সৌরভ ভট্টাচার্য
25 February 2020
১
সমুদ্রের জলটা এক এক সময় মনে হয় অনেক বেশি। তাদের পুরো গ্রামটাকে ডুবিয়েও যেন কিচ্ছু উপচাবে না, আজ যেমন মনে হচ্ছে বেলিয়ার, সে যদি ডুবে যায়? যদি সে দাদার কাছে না যায়? যদি সে এই পঞ্চানন, বিশাখা, নরহরি --- এদের সবার সাথেই থেকে যায়?
বেলিয়া একবার মাথাটা ঘুরিয়ে বাড়িটার দিকে তাকালো। পারাদ্বীপের ছোট্টো একটা গ্রাম, ডুবুপুরী, এই গ্রামেই বেলিয়া প্রধানদের পাঁচ পুরুষের বাস। আগে তাদের বাড়ি ছিল ঢেঙ্কানলে। সেখানে কেউ নেই আর। এসব কথা বেলিয়া তার দাদাদের কাছে শুনেছে অনেকবার। বেলিয়া উচ্চমাধ্যমিক পাশ করল, গতকাল রেজাল্ট বেরিয়েছে, ফার্স্ট ডিভিশন হয়নি, হওয়ার কথাও ছিল না।
কেন ছিল না? তার দুটো কারণ বেলিয়া মনে মনে ভেবে দেখেছে। এক, তার মাথা নরহরির মত অত পরিষ্কার নয়; দুই, তাকে বাড়ির যত কাজ করতে হয় তার বন্ধুদের কাউকেই অত কাজ করতে হয় না। বেলিয়ার তিন দাদা। সে সবার ছোটো। বড়দাদা গোপেশ্বর সালকিয়ায় থাকে, সেখানে তার ব্যবসা। আর দুই দাদা জলেশ্বর আর ঢলেশ্বর। জলেশ্বর পঞ্চায়েতে কাজ করে, ঢলেশ্বর কাজ করে কটকের একটা প্রাইভেট ফার্মে। তিন দাদারই ভরা সংসার। বেলিয়া হতে গিয়েই তার মা মারা যায়। লোকে বলে অত বয়সে, অত দেরি করে আরেকটা সন্তান নেওয়াই নাকি উচিৎ হয়নি, তাই মারা গেল। তার মা মারা যাওয়ার এক বছরের মধ্যেই তার বাবা মারা যায়, এসবই অবশ্য দাদাদের মুখে শোনা কথা। ঢলেশ্বরের থেকে তার বয়সের পার্থক্য ছিল চোদ্দো বছরের। বাকি দাদারা সব পিঠোপিঠি। জলেশ্বরের দুটো ছেলে, পরে তাদের পরিচয় সময় মত দেওয়া যাবে, আর ঢলেশ্বরের এক ছেলে, এক মেয়ে, যাদের সাথে আমাদের পরিচয় সময়মত হবেখন। মোটকথা পারাদ্বীপের এই বাড়িতে বেলিয়া ওরফে বালেশ্বর সহ সবাই থাকে, জলেশ্বর শনি-রবি আসে। সারাদিন সবার ফাইফরমাশ খাটার কাজ পড়ে বেলিয়ার ওপর। ঘুম থেকে উঠে রান্নার জন্য উনুনে আঁচ দেওয়া, গরুর জাব মাখা, দুধ দোয়ানো, ভাইপো-ভাইঝিদের সকালের স্কুল, বেলার স্কুলে নিয়ে যাওয়া সাইকেলে করে, তাছাড়া বউদিদের নানা ফরমায়েশ তো আছেই। এটা ওটা দিতে আনতে মাঝে মাঝেই তাকে বউদিদের বাপের বাড়িও দৌড়াতে হয় মাসে আর না হোক দু থেকে তিনবার তো হবেই।
বেলিয়া ভেবেছিল তার জীবনটা এরকমই কেটে যাবে, এইখানেই এদের ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে একদিন এই সমুদ্রের ধারে মরে পড়ে থাকবে। এটা ভাবার অবশ্য কারণ ছিল। বেলিয়ার শরীরটার দিকে তাকালে চারটে হাড়ের ওপর মাংস জড়ানো এক অদ্ভুত জীব বলে মনে হত। দেখার মধ্যে ছিল উজ্জ্বল দু'জোড়া চোখ। সে চোখে যেন সবসময় স্বপ্নের ধোঁয়া, একটা ঘোর। বেলিয়া জোরে কথা বলত না। রেগে গেলে বুকটা এত জোরে ধড়াস ধড়াস করত যে মনে হত সমুদ্রের মানুষ প্রমাণ এক-একটা ঢেউ তার বুকের উপর এসে আছড়াচ্ছে। মা-বাবার স্মৃতি বলতে দুটো ছবি। বাবার ছবিটা কালো হয়ে গেছে। তার বাবা পিওনের কাজ করত। পোস্ট অফিসের চাতালে বসেই কেউ ছবিটা তুলে দিয়েছিল। তার বাবাকে অনেকটা তার বড়দা গোপেশ্বরের মত দেখতে, তার তাই বড়দাকে দেখলে মনে হয় যেন বাবার ঘাম আর গায়ের ময়লা জমেই তার দাদা হয়েছে। যেমন গণেশ জন্মেছিল না পার্বতী থেকে? ঠিক তেমন। কিন্তু তার দাদা আসে কই? সেই দু-তিন বছরে একবার। মায়ের ছবিটার কপালে সিঁদুর দিয়ে দিয়ে মুখটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। বেলিয়া বুঝতে পারে না ভালো। তবে তার নুয়াপাড়ার মাসি একবার বলেছিল তার মা নাকি খুব ফর্সা ছিল, অনেকটা জলেশ্বরের মত। তার মত রঙ কেউ পায়নি। বেলিয়া কালো, সে নাকি তার বাবার চাইতেও কালো।
বেলিয়া একবার মাথাটা ঘুরিয়ে বাড়িটার দিকে তাকালো। পারাদ্বীপের ছোট্টো একটা গ্রাম, ডুবুপুরী, এই গ্রামেই বেলিয়া প্রধানদের পাঁচ পুরুষের বাস। আগে তাদের বাড়ি ছিল ঢেঙ্কানলে। সেখানে কেউ নেই আর। এসব কথা বেলিয়া তার দাদাদের কাছে শুনেছে অনেকবার। বেলিয়া উচ্চমাধ্যমিক পাশ করল, গতকাল রেজাল্ট বেরিয়েছে, ফার্স্ট ডিভিশন হয়নি, হওয়ার কথাও ছিল না।
কেন ছিল না? তার দুটো কারণ বেলিয়া মনে মনে ভেবে দেখেছে। এক, তার মাথা নরহরির মত অত পরিষ্কার নয়; দুই, তাকে বাড়ির যত কাজ করতে হয় তার বন্ধুদের কাউকেই অত কাজ করতে হয় না। বেলিয়ার তিন দাদা। সে সবার ছোটো। বড়দাদা গোপেশ্বর সালকিয়ায় থাকে, সেখানে তার ব্যবসা। আর দুই দাদা জলেশ্বর আর ঢলেশ্বর। জলেশ্বর পঞ্চায়েতে কাজ করে, ঢলেশ্বর কাজ করে কটকের একটা প্রাইভেট ফার্মে। তিন দাদারই ভরা সংসার। বেলিয়া হতে গিয়েই তার মা মারা যায়। লোকে বলে অত বয়সে, অত দেরি করে আরেকটা সন্তান নেওয়াই নাকি উচিৎ হয়নি, তাই মারা গেল। তার মা মারা যাওয়ার এক বছরের মধ্যেই তার বাবা মারা যায়, এসবই অবশ্য দাদাদের মুখে শোনা কথা। ঢলেশ্বরের থেকে তার বয়সের পার্থক্য ছিল চোদ্দো বছরের। বাকি দাদারা সব পিঠোপিঠি। জলেশ্বরের দুটো ছেলে, পরে তাদের পরিচয় সময় মত দেওয়া যাবে, আর ঢলেশ্বরের এক ছেলে, এক মেয়ে, যাদের সাথে আমাদের পরিচয় সময়মত হবেখন। মোটকথা পারাদ্বীপের এই বাড়িতে বেলিয়া ওরফে বালেশ্বর সহ সবাই থাকে, জলেশ্বর শনি-রবি আসে। সারাদিন সবার ফাইফরমাশ খাটার কাজ পড়ে বেলিয়ার ওপর। ঘুম থেকে উঠে রান্নার জন্য উনুনে আঁচ দেওয়া, গরুর জাব মাখা, দুধ দোয়ানো, ভাইপো-ভাইঝিদের সকালের স্কুল, বেলার স্কুলে নিয়ে যাওয়া সাইকেলে করে, তাছাড়া বউদিদের নানা ফরমায়েশ তো আছেই। এটা ওটা দিতে আনতে মাঝে মাঝেই তাকে বউদিদের বাপের বাড়িও দৌড়াতে হয় মাসে আর না হোক দু থেকে তিনবার তো হবেই।
বেলিয়া ভেবেছিল তার জীবনটা এরকমই কেটে যাবে, এইখানেই এদের ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে একদিন এই সমুদ্রের ধারে মরে পড়ে থাকবে। এটা ভাবার অবশ্য কারণ ছিল। বেলিয়ার শরীরটার দিকে তাকালে চারটে হাড়ের ওপর মাংস জড়ানো এক অদ্ভুত জীব বলে মনে হত। দেখার মধ্যে ছিল উজ্জ্বল দু'জোড়া চোখ। সে চোখে যেন সবসময় স্বপ্নের ধোঁয়া, একটা ঘোর। বেলিয়া জোরে কথা বলত না। রেগে গেলে বুকটা এত জোরে ধড়াস ধড়াস করত যে মনে হত সমুদ্রের মানুষ প্রমাণ এক-একটা ঢেউ তার বুকের উপর এসে আছড়াচ্ছে। মা-বাবার স্মৃতি বলতে দুটো ছবি। বাবার ছবিটা কালো হয়ে গেছে। তার বাবা পিওনের কাজ করত। পোস্ট অফিসের চাতালে বসেই কেউ ছবিটা তুলে দিয়েছিল। তার বাবাকে অনেকটা তার বড়দা গোপেশ্বরের মত দেখতে, তার তাই বড়দাকে দেখলে মনে হয় যেন বাবার ঘাম আর গায়ের ময়লা জমেই তার দাদা হয়েছে। যেমন গণেশ জন্মেছিল না পার্বতী থেকে? ঠিক তেমন। কিন্তু তার দাদা আসে কই? সেই দু-তিন বছরে একবার। মায়ের ছবিটার কপালে সিঁদুর দিয়ে দিয়ে মুখটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। বেলিয়া বুঝতে পারে না ভালো। তবে তার নুয়াপাড়ার মাসি একবার বলেছিল তার মা নাকি খুব ফর্সা ছিল, অনেকটা জলেশ্বরের মত। তার মত রঙ কেউ পায়নি। বেলিয়া কালো, সে নাকি তার বাবার চাইতেও কালো।
বেলিয়া অনেক রাত অবধি সমুদ্রের ধারে বসে থাকে খাওয়া হয়ে গেলে। বড় বড় বালির ঢিবি বানায়, একটা তার বাবা, একটা মা। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কোনো কোনোদিন কান্না কান্না পায়। কোনো কোনোদিন রাগ হয়। খুব রাগ। তার মা কাদের কাছে রেখে গেল তাকে? কেউ ভালোবাসে না। কেউ না! মাঝে মাঝে বড়দা যখন ফোন করে পোস্ট অফিসে, বেশিরভাগই রবিবার করে, দুই দাদার সাথে সে-ও যায়, কিন্তু ক'দিন কথা বলতে পারে? দুই দাদার পরে তাদের বাচ্চারা, এটা সেটা কত অনাবশ্যক কথা বলে, কিন্তু তার তো কত কাজের কথা থাকে, সে কি সুযোগ পায়? পায় না তো। বেশিরভাগ দিনই কিছু কথার পর কোনো এক দাদা বলে, বেলিয়া, একে ঘরে রেখে আয়, কি দোকানে একটু এইটা কিনে তোর ছোটোবউদিকে দিয়ে আয়, এই কর, সেই কর। অথচ তার কত কাজের কথা থাকে, তার খাতা শেষ হয়ে যায়, কত ছোটো করে লেখে একটা মানুষ? সে তো চেষ্টা করে, তবু তার মেজোবউদি বলে সে যেন খাতায় একটা একটা করে কোলাব্যাঙ এঁকে রাখে। মোটেও না, একটা লাল পিঁপড়ের মত অক্ষরে সে লেখে, এমনকি মাষ্টারেরাও তো বকে, বলে, আমরা কি আতসকাঁচ নিয়ে তোর খাতা দেখব নাকি রে বালেশ্বর? তার লজ্জাও লাগে, রাগও হয়, কান্না পায়। তাকে বোঝে নরহরি, সে তাকে পাতা ছিঁড়ে দেয়, পেন্সিল ধার দেয়, পেন দেয়। কিন্তু সে-ও বা কত দেবে, তার বাবা পশুর ডাক্তার, এখানে তেমন পসার নেই, সে নিজেই বলে, সম্বলপুরের দিকে গেলে নাকি তাদের অনেক পসার হবে। হবেও বা, কিন্তু কেন হবে সে কথা আর জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে না বেলিয়ার। কি হবে জিজ্ঞাসা করে? গেলে যাবে, তার যা কপাল। এক সেই তো আছে যে তাকে বোঝে, তার জন্মদিনটা পর্যন্ত মনে রেখে দেয়।
অথচ তার বড়দা তার পড়ার খরচ পাঠায়, সে শুনেছে। সে টাকা কোথায় যায়? তার বড়বউদিকে দেখলে কেমন একটা ভয় ভয় করে। অন্য বউদিরাও তার বড়বউদিকে ভয় পায় সে জানে। বড়বউদির এক ছেলে, এক মেয়ে, অনেক ছোটো, ওরা অন্যরকম, বেলিয়ার সাথে হেসে কথা বলে, এটা ওটা অর্ডার করে না, অকারণে বিরক্ত করে না। কিন্তু বড়বউদির বড় বড় চোখদুটো দেখলেই সে দূরে সরে যায়। ওরকম করে তাকিয়ে থাকে কেন তার দিকে? মেজবউদি বলে যেন তাড়কা। তা খারাপ বলে না, তার বড়বউদির চেহারাটাও অনেক বড়, তার দাদার থেকে লম্বাও তো বেশ কিছুটা। তবু বড়বউদিকে দেখলে তার মনের মধ্যে কোথাও একটা শান্তি জন্মায়। আশ্রয় পায় যেন বেলিয়ার স্নেহক্ষুব্ধ মন। ওই বড় বড় চোখদুটোর আড়ালে শুধু ভয় নেই, যেন একটা রক্ষাকর্ত্রীও আছে বেলিয়া বোঝে, অনেকটা 'মা মা' মতন। যদিও 'মা' শব্দটার মানে সে যতটা জানে ততটা অনুভব করতে পারে না, 'মা' বললেই সিঁদুর লেপা ছবিটার কথা মনে পড়ে। কিন্তু শেষ যেবার এলো বড়বউদি, তার খাবার সময় ঠিক তার কাছাকাছি কোথাও থাকত। বেলিয়া দেখত তার ভাতের থালায় ভাতের পরিমাণ বেশি হত, মাছের মুড়োটা, যা কোনোদিন সে ভাইপো-ভাইঝিদের এড়িয়ে পেত না, তার পাত জুড়ে থাকত। গেলবারে প্রায় পনেরো দিন ছিল বড়দা। তার ভাত খাওয়ার অভ্যাস এতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল যে বড়বউদি চলে গেলে তার খিদে মিটতে চাইত না, আরেকটু ভাতের প্রত্যাশায় বসে থাকত, কিন্তু হাঁড়িতে ভাত থাকলেও সে চাইবে কাকে? কেউ থাকত না তার আশেপাশে। তারপর গাছের পেয়ারা কি এটা সেটা খেয়ে খিদে মেটাত। তারপর আবার অভ্যাস হয়ে গেল অল্প ভাতের, আধপেটা খাওয়ার।
কিন্তু কম ভাতের অভ্যাস যে না হয় হল, বড়বউদির ওই বড় বড় চোখদুটো তার মায়ের স্মৃতির পাশে বাসা করে নিল যেন। সে মনে মনে তার বড়বউদির সাথে কথা বলে, মনে মনেই তার কষ্ট জানায়। এমন করে করেই সে উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে ফেলল, গতকাল রেজাল্ট বেরিয়ে গেল। আগামীকাল তার ট্রেন, সে যাবে, বড়দার কাছে যাবে। কি করে এমন ঘটল? একদিন সে মেজদার ডায়েরিতে বড়দার ঠিকানা পেল। তার একমাস পর সে সাহস সঞ্চয় করে একটা চিঠি লিখল। তার পনেরো দিন পরে ফোন এল বড়বউদির, তিনি বললেন, তোমার দাদা তোমায় রেজাল্ট বেরোনোর পর নিতে আসবে, তুমি তৈরি থেকো। দাদা এসেছে তাকে নিতে।
অনেক রাত। বেলিয়া সমুদ্রের ধার থেকে যেতে চাইছে না। আজ প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। বাবা-মায়ের ছবিগুলো সে নিয়ে যেতে পারবে না। নরহরি সম্বলপুর চলে যাচ্ছে, সেখানকার কলেজে পড়বে। এই সমুদ্র, এই পেয়ারা গাছ, এই বালির তীর --- এরা তার কত কান্নার, কত খিদের, কত যন্ত্রণার সাক্ষী, এদের সে ছেড়ে যাবে কি করে? তবু এই ঢেউয়ের উপরেই বড়বউদির দুটো চোখ ভেসে ভেসে উঠছে, তাকে যেতেই হবে।
১১
পাঠক, আমার গল্পের আর কিছু বাকি নেই। শুনেছি লক্ষ্মীর কোলে মাথা রেখেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বেলিয়া, ভোর রাতে। সেদিন ছিল বড়মার স্নানযাত্রা। এর কয়েক বছর পর গোপেশ্বর আর মনোরমা এই বাড়ি, দোকান বিক্রি করে পারাদ্বীপ চলে যায়। বয়েস হচ্ছে, আর ভালো লাগে না গোপেশ্বরের বিদেশ-বিভূঁইয়ে পড়ে থাকতে। প্রকাশ ব্যাঙ্গালোরে আছে। প্রতিদিন বিকালে মনোরমা আর গোপেশ্বর সমুদ্রের ধারে বসে থাকে। তাদের গল্প আর ফুরায় না। কত গল্প তাদের - হাসির গল্প, বেলিয়ার গল্প, মৃন্ময়ীর গল্প, পুষ্পর গল্প, ভুবনের গল্প।
২
ট্রেন রাতে, ভুবনেশ্বর থেকে, পুরী এক্সপ্রেস। গোপেশ্বরের কিছু কাজ আছে ভুবনেশ্বরে, সেটা সেরে তারপর ট্রেনে ওঠা। আজ খাবার সময় মেজবউ আর ছোটোবউ দু'জনেই বেলিয়ার পাশে বসেছিল। সকাল থেকেই মনটা বেলিয়ার এমন বিকল হয়ে আছে, বারবার মনে হচ্ছে কেউ কেন তাকে আজ একবারের জন্যেও দোকানে যেতে বলছে না? এটা সেটা করে দিতে বলছে না কেন? কিন্তু এরকম কেন মনে হচ্ছে তার? এই দোকান যাওয়া, এটা সেটা রাতদিন ফাইফরমাশ খাটা কি কম ক্ষতি করেছে? তবু এই কাজগুলোকেই আরেকবার করতে ইচ্ছা করছে, ভাইপো-ভাইঝিগুলোকে স্কুলে নিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু আজ তো রবিবার। আজ সবাই তার সাথে এমন একটা ব্যবহার করছে যে বেলিয়ার খুব অস্বস্তি হচ্ছে, কান্না পাচ্ছে, নিজেকে অপরাধী লাগছে। যেন সে অকারণেই এতদিন এদের এত খারাপ ভেবে এসেছে, আসলে এরা কেউ খারাপ না। একফাঁকে সে সমুদ্রের ধারে গিয়ে কেঁদে এসেছে। অন্যবার যেই সে কেঁদে নিত অমনি তার বুকের ভারটা নেমে যেত, আজ যতই কাঁদছে ততই তার বুকের ভেতরটা যেন খামচে ধরছে, এই মাটি, গাছপালা, সমুদ্র, বাবা-মায়ের ছবিদুটো, নরহরি, দাদা-বউদিরা, গরুগুলো --- সবাই। কেউ তাকে যেতে দিতে চায় না। কেউ তাকে যেন আধপেটা খাইয়ে রাখেনি কোনোদিন, কেউ যেন তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি কোনোদিন, সে যেন মুক্ত পাখির মত উড়ে বেড়িয়েছে সারাটা পারাদ্বীপের আকাশ, বাতাস, সমুদ্র ঘিরে ঘিরে, তার যেন কোনোদিন কোনো দুঃখ ছিল না, কোনো অভিযোগ ছিল না। গোপেশ্বরের খাওয়া হয়ে গেছে। সে তৈরি হতে হতে এটা ওটা কথা বলছে বাচ্চাগুলোর সাথে। বেলিয়াকেও তৈরি হয়ে নিতে হবে, নইলে বাস চলে যাবে। বেলিয়া যতটা সম্ভব সবার সাথে চোখাচোখি এড়িয়ে তৈরি হতে গেল। তৈরি হওয়ারই বা কি আছে, ক'টা তেমন জামাপ্যান্টই বা তার আছে বাইরে যাওয়ার মত? বেলিয়া তার বাবা-মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে, উপরের পাটির দাঁত দিয়ে নীচে ঠোঁটটা চেপে কামড়িয়ে চুল আঁচড়াতে লাগল। তার চোখের কোল ভর্তি জল। এরা কেউ কেন কোনোদিন বুঝল না সে কতটা ভালোবাসে এদের?
