Skip to main content
jahaj

লোকটা যখন জেগে উঠল, তখন জাহাজটা মাঝ সমুদ্রে। বিশাল বড় জাহাজ। লোকটা হামাগুড়ি দিয়ে জাহাজের পাটাতনে এলো। মাথাটা উঁচু করে তাকালো। চারদিক জল জল আর জল। আকাশের দিকে তাকালো। নীল নীল আর নীল। শূন্য সব। লোকটা বুকের কাছে হাতটা নিয়ে গিয়ে নিজের বুকটা খামচে ধরল। সে জানে সে ডুবে যাবে। এ জাহাজ ডুবে যাবে। সবাই শেষ হয়ে যাবে। না, না, না, এ হতে পারে না। লোকটা নিজেকে গুটিয়ে শামুকের মত কুঁকড়ে শুয়ে থাকল। 
    
    পিঠে কারোর ছোঁয়া লাগল। সে ঘুরে তাকালো। জাহাজের কর্মচারী একজন। সে বলল, কি হয়েছে? বমি পাচ্ছে? 

     লোকটা বলল, না। আমরা সব ডুবে যাব। নাবিক জানে? 

    কর্মচারী বলল, তুমি নেশা করেছ?

    লোকটা বসে পড়ে তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলল, গন্ধ পাও? আমি নেশা করিনি। সব ডুবে যাব। তুমি কি করো? 

    কর্মচারী বলল, আমি রাঁধুনি। 

    লোকটা বলল, নিজেকে ভুলিয়ে রাখছ… বেশ বেশ… সবাই তাই করে। আসলে ভয় হয় তোমার… হয় না? 

    কর্মচারী বলল, ভয় হয় ডুবে মরার না। বাড়িতে বউবাচ্চাদের আর দেখতে পাব না… তার। 

    লোকটা বলল, সে তো কষ্ট, ভয় না। তোমার ভয় করে না? 

    কর্মচারী বলল, এসো রান্নাঘরে, কাজ করো কিছু, ভয় করবে না। 

    লোকটা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। আর উত্তর করল না। 
 
    দুপুর হল। আরেকজন এসে বলল, এই যে দাদা এখানে শুয়ে যে… খাবেন না?

    লোকটা বসে বলল, নাবিকের ঘরটা কোথায় বলতে পারো? 

    সে জাহাজের উপরের দিকে একটা ঘর দেখিয়ে বলল, ওই যে…

    লোকটা উঠে দাঁড়ালো। ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল। নীচের ঘর থেকে নাকি উপরে ওঠার রাস্তা। তার উদাস ভয়ার্ত মুখ দেখে কেউ হাসল, কেউ বিদ্রুপ করল, কেউ উদাস থাকল, কেউ ডাকল। কিসে ডাকল? কেউ ডাকল জুয়ায়, কেউ ডাকল শরীর শরীর খেলায়, কেউ ডাকল গ্রন্থাগারে, কেউ ডাকল প্রার্থনায়, কেউ ডাকল কাজে, অনেক কর্তব্য, অনেক দায় থাকে যে জাহাজে! 

    সে গোঁ ধরে উঠতে শুরু করল নাবিকের ঘরের দিকে। যখন নাবিকের ঘরে এসে পৌঁছালো, তখন আকাশ করে এসেছে কালো মেঘ। নাবিক উদ্বিগ্ন মুখে খাতা পেন্সিল সাজিয়ে কি করছে। সে যে ঢুকেছে খেয়ালই করেনি। 

    লোকটা বলল, সব ডুবে যাবে। জানেন, ও মশায়, শুনছেন, বলছি সব ডুবে যাবে। 

    নাবিক মাথা তুলে তাকালো। চোখ থেকে চশমাটা সরিয়ে বলল, তুমি জানো? সঠিক জানো? 

