বাসন্তীর সবার বাড়ির ছাদে, ফ্ল্যাটের গ্রিল দেওয়া বারান্দায় শুকাতে দেওয়া জামাকাপড় দেখতে ভালো লাগে। জামাকাপড়গুলোর দিকে তাকালে বাসন্তী যেন বুঝতে পারে কোন বাড়ির মানুষ কতটা সুখী। ঝুলে থাকা জামাকাপড়ে মানুষের গল্প লেগে থাকে। বাসন্তী পড়ে। পড়তে পড়তে আনমনা হয়ে যায়। এই যে গোটা পৃথিবীটা চরকির মত রাতদিন ঘুরে চলেছে যুগ যুগ ধরে, সেই পৃথিবী কি জানত তার বুকে একদিন মানুষ জন্মাবে? সেই মানুষের বুকে একদিন এত গল্প জন্মাবে? যা মেলা থাকবে কাপড়ে জামায়? সূর্য সে কাপড় শুকাতে শুকাতে পড়তে পারে সে ভাষা, সে গল্প?
বাসন্তী না তো বই পড়ে, না তো সিনেমা সিরিয়াল দেখে। বাসন্তী মানুষের জামাকাপড়, ফেলে দেওয়া জুতো, ব্যাগ, কৌটো --- এইসব পড়ে। বাসন্তী কথা বলে না বেশি। একা থাকে যে তা নয়। স্বামী, ছেলে, ছেলের বউ, নাতি সব আছে। কিন্তু বাসন্তীর বুকে আরেক বাসন্তী আছে। খাঁচায় আটকানো পাখির মত না, নীড়ে বসা পাখির মত। সে বাসন্তীর বুকে বসে। আবার উড়ে যায়। নানা মানুষের গল্প নিয়ে আসে। নিজের নীড় সাজায়।
এই যে সামনে গোলাপী বাড়িটা, ওরা মাসে দুবার করে সব পর্দাগুলো কাচে। পর্দাগুলো ঝুলতে ঝুলতে বাসন্তীকে বলে, এতটাও ভালো না। এরা বসে না। কথা বলে না। আকাশ দেখে না।
নীল বাড়িটার ছাদে যে নাইটিটা, শাড়িটা, লুঙ্গিটা মেলে… সেগুলো কতদিন হল পুরোনো। ছেঁড়াও তো। কিন্তু ওদের গায়ে যেন কি সুখ। ধুপের গন্ধ। মিষ্টি রান্নার গন্ধ। গরমকালে বিকেলে গা ধুয়ে, গায়ে দেওয়া পাউডারের গন্ধ। বাসন্তীর ইচ্ছা হয় ওদের বাড়ি দুপুরে একদিন ওদের সঙ্গে খেতে বসে।
সাদা বাড়িটা, ওদের বাড়ির ছাদের জামাকাপড় ভীষণ বিষণ্ণ। মেয়েটার ফ্রকগুলো দেখে বাসন্তীর রোজ নাকটা জ্বালা করে ওঠে। জল ভরে আসে চোখে। মেয়েটার মা মারা গেছে করোনায়। বাবা দেখাশোনার জন্য একজনকে রেখেছে। সে জানলায় বসে বসে রাতদিন ফোনে কথা বলে। মেয়েটা একা একা ভাত বেড়ে খায়। একা একা পড়তে বসে। একা একা বিকেলে নাচে। বাসন্তীর কান্না পায়। ওর ওই দেখাশোনা করা মানুষটার সবুজ আর হলুদ নাইটিটা যখন ছাদে এসে মেলে, বাসন্তীর মনে হয় কাকে দিক হেগে ওর উপর, ঝড়ে উড়ে গিয়ে পচা ডোবায় পড়ুক, রোদে ঝলসে যাক রঙ… নষ্ট মেয়েমানুষ কোথাকার!
বাসন্তীর জ্বর। কদিন হল ছাদে ওঠেনি। রাতের বেলায় ঘুম আসছে না। দুর্বল শরীর ভীষণ। বাসন্তীর মনে হল, আজ তো পূর্ণিমা, উঠি না ছাদে, কি হবে?
কাউকে না জাগিয়ে, বেড়ালের মত নিঃশব্দে বাসন্তী ছাদে উঠল। হাঁফ ধরে গেল। বুকটায় মনে হচ্ছে বাতাস নেই। করোনার পর থেকেই এটা হয় আজকাল। একটুতেই হাঁফ ধরে যায়। জলের বোতলটা আনলে হত।
বাসন্তী কার্নিশ ধরে দাঁড়ালো কিছুক্ষণ। সব বাড়ির ছাদ, ফ্ল্যাটের বারান্দা জেগে। ঘরগুলো ঘুমিয়ে। সামনের ফ্ল্যাটের বারান্দায় দড়িতে টাঙানো আটপৌরে শাড়িটা বলল, এতদিন আসোনি কেন দিদি?
এই শাড়িটা বউটার খুব প্রিয়। হয় তো বা এই সবুজ রঙটাই। সবই দেখি সবুজ কেনে মেয়েটা।
দূরের বাড়িটার ছাদে শুকানো বিছানার চাদরটা বলল, ঘুমাবে না?
এই বাড়ির বউটা রোজ কাপড় তুলতে ভুলে যায়। বড্ড আনমনা। কাপড় শুকাতে দিয়ে ক্লিপ দেয় না। কতবার হাওয়ায় উড়ে গেছে কাপড়। বাসন্তীর মনে হয়, হয় তো বউটা যখন মেয়ে ছিল, হাওয়ায় উড়ে গেছে অনেক কিছু… তাই আর ক্লিপে আটকায় না কোনোকিছু। ওর বাড়ির সব জামাকাপড় ভীষণ উদাস।
বাসন্তী বসল। তাকালো আকাশের দিকে। এক আকাশ তারা মেলে দিয়ে গেছে কে। গোটা আকাশ জুড়ে যেন নীল শাড়ি শুকাচ্ছে একটা। চাঁদের কাছটা আঁচল। আঁচলকে এক এক সময় এক এক দিকে নেয় আকাশ।
বাসন্তীর ঘুম আসছে এবার। কিন্তু নীচে যেতে ইচ্ছা করছে না। শিশির জমছে মাথায়। বাসন্তী কখনও নিজের জামাকাপড়ের ভাষা পড়তে পারে না। বড্ড অভিমান জমে আসে। সব কাপড়ে এত এত অভিমান। এতদিন ধরে মেলে থাকল জীবন, তবু শুকালো না!
বাসন্তী অভিযোগ করে না। অভিমানদের বলে, পানকৌড়ির মত ডানা মেলে থাক সূর্যের দিকে। একদিন সব শুকিয়ে যাবে।