সাধুতা ব্যক্তির বা সমাজের কেন্দ্র। একজন অন্ধ মানুষকে “কানা” বলা সত্যপরায়ণতা অবশ্যই, কিন্তু সাধুতা না। তাই আমাদের শাস্ত্র বলছে, সত্য বলো, কিন্তু কাউকে আঘাত করে এমন সত্য বোলো না। কখনও কখনও কারও ভালোর জন্যেই নিষ্ঠুর হতে হয়। কিন্তু সে পরিমাণ কারও 'ভালো' চাওয়ার মানুষ কতজন আমরা? তার 'ভালো' করার অছিলায় তাকে আঘাত করে আমার উত্তপ্ত অহংকে আরাম দেওয়াই আমার প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য বহুলাংশে। সাধুতা কী? ঘাত-প্রতিঘাত, ছলনা, কপটতা, বিশ্বাসঘাতকতা, নিষ্ঠুরতা ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ জগতে সাধুতার মূল্য কতটুকু?
আচ্ছা, সব মানুষের কী অন্যায়-অপরাধ ভীষণ ঠান্ডা মাথায় ঘটিয়ে, বিবেকে লাগে? ঘুম ছুটে যায়? নিজেকে ছোটো, হীন মনে হয়? অনুশোচনায় ভোগে?
মানুষের ইতিহাস তা বলে না। কোনো মানুষ আবেগতাড়িত হয়ে, নেশার বশবর্তী হয়ে, ঝোঁকের বশে কোনো অপরাধ ঘটালো। অনুশোচনা হল। সে কাজ থেকে বিরত থাকল। শুধরে গেল। এমনও হয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তো তা হয় না! তবে এত সুপরিকল্পিত অপরাধ সারা বিশ্বজুড়ে এই মাত্রায় হত না।
এর মধ্যে সাধুতার মশাল কে জাগিয়ে রেখেছে? আমাদের অনেকের মনে আছে হয়তো সেই অসামান্য মহাকাব্যিক সিরিজটার কথা — 'গেম অব থ্রোনস'। সেখানে টিরিয়ান ল্যানিস্টার একদম শেষের দিকে এসে বলছে, মানুষকে একত্রিত রাখে, সমাজকে একত্রিত রাখে কে? রাজা? সুশাসক? না। মানুষকে বেঁধে রাখে — গল্প।
মানুষের সভ্যতায় এই সাধুতা আর অসাধুতার গল্পের শুরু হয় 'মিথোলজি' দিয়ে। মানুষ তার ভাবনা, তার আদর্শ, বাস্তবতা — সবকিছুকে মিশিয়ে মিথোলজি তৈরি করেছে। আজও করে চলেছে। মানুষ পুরোনো গল্প সরিয়ে নতুন গল্প বুনেছে। সেখানেও তার আদর্শ, সুখ-দুঃখ, হতাশা, আশা-ভরসা, বিশ্বাস, স্বপ্ন — সব এসে একে একে জড়ো হয়েছে।
সমাজ সাধুতার উপর বিশ্বাস ছাড়া এক মুহূর্তও টিকে থাকতে পারে না। ধর্ম, বিজ্ঞান, রাজনীতি, মতামত ইত্যাদি যাই থাকুক না কেন, সমাজের প্রধান যজ্ঞাগ্নি হল সাধুতার যজ্ঞাগ্নি। মঙ্গলের যজ্ঞাগ্নি। সেখানে আহুতি না দিতে চাইলেই তৈরি হবে অসাধুতা।
মিথোলজি বা পুরাণের গল্প বস্তুগত সত্যের গল্প না। ভাবজগতের সত্য-মিথ্যার গল্প। যেখানে মানুষ সাধুতাকে সত্য বলে। অনুকম্পা, করুণা, ভালোবাসাকে সত্য বলে। তার বস্তুজগত আছে, কিন্তু সেই বস্তুজগতের বাইরেই তার সবটুকু। তার আনন্দ, সার্থকতা সবটুকুই এই জগতের। সেখানে কোনো কিছুই পরিমাপযোগ্য নয়। একটা বাগানের আকার-আয়তন পরিমাপযোগ্য, কিন্তু সে বাগানে প্রবেশ করে আমার যে আনন্দ, সে অপরিমেয়।
