Skip to main content
 
 
      পেনের খাপের উপর দুটো হীরে বসানো ছিল। একদিন স্কুলে গিয়ে পেন বার করে দেখি পিঁপড়ের গর্তের মত দুটো গর্ত, হীরে দুটো কই? চকচকে হীরে দুটো সূর্যের আলোতে ধরলে কয়েকটা তীরের মত আলোর রেখা ব্ল্যাকবোর্ডের উপর, দেওয়ালের উপর, সামনের বেঞ্চে বসা বন্ধুর সাদা জামার উপর পড়ত। 
      প্রাইমারি স্কুল। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। প্রচণ্ড মন খারাপ আমার। এদিকে বাড়িতে গেলে তো বকবেই। মারতেও পারে। বাড়ি থেকে বারও করে দিতে পারে। দেবে না? হীরে বলে কথা। রাজাদের কাছে থাকত। ডাকাত ডাকাতি করতে, চোর চুরি করতে আসত কেন? সে তো শুধু হীরের জন্যেই নাকি? আর সেই হীরে দুটো কোথায় পড়ে গেল? ক্লাস শেষ হলে ব্যাগ ঝাড়লাম, নেই। পকেট হাতড়ালাম, নেই। কাউকে বলতেও পারছি না, যদি হেডস্যারকে জানিয়ে দেয়। পুলিশও তো আসতে পারে। স্কুল থেকে হেঁটে আমাদের বাড়ি যেতে দশ মিনিট তো লাগেই। আমি দৌড়ে যাবই বা কি করে? কে আসবে বাঁচাতে আমায়? সরস্বতী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সালকিয়া, হাওড়া।
      এবার?
      স্কুল শেষ হল। ঘন্টাগুলো বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস শব্দ তুলে মিলিয়ে গেল। সবার শেষে ক্লাস থেকে বেরোলাম। স্কুলের সামনের আচারের দোকান, গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় জহরকাকুর দোকান, সেই দোকানের কাঁচের পিছনে সার দেওয়া খেলনার সারি, মিষ্টির দোকান, একজন অ্যালোপ্যাথি ডাক্তারের চেম্বার, তার বাইরে সার দিয়ে বেঞ্চে বসে থাকা ইঞ্জেকশানের ভয়ে শুকনো-মুখ মানুষের দল - এ সবই সরে সরে যাচ্ছে, কিন্তু অন্যদিনের মত ভালো লাগছে না দেখতে। হীরে দুটো রাস্তায় পড়েনি তো? বড়মামা দিয়েছিল পেনটা। রাস্তায় নেই। কত অবান্তর কাগজ, ময়লা, ফেলা টায়ার, ফাটা মগ, ছেঁড়া বাজারের থলে, কত কিছু। কিন্তু হীরে দুটো কই?
      বাড়ির বাইরের দরজায় পা রাখতেই শুনলাম বাড়ির ভিতর হইচই। বাইরে অনেকগুলো জুতো রাখা। দরজাতেই মায়ের সাথে দেখা হল। বাড়িতে ঠাকুমার ভাই আর তার বাড়ির সব লোক এসেছে যাদবপুর থেকে। মনটা প্রচণ্ড খুশী হয়ে উঠল এক মুহূর্তেই, তার মানে মনা পিসী সেই চকোলেটটা নিয়ে এসেছে, শঙ্কুর মত দেখতে। কিন্তু পরক্ষণেই দমে গেলাম। কি হবে? সবাই তো হীরে হারানো পেনটা দেখে আমায় বকাবকি শুরু করবে, মারবে, বাড়ি থেকে তাড়াবে। এখান থেকে হাওড়া স্টেশান অটো যায় যদিও, কিন্তু টাকা?
 
      মা বললেন, কি হয়েছে রে? 
      ব্যস, আর যায় কোথায়... ভ্যাঁ... হীরে বসানো পেন......
      সামনে ক্যালেণ্ডারটা হাওয়ায় দুলছে, তাতে খাঁড়া হাতে কালী, মাথার উপর ঘোরা পাখাটার আওয়াজ, মায়ের বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকা...
হঠাৎ কি হল। মা হো হো হেসে খাটে বসে পড়লেন... তারপর ঠাকুমা... তারপর ঠাকুমার ভাই… জেঠিমা... মনা পিসী (হাতে শঙ্কু চকোলেট)… সবাই হাসছে… কেউ গাল টিপছে… কেউ চাঁটি মারছে...
      কাঁচ!!! ওদুটো কাঁচ... মানে... কেন?... না না… আমায় যে মামা বলেছিল... মা বলেছিল… ও দুটো হীরে.... আমার লজ্জায় কান লাল… ইয়ে পাচ্ছে… কালী দুলছে... পাখাটা ঘুরছে... কে একজন চুমু খাচ্ছে... ঠাকুমা জামা প্যান্ট ছেড়ে এসে খেতে বসতে বলছে.... আমি তীব্র প্রতিবাদ করতে চাইছি... পারছি না... আমার হাতে শঙ্কু চকোলেট... আমি দৌড়ে ছাদে গেলাম... একাই গেলাম... পকেটে পেন.... কিন্তু ওতে আলো ঠিকরে পড়ত যে...
 
      ছাদে এলাম। মাথার উপর ঢাকনা আকাশ। সামনে ইয়াব্বড় অশ্বত্থগাছ। পকেট থেকে পেনটা বার করলাম। দুটো গর্ত। ছোট্টো ছোট্টো...
      ভাত খাব না। চকোলেট খাব। কিছুতেই ভাত খাব না না না.... প্রতিবাদ... অবশ্য শান্তিও... হাওড়া স্টেশান যেতে হবে না, কারণ বাড়ি থেকে তো তাড়াচ্ছে না আর....
 
(যেহেতু আজ 1st April)