বাসস্ট্যাণ্ডে বাড়ির সবাই এল। বেলিয়ার নীচের ঠোঁটটা ব্যথা হচ্ছে চিনচিন করে। কারোর চোখের দিকে না তাকিয়ে কোনোরকমে মাথা নীচু করে পর পর প্রণাম করে বাসে উঠে যাচ্ছিল বেলিয়া। ছোটোবৌদি তার হাতটা ধরে বলল, এটা রাখো ভাই, বলে একটা দশটাকা তার পকেটে গুঁজে দিল, বলল, বইখাতা কিনতে লাগবে। বেলিয়া যেন বিহ্বল হয়ে গেল, বেসামাল হয়ে গেল। যে একবিন্দু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সে সবার সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে নিত, সেই ভালোবাসার এই আচমকা তোড়ে সে নিজেকে নিয়ে কি করবে ভেবে পেল না। বারবার তার মনে হতে লাগল, তার মত অভাগা আর তার মত সৌভাগ্যবান বুঝি এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। সে বউদির দিকে তাকিয়ে কি বলবে ভেবে পেল না। তার দুই শীর্ণগাল বেয়ে জলের ধারা তার ইস্তিরি না করা জামাটার ওপর কচুপাতার শীর্ষদেশ ছুঁয়ে পড়া বর্ষার জলের মত পড়তে লাগল। বেলিয়া বাসে উঠে গেল।
বাস চলতে শুরু করল। যখন গ্রামটার শেষভাগে জলাটা পেরোচ্ছে বাসটা, জানলার ধারে বসে বেলিয়া স্পষ্ট দেখল তার মা দাঁড়িয়ে, ডান হাত দিয়ে ধরা আঁচলে মুখটা ঢাকা ছবির মত, তাকে বিদায় জানাচ্ছে, মায়ের মাথাভর্তি সিঁদুর। দাদার দিকে আড়চোখে দেখল, দাদা খবরের কাগজ পড়ছে মন দিয়ে। এ মানুষটা এক অর্থে সম্পূর্ণ অপরিচিত তার কাছে, কিন্তু এই মানুষটার কাছে থাকবে বলেই সে যেন এতদিন অপেক্ষা করেছিল। যেদিন তার দাদা গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় গেল, সেদিন থেকেই সে জানত তাকে তার দাদা নিতে আসবেই। গ্রামের সবাই বলে, গোপেশ্বরের স্বভাব রামচন্দ্রের মত। সে ভাইগত প্রাণ। বাবা মারা যাওয়ার পর সে যেভাবে এ সংসারটাকে দাঁড় করালো, নইলে কোথায় ভেসে যেত পরিবারটা!
বাসটা এগোক, পাঠক, আমি এই ফাঁকে একটু গোপেশ্বরের গল্পটা বলে নিই। বাবা যখন মারা যায়, তখন গোপেশ্বরের বয়েস সম্ভবত তেইশ কি চব্বিশ হবে। গ্রামের মানুষ, কেউ লেখাপড়া সেই অর্থে জানে না, বয়েসের হিসাবে অনেক জল মেশানো থাকে, তার ওপরে বাল্যবিবাহ তখনও গ্রাম ছেড়ে যায়নি, আজও ভারতের গ্রামেগঞ্জে ঘুরলে এমন বাল্যবিবাহ যে একেবারে উঠে গেছে এ আমি হলফ করে বলতে পারি না। সে যাই হোক না কেন, মোট কথা গোপেশ্বর বুঝল তার তিনটে ভাই তারই মুখ চেয়ে বেঁচে। গোপেশ্বর নামমাত্র পারিশ্রমিকে সুমন্ত মহাপাত্রের হয়ে জন খাটতে শুরু করল। গ্রাম থেকে ভ্যানে করে ডাব শহরে নিয়ে যাওয়া তার কাজ। সুমন্ত মহাপাত্র ভালো মানুষ, মা-বাপ মরা সংসারটার পাশে এসে দাঁড়ালো। এটা-ওটা সাহায্য তো করতই, গোপেশ্বরকে সে নিজের বিশ্বস্ত লোকের মধ্যে রাখল, মাঝে মাঝে হিসাবপত্র দেখে দিতে বলত। প্রতি বছর নুয়াখাইয়ের সময় হাটের থেকে জামাকাপড় কিনে ভাইগুলোর জন্য পাঠাত সে যত সস্তাই হোক না কেন। শহরে যেতে যেতে গোপেশ্বরের পরিচিত মহল বাড়ল। সে মিশুকে, কথা বলতে জানে, কার সাথে কি ব্যবহারটুকু করলে সব দিকে লাভ সেও বুঝতে শিখছে। তার শরীরের কাঠামোটা ছিল বেশ শক্তপোক্ত, যদিও উচ্চতার দিক থেকে ছোটোখাটোই মানুষটা। ক্লান্তি আর বিষাদ তার দেহেমনে দেয়নি বিধাতা। ভাইদের যতটা সম্ভব হল পড়াশোনা শেখালো। ইতিমধ্যে সে শহরে একটা চালের আড়তে ম্যানেজারের কাজ পেয়েছে। সুমন্তেরই পরিচয়ে পেয়েছে। তবে সুমন্ত'র কাজও একেবারে ছাড়েনি। পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলে কি হবে, গোপেশ্বরের ব্যবসা-বুদ্ধি আর হিসাব-বুদ্ধি দিনে দিনে ক্ষুরধার হয়ে উঠতে লাগল। সংসারে শ্রী ফিরল। লোকে বলত, গোপেশ্বরের বাবা সারাজীবন যা করে যেতে পারেনি গোপেশ্বর এই বয়সেই তা করে দেখালো।
কথাটা মিথ্যা নয়। সংসারে শ্রী শুধু অর্থের আগমনেই হয় না, গ্রামে সবাই যুক্তি দিল গোপেশ্বরকে, বাড়িতে লক্ষ্মী আনো গোপেশ্বর। সুমন্ত মহাপাত্রই দায়িত্ব নিল। সে বলল, বাড়িতে একটা মেয়েমানুষ না এলে লক্ষ্মীকে বাঁধবে কে গোপেশ্বর? কিছুটা সুমন্ত'র প্রতি শ্রদ্ধায় আর কিছুটা হৃদয়ের তাগিদে 'হ্যাঁ' বলেছিল গোপেশ্বর। মনোরমাকে পছন্দ হল তার। মনোরমা সংসারে আসার পর গোপেশ্বরের যেন মনে হল, কি বিশাল শূন্যতাকে সে তার বুকে করে নিয়ে বেড়াচ্ছিল সে। সত্যিই শ্রী ফিরল সংসারে।
ক্রমে একে একে ভাইয়েরা দাঁড়িয়ে গেল, কেউই সরস্বতীর আঙিনা মাড়ালো না যদিও, কিন্তু লক্ষ্মীর কৃপা পেতে অসুবিধা হল না গোপেশ্বরের পরিবারের। বিয়ে একটু তাড়াতাড়িই দিয়ে দিল দুই ভাইয়ের গোপেশ্বর। দিনকাল ভালো না, একবার বদ হাওয়া মনের মধ্যে ঢুকলে আর রক্ষে নেই। সংসারে নষ্ট হওয়ার ফাঁদ পাতা চারদিকে।
পরিবার বড় হল। অর্থ শুধু অর্থই আনে না, অনর্থও আনে। ঘরে ঈর্ষা আর কোন্দলের সূত্রপাতের ইঙ্গিত চোখ এড়ালো না গোপেশ্বরের। প্রায়ই সুর কেটে যায় সংসারের। ইতিমধ্যে তার একটা মেয়ে হয়েছে, হাসি, ফুটফুটে ফর্সা, বাবা অন্তপ্রাণ। কিন্তু সারাদিনের নানা অশান্তির ঘায়ে সেও যেন কোনো প্রলেপ দিতে পারে না। গোপেশ্বরের মন হাঁপিয়ে ওঠে, ছুটি চায়, মাঝে মাঝেই বাণপ্রস্থে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করে। এরই মধ্যে সুমন্ত মহাপাত্র হঠাৎ চারদিনের জ্বরে মারা গেল। এই গ্রাম নির্বান্ধবপুরী হল তার কাছে। বেলিয়ার জন্যেই যেন সে আটকে পড়ে আছে সংসারে। এর মধ্যে হঠাৎ কি মনে হল, নতুন কাজ খোঁজার আছিলায় ভুবনেশ্বর যাচ্ছি বলে একাই পুরী চলে এল গোপেশ্বর। এই পুরীতেই তার ভাগ্যের স্রোতের মোড় ঘুরে গেল।
পুরীতে আলাপ হল এক বাঙালি বাবুর সাথে, নাম বিপ্রদাস মুখার্জী, তাদের পাশাপাশি ঘর হোটেলে। বাড়ি হাওড়ার সালকিয়ায়, বিপত্নীক, সংসার বিরাগী মানুষ, শুধুমাত্র মেয়ে মালতী'র জন্য পুরোপুরি বিবাগী হতে পারছেন না। রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষিত, সারাদিন অধ্যাত্মচর্চায় দিন কাটে। এমন মানুষের গোপেশ্বরকে ভালো লাগবে বলাই বাহুল্য। কথায় বলে, মনের মানুষ হয় যে জনা, তারে নয়নেতে যায় গো চেনা। সংসারে কে কখন কোথায় আপন হয়ে যায়, এ রহস্য যে কেউ জানে না বিপ্রদাস তা জানে। গোপেশ্বরের সাথে কথা বলে মনে হয়েছিল তার এত পুরুষের ব্যবসা এমন একজন মানুষের হাতে পড়লে ডুববে না। কাজ শিখতে আর কদ্দিন। গোপেশ্বরও এরকম একটা সুযোগ যেন মনে মনে চাইছিল, সেও রাজি হল শোনামাত্র। আসলে গোপেশ্বর যে উপায় খুঁজছিল, তা শাস্ত্রে নেই। জতুগৃহ থেকে মুক্তির তাগিদ আর সোনার লঙ্কা ছেড়ে বেরোনোর বৈরাগ্য তো এক নয়।
পুরী থেকে ঘুরে এসেই সে এক সপ্তাহের মধ্যে সব গুছিয়ে নিয়ে রওনা হল কলকাতার পথে। সবচাইতে আশ্চর্য হয়েছিল যতটা বাধা আসবে সে আশা করেছিল ভাইদের থেকে, তার অর্ধেকও সে পেল না। তার পোড় খাওয়া মন দুই ভাইয়ের একটা প্রচ্ছন্ন সম্মতিই টের পেয়েছিল এই চলে যাওয়ায়। বুকে শেল বেজেছিল শুধু বেলিয়ার চোখদুটো দেখে। সেই মা-হারা বালকটার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়া বিভ্রান্ত চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে তার ভিতরটা হাহাকার করে উঠেছিল। মনোরমা বুঝেছিল গোপেশ্বরের কোথায় বাজছে বেশি। সে বলেছিল, তুমি ওকে উচ্চমাধ্যমিকটা এখান থেকে দিয়ে নিতে দাও, ততদিনে তুমিও দাঁড়িয়ে যাবে, তারপর বেলিয়াকে নিয়ে গেলেই হবে। ও পড়ুক। সংসারে একটা মানুষ অন্তত স্কুলের গন্ডী পেরোক।
হাওড়া স্টেশানে বিপ্রদাসবাবু আর ওনার মেয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের নিতে। যেন কতদিনের চেনা আত্মীয়। সেদিন বিকালেই বেলুড়মঠ আর দক্ষিণেশ্বর নিয়ে গিয়েছিল মনোরমা, গোপেশ্বর আর হাসিকে সাথে করে। গোপেশ্বর মনে মনে বুঝেছিল এ জগন্নাথের কৃপা, নইলে এমন যোগাযোগও হয় এ কলিকালে? বিপ্রদাসের মেয়ে মালতীও খুব খুশী হয়েছিল তার বাবা একজন মনের মত সাথী পেয়েছে বলে।
গোপেশ্বর বিপ্রদাসের বাড়ির পিছনের দিকের দুটো ঘরে প্রথমে সংসার পাতল। চশমার দোকানে কাজ শিখতে বেগ পেতে হল না তাকে। প্রতিদিন অর্ডার নিয়ে কলকাতা যায়, রাতে ফেরে। বৃহস্পতিবার করে যেদিন দোকান বন্ধ সেদিন রামকৃষ্ণ পাঠচক্রে যোগ দেয়, জগন্নাথের ভজন গেয়ে শোনায় গোপেশ্বর মাঝে মাঝে। ধীরে ধীরে বাংলাটা শিখতে শুরু করেছে। অল্প অল্প বলতেও পারল ক'দিনেই - অনেক শব্দ ওড়িয়া শব্দের মত, শুধু উচ্চারণে এরা 'আ' টা বেশি বলে, তারা 'অ' টা।
দিন যত সহজ হতে লাগল গোপেশ্বরের মনের মধ্যে একটা অন্য সুর বাজতে শুরু করল। স্বাধীন কাজের ইচ্ছা পেয়ে বসেছে তাকে। সে বুঝল তার বৈরাগ্যের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। যে রসে মজেছেন বিপ্রদাস, সে রসে সে ডুবতে চাইলেও ডুবতে পারছে না। তার মধ্যে আবার রজোগুণ চাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে।
সে পাঠচক্রে অন্যমনস্ক হয়, ঘুমিয়ে পড়ে। বিপ্রদাসের চোখ এড়ালো না। বিপ্রদাস একদিন জিজ্ঞাসা করেই বসল, তুমি ঠিক আছ গোপেশ্বর? বাড়ির জন্য মন খারাপ? যাবে বাড়ি?