এই অপরিমেয়র আরেক দিক মানুষের চেতনার অতীন্দ্রিয় অনুভব। যাকে 'মিস্টিসিজম' বলা হয়। মিথোলজি ছাড়া মিস্টিসিজমের অস্তিত্ব হয় না, যদি মিথোলজিকে অনেক বড় রূপক হিসাবে ধরি। আফ্রিকার মাটিতে বসে কোনো মানুষের বৃন্দাবনলীলার অতীন্দ্রিয় অনুভব সম্ভব না, যা সুরদাস, হরিদাস প্রমুখ কবির চেতনায় তাদের কল্পনার মাধুর্য মিশে জন্মেছিল। মিথোলজি যেমন অতীন্দ্রিয় অনুভবকে জাগিয়ে তোলে, তেমনই অতীন্দ্রিয় অনুভব আবার নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে মিথোলজিকেও অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়।
তবু, মানুষের মধ্যে যে পরিমেয় আর অপরিমেয়র দ্বন্দ্ব সে কালাতীত। যা পরিমেয়, তার লাভের অঙ্ক, হিসাব গর্বের সঙ্গে দেখানো যায়। কিন্তু যা অপরিমেয় তার লাভের কোনো জয়ধ্বজা নেই। তাই সংসারে মার্কশিট নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সুবিধা থেকে সে বঞ্চিত। যে বোঝে, সে বোঝে। যে রবিশঙ্করের সেতারের মাধুর্য বোঝে না, সে রবিশঙ্করের বাহ্যিক চাকচিক্য, আড়ম্বর ইত্যাদি শ্রদ্ধালু হয়ে বসে শুনবে। ভান করবে তার ভালো লাগছে। কিন্তু যে সত্যিই রসজ্ঞ সে খাঁটি রসের অন্বেষণ করে বেড়ায়। গ্ল্যামারের খোঁজ তার নেই।
কিন্তু হিংসা, ক্রোধ, ঈর্ষা ইত্যাদিও তো অপরিমেয়। তবে? তাদেরকে কেন বলা হল রিপু? কেন বলা হল ভাইস, পাপ? কারণ সে সংগতিকে বিনষ্ট করে। সাম্যকে বিড়ম্বনায় ফেলে। সংহতিকে ধ্বংসের মুখে দাঁড় করায়।
মিথোলজি যেমন সাধুতা-অসাধুতার দ্বন্দ্বে গড়ে ওঠে, তেমনই নানারকম হাইপোথিসিসও গড়ে ওঠে। যার ভাষ্য তার থিওলজিতে। সব ধর্মতত্ত্বই জগতে সব রহস্যের আনুমানিক ভাষ্য। একদিন বিজ্ঞানের উন্মেষ হয়নি, কিন্তু মানুষের সব কিছুর একটা ব্যাখ্যা তো চাই। তার কাছে অনুমান আর কল্পনা ছাড়া কী আছে? তার উপর নির্ভর করে সে গোটা জগতকে এক তত্ত্বে দাঁড় করালো। যাকে সে বলল, নির্ভুল, পবিত্র তত্ত্ব। তাকে প্রশ্ন করা যাবে না। কারণ যার ভিত্তি অনুমানের উপর তাকে প্রশ্নের সামনে আনার থেকে বাঁচাতে পারে একমাত্র একটাই বিধান — পবিত্রতার বিধান। কী পবিত্র? যা অবিনশ্বর, ত্রুটিবিচ্যুতিহীন, প্রশ্নাতীত।
