Skip to main content

সনাতনের মৃত শরীরটা নিয়ে ভাবনা ছিল না, ভাবনা ছিল মনটা নিয়ে। মানুষের শরীর মরে, মন তো মরে না। মন, কথা হয়ে বাতাসে, গাছে, মাটিতে বিঁধে থাকে। বেঁধে। জ্বালা দেয়।

সনাতনের ঝুলন্ত অভিমানী দেহটা প্রথম দেখেছিল চম্পা, ভাইয়ের বউ। প্রথমে ঘাবড়ে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ে। তারপর রাগ হয়, আজ তার ছোটো ছেলেটার জন্মদিন, বাড়িতে আর না হোক চারটে বাচ্চা তো আসবেই। বেশ কিছুক্ষণ বসে বসে সনাতনের হিসিতে ভিজে যাওয়া লুঙ্গিটা দেখে। কাকলির কথা মনে হয়। সনাতনের বউ। ছেড়ে গেছে আজ বছর দুই হল। যাবে না? গ্রামের মেয়ে বলে কি শখ থাকতে নেই! সনাতন বলত কাকলির নাকি খাই অনেক। আজ সিনেমা, কাল শাড়ি, পরশু নাকেরটা। চম্পার হিংসা হত। তাও তো মেয়েটা মুখে বলতে পারত। সে বলতে গেলে তো মারমুখী হয়ে তেড়ে আসে তার বর। ছেলেদের সামনেই দু চড় লাগিয়ে দেয়।

চম্পা উঠল। এঁটো বাসন পড়ে, ঘর মোছা হয়নি, উঠান ঝেঁটানো হয়নি, ছাগল মুরগীগুলো খোলা হয়নি…. অসহ্য!

======

পুলিশ এলো বেলায়। খবরই দিয়েছে জগন্নাথ বেলায়। ভাইটা মরেছে শুনে পাশ ফিরে শুলো। মালের ঘোর নামেনি হয় তো। চম্পা চা করে নিয়ে যাওয়ার পর উঠল। কে দেখেছে…. ছাগলগুলো ছাড়া হয়েছে কিনা…. বড়ছেলে ফোন করেছে কিনা… ছোটোছেলে পড়তে গেছে কিনা…. সব খোঁজ বিছানায় বসে বসে নিল। বড়ছেলে মাসির কাছে থাকে বর্ধমানে। এই গ্রামে কিচ্ছু হবে না, জগন্নাথ বলে। ছোটোটাকেও পাঠিয়ে দিতে হবে…. এও বলে। চম্পা বলে না কিছু। বলার কি যে আছে তার সংসারে তাই বুঝে পেলো না এদ্দিনে।

=====

সনাতনের বাবা মা এলো আরো বেলায়। সনাতনের মা এসেই দুবার কেঁদে জিজ্ঞাসা করল, "কিছু টাকাপয়সা আছে ঘরে দেকেছিস?, পুলিশে কাটাছেঁড়ার পর তো আমাদেরই পুড়াতে হবে…. আবার তিনদিনে কাজ… ওর বাবার তো কাজ নেই জানিস…. কোত্থেকে যে কি হবে… পঞ্চায়েতে কথা বলে দেক না…."

জগন্নাথ সব শুনে একটা গালাগাল করে বলল, বেশি হেজিও না তো….

দুর্গা চম্পাকে বলল, চা করেছিস…. দে না মা…. দু চামচ চিনি দিস… এতটা রাস্তা বাসে…. পিঠটা ধরে গেছে…. হ্যাঁ রে পেটটা অমন কেন? আবার ধরেছিস নাকি?...

চম্পা ঝাঁঝিয়ে বলল, তোমার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করো না…. আমি তো গাব জ্বাল দিয়ে পেট করিনি… তার শখের তো শেষ নেই….

======

দুর্গা আর বিষ্ণু উঠানে বসে। চম্পা চা দিয়ে গেল। বিষ্ণু বলল, বউমা এবারে দীক্ষাটা নিয়ে নাও। ওকেও বোঝাও। জীবন এই তো দেখছ।

চম্পা কিছু বলল না। শ্বশুরকে সে শ্রদ্ধা না করলেও অসহ্য লাগে না। মানুষটা বোকা। ধম্মোকম্মোর আড়ালে সংসারে নিজেকে বাঁচিয়ে চলে। আসলে মানুষটা ভীতু। সংসারে সবার একটা ভেক লাগে। খাঁটি জিনিস বলতে সংসারে একটাই, গু। আর সবে ভেজাল।

চম্পা বলল, দীক্ষা নেব বাবা, তার আগে ছেলেমেয়ে বিইয়ে জিরিয়ে নিই… এই তো দেখছেন… পেটটা…

বিষ্ণু থতমত খেয়ে উঠে গেল। ছেলেটাকে পুলিশে নিয়ে যাচ্ছে, দাঁড়াতে তো হয় একটু। গিয়ে দাঁড়ালো। মিত্তিরদের পাকা বাড়ি হল কবে?