গোপেশ্বর কোনো ভণিতা না করেই বলল যে সে আসলে একটা স্বাধীন ব্যবসা শুরু করতে চায়, একটা মুদির দোকান খুলতে চায়। এ তার অনেক দিনের ইচ্ছা।
কথাটা অপ্রত্যাশিত হলেও অস্বাভাবিক নয়, বিপ্রদাস ভাবল। তার মত একজন সমর্থ চৌখস মানুষ তার দাসত্বই বা চিরকাল করবে কেন? বিপ্রদাস মালতীর সাথে কথা বলে, তার দোকানের পাশে ফাঁকা জমিটাতেই গোপেশ্বরের দোকান খুলে দিল। আসলে যতই মোক্ষের দিকে এগোক না কেন বিপ্রদাস, তার ব্যবসায়ী চোখে গোপেশ্বরের ব্যবসায়ী হওয়ার সম্ভবনাটা এড়িয়ে যায়নি। কয়েক বছরের মধ্যে গোপেশ্বরের 'জগন্নাথ ভাণ্ডার' ফুলেফেঁপে ওঠে। কথামতো ঋণ অল্প অল্প করে শোধ করতে শুরু করে গোপেশ্বর। আবার ঈশ্বরে মন হয়, তবে এবারে মোক্ষের জন্য না, এখন তার অভ্যুদয়ের দিকে এগোনো। এ শব্দটা বিপ্রদাসই শিখিয়েছে তাকে। এর মানে পার্থিব উন্নতি। পার্থিব উন্নতির পরেই আসে মোক্ষের অধিকার। ভিখারী আবার কি ত্যাগ করবে? বিপ্রদাস এই বলে উৎসাহ জুগিয়ে যেত গোপেশ্বরকে।
বিপ্রদাস মারা গেল বয়সের নিয়মেই। ঋণ পুরো শোধ করা হল না। মালতী বলল, থাক কাকু, বাবা তোমায় খুব ভালোবাসতেন। তুমি আমার মাথার উপর থেকো। মালতী একটা স্কুলে পড়ায়, সে বিয়ে করবে না ঠিক করেছে। গোপেশ্বর মেনে নিতে পারে না, কিন্তু না-ও বলতে পারে না। মেয়েটার এমন একটা ব্যক্তিত্ব।
৩
গোপেশ্বরের কাজ আছে ভুবনেশ্বরে, পার্থিব কোনো কাজ না, একটা মানসিক আছে লিঙ্গরাজ মন্দিরে। হাসির জন্যে মানসিক, সে ছোটোবেলায় একবার এমন ডায়েরিয়ায় ভুগেছিল যে মেয়ে এই যায় কি সেই যায়। তখন মনোরমা এই মানসিকটা করে। হাসি এখন ক্লাস সিক্সে পড়ে, প্রকাশ ক্লাস ফোরে। প্রকাশকে দেখতে হয়েছে অনেকটা ওর মায়ের মত, বড় বড় চোখ, টিকালো নাক, ঠোঁটটা সরু। বড় চোখের জন্য মনোরমা মাঝে মাঝে ডাকে, চকা আঁখি। হাসিকে ওর ঠাকুমার মত দেখতে হয়েছে, চোখদুটো কুদে কুদে, হাসলে গালে টোল পড়ে ঠাকুমারই মত। গোপেশ্বর হাসিকে 'মা' বলে ডাকে মাঝে মাঝে।
দুই ভাই বাস থেকে নেমে আগে-পিছে হাঁটছে। হেঁটেই যাবে, রিকশা নিলেও হত, কিন্তু না, বাজে খরচের অভ্যাস একবার হয়ে গেলে আর থামানো যায় না। বাজে খরচের অভ্যাসটা অনেকটা অকারণে মিথ্যা বলার মত, যত বলবে ততই অভ্যাসটা বাড়বে। সাময়িক সুখ আছে, কিন্তু সেই সুখে বিষ। সংসারে বিষাক্ত সুখ কম দেখেনি গোপেশ্বর, বিপ্রদা বলতেন, গোপেশ্বর রসেবশে থাকতে শেখো, এটা রামকৃষ্ণের শিক্ষা। এই কথাটার মানে এখন বেশ বুঝতে পারে গোপেশ্বর। বেলিয়া বাসে ওঠার আগে যখন কাঁদছিল তখন গোপেশ্বরের বারবার এই কথাটাই মনে হচ্ছিল, সংসারে এই কান্না, এই বাঁধনগুলো তলে তলে কত আলগা! এই বেলিয়াই ক্রমশ ভুলে যাবে সব, তার এই গ্রাম, এই বাড়ি, এই সুখে-দুখে ঘেরা আলোছায়া জীবন, কিচ্ছু মনে থাকবে না। সময় সব বদলে দেবে, তাকে যেমন বদলে দিয়েছে। মানুষ এমনই পরিযায়ী পাখির মত মনে মনে, সময়ের সাথে সাথে নতুন ভাবনার দেশে নতুন আশার নীড় বাঁধে।
বেলিয়া গোপেশ্বরের পিছন পিছন হাঁটতে হাঁটতে দাদার হাঁটাচলা, কথা বলা, ঘাম মোছা, হাত নাড়া - সব লক্ষ্য করছে। জ্ঞানত সে দাদার সাথে কয়েকবার তাদের গ্রামের বাড়িতে থাকলেও এতক্ষণ কাছাকাছি থাকেনি কখনও। মনের মধ্যে তাই একটা দূরত্বের অস্বস্তি আর কাছে থাকার ভালো লাগা --- দুই-ই কাজ করছে। সে নিজের অজান্তে কিছু করে ফেললে দাদা অসন্তুষ্ট হতে পারে ভেবে তার মনের মধ্যে একটা আশঙ্কার মেঘ তৈরি হচ্ছে মাঝে মাঝে, সেকি খুব জোরে হাঁটছে? সেকি খুব ধীরে হাঁটছে? তার কি নিজের থেকে কথা বলা উচিৎ? সেকি বেশি চুপ করে আছে? --- এরকম নানা চিন্তায় নিজেকে নিয়ে সুস্থির হয়ে উঠতে পারছে না। দাদার হাতে একটা ব্যাগ আছে, সেটা একবার সে নিজে এগিয়ে গিয়ে নিতে গেল, দাদা হেসে বলল, থাক। ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে গেল সে কিছুক্ষণের জন্য, কেন, সেকি এইটুকুও করতে পারে না? সে যদি কিছু করতে না পারে, সে যদি দাদা-বউদির মনের মত হয়ে উঠতে না পারে, যদি দাদা তাকে ফিরিয়ে দেয় আবার গ্রামের বাড়িতে? এই কথাটা ভাবতেই তার মনের মধ্যে একরাশ অন্ধকার নেমে এল ঝুপ করে। ভুবনেশ্বরে সে আগেও এসেছে কয়েকবার, চারদিকে দেখার কত কি --- কতরকম বাইক, গাড়ি, দোকান, কিন্তু আজ এখন তার কিচ্ছু চোখে পড়ছে না, কিচ্ছু না। তার মনের মধ্যে সংশয়ের ঘূর্ণি। যদি ফিরে আসতে হয়? তার একটু আগে মনে হচ্ছিল খিদে পাচ্ছে, কিন্তু এখন আর পাচ্ছে না। ওই তো লিঙ্গরাজ মন্দিরের চূড়া, এসেই তো গেছে।
পুজোটা দেওয়া হল। সামনে মেঝেতে বড় গোল চাকতির মত শিবলিঙ্গ। মন্দির ফাঁকাই, তেমন ভিড় নেই। বেলিয়া গোপেশ্বরের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে। গোপেশ্বরের মন অন্য জগতে। যা কিছু পেয়েছে সে জীবনে, তার সবটুকু কি শুধুই নিজের চেষ্টায়? তা নয় তো! কোনো এক অদৃশ্য শক্তির ভালোবাসা তাকে হাত ধরে নিয়ে এসেছে যেন এতটা পথ। তবে ভবিষ্যৎ নিয়ে আর ভয় কি, বাকিটাও সে-ই ধরে থাকবে। মনের মধ্যে এই বিশ্বাসটুকুকে সম্বল করেই চলা। বেলিয়ার কাঁধে হাত রেখে মন্দিরের বাইরে এসে দাঁড়ালো গোপেশ্বর। মনটা গোপেশ্বরের ভীষণ শান্ত, তৃপ্ত, প্রসন্ন। কিছু একটা খেতে হবে। বেলিয়ার চেহারাটা দেখলে সে বোঝে মনোরমা কেন বারবার বলে ছেলেটাকে এখানে নিয়ে চলে এসো নইলে নির্ঘাত ম্যালেরিয়ায় ভুগে মারা যাবে। মানুষ নির্দয় কেন হয়, ক্ষুদ্রবুদ্ধির মত বালাই সংসারে দুটো নেই, নইলে এইটুকু মানুষকে এত কিছু কেন সহ্য করতে হয় সংসারে? এ বিশ্বে বেলিয়ার তো অভাব নেই, রাস্তাঘাটে, স্টেশানে, ফুটপাথে অজস্র বেলিয়া। কেন মানুষের মন এত রূঢ়, এত পাষাণের মত হয়ে যায়?
গোপেশ্বর একটাও ভাতের হোটেল খোলা পেল না। একে রবিবার, তায় বিকাল গড়াতে চলল। নিজের উপর রাগ হল, বাস থেকে নেমেই খাইয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল ভাইটাকে। যা হোক, চা আর কেক খেয়ে দুইভাই একটু এদিক ওদিক ঘুরে ভুবনেশ্বর স্টেশানে চলে এল। স্টেশানে একটা বড় বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, কিছু পছন্দ হয়? নেব? বেলিয়া মাথা নাড়ল।
ক্রমে সন্ধ্যে হয়ে এল। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে গোপেশ্বর, বেলিয়া কিছু শোনার আগেই মাথা নেড়ে দেয়, সংসারে তার যেন কিছুই না হলে হয়। কতটা বঞ্চিত ছিল তবে! বেলিয়া একটা বেঞ্চে বসে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। গোপেশ্বর পায়চারি করতে করতে এত কথা ভাবছে যে তার খেই পাওয়া দায়। ফেলে আসা জীবনের টুকরো টুকরো ছবি যেন সিনেমার মত তার চোখের সামনে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে তখন। আর ওদিকে বেলিয়া তন্দ্রাচ্ছন্ন, কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি উত্তেজনায়। তার ঘুমের মধ্যে সমুদ্রের গর্জন, সমুদ্রে ভেসে আসা নরহরির দেওয়া অঙ্ক করা ছেঁড়া পাতা, মায়ের আবছা মুখ, পেটের মধ্যে একটা খিদে খিদে ভাব, কিন্তু এতটা খিদে কেন পাচ্ছে? বাড়িতে তো পায় না! চোখ মেলে তাকালো।
দাদা পায়চারি করে যাচ্ছে, কি ভাবছে দাদা?
* * * * * * * * *
সালকিয়ার বাড়িতে যখন পৌঁছাল তখন সাড়ে আটটা বাজে। গুমোট গরম একটা। বেলিয়া এই প্রথম দাদার দোকানটা দেখল, বাংলা পড়তে পারে না, কিন্তু বুঝল লেখা আছে - জগন্নাথ ভাণ্ডার। দাদা এক কাপ চা খেয়েই দোকান খুলতে গেল, বেলিয়াও এল পেছনে পেছনে। এত জিনিস! একটা টুলে দাদা বসল। সামনে অনেকগুলো কাঁচের বড় বড় জার। কত জিনিসের তো নামই জানে না বেলিয়া, চোখেও দেখেনি। দোকানের সামনে একটা ছোটো মাঠ, তার দু'পাশে দুটো বড় বড় বাড়ি। অবশ্য চারদিকেই শুধু বাড়ি আর বাড়ি। দোকানটা গলির মুখেই, গলিটা বড় রাস্তায় এসে মিশেছে। জায়গাটার নাম সাহেব কলোনি। বড়বৌদি তাকে স্নানে যেতে বলল। বাথরুমে জল ধরা আছে। রাস্তার জামাকাপড় একটা টব দেখিয়ে সেখানে খুলে রাখতে বলল, তারপর একটা তাকের উপর সাবান আর একটা কৌটো দেখিয়ে বলল, এটা শ্যাম্পু। "ভালো করে স্নান করে এসো", বলে মনোরমা বাথরুমের দরজাটা টেনে চলে গেল।
বেলিয়া কোনোদিনই সব জামাকাপড় খুলে স্নান করেনি। লজ্জা লাগল, হোক চারদিক বন্ধ, কিন্তু দেওয়ালের কান যেমন আছে, চোখও আছে। সে জামাটা খুলে টবে রেখে প্যান্টটা পরেই জল ঢালতে শুরু করল। সাবানটার দারুণ গন্ধ, শ্যাম্পু চোখে গিয়ে একটু জ্বালা জ্বালা করল। এ সবই তার আগে হয়েছে, তবে এখানে যেন সবটাই অন্যরকম। গ্রামের বাড়িতে কিছুই তার নিজের ছিল না, কিন্তু তবু সে তার নিজের বাড়ি ছিল। এখানে একটু ইতস্ততভাব লাগছে। স্নান হলে, প্যান্টটা খুলে গামছাটা জড়িয়ে কাচতে বসল। কাপড় কাচার সাবানটা টবের পাশেই একটা প্লাস্টিকে মোড়া ছিল। যেই সে সাবান ঘষতে গেছে, অমনি দরজায় টোকা, বেলিয়া তুমি কাচবে না, বাইরে এসো, মনোরমার গলা। কিন্তু এগুলো করতে তো সে অভ্যস্ত। কে কাচবে তবে?
বেলিয়া কাচা বন্ধ রেখে বাইরে এলো। বাইরে এসে দেখে বউদি বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে, হাসি আর প্রকাশ সোফায় আর মেঝেতে আধশোয়া হয়ে তার দিকে তাকিয়ে, তাদের সামনে খাতা-বই খোলা। বউদি একটা ঘর দেখিয়ে বলল, ওই ঘরে তোমার জন্য লুঙ্গি আর জামা আছে, ওগুলো পরে খেতে এসো।
দুটো বড় ঘর। একটা ঘরের ভিতর দিয়ে সামনে যাওয়া যায় যেদিকে দোকান, ঘরের সাথেই লাগোয়া। এদিকে একটা বারান্দা, তার কোণে রান্নাঘর, একদিকে বাথরুম, পায়খানা বাইরে উঠানে আলাদা। একটা ঘরে দাদা বউদি থাকে, অন্যঘরে হাসি আর প্রকাশ। বেলিয়ার শোয়ার ব্যবস্থাও হয়েছে, চৌকির পাশে একটা ক্যাম্পখাট রাখা আছে। পরের মাসে একটা একজনের শোয়ার মত চৌকি কিনবে ঠিক করেই রেখেছে মনোরমা, বড়টাতে কাকা-ভাইপো শোবে, আর সিঙ্গলটাতে হাসি।
বেলিয়া খেতে বসল। দুই ভাইপো ভাইঝিও তার সাথে দু'পাশে বসল। মনোরমা গরম ভাত আর ঘি দিয়ে বলল, আমি ডাল আর আলুভাজা আনছি। হাসি আর প্রকাশ স্কুলে বেরোবে। বাইরে উঠানে একটা কাক ক্রমাগত ডেকেই যাচ্ছে, আরো হাজার রকম আওয়াজ রাস্তা থেকে আসছে, এত আওয়াজে অভ্যস্ত নয় বেলিয়া। সব মিলিয়ে তার অবচেতন মনে কেমন একটা ঘোর তৈরি হয়েছে। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে বেলিয়া, দোকানে দাদার গলা শোনা যাচ্ছে। তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। কালও ট্রেনে ঘুম হল না। চোখদুটো টেনে আসছে। এত ঘুম, এত আরামের ঘুম, এত শান্তির ঘুম তার কোনোদিন পেয়েছে? আচমকা মাথায় একটা হাতের ছোঁয়ায় তার ঘোরটা কেটে গেল, সে লাল হয়ে যাওয়া চোখটা বড় বড় করে তাকিয়ে দেখল মনোরমা তার মাথায় হাত দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে। একটু হেসে মনোরমা বলল, টেবিলে ঘুমিয়ে পোড়ো না, আমি বিছানা করে দিয়েছি, তুমি যাও ঘুমিয়ে নাও, একটু ঘুমিয়ে নিলে শরীরটা ভালো লাগবে। এতটা জার্নি তো।
কি করে কি করে খাওয়া শেষ করে কলপাড়ে মুখ ধুয়ে বিছানায় পৌঁছাল বেলিয়া বোধ করি নিজেও টের পেল না। ঘুমের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে মনে হল মা মাথার কাছে আছে বসে। পরক্ষণেই মনে হল তার দোকানে যাওয়া উচিৎ, দাদাকে সাহায্য করতে.... দাদার ক্লান্ত লাগছে না?
ক্রমে চিন্তার সুতো আলগা হয়ে অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে তাকে যেন ডেকে গেল কেউ...
বেলিয়া গভীর ঘুমে। তার রোগা শরীরটার দিকে করুণ চোখে সস্নেহে তাকিয়ে মনোরমা দরজাটা আস্তে করে ভেজিয়ে দিয়ে আঙুলের ইশারায় হাসি আর প্রকাশকে বলল, আওয়াজ কোরো না, কাকা খুব ক্লান্ত, ঘুমিয়ে নিক। তোমরা স্কুলের জন্য রেডি হয়ে যাও, বেশি হুটোপাটি কোরো না।
প্রকাশ বলল, আমরা খেলব না কাকার সাথে?
মনোরমা কিছু উত্তর করল না। মনে মনে জগন্নাথের চরণে প্রণাম জানিয়ে, নিজের সমস্ত মাতৃত্বের স্নেহটুকু দিয়ে বেলিয়াকে আগলানোর জন্য শক্তি চাইল। ছোটোবেলায় মা-কে হারিয়ে অন্যের বাড়ি বড় হওয়ার যন্ত্রণা মনোরমা জানে। মামাবাড়িতে মানুষ মনোরমা। মা-বাবা মারা গিয়েছিল কলেরায়, সে তখন অনেক ছোটো। আধপেটা খাওয়ার যন্ত্রণার চাইতে বেশি যন্ত্রণা অবহেলার, মনোরমা জানে, তাই বেলিয়ার ওই কূল হারানো চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে বুকটা মুচড়ে উঠত। আজ সে তার ছাদের তলায়, এ যে কি সুখ। মনোরমা দোকানে গিয়ে গোপেশ্বরকে বলল, খেতে এসো।
গোপেশ্বর বলল, বেলিয়া?
মনোরমা ফিরে যাচ্ছিল, থেমে গিয়ে পেছন ফিরে গোপেশ্বরের চোখের উপর চোখ রেখে বলল, ঘুমাচ্ছে।
মনোরমার গলায় একটা যুদ্ধে জিতে যাওয়ার গর্ব। আহত মাতৃত্ববোধের ক্ষুব্ধ অহংকারের গর্জনের মত যেন, এই ঘুম যা মনোরমা দিয়েছে বেলিয়াকে সে বেলিয়ার প্রাপ্য ছিল এতদিন, কেন দেওয়া হয়নি তাকে?
গোপেশ্বর মনোরমার দিকে তাকালো, বলল, আচ্ছা তুমি বসো তা হলে আমি খেয়ে আসি।
এত সুক্ষ্ম নাটিকাটি খুদে এক খদ্দেরের চোখে পড়েনি, সে এর মধ্যে বলে উঠেছে কিছুটা চেঁচিয়েই, উফ্... তোমরা কত দেরি করবে একটা পেন্সিল দিতে, ঘন্টা পড়ে যাবে না স্কুলে!
মনোরমার ঘোরটা যেন কাটল, সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বলল, তাই তো বাবা, কি পেন্সিল দেব?
খুদে খদ্দের একটা পেন্সিলের নাম বলল। মনোরমা বার করে দিতে দিতে খুদে খদ্দেরের চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবল, এমন বাঁকা কাজল কে পরালো?
