Skip to main content
 
 
       গাড়িটা সিগন্যালে আটকে। কাঁচ তোলা। এসি চলছে। অলোক ICU -তে।
       বৃষ্টি হয়ে গেছে সকাল থেকে খেপে খেপে। মঞ্জুলা অন্যমনস্ক। জমা জলে দোকানের হোর্ডিং-এর আলোর প্রতিফলন দেখছে। জ্বলছে নিভছে। যেন জীবন্ত। আসলে সে জীবনের অনুকরণ করছে, মিমিক্রি। মুভমেন্ট মানে জীবন। অলোক হয়ত ফিরবে না। বাহান্নতেই জীবনীশক্তি ফুরিয়ে ফেলল। একটা ফ্ল্যাট, একটা গাড়ি, কিছু আসবাব, বই, একটা ব্যস্ত ছেলে, আর সে। আর কি চাই? ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, অবশ্যই বড় কথা। কিন্তু ভোলাটাইল। জীবনটার মত।
       একজন মহিলা ভিক্ষা করছে। কোলে বাচ্চা। মঞ্জুলা গরীব মানুষ দেখলে নার্ভাস হয়। ওরা একটা প্রতিযোগিতায় ডাক দেয় - একবার এভাবে বেঁচে দেখো... মঞ্জুলা বারবার মাথা নাড়ে, না না, কিছুতেই না। মঞ্জুলার বাবা অনেক টাকা ধার করে ফেলেছিলেন। আত্মহত্যা করেন। মঞ্জুলার মা-ও। সে মামাবাড়িতে মানুষ। অলোক তার মামার বন্ধু। একটা সিক্যিওর লাইফের টানে বিয়ে করেছিল। অলোক জানে। মঞ্জুলাও ভুল ভাঙায়নি। তবু অভ্যাসে হোক, কি জৈবিক কারণে হোক বা ভাগ্যের কলকাঠিতে, সংসারটা প্রায় নির্ঝঞ্ঝাট করতে পেরেছে দু'জনেই।
 
       গাড়িটা নিয়ে এগোনো যাচ্ছে না। সামনে নাকি কি একটা গোলমাল হয়েছে। রোজ লেগে থাকে কলকাতায়। মঞ্জুলা দেখছে লোকে বাস থেকে নেমে হাঁটছে, অনেক মানুষ হাঁটছে। বাইরে কোথাও একটা কিছু গোলমাল হচ্ছে, নামতে ইচ্ছা করছে না। শ্রীকান্ত আচার্যের গলা গাড়ির বন্ধ কাঁচের মধ্যে, একটু বাড়িয়ে দিল - আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। 
       অগাস্টের গরম বাইরে। প্যাচপেচে গরম। বৃষ্টির পরে যেন আরো বেড়ে গেছে, গাড়িতে উঠতেই টের পেয়েছিল মঞ্জুলা। লোকেদের ঘর্মাক্ত মুখ, জল বাঁচিয়ে হেঁটে যাওয়া দেখলে বাবার মুখটা মনে পড়ে, শ্রী বিমল জোয়ারদার। হেরে যাওয়া মুখ। ব্যর্থ জীবন। মায়েরও। সিদ্ধান্তটাই আসল। সেখানে ভুল করলে সব ভুল, অলোক শিখিয়েছে। অলোকের ব্যবসা। মঞ্জুলাও সক্রিয় অংশীদার। সফলতার স্বাদ আলাদা। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। আদর্শ শব্দটার মত, ঠুনকো নয়, উদ্বায়ী। 
       মঞ্জুলা ঘড়িটা দেখল। দেড়ঘন্টা হল। টয়লেট পাচ্ছে। টাইপ টু ডায়াবেটিক। ডাক্তার মিট করার আছে। কাঁচটা নামালো। কারণ জিজ্ঞাসা করতে শুনলো হিল ক্লিনিক নার্সিং হোমে আগুন লেগেছে। অলোক চার তলায়। ICU -তে। গলার কাছে একটা উৎকণ্ঠা জমে এলো। টয়লেট পাচ্ছে না। ভিড়টা চোখের সামনে নেই। কি করে কি করে গাড়িটা একটা সাইডে পার্ক করল। হাঁটছে। ICU বেড নাম্বার ফোর। 
       নার্সিং হোমে বাড়ির লোক ছাড়া ঢুকতে দিচ্ছে না। মঞ্জুলা একটা তীব্র উত্তেজনা অনুভব করছে। শোক নিয়ে তবে লোকে এত বাড়িয়ে বলে কেন? এমন তীব্র তো নয়, অসহ্য তো নয়! তার টয়লেটের চাপটা আবার তলপেটে লাগছে। প্রচণ্ড ভিড়। ঘাম হচ্ছে, হাইপোগ্লাইসেমিয়া নয়, বেরোবার আগেই ভাত খেয়ে বেরিয়েছে। উত্তেজনায়। কিন্তু ভেঙে পড়ার মত অস্থির লাগছে না তো, তবে কি লোকে অভিনয় করে? আসলে এতটাই হয়? 
       নার্সিং হোমে মৃত মানুষদের একটা প্রাথমিক লিস্ট ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন ভিড় করে। এতক্ষণ খেয়াল করেনি অনেকেই কান্নায় রাস্তার উপরেই ভেঙে পড়েছে। অনেকের মুখও চেনা। এখানে যাতায়াত করতে করতেই চেনা। অলোক আজ প্রায় মাসখানেক হল কোমায়।
       মৃতদের লিস্টে নেই। উপরে উঠতে দিচ্ছে না। ICU নাকি পুড়ে ছাই। মঞ্জুলার কান্না পাচ্ছে। একটা তীব্র উত্তেজনাও সাথে। এটা কি সুখ? কিন্তু কেন? একটা চাপা আনন্দের স্রোত বুকের মধ্যে। অ্যাকোরিয়ামে টোকা দিলে মাছ যেমন নড়েচড়ে ঘোরে তেমন ঘুরছে।
       বিয়ার্স আসছে। দৌড়ে আসছে। ICU -র নার্স। এত উত্তেজিত কেন মুখটা...
       স্যারের কিচ্ছু হয়নি ম্যাডাম... ওনাকে নিয়ে স্ক্যান করতে বেরিয়েছে আর কুড়ি মিনিটের মধ্যেই.... আপনি রিয়েলি লাকি ম্যাডাম....
       মঞ্জুলার মনে হল হঠাৎ করে যেন বাথরুমের মধ্যে কারেন্ট চলে গেল। অন্ধকার চারদিক। অস্বস্তিকর অন্ধকার। টয়লেটে যেতে হবে। সাউথের ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামটা জানতে হবে। ওকে নিয়ে অন্য কোনো নার্সিং হোমে যেতে হবে...
       মঞ্জুলা গাড়িতে এসে বসল। কাঁচ তুলে এসিটা অন্ করল। গানটা চালালো। সারা মুখে ভোরে উঠে ব্রাশ না করার অস্বস্তি। ফিরতে ইচ্ছা করছে না। কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। ভিড়টা ঠেলে রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে চালাচ্ছে। একটা অস্বস্তি। এই অস্বস্তিটাই অভ্যাস। মঞ্জুলা ধীরে ধীরে জ্যাম কেটে বেরোবার রাস্তা খুঁজছে।