======

সনাতনের ঘরে টাকা পাওয়া গেল পাঁচশো কুড়িটাকা। আর ক'টা খুচরো। তাতে করে ওই তিরিশ টাকার মত হবে আরো। চম্পা আশ্চর্য হয়ে গেল ওর আলমারির মধ্যে কাকলির ছবি দেখে। কাকলিই নিশ্চয় ভুল করে রেখে গিয়েছিল, ও রাখবে?! তবেই হয়েছে আরকি! দেওরকে সে চেনে না? সব শয়তানি চেনে। তুমি তো বিয়ে হয়ে এসেছিলে মাত্র ক'টা দিন…আমি চিনি….

শ্বশুর ঢুকল। বৌমা…. আমি তো শ্রাদ্ধতে থাকতে পারব না…. আমাকে একটু গঙ্গাসাগর যেতে হচ্ছে, গুরুদেবের দেহান্ত হল। ভাণ্ডারা আছে।

কিন্তু বাবা আপনার তো অশৌচ….

মা… এ সংসারে জন্ম থেকেই আমার অশৌচ… আলাদা করে মানার কিছু নেই…. আমি বেরোব…. রাস্তায় খেয়ে নেব কিছু… তোমার শাশুড়ি কি করবে সে-ই জানে…. দেখো…. আমি আসি….

সকাল থেকে এই প্রথম চম্পার চোখে জল চলে এলো। কোথা থেকে কান্না চলে এলো তাও বুঝল না। গলা বুজে কান্না বেরিয়ে এলো। মাটিতে বসে পড়ল মুখে আঁচল দিয়ে… দু’দিন আমি ভাত দিই না বাবা…. ইচ্ছা করেই দিইনি… মাল খেয়ে এসে ঘরে দোর দিয়ে শুয়ে থাকত…. ওর দাদার মত চীৎকার, চেঁচামেচি করলে মানতাম পুরুষমানুষ.. আমাকে দু ঘা দিলেও মেনে নিতাম… কিন্তু ওকি অভিমান…. সারাদিন ঘরে শুয়ে… ছোটো ছেলেটা বলেছিল কাকাইয়ের জ্বর… কানে নিইনি… দিইনি ভাত…. কাউকে শাসন করতে জানল না… না নিজের মনকে, না বউকে…..

বিষ্ণু চম্পার কাছে এসে দাঁড়ালো। চম্পার মাথায় হাত রেখে বলল, ও আমার ধাত পেয়েছিল রে মা…. মার হজম করে নিত, কিন্তু মুখে শব্দ জুগাতো না….

চম্পা ফুঁপিয়ে উঠল দুবার। আড়চোখে দেখল উঠানে ভর্তি লোক। এমনিতে কেচ্ছার অন্ত নেই। ঘুঁটের মত সবার দেওয়ালে দিয়ে বেড়াচ্ছে সবাই। তারপর সেই ঘুঁটে তুলে মনে তাপ দিচ্ছে। কুকথার তাপে আরাম বেশি।

=====

বিষ্ণুর সঙ্গে সঙ্গে দুর্গাও চলে এলো। কি করবে থেকে? না আছে কেবল টিভি, না তেমন বাজারদোকান। দম আটকে আসে।

বাসে দু’জনে পাশাপাশি সিটে বসল। দুর্গা বলল, তুমি কবে ফিরবে?

বিষ্ণু বলল, যদি না ফিরি?

দুর্গা বলল, তুমিও বাঁচবে, আমিও বাঁচব।

বাস চলছে। দুর্গা উদাস হয়ে ধানক্ষেত দেখতে লাগল। কয়েক বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে তার বেশ চলে যায়। কিন্তু এই যে বলল, তুমিও বাঁচবে, আমিও…. বাঁচা মানে কি?

টিকিট….

দুর্গা বলল, জাহান্নাম, দুটো…