কিছু বলল না। হাসল। তার উঠানে একটা কাক সকাল থেকে ডেকেই যাচ্ছে। মনোরমা অন্যমনস্ক হল।
৪
অনেকে এখন জানে মনোরমার দুই ছেলে, এক মেয়ে। তারা ভাবে মনোরমার বড় ছেলেকে এতদিন গ্রামে রেখে এসেছিল, এখন এখানে থাকে সে। বলাই বাহুল্য, মনোরমার সেই বড় ছেলে বেলিয়া।
বেলিয়া গ্র্যাজুয়েশনটা করল এখানের একটা কলেজ থেকে। আর পড়ল না, ইচ্ছা নেই। এদিকে ‘জগন্নাথ ভাণ্ডার’ বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছে। এই তল্লাটে মুদির দোকান বলতে এই একটাই। বেলিয়া এখন অনেক বাড়িতে মাসের মাল পৌঁছাতে যায় সাইকেলে করে। অনেকের সাথে পরিচয় সেই জন্যে বেলিয়ার এখন। তার স্বভাবের জন্য বাড়ির লোকই সে হয়ে উঠেছে বলা যায় অনেক বাড়ির সে। তার পেশীবহুল শরীর, উজ্জ্বল চোখ, তৎপর ক্ষিপ্র চালচলন – বেলিয়াকে এমনিতেই আকর্ষণীয় করে। যে কোনো কাজে সে নিজেকে ডুবিয়ে দেয়, গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে কাজটা সমাধা করে ফেলে। যদি না জানা কাজ হয়, তবে শিখে নেয়, সব বিষয়েই তার ভীষণ আগ্রহ, অবশ্যই হাতের কাজে, পড়াশোনায় নয়। এই করে ছোটোখাটো ইলেকট্রিকের কাজ, কাঠের কাজ, অল্পবিস্তর রেডিও, টিভির কাজও শিখে নিয়েছে। অতএব সারাদিন এ বাড়ি, সে বাড়ি থেকে 'বেলিয়া...', 'বেলিয়া...' ডাকটা এমন অভ্যাস হয়ে গেছে মনোরমার, যে বেলিয়া বেশিক্ষণ বাড়ি থাকলেই সে আশ্চর্য হয়। তা ছাড়া বেলিয়ার বাড়িতেও অনেক কাজ – ভাইপো-ভাইঝি দু'জনের দরকারি অদরকারি নানা প্রয়োজন আবদার মেটানো। মনোরমার সাথে টুকটাক ঘরের এটাসেটা, বিশেষ করে ভারি কাজগুলো মনোরমাকে একদমই করতে দেয় না যদি সে বাড়ি থাকে। আর একটা বড় কাজ হল মাসে অন্তত তিন-চারবার বড়বাজারে যাওয়া দোকানের মাল আনতে। সাধারণত একাই যায়, কখনও কখনও সাথে প্রকাশ যায়। তবে সে কদাচিৎ। হাসি পড়াশোনায় বেশ ভালো, দারুণ রেজাল্ট করে সে, স্ট্যান্ড করে ক্লাসে। এই নিয়ে বেলিয়ার গর্বও খুব, তাই হাসির প্রতি বেশ দুর্বল সে। হাসি কাকার কাছে প্রশ্রয় পায় যথেষ্টই।
এ সবের মাঝে বেলিয়ার মনের মধ্যে একটা সুপ্ত ইচ্ছা অল্প অল্প দানা বাঁধছিল। বলা যায় অধঃক্ষিপ্ত হচ্ছিল। বেলিয়া এখন অনেক বাড়ি যেতে যেতে বুঝতে শিখেছে চাকরি পাওয়ার দুটো পথ। এক পরিশ্রম করে, চিরাচরিত নিয়ম, আরেকটা কারোর জানাশোনা দিয়ে। বেলিয়া এমন অনেক বাড়ি যায় যে বাড়ির কর্তারা বেশ উচ্চপদস্থ। বেলিয়ার আন্তরিক অকপট ব্যবহারের জন্য সে অনেকের কাছের লোক আগেই বলেছি, এর ফলে ক্রমে তার মনে হয় সেই বা পাবে না কেন? এত তো সবাই ভালোবাসে তাকে, একটা চাকরি করে দিতে পারবে না? এই ইচ্ছাটা তার মনের মধ্যে কখন যে ধীরে ধীরে ডালপালা মেলে তার মনের অধিকাংশটা গ্রাস করে বসছে, বেলিয়া সচেতনভাবে লক্ষ্য করেনি। কিছুটা আভাস পেয়েছে মনোরমা, বেলিয়ার কথাবার্তায়। মনোরমা মাঝে মাঝেই বেলিয়াকে তাই বলে, তুমি এত কাজে না সারাদিন নিজেকে ব্যস্ত রেখে একটু পড়লেও তো পারো, মানুষ পড়ে কি চাকরি পাচ্ছে না? তুমি পরিশ্রম করো, ঠিক পাবে।
আসলে মনোরমা ঘরের বাইরে বেশি না বেরোলোও, মানুষ চিনতে খুব একটা ভুল তার কোনোদিন হয়নি। বেলিয়া সরল, বেলিয়া এত প্যাঁচ, মতলব বোঝে না। মতলবের ভালোবাসা আর হৃদয়ের শর্তহীন ভালোবাসা – এই দুইকে আলাদা করে বোঝার মত মন বেলিয়াকে বিধাতা দেননি সে মনোরমার চাইতে ভালো আর কে জানে? বেলিয়া না বুঝুক, মনোরমা জানে বেলিয়াকে নিয়ে এত টানাটানি, এত দরদ সবার তা শুধু সে অনেকেরই সহজলভ্য, মুশকিল আশান বলে। অবশ্যই সস্তায়। একমাত্র মৃন্ময়ীকে আলাদা চোখে দেখে মনোরমা, তার কথাতে পরে আসছি। কিন্ত এই মতলবি মানুষগুলোই বেলিয়ার চোখে একটা স্বপ্ন এঁকে দিচ্ছে, “তুমি চেষ্টা করো – পরে আমি তো আছিই”, এই কথাটা বেলিয়ার মনে একটা ঘোর তৈরি করছে। মনোরমা নিজেও চায় বেলিয়া নিজের মত করে প্রতিষ্ঠিত হোক, কিন্তু সে নিজের শ্রমেই হোক, কারোর উমেদারিতে নয়, মনোরমার আত্মসম্মানে লাগে। হয় তো এই বিদেশে এসে অন্যের ভাষায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হয় বলে তার আত্মসম্মান বোধটা বেশি স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে।
বেলিয়ার মনের এই একদিকের অবস্থান হলেও, মনোরমার প্রতি তার শিশুসুলভ নির্ভরতার বোধটার কিছুমাত্র হ্রাসবৃদ্ধি হয়নি। বেলিয়ার আর সব হলে না হলেও চলে কিন্তু মনোরমাকে ছাড়া সে নিজেকে ভাবতে পারে। মাঝে মাঝে খাওয়ার পর যখন বেলিয়া অতি ব্যস্ততার মধ্যে মনোরমার আঁচলে মুখ মুছে সাইকেল নিয়ে ছুট দেয়, মনোরমা অস্বস্তি আর বাৎসল্যের মধ্যে ঠিক দাঁড়াবার মত একটা জায়গা খুঁজে পায় না। একবার মনোরমা বেলিয়াকে বলতে গিয়েছিল, বেলিয়া এখন বড় হয়েছ, হাজার হোক তুমি তো আমার দেওর, সন্তান নও, লোকে কি ভাববে?
কথাগুলো উচ্চারণ করার সময় মনোরমার জিভ যেন আড়ষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিল। বেলিয়া ছলছল চোখে, মনোরমার হাতটা নিজের মাথায় দিয়ে বলেছিল, তুমি দিব্যি দাও এরকম কথা আর কোনোদিন উচ্চারণও করবে না, লোকের চোখে কি হও তুমি সে লোক বুঝুক, কিন্তু ওই আস্তকুঁড়ের থেকে আধপেটা খাওয়া আমাকে যে বাঁচাতে দৌড়েছিলে, সে বৌদি হয়ে না মা হয়ে? মনে নেই? তোমার সমাজের ভয়ে তুমি ভুলতে পারো, বেলিয়া ভোলে না, সে এতটা নেমকহারাম নয়।
তবে এই কথাগুলো বললেও বৌদির যাতে কোনো অসম্মান না হয়, তাই বাইরের লোক থাকলে বেলিয়া সচেতন ব্যবহারই করত মনোরমার সাথে। মনোরমার বেলিয়ার এই অতিচেষ্টা দেখে মনে নিদারুণ কৌতুক জন্মাত।
একবারের ঘটনা, মালতী দ্বারভাঙ্গায় চলে যাচ্ছে একটা স্কুলের হেডদিদিমণি হয়ে। বেলিয়াই ছাড়তে যাবে ঠিক হল। গেল সে, ছিলও দিন তিনেক মালতীর সাথে। গোপেশ্বর বারবার বেলিয়াকে বলে পাঠিয়েছিল সে যেন পারাদ্বীপ হয়ে ফেরে। বেলিয়া গেল না। তার ইচ্ছাই করেনি। মনোরমাকে ছেড়ে তার কোথাও দু'দণ্ড ভালো লাগে না।
হঠাৎ করে একদিন ভোরে বাড়িতে ফিরে এল নির্ধারিত দিনের চার-পাঁচদিন আগেই বেলিয়া। গোপেশ্বর তাকে খুব বকেছিল - এটা অন্যায়, ওরাও তোর আপন বেলিয়া, দাদা-বৌদি, বাচ্চাগুলো তোকে এত ভালোবাসে, তোর উচিৎ ছিল না কয়েকটা দিন ওদের সাথে কাটিয়ে আসা? এতটা অকৃতজ্ঞ হতে নেই বেলিয়া... ইত্যাদি ইত্যাদি গোপেশ্বর গজগজ করেই যাচ্ছিল। বেলিয়া চুপ করে শুনতে শুনতে শুধু মনোরমার প্রতীক্ষায় ছিল, গোপেশ্বরের কথা সে গায়ে মাখছিল না, মনোরমা তখন মন্দিরে গিয়েছিল, হাসির জন্মদিনের জন্য পুজো দিতে।
মনোরমা পুজো দিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই গোপেশ্বরের গলার আওয়াজ পাচ্ছিল, বাইরের দরজাটা ভেজিয়ে ঢোকার সময় বেলিয়ার জুতোটা দেখে বুঝে নিতে অসুবিধা হল না কি হয়েছে, কিন্তু মনের সবটুকু প্রসন্নতাকে এখন একটা কপট গম্ভীর কালো চাদরে না ঢাকলেই নয়, নইলে গোপেশ্বর আরো রেগে যাবে। ইদানীং গোপেশ্বরের হাইপ্রেশার ধরা পড়েছে, তারও রাগও আগের থেকে ঘনঘন হয়।
মনোরমা ঘরে ঢুকতেই বেলিয়া এসে তার মুখের দিকে না তাকিয়েই পায়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম করল, মনোরমার বেলিয়ার মুখটা দেখেই প্রচণ্ড হাসি পেল, নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে বাথরুমে ঢুকে গেল। খানিক হেসে, চোখের জল আঁচলে মুছে বাইরে এলো, একমাত্র অন্তর্যামী জানেন কি দুশ্চিন্তায় তার এই ক'টা দিন কাটছিল।
বেলিয়া আর মনোরমার কথা হল দুপুরে খাওয়ার সময়। গোপেশ্বর দু'জনের হাসির আওয়াজ দোকান থেকে শুনতে পেল, সাথে ভাইপো-ভাইঝির গলার উচ্ছ্বাস, নিজের মনে মনে তার একটা অনুতাপ হল, সেকি বেশি বলে ফেলেছে? আসলে তার পারাদ্বীপের বাকি দুই ভাইয়ের উপর স্নেহের উচ্ছ্বাসটা নানা ঘাত-প্রতিঘাতে যত কমে আসছে, তত তাদের উপর কর্তব্যের তাগিদটা বেড়ে উঠছে। তার নিজের অনেকবার যেতে ইচ্ছা করেছে, কিন্তু কেন যেন যেতে মন সরেনি। বড্ড 'পর' বোধ হয় সেখানে গেলে নিজেকে। সেই না যাওয়ার একটা অপরাধবোধ নীতিনিষ্ঠ গোপেশ্বরের মনে অঙ্কুশের আঘাত করে দিবারাত্র। সেই আঘাতে একটু মলম পড়ত যদি বেলিয়া যেত, সে তো তার প্রতিনিধি এখন। কত চৌখস সে এখন চলনে-বলনে। কত বিষয়ে সে আর মনোরমা নির্ভর করে তার উপর। তার ছেলেমেয়ে দুটোর সব সিদ্ধান্ত তো বেলিয়াই নেয়। মনটা খচ খচ করতে লাগল গোপেশ্বরের, নাহ্, একটু বেশিই বকাঝকা হয়েছে।
দুপুরে খাওয়ার পর গোপেশ্বর বেলিয়ার ঘরে ঢুকল। বেলিয়া শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিল। গোপেশ্বর ঢুকতেই সে বসতে যাবে, গোপেশ্বর তাকে জোর করে শুইয়ে তার মাথার কাছে বসল। বেলিয়ার মাথায় বড় বড় চুল, ঘন। তার মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে গোপেশ্বর বলল, জানিস বেলিয়া, আমি এমনি এমনি তোর উপর রেগে গেলাম, আসলে আমার আরো দুই ভাই এমন অমানুষ হয়ে যাচ্ছে, দাদাটার যে একটু খোঁজ নেবে তাও নেয় না, ক'টা চিঠি আসে বল মাসে? একটাও না। আগে এটা ওটা দরকার পড়ত তারা যোগাযোগ রাখত, সবাই যদি এমন স্বার্থপর হয়ে যাবে তবে মানুষের আর পরিবার করে থাকার কি মানে বল? জঙ্গলে চলে গেলেই হয়... বলতে বলতে গোপেশ্বরের গলাটা বুজে এলো, এতটা অভিমান জমে আছে গোপেশ্বর বোধ করি নিজেও জানত না। বেলিয়া গোপেশ্বরের কোলের উপর মাথাটা তুলে চোখটা বন্ধ করে শুয়ে থাকল, তার চোখের কোনায় চিকচিক করছে জল, এমন কষ্ট পেতে সে কোনোদিন গোপেশ্বরকে দেখেনি, বউদি কই?
মনোরমা রান্নাঘর গোছাতে গোছাতে সবটা শুনছিল, অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল, সে জানে এই কষ্টটার কথা, বেরিয়ে যাচ্ছে এই বরং ভালো, রাগ-কষ্ট যত গভীরে যাবে তত শিকড় ছড়াবে, জীবনীশক্তি শুষে নেবে। কাঁদুক গোপশ্বর। মনোরমা উঠানে গিয়ে বসল উনুন লেপতে। তার বুকের ভেতরের উথাল-পাথালের খবর সে চায় না কাকপক্ষীতে টের পাক।
* * * * * * * * *
পাঠক, আবার গল্পের বাঁক একটা ছোটো উপকূলে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। মৃন্ময়ীর গল্প না বললে বেলিয়ার গল্প এগোব কি করে? বেলিয়ার জীবনে তার বৌদির পরে আরেকজন মানুষ এসেছে, মৃন্ময়ী বন্দ্যোপাধ্যায়। মৃন্ময়ীর সম্বন্ধে একটু বলে নিই, বেলিয়ায় জীবনে এর প্রভাব এখন যথেষ্ট।
মৃন্ময়ীর জন্ম সম্বলপুরে, বাবা প্রবাসী বাঙালী, মা শান্তিনিকেতনের ছাত্রী। মৃন্ময়ীর বাবা ছিলেন স্বনামধন্য চিকিৎসক। মৃন্ময়ীর বিয়ে হয় জলধর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে, যিনি পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, নানা জায়গায় থেকে অবশেষে থিতু হয় এই সালকিয়ায়।
বেলিয়া যখন কলেজ শেষ করল, ধীরে ধীরে দোকানের ভার নিতে শুরু করল তখন জলধরবাবুর সাথে তার পরিচয় হয়। তারপর বেলিয়া বাড়ি বাড়ি মাসকাবারি মাল পৌঁছাতে শুরু করল তার সাইকেলে করে আগেই বলেছি, সেই থেকেই মৃন্ময়ীর সাথে পরিচয় বেলিয়ার।
মৃন্ময়ী বেলিয়ার পরিবারকে উড়িষ্যার জেনে যারপরনাই খুশী। বেলিয়ার সাথে উড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পেয়ে যেন মৃন্ময়ী তার ফেলে আসা দিনগুলোকে খুঁজে পেল। এ ভাষার সাথে তার সমস্ত সত্তা জড়িয়ে, যতই বাঙালি হোক জন্মসূত্রে মৃন্ময়ী, মনের ভাষা যেন উড়িয়া। উড়িয়া গান, নাচ, কথা বলার ধরণধারণ সব কিছুই খুব কাছের। বেলিয়া সেই সূত্রে বড় আপন হয়ে উঠল মৃন্ময়ীর, যেন সে তার বাড়ির লোক। ক্রমে দুই পরিবারের মধ্যে একরকম আত্মীয়তা গড়ে উঠতে শুরু করল। মৃন্ময়ীর চরিত্রের মধ্যে এমন একটা শ্রী, স্নিগ্ধতা, অকৃত্রিম স্নেহর পরশ যে ক্রমে সে যেন নিজের দিদি হয়ে উঠল বেলিয়ার। প্রথম প্রথম মনোরমার ঈর্ষা হত, ভালো লাগত না বেলিয়ার মুখে এত 'দিদি দিদি' ডাক, কিন্তু ওই যে বললাম মৃন্ময়ীর চরিত্রে এমন কিছু একটা ছিল যে তার কাছে পর হয়ে থাকা শুধু শক্ত না, এক প্রকার অসম্ভব ছিল। ক্রমে মনোরমা-গোপেশ্বরেরও সে দিদি হয়ে উঠল। নানা বিষয়ে পরামর্শ নিতে গোপেশ্বরও দিদির কাছে যেতে লাগল। মনোরমা তো যেতই। যদিও মনোরমার থেকে মৃন্ময়ী বয়সে এমন কিছু বড় ছিল না, তবু মনোরমার মনে হত মৃন্ময়ী যেন অনেক বড় তার থেকে। আসলে ভরসাস্থল হয়ে ওঠা মানুষের বয়স তো আর সংখ্যায় মাপা যায় না, সে তখন শুধুই একটা অনুভব, একটা খুঁটি। মৃন্ময়ী সেরকম একজন খুঁটি। মৃন্ময়ীর দুই ছেলে ভুবন আর স্বপন, বেলিয়া তাদের মামা এখন। হাসি আর প্রকাশের মত এদেরও নানা আবদার বেলিয়াকে ঘিরে। স্বপনের চাইতে ভুবন বেলিয়ার চরিত্রের অনেক কাছাকাছি। ভুবন শান্ত, বেলিয়ার কথা শোনে, যা পড়ে তা পড়ে শোনায়, গান শুনতে ভালোবাসে। শুধু সে বড্ড উদাসীন, মাঝে মাঝে মনে হয় অনেক দূরের কেউ যেন। অথচ কতই বা তার বয়েস, এই তো মাধ্যমিক দিল, এর মধ্যেই যেন সে সংসারের বাইরের মানুষ, কোনো কিছুতেই না আছে উচ্ছ্বাস, না আসক্তি। বেলিয়ার ভুবনকে হিংসা হয়, গর্বও হয়। ঈর্ষা হয় ভুবনের নিস্পৃহ আত্মমগ্নতার জন্য, গর্ব হয় সে তাকে যখন 'মামা' ডাকে তার মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা থাকে না বলে। মাঝে মাঝে সে আর ভুবন সাইকেলে করে বেড়াতে বেরোয়। বেলিয়া ভুবনকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যায়। বেলিয়ার খুব ইচ্ছা মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোলে সে তাকে একটা এফ এম রেডিও কিনে দেবে।
স্বপন ভুবনের সম্পূর্ণ উল্টো। সে চঞ্চল, সারাদিন তার এটা-ওটা দুষ্টুমির তাড়ায় দিদির প্রাণ ওষ্ঠাগত, কিন্তু একেও খুব স্নেহ করে বেলিয়া। বেলিয়ার এখন দুটো পরিবার, এক তার নিজের প্রধান পরিবার, দুই এই বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার।
৫
প্রতিদিন মৃন্ময়ীদের বাড়ি কিছুক্ষণ সময় কাটানো এখন বেলিয়ার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। একদিন না গেলে পরের দিন কেউ না কেউ খোঁজ নিতে যায় বেলিয়ার। ভালো কিছু রান্না হলে বেলিয়ার ডাক পড়ে, বাড়িতে কোনো ছোটোখাটো কাজ হলে বেলিয়ার ডাক পড়ে। সে টিউবলাইট লাগানো হোক, অ্যান্টেনা ঠিক করা হোক, ড্রিল মেশিন দিয়ে দেওয়ালে পেরেক লাগানো হোক — সব বিষয়েই বেলিয়াকে দরকার সবার এখন।
ভুবনের মনের মধ্যে বেলিয়াকে নিয়ে একটা মিশ্র অনুভূতি এখন। এমনিতে সে বেলিয়ামামাকে খুবই ভালোবাসে, কিন্তু মা? মায়ের ভালোবাসায় ভাগ বসাচ্ছে না? সেই জন্যেই একটা চোরাগোপ্তা ঈর্ষা কুটকুট করে মাঝে মাঝে ভুবনের মনে। কাউকে বলার নয় যদিও সে কথা।
ভুবনের মনের মধ্যে বেলিয়াকে নিয়ে একটা মিশ্র অনুভূতি এখন। এমনিতে সে বেলিয়ামামাকে খুবই ভালোবাসে, কিন্তু মা? মায়ের ভালোবাসায় ভাগ বসাচ্ছে না? সেই জন্যেই একটা চোরাগোপ্তা ঈর্ষা কুটকুট করে মাঝে মাঝে ভুবনের মনে। কাউকে বলার নয় যদিও সে কথা।
যেদিন মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোলো সেদিন সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ বেলিয়া এসে বলল, চল, তোকে নিয়ে একটা কাজ আছে। কি কাজ হতে পারে? এমনিতেই ভুবনের বেলিয়ার উপর মন খুব একটা অনুকূল যাচ্ছে না ইদানীং, তার ওপর কেউ জোর খাটাক ভুবন একদম পছন্দ করে না। সে একটু কঠিন স্বরেই বলল, আজ তো হবে না মামা, আজ রেজাল্ট বেরোলো, অনেকে আসবে বাড়িতে, আমরা বরং অন্যদিন যাই।
বেলিয়ার মুখটা সাথে সাথে কালো হয়ে গেল। মৃন্ময়ীর চোখ এড়ালো না। মৃন্ময়ী মেঝেতে বসে বসে কুটনো কাটছিল, একবার আড়চোখে বেলিয়ার মুখের দিকে তাকিয়েই ব্যপারটা বুঝে বলল, যা না বাবু, বেশি বাড়াবাড়ি তোর, ওর সাথে একটু যা, যে আসবে আমি কথা বলে নেবখন। ভারি তো রেজাল্ট করেছিস।
ভুবনের মেজাজটা চড়ল। বাইরে কিছু বলল না। একে বেলিয়ার উপদ্রব, দুই মায়ের রেজাল্টের খোঁচা। আশানুরূপ হয়নি ঠিকই তা বলে অতটাও খারাপ হয়নি। আসলে মায়ের অসন্তোষের কারণ যে রেজাল্ট নয়, তার রূঢ় ব্যবহার, সেটা মনে মনে বুঝেছিল ভুবন। সে আর কোনো উচ্চবাচ্চ্য না করে বেরিয়ে গেল বেলিয়ার সাথে।
বেরোতে যাবে, বেলিয়া বলল, তোকে সাইকেল নিতে হবে না, একটু দূরেই যাব। তুই সাইকেল রেখে দে। অবশ্য বেলিয়া ঠিক সাইকেল বলতে পারত না, বলত 'সাইকিল'। পেরেককে বলত 'পিরক'। এই নিয়ে মাঝে মাঝে সে আর তার ভাই মজাও করত বেলিয়ার সাথে।
এবারে আর অমত পোষণ করল না ভুবন, বেলিয়ার সাইকেলের ক্যারিয়ারে পা ঝুলিয়ে বসল। বেলিয়ার সাইকেলের ক্যারিয়ারটা অন্যরকম, বেশ চওড়া আর মোটা রড দিয়ে বানানো, মাসের মাল ভারি ভারি বস্তায় ভরে আনার জন্য। ভুবনের অসুবিধাই হচ্ছিল, কিন্তু সামনে বসবে না, বেলিয়ার মুখে কাঁচা পেয়াজের গন্ধ বেরোয়, ভুবনের ভালো লাগে না গন্ধটা। পেঁয়াজ-রসুন মানুষের কামকে বাড়িয়ে দেয়, বইতে পড়েছে, ভারত সেবাশ্রমের একটা বই এখন পড়ছে ভুবন, ব্রহ্মচর্যের উপর, সেখানে এমন অনেক কথা লেখা আছে, সেগুলো ভুবনকে ভাবায়, ব্রহ্মচর্য ছাড়া শরীর মনের শুদ্ধি হবে কি করে? কেন যে মানুষ ওসব খায়?
