জনার্দনবাবুর দুঃখ হয়। কারণ দুঃখ পাওয়ার মত দুঃখ কিছু নেই। জাগতিক যা যা থাকলে সুখী হয় মানুষ, তার আছে। সুখী হলে এত সাদামাটা এলেবেলে জীবন হয়ে যায় যে অন্যের কথা কী, নিজেই নিজের দিকে আয়নায় তাকানো যায় না। লজ্জা লাগে।
জনার্দনবাবু দুঃখ খোঁজেন। এক এক সময় ভীষণ নস্ট্যালজিক হয়ে ভাবেন, আগের বেলপাতা কী এখনকার বেলপাতার মত ছিল? না তো। আগের বেলপাতা ছিল আরো সবুজ। আরো সরল। জনার্দনবাবু কচি পাঁঠার মাংস খেতে খেতে নিজের দিকে তাকান। একটা বৈশিষ্ট্যহীন সুখী জীব। আর কিছু নয়। জগতে এত এত বিখ্যাত মানুষ। তার জায়গা কোথায়? তখন উনি মনে মনে ছোটোবেলায় ফিরে যান। দুপুরে এক তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়ার কথা মনে করেন। নিজেকে বলেন, বিশ্বাস করান, সেদিন যা সুখ ছিল, আজ নেই।
মনকে নিয়ে একটা সুবিধা আছে। মন বিশ্বাসে চলে। মনকে যদি বলো, আমি দুঃখী। মন কথাটা ধাঁ করে লুফে নেয়। সে তখন যুক্তি সাজায়, আজ আমার ফ্রিজ আছে বলেই না আমি দুঃখী। যার কুঁজো সে কত সুখী। আজ আমার এতগুলো জামাপ্যান্ট আছে বলেই না আমি এত দুঃখী। যার এক সেট মাত্র জামাপ্যান্ট সে কত সুখী। আজ আমার এতরকমের চর্ব্যচোষ্য বলেই না আমি দুঃখী, যার একপদে খাওয়া সারা সে কত সুখী। আজ আমি এত জেনেছি বলেই না দুঃখী, যে এসব জানে না সে কত সুখী।
সুখ আছে। দুঃখ আছে। ভাবের সুখ আছে। ভাবের দুঃখ আছে। তেমন পার্থিব সুখ আছে। আবার পার্থিব দুঃখ আছে। ভাবের সুখদুঃখ, আর পার্থিব সুখদুঃখ একে অন্যের বিপরীতে। জনার্দনবাবু সেটা জানেন। তিনি মনকে ভাষার চাতুরীতে বাঁধেন। এই যেমন তিনি মনকে বললেন, দেখো, এই যে বর্ষার মেঘে সূর্যাস্তের রঙ লেগেছে বলে আমার কান্না আসছে, কিন্তু যার মনে এ ভাব নেই, সে কেমন দিব্যি ছাদে নিশ্চিন্তে দামী দোলনায় দুলতে দুলতে, ভুঁড়িতে সোনার আংটি লাগানো হাত বুলাতে বুলাতে সুখ পাচ্ছে।
জনার্দনবাবু এ খেলাটা দারুণ খেলেন। তার ভাবের দুঃখের সঙ্গে, পার্থিব সুখকে তুলনা করেন। কিন্তু ভুলেও বিপরীত খেলাটা খেলেন না। নিজের ভাবের দুঃখকে রাঙিয়ে অবশেষে বলেন, এই দুঃখ আমার মাথার মুকুট। উনি বলেন, থাক ওর ভুঁড়ি, থাক ওর সোনার আংটি, থাক ওর বারোতলা বাড়ির সোনাবাঁধানো দোলনা, আমি এই বর্ষার মেঘের বিষাদ রঙের দুঃখ নিয়েই বাঁচতে চাই। ওতেই আমার সুখ।
জনার্দনবাবুকে একদিন স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, ওগো, ভাব কীসে হয়? জনার্দনবাবু সজল চোখে চৈতন্যচরিতামৃত, গীতবিতানের দিকে তাকালেন। ভাবের দুঃখে চোখে জল আসা আর অর্শের যন্ত্রণায় চোখে জল আসার পার্থক্য যে না বোঝে, সে মানুষ হতে পারে, কিন্তু বাঙালি কি?
স্ত্রী বললেন, আমাদের বাড়ি যে কাজ করে, লতিকা গো, সে বলে কী জানো…. দাদাবাবু যে গানগুলো শোনে, শুনে আমার কান্না পায়। কী করুণ সুরগুলো বৌদি।
জনার্দনবাবু হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন বউয়ের দিকে। লতিকার পার্থিব দিক আর ভাবের দিকের মধ্যে তুলনা টানলেন। পাল্লা যেদিকে ভারী হল তা প্রকাশের নয়, গুপ্তসুখের। কিন্তু ভাবের দিকটা?
জনার্দনবাবু বললেন, ওটা চিপ সেন্টিমেন্টালিজম গিন্নি…. ওদের ওগুলো হয়…. দেখো গিয়ে শাহরুখের সিনেমার গান শুনেও কাঁদে…. ওদের কান্না আলাদা গিন্নি, কোনো সংস্কৃতি নেই ওতে….. সেন্টিমেন্টালিজম আছে…. বাদ দাও….
গিন্নি চলে গেল। জনার্দনবাবু ঝুলবারান্দায় বসে। পাশে দেবব্রত বিশ্বাস চলছে। “সুনীল সাগরের, শ্যামল কিনারে, দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে”....
লতিকা পুরীর বিচে হাঁটছে। পিছনে দৌড়াচ্ছেন জনার্দনবাবু। লতিকা… অ্যাই…. অ্যাই….
দাদাবাবু…. দাদাবাবু… পা তুলুন….
লতিকা…..
অ্যাই পা টা তোলো…. ও ঝাঁটাবে তো…..
ধড়ফড় করে উঠলেন জনার্দনবাবু। ছি ছি। তন্দ্রাতেই এই…. গভীর ঘুমে…. থাক থাক….
সুখী মনটাকে সামলে নিয়ে রাস্তায় এলেন। হাঁটবেন। একটা দুঃখ জাগিয়ে হাঁটবেন। ভাবের দুঃখ। পার্থিব সব সুখকে নস্যাৎ করে দিয়ে। কিন্তু লতিকা…. ছি ছি…. ভাবের লতিকাকে ছাপিয়ে যায় পার্থিব লতিকা…. জনার্দনবাবু গলি বদলান। যে গলিতে পার্থিব সুখ অনেক। স্বস্তির নাগালে দুঃখকে জাগান। যে দুঃখ কাঙাল করে না। কাতর করে।