Skip to main content

“আমার জীবন থেকে সব ভালোবাসা সরিয়ে নাও।”

    জৈন সাধক ভাস্কর এই কথাটা তিনবার উচ্চারণ করল। অনেক উঁচু পাহাড়ের মাথায় এই মন্দির। চারদিক জঙ্গল। দিনের উজ্জ্বল আলোয় স্নিগ্ধ শান্ত দশদিক।

    ভাস্কর দূরে তাকিয়ে। নীল আকাশে ভেসে চলা কয়েক মুঠো মেঘ। নীচে সবুজের সারি। ভাস্কর একটা পাথরের উপর বসে। জীবনকে এক রঙে ব্যাখ্যা করা যায় না। জীবনের কোনো একটা সিদ্ধান্তও হয় না। সত্যে পৌঁছানোর পথ একটাই - অহিংসা। অহিংসা জীবনকে নানা রঙে দেখার রাস্তা খুলে দেয়। হিংসা চিত্তকে সঙ্কীর্ণ করে। একমুখী করে। অশান্ত করে। 

    ভাস্কর সংসারকে কাছ থেকে দেখেছে, কিন্তু সংসারকে কাছে আসতে দেয়নি। যদি বলো, কি সত্য তবে? ভাস্কর বলে, জানি না। এই সব চাইতে বড় সত্য। ভালোবাসাহীন হও। তবে মনের মধ্যে অহিংসাকে অনুভব করবে। তবে জানবে সত্যের সহস্র শাখা। সব শাখা কোথায় গিয়ে মেশে সে জ্ঞানের অতীত। 

    একটা ছাগল ভাস্করের পাশে বসে। ভাস্কর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ভালোবাসাহীন হ। নইলে শান্তি পাবি না। 

    মন্দির ফাঁকা। অল্প অল্প উত্তরের হাওয়া বইছে। কতরকমের ফুলের গন্ধ। আজ কোন পার্টি যেন বনধ্‌ ডেকেছে। কেউ আসবে না এদিকে। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে ভাস্কর পিছন ফিরে তাকালো। কেউ এসেছে। 

    ভাস্কর জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি বসবে? ঘরের ভেতর থেকে শব্দ এলো, হ্যাঁ, এইবেলাটা শুধু। 

    ভাস্করের কাছে মানুষ শুধু জীবন থাকতেই আসে না। ভাস্কর জীবনের পরের রাস্তাতেও দেখা করে। সাধারণত ওরা রাতের বেলায় নির্জনে আসে। আজ এখন এসেছে, দুটো কারণ হতে পারে। এক ভীষণ তাড়া, দুই, আজ এদিক নির্জন বলে। 

    ভাস্কর উঠে গিয়ে বন্ধ ঘরের দরজার সামনে বসল। বলল, বলো। 

    আমি শৌনক। কাল বিকেলে মারা গেছি। একা। আমার মৃত্যুর সময় পশ্চিমের রোদ এসে পড়েছিল আমার মুখে। সেই রোদে তোমার মুখটা মনে পড়ল। তাই এলাম। তুমি আমাদের শহরে যেতে ভিক্ষার জন্য। একবার এক স্টেশানে তোমার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তুমি বলেছিলেন তুমি এখানেই থাকো। সেদিন তোমার মুখে এসে পড়েছিল পশ্চিমের রোদ। তুমি বলেছিলে, তুমি এখানে থাকো চারমাস করে বছরে। 

    ভাস্কর চোখ বন্ধ করে বসে। পদ্মাসনে। শৌনকের ফেলে আসা জীবনের রাস্তায় হাঁটছে। বড় অন্ধকার রাস্তা। অনেক অন্যায়। অনেক বর্বরতা। অনেক স্বার্থপরতা। 

    ভাস্কর চোখ খুলে বলল, বলো, কি জানতে চাও। 

    শৌনক বলল, আমি জানি আমি কি। আমি ভালো নই। আমার মাথায় অজস্র অন্ধগলি। আমি নিজেই নিজের মধ্যে হারিয়ে গেছি। আমার এ সংসারে কেউ ছিল না। কেউ নেই আজও। আমি কেন এরকম হলাম তা জানতে চাই না। সে ব্যাখ্যা অনর্থক। আমি কোনোদিন কারোর ব্যাখ্যা শুনিনি। আমি আমাকে জানতে চাই না। আমি তোমাকে জানতে চাই। তোমার লোভ নেই? তোমার হিংসা নেই? তোমার মধ্যে পৈশাচিক সুখের উল্লাস নেই? তুমি মিথ্যাকে অবলম্বন করে সুখ চাও না?