হরগঞ্জ বাজার বেশ বড় বাজার। বহু পুরোনো বাজার। বাজারের মধ্যে বড়মার বিশাল মন্দির। এই সালকিয়ায় জগন্নাথের মত মায়ের মূর্তি - বড়মা, মেজমা, সেজমা, ছোটোমা আছে। বড়মার মন্দিরের বিরাট দরজা। ঢুকলেই ছাদ খোলা একটা চাতাল। চারদিকে পায়রা আর পায়রা, তাদের বিষ্ঠা ছড়ানো এদিক সেদিক। মায়ের মূর্তিটা দেখলে যে কেউ বলবে জগন্নাথের মহিলা রূপ। ওরকম বড় বড় চোখ, বিশাল মাথাই শুধু, লাল বেণারসীতে সাজানো, অনেক গয়না গায়ে। প্রতি বছর এক বিশেষ দিনে সব মায়েদের স্নানযাত্রা হয়। সেদিন সালকিয়ার সব স্কুল ছুটি, রাস্তাঘাট বন্ধ থাকে। কত কত রকমের সঙ যায়, দারুণ লাগে ভুবনের। মায়ের কাছে শুনেছে ছোটোবেলায় নাকি সে ছিন্নমস্তা সেজে গেলে ভয় পেত, এখন পায় না। সে দশমহাবিদ্যা নিয়ে পড়েছে।
বাজারে এসে আগে বড়মার মন্দিরে নিয়ে গেল বেলিয়া ভুবনকে। বলল, আগে মা'কে প্রণাম কর, পরীক্ষায় পাশ করলি। মন্দিরে এলে সবসময় মনটা ভালো হয়ে যায় ভুবনের। এখনও হয়ে গেল। একটু লজ্জাই পেল নিজেকে নিয়ে কেন যে মিছিমিছি অমন একটা বাজে ব্যবহার সে বেলিয়ার সঙ্গে করল আজ বেলিয়ার সাথে বেরোতে হবে শুনেই। মা বারবার বলেন, জানিস তো মা নেই বেচারার জন্ম থেকে। আসলে ভুবন জানে যে তার মা তার ঈর্ষার ব্যপারটা বোঝে। কথাটা মিথ্যা ভাবেনি ভুবন, মৃন্ময়ী জানে ছেলের ঈর্ষাটা। কিন্তু এই সব প্রশ্রয় দেওয়া মানে ছেলেকে দুর্বল করে মানুষ করা। মানুষের দুর্বলতা থাকবে না তা তো নয়, কিন্তু তাকে একবার লাই দিলে সে মানুষের স্বভাবে এমনি জাঁকিয়ে বসে যে সারাজীবন সেটা দূর হওয়ার নয়। তাই একটু কঠিনই এই বিষয়ে মৃন্ময়ী।
বড়মা-কে প্রণাম করে বেলিয়া আর ভুবন পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। বেলিয়া ভুবনকে বাঁদিকে রেখে, একহাতে ডানদিকে সাইকেলটাকে নিয়ে হাঁটছে। বাজারে প্রচণ্ড ভিড়, এই সময় এরকমই থাকে। বেলিয়া একটা ইলেকট্রিকের দোকানের বাইরে সাইকেলটাকে স্ট্যাণ্ড করে ভুবনকে বলল, আয়।
দোকানি পরিচিত বেলিয়ার। বেলিয়া ঢুকেই বলল, এসেছে রতনদা?
রতন মাথা নেড়ে দোকানের ভিতরে চলে গেল। এই দোকানটা বাইরে থেকে অনেকবার দেখেছে ভুবন, ভিতরে আসেনি কোনোদিন। ছোটো একফালি দোকান, বড়জোর চারজন মানুষ পাশাপাশি দাঁড়াতে পারে। সামনের তাকে থরে থরে নানা ইলেকট্রিকের জিনিস সাজানো — টুনি, বাল্ব, এটা-সেটা। গান চলছে ছাদের সাথে আটকানো কোনো একটা স্পিকার থেকে, সাঁইয়ের ভজন – ওম সাঁই নমো নমঃ, শ্রী সাঁই নমো নমঃ।
একটু পর একটা কালো রঙের ছোটো একটা ফিলিপ্স-এর রেডিও রতন আবার বাইরে এলো। সামনের কাঁচের পাটাতনটার উপর রেখে বলল, এই কালারটা তো?
বেলিয়ার চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে হেসে উঠল, সে হাতে নিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, এটাই। কেমন সাউন্ড একটু চালাও।
রতন রেডিওটা হাতে নিয়ে দুটো নতুন পেন্সিল ব্যাটারি ভরে অন্ করল। একটা স্টেশানে দাঁড়িয়ে আওয়াজটা শোনার চেষ্টা করল, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান হচ্ছে, তবে একটু নয়েজ আসছে। বেলিয়ার কোঁচকানো ভুরুর দিকে তাকিয়ে, একটু হেসে রতন বলল, ভিতরের দিকে তো দোকানটা আমার, আওয়াজটা হেজি আসছে, বাড়িতে নিয়ে গিয়ে শোনো, খারাপ হলে আমি তো আছি।
ভুবন লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। ছি ছি এত দামী জিনিস কেউ কাউকে দেয়? একবার বলতে চেষ্টা করল, এটার দরকার ছিল না মামা, বাড়িতে একটা বড় রেডিও তো আছে। কিন্তু বলতে পারল না, যদি কিছু মনে করে। তবে তার সম্পূর্ণ নিজের একটা রেডিও হবে ভাবতেও বেশ উত্তেজনা লাগছিল। কিন্তু তবু, বেশ দামী তো!
রেডিও কিনে ফেরার সময় ভুবন বলল, আমি বরং সামনেই বসি, পিছনে ক্যারিয়ারটায় পায়ে খুব লাগে।
* * * * * * * * *
ভুবনের বেলিয়ার উপর বিরূপ মনোভাবটা কেটে গিয়েছিল একটা ঘটনায়। সেটা বলেই এই অধ্যায়টা শেষ করি। সেদিন স্বপনের জন্মদিন ছিল। স্বপনের জন্মদিনটা পুজোর ছুটির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। বাড়িতে প্রচুর আত্মীয়স্বজন। মৃন্ময়ীর ভাশুর আর জা, শশধর আর বুলবুল এসেছে, সঙ্গে তাদের দুই মেয়ে। মৃন্ময়ীর ছোটোবোন এসেছে ভুবনেশ্বর থেকে, তার বর আর এক মেয়ে। বাড়ি গমগম করছে। মৃন্ময়ী রাঁধতে যেমন ভালোবাসে খাওয়াতেও তেমনই। সকাল থেকে চলছে সেই পর্ব। রান্নার পুরো কাজটা সে একাই দেখছে। এই একটা ব্যপারে মৃন্ময়ীর একটু শুচিবাই আছে, রান্নাঘর সহজে সে কারোর হাতে ছেড়ে দেয় না, যদি নোংরা করে ফেলে। মাঝে মাঝে এই নিয়ে সে ভুবনকেও বলে, বাবু দেখ, তোর বউয়ের সাথে আমার এই রান্নাঘর নিয়েই একটা দক্ষযজ্ঞ বাধবে।
সে যা হোক, সন্ধ্যেবেলা আরো অনেক অতিথি এসেছে। বেলিয়ার কলকাতায় কিছু একটা কাজ আছে তাই আসতে আসতে সন্ধ্যে হবে, বলেই গেছে। বাড়িতে অতিথি সমাগম যখন তুঙ্গে তখন বেলিয়া একটা প্লাস্টিক হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে ঢুকল, স্বপনের হাতে দিয়ে, একটু হেসে বলল, বৌদি পাঠিয়েছে। স্বপন প্লাস্টিকের ভিতর থেকে একটা লালের উপর কালো ছিটছিট জামার ছিট পেল, সেটা হাতে নিয়ে একটু হেসে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ মামা, তারপর বেলিয়ার একটা-দুটো কথা বলে নিজের বন্ধুদের সাথে আবার মত্ত হয়ে গেল। বেলিয়ার খুব অস্বস্তি লাগছে, সে তেমন সহজ কারোর সাথে হতে পারে না শুধু এই বাড়ির লোকগুলো ছাড়া। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে তার ভীষণ রাগই হচ্ছে। সে দু'দিন আসেনি মৃন্ময়ীর বাড়ি, তা-ও কেউ খোঁজ নিতে যাওয়ার প্রয়োজন অবধি বোধ করেনি। রাগে-অভিমানে সে ইচ্ছা করেই আজ কলকাতার কাজটা নিয়েছিল, ওটা দু'দিন পরে করলেও অসুবিধা ছিল না। এটা সত্যি যে মৃন্ময়ী একরকম ভুলেই গিয়েছিল যে দু'দিন বেলিয়া আসছে না। বেলিয়ায় চরিত্রে অভিমান ভীষণ বেশি তাও জানে মৃন্ময়ী, কিন্তু দু'বারই মনে পড়েছে রাতে শুতে যাওয়ার সময়, তখন কি করে কাউকে পাঠানো যায়? তা ছাড়া ছোটোবোন মাধবী এলে আর কোনোদিকে তেমন একটা খেয়ালও থাকে না মৃন্ময়ীর সে জানে।
বেলিয়া বড়ঘরের পাশের একটা ছোটো বারান্দায় গিয়ে একটা টুলে বসল। এইদিকে তেমন কেউ একটা আসে না। কয়েকটা বাচ্চা খেলছে শুধু। একটা বই হাতে নিয়ে যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে পাতা ওল্টাতে লাগল। একটু পর মৃন্ময়ী এল, হাতে একটা বড় থালা, তাতে চারটে লুচি, মাংসের বাটি, পায়েসের বাটি, হালুয়া আর কয়েকটা মিষ্টি সাজানো। বেলিয়ার সামনে থালাটা রেখে বলল, তুই খা, আমি ওদিকটা দেখে আসি। ভুবনকে বলে গেল, মামাকে একটু জল দিয়ে যা বাবু।
বেলিয়া চোয়াল দুটো শক্ত করে নিজের কান্নার বেগটা সামলালো। একবার জিজ্ঞাসাও করল না, কেন আসিস নি রে বেলিয়া দু'দিন? কেনই বা জিজ্ঞাসা করবে, সে তো হাজার হলেও পর, এই যদি সে নিজের ভাই হত, পারত?
এরকম নানা কান্না ঠেলা কথা তার মাথা বুক ঘুরে ফিরে তাকে বিহ্বল করে দিতে লাগল। এরই মধ্যে হঠাৎ করে মৃন্ময়ী তার সামনে এসে দাঁড়াল, আঁচলে মুখের ঘামটা মুছতে মুছতে জিজ্ঞাসা করল, দু'দিন আসিসনি কেন রে বেলিয়া? উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল, এই হালুয়াটা আমি বিশেষ করে তোরই জন্য করলাম, তুই এত ভালোবাসিস খেতে, এরা তো কেউ পছন্দ করে না তেমন।
আরেকটু হলেই বেসামাল হয়ে যাচ্ছিল বেলিয়া, ভাগ্যে ভিতর থেকে কেউ একজন ডাকল মৃন্ময়ীকে। বেলিয়া চোখদুটো মুছে খেতে শুরু করেছে। কই অভিমান তার? একটুও নেই। কিন্তু শেষরক্ষা হল কই? আরেকটু পর যখন একটা গামলায় আর কয়েকটা গরম ফোলা লুচি নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে মৃন্ময়ী, বেলিয়া হঠাৎ করে মাথাটা নীচু করে ফুঁপিয়ে উঠল। মৃন্ময়ী তাড়াতাড়ি লুচির গামলাটা টেবিলের উপর রেখে বেলিয়ার মাথাটা তুলে উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করল, কি হল রে বেলিয়া?
বেলিয়া তার নাকটা এঁটো ডান হাতের পিছনটা দিয়ে মুছে, বলল, তোমার বাড়িতে কত লোক, কত আত্মীয়, তবু তুমি আমি এখানে বসে খাচ্ছি মনে রেখেছ, আমি কে তোমার? কে বলো, কে?
বেলিয়ার চোখ থেকে বড় বড় জলের ফোঁটা গাল গড়িয়ে পড়ছে, বেলিয়া প্রাণপণ নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু এই দুদিনের অপ্রকাশিত অভিমান, নানা নঞর্থক চিন্তার গ্লানি সব মিলে সে যেন কান্নার তোড় আর সামলে রাখতে পারছে না। ভুবন বেলিয়ামামার আর জল লাগবে কিনা জিজ্ঞাসা করতে এসে, এই দৃশ্যের সামনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে। হাতে জগ ভর্তি জল। মৃন্ময়ীর সারাদিনের পরিশ্রমের জন্য তৈলাক্ত গাল বেয়ে জল গড়াচ্ছে, সে বুজে আসা গলায় বলল, পাগলের মত বকিসনি বেলিয়া, খেয়ে নে... তুই আমার কি সে আমার অন্তর্যামীই জানেন।
মৃন্ময়ীর অন্তর্যামী কি জানেন তা বলতে পারি না, কিন্তু ভুবনের অন্তর্যামী সেদিন সমস্ত ঈর্ষা, কটু ব্যবহারের জন্য ভুবনের দিকে যে ভ্রুকুটি করেছিল তা ভুবন বোধ করি সারাজীবন ভুলতে পারেনি। আর কোনোদিন সে বেলিয়াকে না তো রূঢ় কথা বলেছে, না তো কোনো ঈর্ষাকে নিজের মনে স্থান দিয়েছে।
৬
কিন্তু বেলিয়ার সাথে মৃন্ময়ীদের পরিবারের এই সহজ সম্পর্কটা ক্রমে বিষাক্ত হয়ে উঠতে লাগল পুষ্প'র কাছে। পুষ্প ঘোষ, মৃন্ময়ীর প্রতিবেশী, প্রায় পাশাপাশি বাড়িই বলা যায়। পুষ্প'র বয়েস বেলিয়ার কাছাকাছিই হবে। সে আসানসোলের মেয়ে, পুষ্প'র স্বামী লিলুয়ায় রেলের ফোরম্যান, একটা ছোটো মেয়ে আছে। পুষ্প মৃন্ময়ী এখানে আসার অনেক পরে আসে। মৃন্ময়ীর সাথে পরিচয় হওয়ার পর দুই পরিবারের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্কও গড়ে উঠছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে পুষ্প মৃন্ময়ীকে নিজের প্রতিযোগী ভাবতে শুরু করে, বোধহয় নিজের অজান্তেই। মৃন্ময়ীর পছন্দের খুঁত বার করে, মৃন্ময়ীর বাংলা উচ্চারণে প্রবাসের টানকে নিয়ে মজা করে, মৃন্ময়ীর সংসারে সবকিছুর সাথে এত ওতোপ্রতো জড়িয়ে থাকাকে প্রাচীন যুগের ধ্যানধারণা বলে ব্যঙ্গ করে – কিন্তু এ সবটাই করে সে হাসির ছলে। মৃন্ময়ী সবটাই বুঝতে পারে। তবে একে সে পুষ্প'র স্পর্ধা বলেও দেখে না, নির্বুদ্ধিতাও বলে না। ভুবন বা অন্য কেউ এই বিষয়ে কিছু বললে মৃন্ময়ী হেসে বলে, আরে ওর বয়েসটা দেখো, কতটুকু মেয়ে, এখানে তেমন করে কারোর সাথে মিশতে পারে না, ওর বরের সাথেও যে খুব মেলে ওর তাও নয়, তবে ও থাকবে কি নিয়ে? ওটুকু মেনে না নিলে কি আর সবাই মিলে থাকা যায়?
