি সেই আদিখ্যেতার বহর। তারা যেন ভুলে গেছে তারা চিড়িয়াখানায় আসেনি, এসেছে মানুষের মধ্যেই। স্থানীয় লোকেরা, যারা এটা সেটা বিক্রি করতে এসেছে, কি উন্নাসিক ব্যবহার তাদের সাথে দেখলে হতভম্ব হতে হয়। কার ছেলে রাশিয়ায়, কার স্বামী টোকিয়ো, কার জন্ম হনলুলু... এটা একটা নোংরা থার্ড ওয়ার্ল্ড দেশ... এই আইস্ক্রীমওয়ালা যাবে না, যতক্ষণ না আমার খাওয়া হয়... আমার আরো খেতে ইচ্ছা হতে পারে... এই বেবি তুমি প্লাস্টিক পকেটে ভরো...
        এরকম আরো সব নমুনার সামনে উদাসীন সূর্য বরান্টির দিগন্তে হ্রদের জলকে সিন্দুরে রাঙিয়ে ডুবছে। আশেপাশে বিশ্রী সভ্য কোলাহল। অবশ্য সে কোলাহলও ছাপালো। সারি সারি গাড়ি এসে পড়ল কোথা থেকে। লরি, ট্রেকার, অটো, বাইক ইত্যাদি। বেশীরভাগ পুরুষ নারীর মাথায় গেরুয়া ফেট্টি। চীৎকার করছে জয় শ্রীরাম... জয় শ্রীরাম... সুর্য অস্ত গেছে। ধীরে ধীরে সূর্যালোক শোষিত পথের দু'পাশের আলো জ্বলে উঠছে।
 
        আমার মনের মধ্যে অনেক টুকরো। আতঙ্ক। ভরসা খুঁজছি। ভরসা কোথায়? চারদিক অন্ধকার। আমার আশেপাশে কৃত্রিম, জীবনীশক্তিহীন, দুর্বল মানুষের ঢল। আরেকদিকে প্রাণশক্তিতে ভরপুর উদ্দাম নেশায় মত্ত মানুষের সমুদ্র। ওদিকে বৃষ্টি কমছে। নদী শুকাচ্ছে। চাষের জল কমছে। একদিন গঙ্গার অববাহিকায় কিশোরীর বেণীর মত ক্ষীণ জলধারা বইবে হয়ত। গ্লোবাল ওয়ার্মিং, দূষণ নিয়ে ভাবার মত মানুষও রইবে না। ধুঁকতে ধুঁকতে তেষ্টায় খিদেতে নিজেদের মধ্যে লড়তে লড়তে মানুষের ইতিহাস শেষ হবে। পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হবে একটা অধ্যায়। তাতে কিচ্ছু এসে যাবে না এ মহাবিশ্বের, এ চরাচরের। চারদিক বড্ড অন্ধকার। 
        সুমন আবার তারা চেনা। কোনটা ধ্রুবতারা রে? এত ধোঁয়া কেন আকাশে আজ? মানুষ আগে দিক স্থির করত কি করে? শেখা আমায়... আমাদের আবার প্রথম থেকে শিখতে হবে...
 
(আমার কথাটি ফুরালো...)
 
 

Category