মানুষের বস্তুজ্ঞান বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে দিকটা প্রথম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হল সে তার পবিত্রতার দাবি। কিন্তু তাত্ত্বিক পবিত্রতার বাইরে তার মধ্যে আরেকটা পবিত্রতার বোধও জন্মে গেছে ততদিনে, তার নৈতিক জীবনের পবিত্রতা। শর্ত একই, সে পবিত্রতাও অবিনশ্বরতা, নির্ভুলতা ও প্রশ্নাতীত আনুগত্যের দাবি রাখে। যে সমাজ যত পুরোনো তার বিধানের অচলায়তনও ততটাই কঠিন শিকড়ে আবদ্ধ।
মানুষ যত জানতে শুরু করল বাইরের প্রকৃতি আর নিজের প্রকৃতিকে, তত তার মধ্যে থেকে একটা একটা করে পাঁচিল ভাঙতে শুরু করল। কিন্তু সেখানেও এলো আরেক বিপত্তি। বেশ কিছু মানুষ ততদিনে এই পবিত্রতার বিধানে তাদের ক্ষমতার প্রাসাদ তুলে ফেলেছে। মিথোলজি, ধর্মতত্ত্ব ততদিনে এক শ্রেণীর মানুষের অস্ত্র হয়ে গেছে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার। নানা কৌশলে মানুষের মাথায় তার ভয়কে আর লোভকে কাজে লাগিয়ে, তার অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে বানিয়ে ফেলেছে প্রতিষ্ঠানের পর প্রতিষ্ঠান। সেখানে যত নিঃশর্ত আনুগত্য, তত শান্তি। অন্তর্লোকের শান্তি প্রতিস্থাপিত হল বিশেষ ক্ষমতাধর পুরুষের অনুগ্রহের তৃপ্তি দিয়ে। লোভ প্রবেশ করল তার সংগতির ভিত্তিতে দাঁড়ানো সাধুতার দেউলে। অন্তরের স্বাভাবিক আলো নিভল। বাইরের কৃত্রিম আলোর আড়ম্বরের ঔজ্জ্বল্য বাড়ল।
কিন্তু সাধুতার বীজ নষ্ট হল না এত কিছুতেও। সমাজের প্রাণভোমরা তো সে। সাধুতার ভিত্তিভূমি যে আদিম নিয়ম তাকে কিছুতেই নাশ করা গেল না। কী সে? সে হল — অন্যের সঙ্গে তুমি তেমনই ব্যবহার করো যেমন ব্যবহার তুমি অন্যের কাছ থেকে আশা করো।
এ কথা বুঝতে কোনো হাইপোথিসিস, ধর্মতত্ত্বের অতিজাগতিক ব্যাখ্যা লাগে না। লাগে স্বচ্ছ, উন্নত হৃদয়। পৌরাণিক নানা উপাখ্যানে সে এই সত্যকেই সাধুতার মধ্যে খুঁজে পায়। বারবার বলে, আমার মধ্যে এমন কিছু একটা আছে যা অপরিমেয়। তাকে না পেলে আমি ব্যর্থ। বাইরে অনেক কিছু জমিয়ে সফল হলেও আমি সার্থক নই। কী সে? তার কোনো নাম নেই। সে জীবনের মানদণ্ড। জীবনের আনন্দময় রহস্য। তাকে না স্বীকার করলে বিজ্ঞান তাকে বলছে, তুমি অমানুষ। তুমি সাইকোপ্যাথ। তুমি সোশিওপ্যাথ। তুমি বিকারগ্রস্ত। কারণ তুমি নিজেকে বিপন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করছ যা গোটা সমাজ অনুসরণ করলে সমাজ এক মুহূর্ত টিকবে না।
সমাজ মানুষের চরিত্রের গবেষণাগার। তাকে নানাদিক থেকে নানাভাবে জানার চেষ্টাই সাধন। যত নিজেকে জানবে মানুষ, তত সে জানবে তার মুক্তির রাস্তা কোন পথে। পালিয়ে গিয়ে? নিজেকে সম্মোহিত করে? নাকি বারবার ব্যর্থ হলেও জীবনের ছন্দটাকে শিখে নিয়ে? এর উত্তর খোঁজার দায় সব মানুষের, সব সমাজের।