মৃন্ময়ীর তার প্রতি এই প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের কথা কি পুষ্প’র অজানা? তাই কি হয় পাঠক? একটা জন্তুও কে তার প্রতি সদয় আর কে নির্দয় অনুমান করে নিতে পারে, এ কারোর কাছে শিখতে হয় না। পুষ্পও জানে সব, বোঝে সব, কিন্তু নিজের স্বভাবের কাছে সে নিরুপায়।
পাঠক, একবার নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করে দেখো দেখি, নিজের স্বভাবের কাছে নাস্তানাবুদ হওয়া কি আমাদের ভবিতব্য নয়? আমি মহাপুরুষদের কথা বলছি না, তাদের কথা স্বতন্ত্র, কিন্তু আমরা? আমরা কি বুঝেশুনেও নিজেদের আটকাতে পারি? তাই পুষ্পও যদি না পারে তবে তা মেনেই নিই না কেন? পুষ্প জানে বলেই তো তার তরকারিতে বেশি নুন হয়ে গেলে, ভাতটা জলের অভাবে পুড়ে গেলে, কাঁচা দুধে বেড়ালে মুখ দিলে, তার পোষা বেড়াল হারিয়ে গেলে – সব সান্ত্বনা খুঁজতে তো সে মৃন্ময়ীর আঁচলের ছায়াই খোঁজে। যখন তার গলব্লাডার অপারেশান হল, সে বড় মুখ করে তার বাড়ির লোককে জানিয়ে দিল, আমি এখানেই থাকব, দিদির কাছে, আমার কারোর দরকার নেই। সে কিসের জোরে এ কথা বলল পাঠক? সে জানে তার বাপের বাড়িতে তাকে দেখাশোনা করবে তেমন কেউ নেই, আর শ্বশুরবাড়ির কথা তো দূর অস্ত। তবে? তাই সে মৃন্ময়ীকেই তার আশ্রয় জানে, মানে। মৃন্ময়ীও তাকে নিজের মেয়ের মতই সেবা করে সুস্থ করে তুলল।
এ সব বেশ আগের কথা পাঠক। আমরা আবার আমাদের গল্পে ফিরি। এবারের গোলমালটা ভালোরকম শুরু হল বেলিয়াকে নিয়ে। বেলিয়ার মৃন্ময়ীদের বাড়ির লোক হয়ে ওঠাকে ভালো চোখে দেখল না পুষ্প। তার মধ্যে একটা ঈর্ষা কাজ করতে শুরু করল। এ ঈর্ষা ঠিক জ্বালায় না তাকে, কোথাও যেন অস্থির করে তোলে। বেলিয়াকে যেন তারও খুব দরকার। বেলিয়াকে দেখলে ভালো লাগে পুষ্প’র। কেন লাগে সেটা সাহস করে খুঁজে দেখতে চায় না, কিন্তু ভালো লাগাটাই যে ঈর্ষাকে যত্ন করে জাগিয়ে রাখছে সেটা স্পষ্ট বোঝে পুষ্প। সে এখানে সেখানে বলে বেড়াতে লাগল যে মৃন্ময়ীদের বাড়ির লোকেরা সব বেলিয়াকে বোকা পেয়ে নানা কাজ করিয়ে নেয়, বেদম খাটায়, পুরো পরিবারটাকেই শোষণ করছে তারা ইত্যাদি ইত্যাদি। এ কথাগুলো যে সম্পূর্ণ মিথ্যা তা পুষ্প ছাড়া বোধ করি সালকিয়ার এ তল্লাটে আর কেউ জানে না এতটা স্পষ্ট করে। আর মিথ্যা বলেই পুষ্প’র যেন সেই কথাটায় রঙ চড়িয়েও সুখ হত না, বারবার বলেও সুখ হত না। সে যেন প্রাণপণ বিশ্বাস করতে চাইত এই মিথ্যাটাকে, কিন্তু বিশ্বাস করার মতো না তো নিজের মনকে পুরো রাজি করাতে পারত, না নিজের মুখ অন্য কথা নিয়ে শান্তি পেত।
মৃন্ময়ীর এই কথাগুলো বুকে বাজত, কষ্ট পেত। তাকে পুষ্প যাই বলুক, কিন্তু ওই অভাগা ছেলেটাকে এর মধ্যে জড়ানো কেন? এদিকে এখন থেকে নানা কাজে পুষ্পও বেলিয়াকে ডাকতে শুরু করল। বেলিয়া না বলতে পারত না, সে ভাবত তার দিদিকে যখন এত শ্রদ্ধা করে তখন নিশ্চয়ই তার সেখানে যাওয়া উচিৎ। মৃন্ময়ী দু-একবার বারণ করবে ভেবেও বারণ করতে পারেনি। সরাসরি পুষ্পকে বলতে চেয়েও বলতে পারেনি মৃন্ময়ী, এত ছোটোকথা বলতে জিভে বাধে, মন ছোটো হয়ে যায়।
এদিকে কয়েক মাস যেতে না যেতেই বেলিয়ারও কোথাও একটা খটকা লাগা শুরু হয়েছে পুষ্পকে নিয়ে। একদিন মৃন্ময়ী রুটি করছে, সন্ধ্যেবেলা, বেলিয়ার দোকানে কাজ নেই, সে রান্নাঘরের দরজার কাছে বসে গরম রুটি আর ছোলার ডাল খাচ্ছে, হঠাৎ এ কথা সে কথার পর বলল, জানো দিদি, ওবাড়ির দিদি কেমন কেমন কথা বলে যেন।
ওবাড়ির দিদি – কথাতেই মৃন্ময়ী বুঝেছে সে কার কথা বলতে চাইছে। তার রুটি বেলার গতিটাও কমে আসল, অমনোযোগীতার ভান করে কানটাকে সতর্ক করে বলল, কোন দিদির কথা বলছিস?
বেলিয়া রুটি চিবোতে চিবোতেই বলল, আরে ওই পুষ্পদিদি গো, কি সব যেন বলে।
মৃন্ময়ী একবার ভাবল শোনে যে সে তার বেলিয়াকে কি কি বিষাক্ত মন্ত্রণা দিয়েছে। তারপরেই ভাবল সংসারে বিষের তো অভাব নেই, তা নিয়ে যত নাড়াঘাটা করো তত বেড়ে যায়। মানুষের গুণই বলো আর দোষই বলো, যেটাই বাড়াবে সেটাই বেড়ে যাবে। মৃন্ময়ী নিজেকে সংযত করে বলল, তোর কান না দিলেই হল, মানুষের জিভটা তার হাতে, কানটা তোর হাতে বেলিয়া।
কিন্তু ও যে তোমার ব্যাপারে...।
আঃ বেলিয়া, ওরম বলতে নেই। একে পরনিন্দা বলে, কারোর পেছনে ওসব বলতে নেই, আর তোর দিদিকে কে কি বলল তাতে তোর কি? তুই তোর দিদিকে চিনিস না?
বেলিয়া একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে বলল, তা চিনি, কিন্তু...
কোনো কিন্তু নয় বেলিয়া, একটু বুঝেশুনে সংসারে চলতে হয়, রাস্তার ধারে তো নর্দমা আছে, তুই কি সেই নর্দমা ধরে ধরে আসিস না রাস্তা দিয়ে? সেরকম এড়িয়ে যাবি...
একগাল হেসে বেলিয়া বলল, তুমি বড্ড অন্যরকম।
মৃন্ময়ী হাসল। তার মনের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করেই যাচ্ছে, কতদূর সে এ বিষকে ঠেকিয়ে রাখবে, কিছু কি বলা উচিৎ?
যা হোক, বেলিয়া একরকম বুঝেশুনেই চলতে শুরু করেছে এখন। কিন্তু সংসার তো জঙ্গল। বিধি শিকারী, কাকে কোন ফাঁদে আটকায় তা কেউ জানে না।
পাঠক, এইবার মনের আরেকদিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রয়াস পাই। বেলিয়া প্রায় তিরিশের কাছাকাছি এসে পৌঁছিয়েছে। সে পণ করেছে সরকারি চাকরি না পেয়ে কিছুতেই বিয়ে করবে না। কারণ বেলিয়া জাতে উঠতে চায়। তার মনে হয় তার দাদারা যে জীবনটাকে বেছে নিয়েছে সে তাদের নিরুপায় ভবিতব্যের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছুই না। মনে মনে সে এ জীবনটাকে ঘেন্না করে। যত তার বয়েস বাড়ছে তত তার এই ক্ষোভটা মাথা চাড়া দিচ্ছে। মনোরমা বুঝতে পারে বেলিয়া কোথাও একটু বদলে যাচ্ছে, কিন্তু কোথায় বদলে যাচ্ছে সে টের পায় না। সে অশিক্ষিত নারী, পুরুষের আকাশকুসুম স্বপ্নের বিলাসিতার সময় তার কই? ঈশ্বর, সমাজ আর নিজের পরিবারের মধ্যে খিদে আর ভদ্রতার সাম্যতা রাখতে রাখতে তার চুলে অল্প অল্প পাক ধরেছে। চেহারায় একটা ভারিক্কি ভাব এসেছে। যতটুকু আছে সেইটুকুতে সংসারটাকে প্রতিদিন এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই সব তার জীবনের। তার জন্য না আছে বাহবা, না আছে সহানুভূতি, না আছে বন্ধুত্ব। অভিযোগ বরং ক্রমে ক্রমে জমে উঠছে পাহাড় প্রমাণ। প্রকাশের অভিযোগ, গোপেশ্বরের অভিযোগ, ইদানীং বেলিয়ারও অভিযোগ। মনোরমা অনেকবার গোপেশ্বরকে বলেছে বেলিয়ার বিয়ের ব্যবস্থা করতে, মেয়েও দেখা হয়েছে পারাদ্বীপে, কিন্তু বেলিয়া বেঁকে বসেছে। সে এই গড্ডালিকা প্রবাহে কিছুতেই ঢুকবে না। উঠানের একদিকে তার জন্য একটা ছোটো বেড়ার ঘর বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, একজন মানুষ কোনোরকমে মাথা গুঁজে থাকতে পারে এমন তার পরিসর, মাথার উপর টালি।
বেলিয়ার যখন কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না সে এই ঘরে চৌকির উপর শুয়ে পড়ে আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখে। তার মনে হয়, জলধরদা যদি তার জন্যে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। সে অনেকবার বলেছে, জলধর হাসে, বলে, আমার কি সে ক্ষমতা আছে রে বেলিয়া? বেলিয়া কিন্তু নিশ্চিত জানে জলধরদা পারে, চাইলেই পারে। এতবড় পোস্টে কাজ করে জলধরদা, বাড়িতে গাড়ি আসে নিতে, প্রায়ই কাজে দেশ-বিদেশ প্লেনে চড়ে যেতে হয়, সে পারে না?
কথাটা খুব মিথ্যা নয়। জলধরের ইতিমধ্যে সত্যিই পদোন্নতি হয়েছে। আয়ের পরিমাণ বেড়েছে, কানাঘুষোয় এমনও শোনা যাচ্ছে তারা নাকি এই বাড়ি বিক্রি করে উত্তরপাড়া, নয় লিলুয়ার দিকে চলে যাবে। তবে বেলিয়াকে চাকরি দেওয়ার ব্যাপারটা কোনোদিনই সিরিয়াসলি নেয়নি জলধর। নীতির বাইরে সে যাবে না। বেলিয়া কেন, ভুবন বা স্বপনের জন্যেও কোনোদিন যাবে না। সে নিজে কত খেটে পরিশ্রম করে আজ এই জায়গায়। পরিশ্রম করলে ফল পাওয়া যাবে না বিশ্বাস করে না জলধর। সে বেলিয়াকে বলে, তুই তোর পড়া নিয়ে আমার কাছে বোস রবিবার করে, আমি তোকে পড়াচ্ছি, আমি তোর সাথে খাটছি, কিন্তু চাকরি তোকে নিজে নিজেই পেতে হবে বেলিয়া।
বেলিয়ার তবু মনে হয় এ যেন কথার কথা। আসলে জলধর সময়ের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু মনে মনে একটা হতাশাও আসতে শুরু করেছে তার, যদি না হয়?
পুষ্প এই সুযোগটাকে টোপের মত ব্যবহার করল। একদিন কোনো এক সময়ে নিজের অজান্তেই বেলিয়া নিজের মনের অবস্থাটা পুষ্পের কাছে বলে ফেলে। পাঠক, এইখানে গল্পটাকে এগোবার আগে পুষ্পকে নিয়ে ক'টা কথা বলে নিতে হয়। পুষ্প সুন্দরী। আসানসোলে তার বাবা রেলেই কাজ করত। পুষ্প'র বর, মানে দিব্যেন্দু, আসানসোলেই সিগন্যাল ইন্সপেক্টর হিসাবে জয়েন করে। পুষ্প তখন সদ্য গ্র্যাজুয়েট হয়েছে। পুষ্প'র চাইতে দিব্যেন্দু বছর পনেরো বড়ো, কিন্তু হলে কি হবে সরকারি চাকরির এই দুর্দিনে এমন একটা পাত্র হাতছাড়া করতে কিছুতেই মেনে নিতে পারল না পুষ্প’র বাবা আনন্দমোহন। ওদিকে দিব্যেন্দুর বিয়েটাও হব হব করেও হচ্ছিল না, সাতকূলে তেমন কেউ নেই দিব্যেন্দুর। পুষ্পকে দেখে তাই না বলার আশু কোনো কারণ সে খুঁজে পেল না। কিন্তু বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বুঝেছিল দিব্যেন্দু যে আনন্দমোহনবাবুর লোভ আর পুষ্প’র দৈহিক সৌন্দর্যের প্রতি তার আসক্তি ছাড়া আর কোনো কারণেই বিয়েটা সম্ভব হত না যদি তারা আগে দু’জন দু’জনকে চিনবার সুযোগ পেত। দু'জনে দুই মেরুর মানুষ। দিব্যেন্দু স্বল্পভাষী, মিতব্যয়ী, শান্ত, ধীরস্থির। পুষ্প সম্পূর্ণ তার বিপরীত। এমনকি তাদের মধ্যে বিবাদ উপস্থিত হলে, সে ন্যায্য অন্যায্য যাই হোক না কেন, নিজের পক্ষ সমর্থন করতে পর্যন্ত ইচ্ছা করত না দিব্যেন্দুর। একবার তো এতদূর গড়িয়েছিল তার এই নিরুত্তাপ প্রতিক্রিয়ার জের যে পুষ্প স্নানের জন্য তৈরি গরম জল দিব্যেন্দুর গায়ে ঢেলে দিয়েছিল। আজও থাইয়ে সে দাগ বহন করে বেড়াচ্ছে দিব্যেন্দু। কাছের মানুষ কারণটা জানে, দূরের মানুষ জানে এ বাজি ফাটার দাগ।
পুষ্প'র তাপ তাই শুধু মনেই যে সীমাবদ্ধ ছিল তাই নয়, শরীরেও তার আঁচ এসে লাগত। বেলিয়া যখন তার নিজের দুর্বলতাটুকু মেলে ধরল তার সামনে সে বুঝলই না যে সে নিজের অজান্তে জীবনের কোন বাঁকে এসে দাঁড়ালো।
পুষ্প দিব্যেন্দুর কাছে যতরকম কৌশল ছিল তার সবকটাকে ব্যবহার করে এইটুকু কথা আদায় করে নিল যে সে বেলিয়ার রেলে চাকরির জন্য চেষ্টা করবে। মনে মনে যদিও জানত এ হয়তো অসম্ভব। ওদিকে জীবনে হয়তো এই একটাই ছলের আশ্রয় নিয়েছিল দিব্যেন্দু গৃহশান্তি টিকিয়ে রাখার আর নিজের ভীরুতাকে আড়াল করার জন্য, কিন্তু তার শোধ তাকে কিভাবে করতে হয়েছিল তা আগামী দিনগুলোতেই সে টের পেয়েছিল।
আমরা এইটুকু বলে এই অধ্যায়ের বিরাম টানি যে বেলিয়া সর্বান্তঃকরণে দিব্যেন্দুর ওই মিথ্যা সম্মতিকে ধ্রুবসত্য বলে নিজের মধ্যে গ্রহণ করল, ও বিশ্বাস করল সুদিন তার সামনেই, তার দরজায় আঘাত করতে উদ্যত।
৭
মাস ঘুরতে না ঘুরতেই মনোরমা আর গোপেশ্বর দু’জনেই টের পেল হাওয়া ঘুরতে শুরু করেছে। জগন্নাথ ভাণ্ডারের ভিড় কমছে, মা কালী স্টেশানারী ফুলে ফেঁপে উঠছে। কয়েকজন বাঁধা খদ্দের অবশ্য গেল না মা কালীতে, কিন্তু তারাই বা কত সংখ্যায়? এদিকে সংসারের খরচ আগের তুলনায় এখন অনেক বেড়ে গেছে। একে তো জিনিসের দাম বাড়ছে রোজ, তায় এটা-ওটা প্রয়োজনও বাড়ছে। হাসি পড়াশোনায় ভালো, সে একটা বড় কিছু হতে চায়। গোপেশ্বর আর মনোরমা দু’জনেই জানে হাসি একটা কিছু করবে, এমন অধ্যবসায় তার। একটা ভালো স্কুলে পড়ানোর খরচ তো আছেই, তার সাথে প্রাইভেট টিউশান। কিন্তু পড়াশোনায় কোনো অভাব রাখতে চায় না গোপেশ্বর আর মনোরমা। প্রকাশের পড়াশোনায় অত মন নেই। সারাদিন খেলে বেড়ায়, খেলায় ভীষণ ঝোঁক তার। অনেক বায়না করার পর এখানেই একটা ক্রিকেট শেখানোর ক্লাবে ভর্তি করতে হয়েছে প্রকাশকে। লোকে বলে বটে প্রকাশের নাকি খেলায় ভালো ভবিষ্যৎ, মনোরমার বিশ্বাস হয় না, গোপেশ্বরেরও না। তাদের মনে হয়, তাদের মত পরিবারের ছেলে খেলে কি কিছু করতে পারবে আদৌ? এগুলো আকাশকুসুম কল্পনা না? বেলিয়াকেও তেমন পায় না মনোরমা আর গোপেশ্বর আগের মত। সে যেন কি একটা নেশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা দিবাস্বপ্নে বিভোর সে। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে বেলিয়া আজকাল। বড়বাজার থেকে মাসের মাল আনতে এটা-ওটা ভুল হয়ে যাচ্ছে, মনোরমা কিছু বললে আগে যেমন তৎপর হয়ে কাজটা করে ফেলত, এখন কেমন একটা উদাসীনতা বেলিয়ার। সব কাজেই আগের মত উৎসাহ দেখায় না, নিজের ঘরেই থাকে বেশিরভাগ সময়, সামনে একটা বই খোলা, চাকরির বই। কিন্তু মনোরমা বুঝতে পারে বেলিয়া পড়ছে না, বেলিয়া স্বপ্ন দেখছে, কিছু একটা কল্পনায় বিভোর।
তবু এই লড়াইয়ের মধ্যে একটা টানাপোড়েন ছিল, কিন্তু উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ছিল না। কোনোরকমে চালিয়েই নিচ্ছিল গোপেশ্বর আর মনোরমা। বেলিয়াকেও বাড়ির সব ব্যাপারে জড়াতে চাইত না মনোরমা আর গোপেশ্বর, তার অনীহাকে প্রশ্রয়ই দিত। কিন্তু সমস্যা শুরু হল হাসিকে নিয়ে। হাসি মাঝেমাঝেই বলতে শুরু করল তার মাথা ব্যথা করছে, চোখদুটো টেনে আসছে, ঘুম আসছে না, বমি বমি পাচ্ছে। প্রথম কয়েকদিন পড়ার চাপ, খাওয়ার অনিয়ম এইসব ভেবে এটা-ওটা করে কাটল। কিন্তু কিছুতেই কমছে না দেখে পাড়ার একজন ডাক্তার দেখানো হল। তিনিও মাসখানেক চিকিৎসা করলেন। একটু কমে তো আবার বেড়ে যায়। হাসির চেহারায় ছাপ পড়তে শুরু করেছে। চোখের কোণে কালি, চোখ দুটো গর্তে ঢুকে যাচ্ছে, খাওয়া কমে গেছে। স্কুল থেকে একদিন বিভা ম্যাডাম ডেকে পাঠালেন গোপেশ্বর আর মনোরমাকে। সবাই ভীষণ চিন্তিত হাসিকে নিয়ে, বিভা ম্যাডামই বললেন একবার মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়ার জন্য হাসিকে।
মেডিক্যাল কলেজ নিয়ে যাবে কে? মনোরমা তেমন কিছুই চেনে না প্রায়। ওদিকে গোপেশ্বরের পক্ষে দোকান বন্ধ রেখে যাওয়াও সম্ভব না, একে তো খদ্দের কমছে, এরপর যদি দোকান বন্ধ হয় মাঝে মাঝে তবে তো আরো মুশকিল, যেক’জন আসে তারাও আসবে না। অগত্যা মন থেকে না চাইলেও মনোরমা বেলিয়াকেই বলল। বেলিয়া এসব যে খেয়াল করেনি তা নয়, কিন্তু সে যেন একটা অন্যজগতে থাকে আজকাল, তার এই বাড়ি, এই পরিবার সবকিছুই কেমন একটা স্বপ্ন বলে মনে হয়।
বেলিয়াই একদিন হাসিকে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজ গেল। বেশ কয়েকবার যেতে হল। ধরা পড়ল এক বিরল স্নায়ুর রোগ, এই রোগে মানুষ মারা যায় না চট্ করে, কিন্তু স্মৃতিশক্তি, চিন্তাশক্তি কমে যায় ধীরে ধীরে। চিকিৎসার খরচও অনেক। প্রতি মাসে হাজার টাকার ওষুধ। টাকার জোগাড় না হয় কিছু করে হল, মেয়েটার ভবিষ্যৎ? কে বিয়ে করবে ওকে? মনোরমা আর গোপেশ্বরের রাতের ঘুম উড়ে গেল। দু’জনেই পাশাপাশি শুয়ে থাকে, কেউ কারোর সাথে কথা বলে না, কিন্তু বোঝে দু’জনেই জেগে আছে। কি হবে? এই একটাই নিরুত্তর প্রশ্ন অঙ্কুশের মত বেঁধে মনোরমাকে।
হাসিকে রীতিমতো সুন্দরী বলা যায়। তার গায়ের রঙ, নাক-চোখ, শরীরের গড়নে সে অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। এত রূপ কেন দিলেন তবে বিধাতা? মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে বুকটা ফাঁকা হয়ে যায় মনোরমার, কে দেখবে ওকে, কার কাছে রেখে যাবে? বেলিয়া ফেলবে না, কিন্তু ওর বউ? সে যদি অন্যরকম হয়, হতেও তো পারে, সে কেন এ বোঝা নেবে?