    ভাস্কর চোখ মেলে তাকালো। এই বন্ধ ঘরটার মধ্যে ঢুকতে নেই। জীবনের গন্ধ নিয়ে যেতে নেই। তাহলে ওরা আসে না। এই ঘরে কত কত মানুষের কথা শুনেছে ভাস্কর। মানুষের আত্মার কোনো বয়েস হয় না। সে শিশু, যুবক, বৃদ্ধ হয় না। আত্মার কোনো লিঙ্গ, জাতপাত হয় না। সে শুধু অস্তিত্ব। তার স্মৃতি থাকে। তার সংস্কার থাকে। সে সব মুছে গেলেই নির্বাণ। বুদ্ধের মত। সব পথই এই একটাই সাধনের কথা বলে, ভালোবাসাহীন হও। নিষ্ঠুরতাহীন হও। 

    ভাস্কর বলল, আমার মন নেই। কারণ আমার ভালোবাসা নেই, চিন্তা নেই। ভালোবাসা জাল। মোহের বীজ জন্মায় ভালোবাসা থেকে। আমি নিজেকে মুক্ত রেখেছি। আমি নিষ্ঠুরতা থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছি। আমি জাল মুক্ত। আমি মোহ মুক্ত। আমি সুখ মুক্ত। আমি দুঃখ মুক্ত। 

    উফ, তুমি কেন নিজেকে ঠকাচ্ছ? তোমার কি মহৎ হওয়ার লোভ নেই? তোমার অনুপ্রেরণা কি তবে? কেন নিজেকে এমন শুষ্ক রাস্তায় নিয়ে চলেছ? আমি মদের সরোবরে স্নান করেছি। নারীকে উলঙ্গ করেছি। শয্যায় নিয়েছি। উন্মাদের মত ভোগ করেছি শরীরের সমস্ত রোমকূপ দিয়ে। আমি সুখের জন্য ন্যায়-অন্যায়ের বিচারে যাইনি। আমি আমার অহংকারকে মিথ্যার আশ্বাসে বাড়তে দিয়েছি যতটা বাড়তে চায় সে। মানুষ বোকা। পদে পদে লোভের ফাঁদে পা দেয়। আমি ফাঁদ পেতেছি। আমার জন্যেও ফাঁদ পেতেছে লোভ। আমি শিকার করেছি। আমি নিজেও শিকার হয়েছি। এই তো আমার জীবন। ক্ষোভ নেই বলব না, কিন্তু তোমার জীবনের জন্য আমার করুণা হয়। তুমি কে?

    ভাস্কর চুপ করে বসে। ছাগলটা মন্দিরের পাশের অল্প নীচু জমিটায় নেমে ঘাস খাচ্ছে। গায়ের চকচকে লোমে রোদ এসে পড়েছে। লোভ আর ক্ষোভ। সংসারে এই দুটো শব্দকে দেখেছে ভাস্কর। নিজের মধ্যে দেখেছে বীজ। বাইরে বৃক্ষ। 

    ভাস্কর বলল, আমি ভালোবাসাহীন। আমি শান্ত। আমি মুগ্ধ নই। আমি জাগ্রত। আমি ভ্রান্ত নই। আমি জাগ্রত। আমি অনবগত নই। আমি জাগ্রত। আমি নিষ্ঠুরতাহীন। আমি জাগ্রত। আমার সম্পদ অহিংসা। সংসারে কোনো সত্যের উপর আমার হিংসা নেই। আমি হিংসাকে পার করেছি। আমি ক্ষুদ্র স্বার্থ, কোলাহল, ভয়, শত্রুতার আবর্তকে পার করেছি আমার অহিংসা ভেলায়। আমি ভালোবাসাকে পার করেছি। আমি নিষ্ঠুরতাকে পার করেছি। আমি শূন্যের ভয়কে পার করেছি। আমি পূর্ণের লোভকে পার করেছি। আমি শান্ত। আমি গতিমান। আমি নির্বাণের রাস্তায়। বুদ্ধ সত্য। তীর্থঙ্করেরা সত্য। বেদ সত্য। বাইবেল সত্য। কোরাণ সত্য। কারণ সত্যের সত্য যে সে অনন্ত সত্য। সে ভালোবাসাহীন। সে নিষ্ঠুরতাহীন। সে সদা সত্য। সে অবিনাশী। সে পরিবর্তনহীন। 

