সৌরভ ভট্টাচার্য
7 February 2019
রাতের বেলা যজ্ঞেশ্বরী জেগে উঠল। বলাই মারা গেছে বাইশদিন হল। যজ্ঞেশ্বরীর ঊনষাট বছরে এই প্রথম একলা বসন্ত। খাটের উপর একটা আসন বিছিয়ে ধ্যানে বসেছে যজ্ঞেশ্বরী। আলো ফুটতে দেরি এখন। সাদা থানের উপর চায়ের দাগ। জপের মালা ফেরাতে ফেরাতেই চোখে পড়ল। বিরক্ত লাগল। চিনি ছাড়া চায়ের দাগ। বলাইয়ের সুগার ছিল। সুগার ফল করেই মারা গেল। সেই থেকেই চিনি ছাড়া চায়ের অভ্যাস।
জপের মালা উঠিয়ে বাইরে এল। আলো ফুটেছে সদ্য। থানের নীচের দিকটায় কাদার হালকা ছাপ। গত পরশু বৃষ্টি হয়ে উঠোনে জল জমেছিল। পরেরদিন কাদা। কাচাটা ঠিক হয়নি। হাতে জোর পায় না। কাঁধের থেকে একটা ব্যথা হয়।
হালকা শীত শীত সকালের দিকটায় আছে। একটা পাতলা শাল গায়ে দিয়েছে। দার্জিলিং থেকে কিনেছিল। তখনও বাবু হয়নি, পেটেই, দু'মাস। ওদের মিলের সবাই গিয়েছিল। সস্তায় ঘোরা হবেই বলে গিয়েছিল। শালটার তিন-চারটে জায়গায় ফুটো। কেনাই যায় নতুন, বাবু বলেওছে।
বেলা গড়ালো। আজ একাদশী। সেরকম খাওয়ার ঝক্কি নেই। টিভিটা চালাল। সিরিয়াল দেখে পর পর পাঁচটা। না হলে কোনো সিনেমা। পুরোনো বাংলা সিনেমা।
আজ ঘুমিয়ে পড়ল। এই নিয়ে পর পর চারদিন হল। ঘুমিয়ে পড়ছে। চোখ খুলল। ঘড়িটা চশমা ছাড়া দেখা যায় না। তবে আলো দেখে মনে হয় - একটা। উঠে চশমাটা চোখে দিল, আড়াইটে। স্নানে গেল। এই সময়টা কান্না পায়। না পেলেও জোর করে কাঁদাবার চেষ্টা করে। ভালো লাগে। মনে হয় সঙ্গে কেউ যেন আছে। বাবু কলকাতায়, ষাট কিলোমিটার দূরে, নাতি বলেছে, টুয়ে পড়ে, ইংলিশ মিডিয়াম। লোকে বলে, বউমা থাকতে চায় না। যজ্ঞেশ্বরী জানে, বউমা না, বাবু'ই চায় না, পাড়া-গাঁ ভালো লাগে না।
স্নান হল। সিংহাসনের সামনে বসল। লক্ষ্মী, নারায়ণ, শিবলিঙ্গ, লোকনাথবাবা তারই দিকে তাকিয়ে বসে। এক এক সময় যজ্ঞেশ্বরীর মনে হয় এদের দাহ করে আসে। এও তো বন্ধন। যজ্ঞেশ্বরী নকুলদানা দিল। জল দিল। স্টিলের থালা-গ্লাসগুলোয় ময়লা জমেছে।
একটা বাটিতে মুড়ি নিয়ে খাটে এসে বসল। টিভিটা চলছে। এইসময়টা কান্না পায় না। ভালো লাগে। স্বাধীন লাগে। যজ্ঞেশ্বরী নিজের মত রাঁধে। নিজের মত খায়। সুগার নেই।
বিছানায় শুয়েই বিকাল হল। আগে ঘর গুছাতে ভালো লাগত। এখন লাগে না। এপাশ ওপাশ করে পাঁচটা বাজিয়ে সন্ধ্যাদের বাড়ি গেল। কয়েকটা বাড়ি পর। রোজ সন্ধ্যেবেলা কীর্তন, ভাগবতপাঠ হয়। সে হোক। পাঠের জোগাড় আর পাঠের পর হাত-পা ছড়িয়ে গল্প করতে করতে নিজের ছোটোবেলায় ফিরে যায়। যেন তার বিয়ে হয়নি। যেন তার নাড়ি কেটে কোনো প্রাণ জগতে আসেনি। তার কোনো দায় নেই। কারোর উপর নেই।
রাতে ফিরে এলো দশটায়। একাদশী বলে খেয়েই এসেছে। তার মত কিছু বিধবা একসাথেই খায়। সাগু ভিজিয়েই রাখে ও-বাড়ির বড় বউ, বিধবা, বরটা গলায় দড়ি দিয়েছিল।
মশারি টাঙালো। বিছানায় রাতে এখনও দুটো মাথার বালিশ, পাশবালিশ রাখে। ডানদিকটা ছেড়েই শোয়। আজও শুয়েছে।
রাতে সে নিজেকে চিনতে পারে না। কানের ভিতর কড়কড় করে। গলা শুকিয়ে যায়। পায়ের শিরায় টান ধরে। মাথাটা গরম হয়ে যায়। শিরদাঁড়া দিয়ে টনটনে ব্যথা করে। পাখাটা বাড়ায়। আবার কমায়। বন্ধ করে। চালায়। চোখে মুখে ঘাড়ে জল দেয়। শাড়িটা খুলে উলঙ্গ হয়ে শোয়। কাঁথা গায় দেয়। আবার খোলে। ভোর হয়। ঘুম হয় না।
আজ ভোরে উঠেই বাজারে গেল। বাজারে অনেক বিধবা তার বান্ধবী। মিল বন্ধের সময় ফুল বিক্রি করে সংসার চালিয়েছে।
রাত দশটার সময় একজন বৃদ্ধা এল। যজ্ঞেশ্বরী ঘুমালো। মাসের শেষে তিনশো টাকা বৃদ্ধার হাতে দিল। বৃদ্ধা বলল, পাঁচশো দিবা বলেছিলা না? যজ্ঞেশ্বরী বলল, কই পাবো বিভা? তুমি পারবা না এইতি থাকতে? শুধু রাতডাই তো..
বিভা বলল, পাঁচশো দিলি ওর হাঁফের ওষুধ কিনতি আর বাজারে শাক নিয়ে বসি না... কডা টাকার জন্যি সেই চারঘন্টা বসি থাহা... কদ্দিনই বা বাঁচবে বুড়ো... আর এক বচ্ছর... ডাগদার যা কইল... তারপর তো ফিরিতেই....
যজ্ঞেশ্বরী বলল, সামনের মাসে দেখি..., আয়...