মাঝরাতে মাঝে মাঝে উঠানে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে মনোরমা। বড় একটা নিমগাছ উঠানের একপাশে। সেই গাছের তলায় মনোরমা নিজের ছোটোবেলাটা খুঁজে পায়। তার মামাবাড়িতে এমন একটা নিমগাছ ছিল যার তলাতেই সে মন খারাপ লাগলে বসে থাকত। নিমগাছের কাঠেই তো জগন্নাথের কলেবর হয়, নিমগাছেই তো নিমাইয়ের দেহ। হা মহাপ্রভু! যেন জন্মজন্মান্তরের কান্না এসে রাতের অন্ধকারে একা একা ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় মনোরমাকে। কিন্তু কাঁদবে কার কাছে, হা জগন্নাথ, হা মহাপ্রভু, কোথায় যাই, কি করি? এক এক সময় দুশ্চিন্তায় যখন কোনো কূল মেলে না মনোরমার মনে হয় মেয়েটাকে বিষ দিয়ে নিজে বিষ খেয়ে নেয়। সহানুভূতি দেখানোর মানুষের অভাব নেই, কিন্তু কতদিন? এই তো শ্রীরাম ঢ্যাং ক’দিন আগেই হাসির অসুস্থতার খবর পেয়ে দেখা করতে এসেছিল। গোপেশ্বরের কাঁধে হাত দিয়ে বলে গেছে হাসির সাহায্যের জন্য যা লাগে সে দিতে রাজি আছে। মৃন্ময়ীদিদিও তাই বলেছে। কিন্তু কতদিন দেবে এরা? সহানুভূতি তো মৌসুমী বায়ুর মত, তারপর?
মনোরমা এখন প্রাণপণে চায় বেলিয়ার একটা চাকরি হয়ে যাক। ছেলেটা চেষ্টাও তো করছে। মৃন্ময়ীকে গিয়ে নিজে বলবে একবার ভেবেছেও মনোরমা। বেলিয়া আগে খুব বলত যে দাদা একটা কাজ করে দেবেই। কথাটা শুনতে ভালো লাগত না মনোরমার, তবে কি বেলিয়া সেই স্বার্থেই ওদের বাড়ি যায়? ছি ছি, এ তো খুব ছোটো কথা। কোনো মতলব নিয়ে চলাকে বরাবর খুব নিচু চোখে দেখেছে মনোরমা। তার মামাদের চরিত্র সে দেখেছে, একটা শ্বাসও তারা বিনা মতলবে নিত না। কি নিকৃষ্ট জীবন তাদের! বেলিয়াও কি তাই চায়? মনোরমা বারণ করত বেলিয়াকে এই নিয়ে কথা বলতে জলধরের সাথে। কিন্তু এখন? এখন কেন তার নিজের মনে হয়? সে তো পরিস্থিতির জন্য, চোখের সামনে মেয়েটা ভেসে যাবে? তাকে দেখে যেতে হবে? না, তা হয় কি করে? মৃন্ময়ীকে সে বলবেই। কিন্তু কবে বলবে আর কিভাবে বলবে সে কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারে না।
নিজেকে ইদানীং আয়নার সামনে দাঁড় করাতে চায় না মনোরমা। আগে স্নানের পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বড় একটা সিঁদুরের টিপ খুব ধীরে ধীরে চিরুনির পিছন দিকটা দিয়ে গোল করা তার একটা নেশার মত ছিল। মুখটা কেমন ভোরের আভা থেকে দিনের উজ্জ্বল আলোয় ভরে যেত। মনোরমার মুখটা চৌকো আর বেশ বড়, ফর্সা, ফোলাফোলা ছিল। এখন মুখের হাড়গুলো বেরিয়ে গিয়ে দ্রষ্টব্য বলতে শুধু বড় বড় চোখদুটো। সে চোখে আগের মত প্রশান্তি কই? একটা চাপা উদ্বিগ্নতা, আকুতি, যেন খড়কুটো খোঁজার জন্য হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
এখন স্নানের পর তাই কোনোরকমে সিঁদুরটা কপালে, সিঁথিতে লাগিয়ে মনোরমা রান্নাঘরে ঢুকে যায়। কিন্তু রান্নার সে সুখই বা কই? মেয়েটা বেশিরভাগ দিন কলেজ যেতে পারে না, তার ফার্স্ট ইয়ার এটা, উচ্চমাধ্যমিকে যথারীতি সে ভালো রেজাল্ট করেছে। পড়তে পড়তে কাঁদে, চীৎকার করে ওঠে। আগে তার চীৎকার শুনে গোপেশ্বর দোকান থেকে, লক্ষ্মী পিছনের বস্তি থেকে ছুটে আসত। আজকাল কেউ আসে না। সবার গা-সওয়া হয়ে গেছে, যেন হাসি মারা গেলেও সবার নিয়মমাফিক শোকের বেশি অতিরিক্ত কিছু হবে না। ইদানীং সারাদিনই গা গুলিয়ে আসে হাসির, যা খায় সব বমি করে দেয়। কেউ কেউ বলে ভেলোর নিয়ে গেলে হয় না?
পাঠক, বেলিয়া যখন পুষ্পদের বাড়ি যাতায়াত শুরু করল, মোটামুটি সেই সময়েই কথা শুরু হল হাসিকে নিয়ে ভেলোরে যাওয়ার। কিন্তু যাবে কে? বেলিয়া যেতে চায় না, তার সামনে অনেকগুলো পরীক্ষা পর পর, তাকে পড়তে হবে। মনোরমা আর গোপেশ্বর তাকে জোর করতেও পারল না, কারণ তারাও সত্যিই চায় বেলিয়া কিছু করুক অন্তত। তবু কোথাও যেন সন্দেহ হয় মনোরমার - বেলিয়া দেখবে তো তাদের? সে যেন তার বাকি দেওরগুলোর মত কোথাও একটু একটু দূরে সরে যাচ্ছে, শুধুই নিজেকে নিয়ে ভাবে।
এ কথাটা ঠিক। বেলিয়া এখন নিজেকে নিয়ে ছাড়া কিচ্ছু ভাবে না। সে হাসির সাথে কথা বলে না, হাসিকে দেখলে তার ভয় করে। হাসি যেন হেরে যাওয়া মানুষের প্রতিনিধি। মনে মনে সে যেন হাসির মৃত্যুও কামনা করে ফেলে, না চাইতেও। ও যেন একটা অপয়া, একটা অশুভ কিছু। পড়াশোনায় ভাল হওয়ার জন্য হাসির একটা দম্ভ ছিল। বেলিয়ার সেটা বাজত। আজ যখন সেই হাসি তার দম্ভ, তার স্বপ্ন সব কিছু নিয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী, বেলিয়ার এটা ভালো লাগে না, মনে হয় সে নিজেও যদি হেরে যায় হাসির মত? দম্ভ ভালোবাসে বেলিয়া, তাকে বিঁধলেও সে ভালোবাসে। দম্ভ ছাড়া মাথা উঁচু করে বাঁচে কি করে মানুষ?
অবশেষে ঠিক হল বেলিয়া আর প্রকাশ থেকে যাবে, দোকান সামলাবে, গোপেশ্বর আর মনোরমা হাসিকে নিয়ে ভেলোর যাবে। দিন স্থির হল। পুষ্প সবটা শুনে বলল, তুমি তবে এ ক’দিন আমাদের বাড়ি দুপুরে খেয়ে নিও না হয়? বেলিয়া বলল, আর প্রকাশ? পুষ্প’র মাথায় ছিল না কথাটা, তবু সে হেসে বলল, বা রে, আমি কি ভুলে গেছি নাকি, ওর জন্যেও পাঠিয়ে দেব, তুমি নিয়ে যেও।
মনোরমা পুষ্পকে চেনে না, কিন্তু নিজে মেয়েমানুষ তাই মেয়েমানুষের প্রকৃতিটা বোঝে। পুষ্প’র কথা বলতে গেলে বেলিয়া তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না কেন? পুষ্পকে নিয়ে দু-একটা প্রশ্ন করলে বেলিয়ার গলায় একটা ঝাঁঝ ফুটে ওঠে। মনোরমা এই ঝাঁঝটা চেনে। মনের আড়ালে পাপ বাসা বাঁধছে বেলিয়ার, আহত পাপের দম্ভ বড় বেয়াড়া, বিষাক্ত। কিন্তু হাসি? ওকে নিয়ে যে যেতেই হবে। অতএব আর কোনোদিকে না তাকিয়ে নিমগাছের নীচে দাঁড়িয়ে জগন্নাথকে স্মরণ করে রওনা দিল মনোরমা, গোপেশ্বর আর হাসিকে নিয়ে।
বেলিয়া তাদের হাওড়া স্টেশানে রাতের যশবন্তপুর এক্সপ্রেসে তুলে দিয়ে এসে যখন বাড়িটায় ঢুকল, তার ভয়ে বুকটা শুকিয়ে গেল, যেন পুরো বাড়িটা তাকে খেতে আসছে হাঁ করে, এমন শূন্যতা একটা সারা বাড়ি জুড়ে। একটা ভয় তাকে গ্রাস করল। ভয়টা যেন শুধু এই বাড়িটাকে নিয়ে নয়, তার মনের মধ্যে খাদের দিকে পা পিছলানোর যে আশঙ্কা, নিজেকে নিয়ে, সেই ভয়। অজানা ভয়, লোভের ভয়। কিসের লোভ? বেলিয়ার মনের আভাসে কার যেন মুখ, খোলা পিঠ, চোখের কি একটা চাহনি। বেলিয়া মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল। কিন্তু সে প্রার্থনায় জল মেশানো, বেলিয়া জানে।
তার যেদিন প্রথম এ বাড়িতে এসেছিল সেদিনের কথা মনে পড়ল। মনোরমার ছাড়া শাড়িটা আলনার এক কোণে আলুথালু হয়ে ঝুলে, সেটা টেনে গোটাতে গোটাতে বুকভাঙা কান্নায় আছড়ে এল তার বুক, সে শাড়িটাকে মুখের মধ্যে ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো মা... 'বউদি' বলতে পারল না যেন... হাসিকে মনে মনে অজস্র চুম্বন করল। হাসির স্লিপারের লোয়ার বার্থে শুয়ে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকাটা মনে করে চীৎকার করে কেঁদে উঠে বসে পড়ল মাটিতে। বাড়িতে কেউ নেই। প্রকাশ পড়তে গেছে। রাতে ফিরবে। ঈশ্বরের কাছে অনির্দিষ্ট অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে চাইতে মেঝেতেই মনোরমার শাড়িটা কোলের কাছে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল বেলিয়া।
৮
বেলিয়া ঠিক করল সে পুষ্প'র বাড়ি যাবে না। যে করেই হোক এড়িয়ে যাবে। নিজের আর প্রকাশের জন্য একটু ডালভাত ফুটিয়ে নেবে আর সেরকম অসুবিধা হলে হোটেল তো আছেই, খাবার আনিয়ে নেবে।
তাই হল। বেলিয়া দোকানটাকেই আপাতত তার সারাদিনের আস্তানা বানিয়ে নিল। এমনকি যে দুপুরবেলা দোকান বন্ধ থাকত, এমনই রীতি বানিয়েছিল গোপেশ্বর শুরু থেকে, সে রীতিও বদলে বেলিয়া সারা দুপুর দোকান খোলা রাখতে শুরু করল। আসলে বেলিয়া নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চায়। নিজের মন বড্ড ঘোলা থাকে আজকাল। কোনটা দরকার আর কোনটা লোভ গুলিয়ে যায় খুব। চাকরিটা তার দরকার, কিন্তু বাকিটা? কোনটা মুখ্য আর কোনটা গৌণ? বেলিয়া নিজের কাছে খুব অস্পষ্ট।
একদিন দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পর, দোকানেই মেঝেতে বসে বসে একটা বই পড়ছে, প্রকাশ স্কুলে গেছে। এই সময় সাধারণত খদ্দের আসে না। মনের মধ্যে একটা উচাটন। নিজের সাথে কি কোথাও বেইমানি করছে না সে? গেলে কি হয়? হঠাৎ মনে হল যেন চুড়ির আওয়াজ কানে এল। ভুল শুনল? মন এতটা ধোঁকা দিচ্ছে? বইয়ের পাতা থেকে মাথা না তুলে কানটা সজাগ করে রাখল। আবার আওয়াজটা শুনল, কল্পনা না তো, সত্যিই। মনের ভিতরে প্রমাদ গুনল বেলিয়া, পুষ্প?
বেলিয়া উঠে দাঁড়াল। পুষ্প একটা বাজারের ব্যাগ নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে, দৃষ্টিটা তার চোখের দিকে স্থির বিঁধিয়ে রেখেছে। নিঃশব্দে কৈফিয়ৎ চাইছে পুষ্প। তাদের মধ্যেকার অলিখিত প্রতিশ্রুতি থেকে বেলিয়া সরে এসেছে। এটা বেইমানি। বেলিয়াকে সব কিছু ভাষায় বোঝানোর মত ছোটো তো সে নয়। কিন্তু ডালে-ডালে পাতায়-পাতায় চলা, আড়ালে আড়ালে হাঁটা কথাটাকে হঠাৎ করে প্রত্যক্ষ ঝগড়ায় এনে, গোপন সুখের সম্ভাবনাটাকে মাটি করার মত নির্বোধও পুষ্প নয়। পুষ্প কাটাকাটাভাবে রূঢ়স্বরে বলল, আমি তিনটের পর অপেক্ষা করব, আসবে কি না আসবে তোমার ব্যাপার, কিন্তু তোমার জন্য ওই বুড়োর কাছে কম কাকুতি-মিনতি আমায় করতে হয়নি, এটা মনে রেখো, পুষ্প কোনোদিন কারোর কাছে নীচু হয় না, শুধুমাত্র তোমার একটা হিল্লে হবে ভেবেই... বলতে বলতে পুষ্প'র কাজলরেখা বন্দী দুটো ক্ষুধার্ত চোখ জলে ভরে উঠল, যেন হঠাৎ বান এসে নদীর পাড় উছলিয়ে উঠল।
পুষ্প চলে গেল। বাজারের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে গেল দোকানের মেঝেতে। আহত অভিমানী ব্যাগটা দোকানের মেঝেতে লুটিয়ে। বেলিয়ার বুকে বাজল। মনটা টাটিয়ে উঠল। কোথা থেকে এত ভালোবাসা, এত উদ্বেগ, শরীরের প্রতিটা অণুতে অণুতে পুষ্প'র প্রতি এমন অমোঘ আকর্ষণ জেগে উঠল, বেলিয়া থই পেল না। সে শুধু জানে তাকে যেতেই হবে। এখনই যেতে হবে।
বেলিয়া পুষ্প'র বাড়ি ঢুকল সাড়ে তিনটে। ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে এসেছে সে, লিস্ট ব্যাগের মধ্যেই ছিল। বাজার দিতে এসেছে সে – এ ছল, নইলে লোকের সন্দেহ হতে পারে। বেলিয়া ঘরে ঢুকেই বুঝল, আজ পুষ্পের না আছে কোনো আড়, না আছে কোনো বাঁধন। বেলিয়া একবার ভাবল চলে যায়, কিন্তু কোথায় যাবে? আর যাবেই বা কেন? তার সম্পূর্ণ সত্তাও কি তাকে যেতে দিচ্ছে? নিজের ভিতর দু-আধখানা বেলিয়া। আলগা বৃন্ত ফুল যেন সে, পুষ্প'র অল্প আঘাতেই বৃন্তচ্যুত হল বেলিয়া।
পুষ্প'র বাড়ি থেকে বেরিয়ে যখন রাস্তায় এসে দাঁড়ালো তখন সন্ধ্যে হব হব। ইচ্ছা করলে বেলিয়া আরো আগে বেরোতেই পারত, বেরোয় নি। সে চাইছিল অন্ধকারটা গাঢ় হোক আরো। কোনো এক বাড়ির প্রথম শাঁখের আওয়াজটা হতেই তার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। পাশে পুষ্প ঘুমিয়ে। কি করে ঘুমাচ্ছে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্ধকার ঘনিয়ে আসা দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে তার একটা কথাই মনে হল - পুষ্প'র যে সাহস আর নিজের কাছে নিজের স্বচ্ছতা আছে, তার তা নেই। তাই সে ঘুমাচ্ছে। বেলিয়া গ্লানির পাঁকে দম আটকে জল খুঁজছে, পাপ ধোয়ার। মৃন্ময়ীর মুখটা আগে মনে পড়ল, এই তো পাশেই তার বাড়ি। যাবে? বেলিয়া জানে না। দ্বিধান্বিত পায়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো। মৃন্ময়ীদের বাড়ির আলোটা দেখা যাচ্ছে, ভুবন ছাদে হাঁটছে দেখতে পেল বেলিয়া। ভুবন তাকে খেয়াল করেনি, ভুবন কাউকেই খেয়াল করে না, সে শুধু নিজের মধ্যে থাকে, স্বার্থপর ছেলে একটা। দোকানে চলে এল বেলিয়া। সে একা থাকতেই চায়, সবাই স্বার্থপর, যে যার ধান্ধায়, সে নিজেও। দোকানেই বসে থাকল রাত অবধি বেলিয়া।
পরেরদিন দুপুরে সে দোকান খুলল না। মৃন্ময়ীদের বাড়ি এল। সারারাত ঘুম হয় নি। তার নিজের মধ্যে গভীর এক জঙ্গল। এতদিন সে এড়িয়ে এড়িয়ে হেঁটেছে, এতদিন সে জঙ্গলে ঢোকার আর বেরোনোর রাস্তা জানত বলেই বিশ্বাস করত, কিন্তু এখন সে জানে সে পথ হারাচ্ছে, কখন যেন সে জঙ্গলের মধ্যখানে এসে দাঁড়িয়েছে। তবু এখনও এই জঙ্গলের থেকে বেরোনোর রাস্তাটা মিলিয়ে যায়নি পুরো, অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আর বেশিক্ষণ দেখা যাবে না। তারপর?