    শৌনক বলল, তুমি অন্য মানুষ। আমি অন্ধকারে হারিয়ে। তুমি আলোর মধ্যে হারিয়ে। তুমি অন্য মানুষ। আমি অন্য মানুষ। আমরা আলাদা। সংসারে সবাই আলাদা। সবাই পৃথক। আমি খাদ্য খাদক সম্পর্কে বিশ্বাসী। আমি জানি আমি একে অন্যের মৃত শরীরের উপর বাঁচে। তুমিও প্রাণকে হত্যা করো জীবন ধারণের জন্য। করো না?

    ভাস্কর বলল, আমি জানি আমি চেতনা। শরীর বিকারশীল। চেতনা নয়। ধর্মের পথ চেতনার পথ। অহিংসা চেতনার ধর্ম। শরীরের বিজ্ঞান হয়। ধর্ম হয় না। বিজ্ঞান মানে একটা ধারা। তার ব্যতিক্রম চর্চা ধর্মের কাজ নয়। জৈবিক নিয়মে তার পথে। চেতনাকে নিষ্কলুষ করে তোলা আমার সাধনা। চেতনাকে হিংসার পারে নিয়ে যাওয়া সনাতন রাস্তা। হিংসার দ্বারা হিংসাকে রোধ করা যায় না। এই সত্য। সনাতন সত্য। তুমি কি শান্ত?

    শৌনক বলল, না। 

    ভাস্কর বলল, সহস্র সাধন পথ যদি তোমায় অশান্ত করে তোলে তবে সে সাধন নয়। তেমনই যদি কোনো এক জ্ঞান তোমার প্রজ্ঞাকে শান্ত করে তোলে তবে সে-ই সাধন। মনের চঞ্চলতাকে স্থির প্রজ্ঞার মাধ্যমে আমি দেখেছি। ক্রমে মনের চঞ্চলতা স্থির হয়ে এসেছে। মন লীন হয়ে গেছে প্রজ্ঞার ছায়ায়। 

    শৌনক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, আমি নষ্ট করেছি নিজেকে। ফুরিয়ে ফেলেছি নিজেকে। 

    ভাস্কর বলল, বর্ষায় শুষ্ক, রুক্ষ প্রকৃতি আবার সবুজ হয়ে ওঠে। নতুন বীজ অঙ্কুরিত হয়। নদী আবার খরস্রোতা হয়ে ওঠে। তুমি বর্ষায় আবার জেগে ওঠো। সংযত চিত্ত পুরুষের সঙ্গই হবে তোমার বর্ষা ঋতু। জাগ্রত চিত্ত পুরুষের সঙ্গই হবে তোমার বর্ষাঋতু। তুমি নিজেকে প্রস্তুত করো। নিজেকে ভালোবাসাহীন করো। নিজেকে নিষ্ঠুরতাহীন করো। আমি তোমায় বলছি, তুমিও নিজেকে অহিংসার ভেলায় তুলে নাও। অহিংসা আদিকালে সত্য ছিল। বর্তমানে সত্য আছে। ভবিষ্যতেও সত্য থাকবে। তুমি নিজেকে দীক্ষিত করো। শান্ত হও। শান্ত হও। শান্ত হও। জ্ঞানের থেকে পবিত্র সংসারে কিছু নেই। বেদ বলে। তুমি জ্ঞানে শান্ত হও। কৃতকৃত্য হও। ধন্য হও। 

    বাতাস প্রবল হল। ভাস্কর উঠে দাঁড়ালো। বন্ধঘরের ভেতর থেকে কোনো শব্দ এলো না আর। এখন আসবে না। ভাস্কর অপেক্ষা করে না। ভাস্কর এগিয়ে যায়। সামনে যা আসে তাকে আলিঙ্গন করে। জড়িয়ে রাখে না। ছাগলটা আবার ভাস্করের পাশে এসে দাঁড়ালো। ভাস্কর তার গায়ে হাত রেখে বসল। ছাগলটার কাঁপা কাঁপা শরীরটার আন্দোলন ভাস্করের হাতের স্নায়ুগুলোকে আঘাত করল। ভয়। ক্ষোভ। লোভ। মুক্ত হোক সবাই। অহিংস হোক চিত্ত। অহিংস হোক প্রজ্ঞা।