Skip to main content

কথা বন্ধ। কিন্তু কান্না বন্ধ করবে কে? আটাত্তর বছরের শীর্ণ মাথাটাকে বালিশের উপর রেখে, রোগা হাতটা ছেলের হাতের উপর রেখেছেন। মা।

সামনে খাটের কোণে বসে, ছেলে, যারও প্রথম ভাষা ছিল কান্না। খিদের কান্না, ব্যথার কান্না, ঘুম না হওয়ার কান্না। ধীরে ধীরে কান্নার ভাষা বুঝতে পারে মা। কান্না, যোগসূত্রের প্রথম ভাষা।

ছেলে শূন্য চোখে তাকিয়ে। কষ্ট পাচ্ছে। জিভের ভাষা শিখতে শিখতে কান্নার ভাষা ভুলে যায় সভ্য মানুষ। কান্নার কোনো স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ নেই। নেই তালব্য বর্ণ, ওষ্ঠ্যবর্ণ, মূর্ধন্যবর্ণ। কান্নার সবটাই কণ্ঠবর্ণ। হৃদয়বর্ণ।

এই শেষ সময়ে কান্নার শব্দগুলো মনে আসছে। বাবুর কান্না। ভোররাতে, মাঝরাতে, এই খাটের কোণায় মাথা ঠুকে, দিনদুপুরে খিদের তাড়নে, কান্না। বেড়ালের কান্না, কুকুরের কান্না মনে পড়ছে। মনের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে কান্না বোঝার। শেখাতে হয় না। শিখেই জন্মায়। গোটা জগত যেন কান্নাসূত্রে বাঁধা। সে কান্নায় নাকি ঈশ্বরও সাড়া দেন।

একটা ফড়িং জানলার কাঁচের সামনে গিয়ে ডানা ঝাপটাচ্ছে। ওর ডানায় কান্না। বাইরে আলো। ও বাইরে যেতে চায়। ছেলের দিকে ইশারা করলেন মা। ছেলে মায়ের চোখের ইশারায় ডানা ঝাপটালো ফড়িংটাকে দেখল। খুলে দিয়ে এলো জানলা। ফড়িংটা বেরিয়ে গেল। ঘরটায় এক দমকা অতিরিক্ত আলো এসে পড়ল। আবার জানলায় কাঁচ বন্ধ করে দিল ছেলে। ঘরটা বাতানুকূল। গোটা পৃথিবীকে অনুকূল করতে পারেনি মানুষ, তাই ছোটো ছোটো খোপকে অনুকূল করে বাঁচে। ছোটো ঘরে সুখ। বড় জগতে কান্না। সুখে বেড়া দিতে হয়। কান্না শক্ত মাটিকে ভিজিয়ে নরম করে। সে মাটিতে বীজ বোনা হয়। দরদের।

চোখটা বন্ধ করলেন। মা। ছেলে বাইরে গেছে। হয় তো আর দেখা হবে না। কিম্বা দেখা হতেও পারে। ছেলের আদিম কান্নার স্মৃতি শুধু মা জানে। সবাই হারায়। ভুলে যায়। মা ভোলে না। মা খুঁজে খুঁজে কান্নার স্বরমালা বার করছেন। ছেলে তো আছেই। বুক জুড়ে। মৃত্যু পাশে এসে দাঁড়িয়ে। শীর্ণ শরীরের উপরই দাবী ওর শুধু। বুকজোড়া এমনই থাকবে। থাক। ছোটোঘরটুকুই যাবে শুধু। যাক।