    লোকটা মাথা নেড়ে বলল, আলবাত জানি। আজই, এখনই ডুবে যাবে সব। 
 
    নাবিক হেসে বলল, ভাগ্যে তুমি এলে, আমি এতক্ষণ ধরে অনর্থক জাহাজটাকে রক্ষা করার রাস্তা খুঁজে মরছিলাম। তবে তো সিদ্ধান্ত আগেই হয়ে আছে। সব ডুবে যাবে। এসো এসো হাতে যতক্ষণ সময় আছে একটু সেলিব্রেট করা যাক। 
  
    ঝড় উঠল। জাহাজ উঠল দুলে। নাবিক উঠল নেচে। বলল, আহা, আজ কি আনন্দ আমার…আমার ভার নিয়েছ তুমি…কি বিশ্বাস তোমার…কি অটুট দূরদর্শিতা! 

    লোকটা ভেবলে মাটিতে বসে পড়ে বলল, মানে? আপনি জাহাজটাকে বাঁচাবেন না? 

    নাবিক বলল, না। তুমি কি চাও, বাঁচতে, না মরতে? 

    লোকটা বলল, বাঁচতে। 

    নাবিক বলল, কিন্তু এতক্ষণে মনে মনে কতবার ডুবিয়েছ জাহাজটা? 

    লোকটা বলল, আমি বাঁচতে চাইলেও আমার মন চায় না। তার স্বস্তি নেই। সে রাতদিন ডোবার ভয় দেখায়, ডোবার কি নিখুঁত দৃশ্য তৈরি করে মনে মনে। যতদিন যায় সে দৃশ্য আরো আরো নিখুঁত হয়। আমি সত্য মিথ্যা আলাদা করতে পারি না আর। মনে হয় যেন এই যা দেখছি, এই সত্য। 

    জাহাজের অবস্থা আরো টলোমলো। লোকটা বলল, তবে কি আমরা ডুবে যাচ্ছি? 

    নাবিক বলল, হ্যাঁ। কিন্তু দেখো তোমার ভয় কত কমে যাচ্ছে। তাই না?

    লোকটা আশ্চর্য হয়ে বলল, আমিও টের পাচ্ছিলাম… ভাবছিলাম খেয়াল বুঝি… কিন্তু এতো আপনিও বুঝছেন… মানে সত্যি সত্যিই আমার ভয় লাগছে না… কি আশ্চর্য… কিন্তু এই তো আসন্ন মৃত্যু… এই তো দেখছি আমি…

    নাবিক কিছু বলতে যাচ্ছিল। লোকটা বিদ্যুৎ গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দয়া করে কিছু বলবেন না… আমার হাতে আর সময় নেই… এখনই নীচে যেতে হবে…দেখি কটা মানুষকে বাঁচানো যায়… অনেক শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আছেন যে!

    লোকটা দরজা ঠেলে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে চীৎকার করে বলে উঠল, তোমরা কেউ হুড়োহুড়ি কোরো না, আতঙ্কিত হয়ো না… আমি আসছি… আমি আসছি…

    জাহাজের পাটাতনে সব মানুষ তখন। আকাশে ঘূর্ণীর মত কালো মেঘ জাহাজটাকে পাকে পাকে ঘিরে ধরছে। যেন মাকড়সা শিকারকে জড়াচ্ছে জালে। জাহাজটা নিস্তেজ হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। লোকটা ঝাঁপিয়ে পড়েছে জনসমুদ্রে। এক এক করে সবাইকে সুরক্ষা কবচ পরিয়ে তাদের নামতে বলছে জলে। 

    হঠাৎ কেউ একজন বলল, ওই দেখো, ওই দেখো আলো… ঝড় সরে যাচ্ছে, আমরা হয় তো বেঁচে যেতেও পারি…

    লোকটা একবার মেঘের দিকে তাকালো… আরেকবার আলোর দিকে…

    তারপর হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠল, যতক্ষণ মেঘ, ততক্ষণ নিশ্চিন্ত হয়ো না বন্ধুরা… অলসতা দিয়ে ঢোকে ভয়, বন্ধুর ছদ্মবেশে… অসতর্কতা দিয়ে ঢোকে বিপদ, নিরীহের ছদ্মবেশে… আমরা চেষ্টাটা করেই যাই… নইলে ভয় এসে চেপে ধরবে… আমরা ডোবার আগেই ডুবে যাব…