এ সব হাতছানি যে আগে আসেনি বেলিয়ার জীবনে তা তো নয়। তার সবচাইতে বড় সমস্যা ছিল লক্ষ্মী। পিছনের বস্তিতে থাকে। অল্প বয়েস, মা এর-ওর বাড়ি কাজ করে। লোকে বলে লক্ষীর বাপের ঠিক নেই, ওর মা’টা যেমন চরিত্রহীন, লক্ষ্মীও তাই। ‘শরীর বেচেই নাকি এত ফুটানি ওদের’ - পাড়ার লোকের কথা। তবে ‘ফুটানি’ শব্দটাকে কোনোদিন বুঝতে পারেনি বেলিয়া। একটা ছেঁড়া নাইটি পরেই রাতদিন দেখে লক্ষ্মীকে বেলিয়া। লোকে বলে ওটা নাকি ওর টোপ। হতে পারে, কারণ সে কয়েকবার ইঙ্গিত করেছিল বেলিয়াকে। বিশেষ করে একবার যখন গোপেশ্বর বাড়ির সবাইকে নিয়ে মনোরমার এক মামাতো বোনের ছেলের জন্মদিনে গিয়েছিল উড়িষ্যায় তখন। বেলিয়া একাই ছিল দোকানের দায়িত্ব নিয়ে।
একদিন দুপুরবেলা লক্ষ্মী এল। বেশ সেজেগুজেই এল। দোকান বন্ধ, বেলিয়া এমনি চোখটা বন্ধ করে শুয়ে, বিশ্রাম নিচ্ছে। লক্ষ্মী এসে পাশে বসল, তার গা ছুঁয়ে তাকে ডেকে বলল, তুমি কি গো, বেলা অবধি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছো? দোকান খুলবে না? বেলিয়া তাড়াতাড়ি ঘড়ির দিকে তাকালো, চারটে বাজতে এখনও মিনিট দশেক বাকি। দোকান তো খুলতে খুলতে পাঁচটা। এখন কি?
লক্ষ্মী একটা ক্যাসেট বেলিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, চলো, গান শুনতে শুনতে চা খাই। একটা হালের হিন্দি সিনেমার গানের ক্যাসেট। বেলিয়া কিছু বলল না। তার বৌদির কাছে লক্ষ্মী প্রায়ই আসে, কিছু মনে হয়নি কোনোদিন। লক্ষ্মী উঠে গিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো। বেলিয়া একবার ভাবল বারণ করে, তারপর ভাবল, থাক, ও তো এমনি আসেই, বারণ করা মানে তো তার নিজের মনেই পাপ।
লক্ষ্মী যখন চায়ের কাপ দুটো নিয়ে তার পাশে বসল, একটু অস্বস্তি লাগলেও ভেবেছিল অনেকদিনের পরিচিতি বলেই হয় তো। চায়ের কাপ দুটো সামনের তেপায়াতে রাখা। লক্ষ্মী কেমন সম্মোহিত চোখে যেন বেলিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে। বেলিয়া কিছু বলা বা বোঝার আগেই আচমকা সে বেলিয়ার মাথাটা শক্ত করে ডানহাতে টেনে, নিজের ঠোঁটটা বেলিয়ার ঠোঁটের সাথে চেপে ধরল। বেলিয়া এক ধাক্কায় লক্ষ্মীকে খাটে ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, এ সব কি? রাগে-অপমানে তার তখন সারা গা ঘিনঘিন করছে। একটা বেশ্যা মেয়েছেলের স্পর্ধা হয় কি করে? তারপর যা নয় তাই বলেছিল লক্ষ্মীকে বেলিয়া। লক্ষ্মী বড় বড় চোখে অপলকে তার দিকে তাকিয়ে শুধু চুপ করে শুনে যাচ্ছিল।
বেলিয়া চুপ করল, যেই দোকানের দিকে এগিয়ে যেতে গেল লক্ষ্মী পিছন থেকে নিষ্পৃহ আহত গলায় বলল, আসতে পারতিস, টাকা নিতাম না, অন্তত একবার তো দেখতাম ভালোবেসে চুমু খেলে শালা কেমন লাগে। বাকিটা না হয় নাই করতিস, এমনিতেও নীচে ওখানে কিছু নেই রে, সব এখানে, বলে নিজের বুকের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, কেউ শালা বুঝলই না লক্ষ্মী ভালোবাসতেও পারে, শালা সবাই জানে লক্ষ্মী শুধু টাকার জন্য বিছানায় শরীর গরম করতেই জানে।
শেষের কথাগুলো ভোলেনি বেলিয়া। আজ একবার মনে হল লক্ষ্মীকে ডেকে ক্ষমা চায়, কিন্তু থাক, বড্ড নাটুকে হয়ে যাবে। বেলিয়া মৃন্ময়ীর বাড়িতে ঢোকার সময় খেয়াল করল পুষ্প দেখছে কিনা। না, এদিকের জানলাটা বন্ধ। পৌনে তিনটে বাজে। স্বপন ঘুমাচ্ছে, ভুবনের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সবে শেষ, সে একটা কিছু পড়ছে। বেলিয়া ঘরে ঢুকতেই ভুবন বলল, তুমি একটু বসো, মা কথা বলছেন একজনের সাথে।
অন্যদিন হলে বেলিয়া জিজ্ঞাসা করত কি বই এটা, আজ ইচ্ছা করল না। খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে পড়তে বসল। কিন্তু আটকালো পাশের ঘরে দিদির গলায়, মনে হচ্ছে মমতা বলে যে মেয়েটা কাজ করে দিদির বাড়ী তার গলা। সে কাঁদছে চাপা গলায়। দিদি তাকে বলছে, যে ধানে চাল নেই রে বাবু, সে ধান ঝাড়িস না। তুই ও বাড়ি ছাড়, ছেলেটাকে মানুষ কর, লোকটা আর শুধরাবে না রে, ভস্মে ঘি ঢালছিস খালি।
হ্যাঁ মামা বলো, এত কম কম আসো কেন এখন? প্রেম করছ নাকি?
বেলিয়া হাসল। ভুবন এরকমই কথা বলে, খুব আন্তরিক, কিন্তু সবটাই আলগা আলগা।
বেলিয়া জিজ্ঞাসা করল, কি বই পড়ছিলি?
ভুবন বলল, এটা সুনীলের লেখা ‘সেই সময়’, পড়ে নিই তারপর দেব, দুর্ধর্ষ বই। চলো, উপর তলায় যাই, তোমার তাড়া নেই তো?
বেলিয়া দোতলায় এসে বসল একটা চেয়ারে। এই ঘরটা গরম, কিন্তু ভুবনের এই ঘরটাই প্রিয়। হঠাৎ বিনা ভূমিকায় বেলিয়া বলে উঠল, ভুবন তোকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?
আমি প্রেম করছি কিনা? বলে ফিক করে হেসে ভুবন ঘরের দরজাটা খুলে দিল। রোদের হল্কায় ঘরের মধ্যেটা মুহূর্তে গরম হয়ে গেল।
তোর সেক্স নিয়ে কোনো ইন্টারেস্ট নেই? বেলিয়া বলেই বুঝল, ঠিক এইভাবে সে প্রশ্নটা করতে চায়নি, কিন্তু মনটা এমন এলোমেলো হয়ে আছে যে ভাষার সাথে চিন্তাগুলো যেন খাপে খাপে বসতে চাইছে না।
ভুবন তার দিকে তাকিয়ে হাসল, বলল, কেন, হঠাৎ?
বেলিয়া বলল, না এমনি, আসলে দেখ আমার তো এখানে বন্ধু বলতে তুই ছাড়া আর কে আছে? তাই এ কথাটা আমি কার সাথে ডিসকাস করব বল?
ভুবন ভাবল এই কথাটা ভীষণ সত্যি যে বেলিয়া আর কারোর সাথে মেশে না, তার সেই অর্থে সমবয়েসী বন্ধু বলতে কেউ নেই। সে বেলিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি জানতে চাইছ বলো...
বেলিয়া বলল, মেয়েদের ওপর শারীরিক আকর্ষণ আসাটাকে তুই খারাপ ভাবে দেখিস?
ভুবন বলল, তা কেন? সেইটাই তো স্বাভাবিক।
বেলিয়া বলল, আচ্ছা ধর আমি দোকানে আছি... এমন সময় কোনো মেয়ে দোকানে এল, বা কোনো বউ... আমার দৃষ্টিটা মাঝে মাঝেই খারাপ হয়ে যায়... এটাকে তুই কি আমার নোংরামি মনে করবি?
ভুবনের এক মুহূর্তে মৃন্ময়ীর কথা মনে হল, বেলিয়া কি সবাইকে একই চোখে দেখে? নিজের মনেই একটা আশঙ্কা আর লজ্জা যুগপৎ শুশুকের মত মাথা তুলে, আপনা থেকেই মিলিয়ে গেল। ভুবন আমল দিল না নিজের এই কুভাবনায়, মনে হল এ আশঙ্কা অযৌক্তিক।
দুপুরের রোদটা খুব চড়া আজ। ভুবনের অস্বস্তি হচ্ছে সেটা বুঝতে পেরে বেলিয়ার জেদটা আরো চড়ে গেল, এরকম নিজেকে আড়াল করে রাখবে কেন ভুবন? সে বলল, আমি খুব খারাপ তাই তো?
ভুবন বলল, দেখো আমার যেটা মনে হয়, এক-একজন মানুষ এক-একরকম হয়। তুমি যেগুলোকে তোমার প্রায়োরিটি ভাবছ...
এটা তো প্রায়োরিটির প্রশ্ন না, এটা তো বায়োলজিক্যাল ব্যাপার একটা, তুই কেন এটাকে বাইপাস করছিস? হাতের মধু যদি কনুই অবধি গড়িয়ে এল, তুই খাবি কি করে? সবকিছুর একটা সময় তো আছে? তুই ওইসব ছবির বই দেখেছিস?
হ্যাঁ, স্কুলে আনে অনেকে..., ভুবন বলল একটু জড়তার সাথে।
তোর মেয়েদের দেখলে কিচ্ছু ইচ্ছা হয় না?... কিচ্ছু না? নাকি ভণ্ডামি করিস... নাকি তুই কাপুরুষ?... এত শান্ত থাকিস কি করে?... এগুলো কদ্দিন ধরে রাখতে পারবি...? একদিন না একদিন তো তোর...
আরো কি সব বলে যাচ্ছে বেলিয়া। বেলিয়া নিজেকে থামাতে পারছে না। তার এতটা আক্রোশ ভুবনের ওপর ছিল তা সে জানত না। এখন বলতে গিয়ে সে বুঝছে যে তার আড় ভাঙছে, পুষ্প'র মত, তবে এ অন্য আড়, এ-ও খাদের ধার, তবে এ অন্য খাদ। ভুবন কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। খানিক পর নিজেকে সামলিয়ে ভুবন বলল,
তোমার কি কিছু হয়েছে? আমায় বলতে পারো...
বেলিয়া কিছু বলল না। কিন্তু তার মুখচোখ যে স্বাভাবিক নেই আর সেটা যে ভুবনের চোখে ধরা পড়েছে বেলিয়া বুঝল। খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকল বেলিয়া, ভুবনও। নীচে এখনও দিদি আর মমতার গলা শোনা যাচ্ছে হালকা।
খানিক বাদে ভুবন বলল, মামা, আমি কিছুই স্থির করে উঠতে পারিনি এখনও, জীবনের সবটাই ভীষণ ধোঁয়াশা আমার কাছে। আমার মনে অনেক প্রশ্ন। সেই প্রশ্নগুলোর একটা শরীর আছে, তারা রাতদিন আমার সাথে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, উত্তর খোঁজে, আমি পাই না। আমি জানি না তোমার কি হয়েছে, হয়তো হাসিকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছো বলে তোমার এরকম মনের অবস্থা, আমি তোমার বন্ধুই হলাম আজ থেকে, আমি উঠি, পড়া আছে। অন্যদিন কথা হবে। ভেবো না আমি এড়িয়ে গেলাম। আমি সত্যিই জানি না স্পষ্ট করে কিছুই।
বেলিয়া ভুবনের সব কথা শুনল না। মনের মধ্যে একটা চাপা গোঙানি বেজেই যাচ্ছে তার। বাজুক, একসময় থেমেই যাবে। তার মনের মধ্যে একটা ইচ্ছা মাথা চাড়া দিচ্ছে, পাশেই পুষ্প'র বাড়ি, যাবে একবার? হা জগন্নাথ, কি মন দিয়ে পাঠিয়েছ প্রভু... লক্ষ্মী আমায় ক্ষমা কর।
৯
বেলিয়া একরকম এড়িয়েই গেল মৃন্ময়ীকে, দেখা করল না। ভুবনের সাথে কথা বলার পর থেকে মনটা কেমন বিকল হয়ে আছে বেলিয়ার, কথা বলতে ইচ্ছা করল না আর মৃন্ময়ীর সাথে। ফিরে এসে দোকান খুলে বসল। নিজেকে ভীষণ ভীতু, দুর্বল মনে হচ্ছে। সে যেন পুষ্প হতে চায়, বেপরোয়া। পুষ্প যা চায় তা যদি আপনা থেকে না আসে তবে ছিনিয়ে নিজের করে নিতে পারে সে, এই কথাটা বেলিয়া কেন জানত না আগে?
মৃন্ময়ী বুঝল বেলিয়া কিছু বলতে এসেছিল, কিন্তু বলল না, এড়িয়ে গেল। অন্যদিন হলে হয়তো জোর করত মৃন্ময়ী, আজ ইচ্ছা করল না। এক, মমতাকে নিয়ে মনটা কিছুটা বিকল, মেয়েটার এমন কপাল! দুই স্বপন, মানে মৃন্ময়ীর ছোটোছেলে, ক্রমশ সে পরিবারের সবার চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বদলে যাচ্ছে ছেলেটা। বাড়িতে কথা বলে না কারোর সাথে খুব একটা। বাড়ির বাইরে থাকার ঝোঁক একটা। রেজাল্ট খারাপ হচ্ছে দিনে দিনে। যে ছেলেগুলোর সঙ্গে মেশে তারাও খুব একটা ঠিকঠাক নয়। ওদিকে লিলুয়ায় একটা জমি কেনা নিয়ে কথা চলছে। কেনার সিদ্ধান্তটা হয়েই গেছে প্রায়। নিজের প্ল্যান অনুযায়ী হবে এমন একটা ইচ্ছা মৃন্ময়ীর অনেকদিনের। তার ফ্ল্যাট ভালো লাগে না, বাড়ির সামনে একটা বাগান করার খুব ইচ্ছা তার। এইসব নানা কারণে মনটা বেশ উদ্বিগ্ন মৃন্ময়ীর। একে এইসব নানা ঝুটঝামেলা, তার মধ্যে জলধরের কাজের চাপ বেড়েছে, বাইরে যাওয়াটাও ঘন ঘন হচ্ছে এখন। জলধর স্বপনের ব্যাপারটা বুঝতে পারে, মাঝে মাঝে রাতে শুতে যাওয়ার সময় মৃন্ময়ীর সাথে কথাও হয়। খুব আপসেট হয়ে যায়, বিশেষ করে নিজের অসহায়তায় নিজের উপরেই ক্ষুব্ধ হয় জলধর, বলে, আমি কি খামতি রেখেছি বলো? আমরা যেভাবে মানুষ হয়েছি এরা তো কল্পনাই করতে পারবে না, যা যখন চাইছে তখনই পেয়ে যাচ্ছে... আমাদের সময় ভাবতে পেরেছি আমরা? বাংলাদেশ থেকে আসার পর কিভাবে কাটিয়েছি সব তো শুনেছ মায়ের কাছে।
কথাটা সত্যি। জলধর আর শশধরকে নিয়ে যখন রাঙাদেবী এই বাংলায় আসেন, তখন সম্বল বলতে একটা অদম্য মনের জোর ছাড়া সত্যি আর কিছু ছিল না। প্রতিষ্ঠিত আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে নানা উপেক্ষা, অপমান সহ্য করতে করতে যেভাবে মানুষ করেছেন দুই ছেলেকে তা বলতে গেলে একটা উপন্যাস হয়ে যায়। তবে কি এ ঘটনাটা ব্যতিক্রমী কিছু না, এরকম কত কত সংসার যে হারিয়েই গেল, মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারল না, সে কথা বলতে বলতে শাশুড়ির সজল চোখ, বুজে আসা গলায় উদাস হয়ে যাওয়া মুখ বহুবার দেখেছে মৃন্ময়ী। অবাক হয়ে যেত মৃন্ময়ী, এমন অভিযোগহীন মানুষ হয় কি করে? এত কিছু যে মানুষটা সহ্য করেছে সে মানুষটার মুখে কোনোদিন কারোর বিরুদ্ধে এতটুকু অভিযোগ শোনেনি মৃন্ময়ী। এর উত্তরে তার শাশুড়ি বলতেন, কি জানো বউমা, বড় যুদ্ধে নামলে মানুষ বড় যোদ্ধা হয়। শুধুমাত্র রান্নাঘর আর সংসারের নানা খুঁটিনাটি অভিযোগ নিয়ে যদি লড়ে মরতাম তবে জীবনটাও এই এতটুকুই হত, বলে নিজের ডান হাতের সবক’টা আঙুলকে জড়ো করে সামনে আনতেন, বলতেন, কত কি দেখলাম বউমা, কত অভিজ্ঞতা হল, তাই ঈশ্বর যা দিয়েছেন তাতেই আমি সুখী। সুখী হতে আর কত বাসনকোসন লাগে বলো, একটা মন লাগে।
জলধরের কথার সূত্র ধরে মৃন্ময়ীর ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। ক্লান্তিতে জলধর ঘুমিয়ে পড়ে। মৃন্ময়ীর ঘুম আসে না। ছোটোছেলেটা কি তবে সত্যিই মানুষ হবে না? ভুবনও যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। ভুবনকে স্পষ্ট বুঝতে পারে না মৃন্ময়ী। সে সব কিছুতেই আছে, অথচ যেন কোন কিছুতেই নেই। অনেকবার তিরস্কার করেও দেখেছে মৃন্ময়ী, কোনো কাজ হয়নি। ভুবন কষ্ট পেয়েছে, সে নিজেও কষ্ট পেয়েছে। তাও তো বড়টাকে বকাঝকা করা যায়, ছোটোটা তো এসবেরও বাইরে। মৃন্ময়ী সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে ভিড় করে আসে নানা দুঃস্বপ্ন।
একদিন ভুবনকে রাস্তায় ডাকল বেলিয়া। বলল, দুপুরে আসিস কথা আছে। বাড়িতে যদিও কিছু কাজ আছে ভুবনের, তবু সে রাজি হল যেতে। ইদানীং বেলিয়ামামাকে একটু অন্যরকম লাগে ভুবনের। কিছু একটা যেন চাপছে। কিছু একটা লুকিয়ে যাচ্ছে। নিজের সাথেই যেন যুদ্ধে নেমেছে। অকারণে মানুষকে ব্যঙ্গ করে, কথায় কথায় একটা তর্ক করার সূত্র খোঁজে। নিজে যেটা মানতে পারে না মন থেকে, সেইটাকেই সমস্ত যুক্তি দিয়ে সত্য বলে প্রমাণ করতে পারলে বেলিয়ামামা যেন বেঁচে যায় এখন। কিন্তু কেন এমন করে? ভুবন বোঝে না, কিন্তু কিছু একটা আভাস পায়, সে আভাসটা ভালো নয়, তাই তলিয়ে ভাবতে চায় না। সংসারে সবকিছু নাড়াঘাঁটা করতে নেই, মৃন্ময়ী বলে, নর্দমার পাঁক পরিষ্কার রাস্তায় তুলে এনে না পথের লাভ, না নর্দমার।
ভুবন দুপুরে এলো বেলিয়ার বাড়ি। দোকান বন্ধ। প্রকাশ স্কুলে গেছে। বেলিয়া ভুবনকে তার ঘরে বসতে বলল। বেলিয়ার হাসিটা একটু অন্যরকম লাগল ভুবনের। বেলিয়া একটু চঞ্চল যেন। সে পাশের ঘর থেকে হাতে করে একটা বই এনে ভুবনের সামনে ধরে বলল, তুই দেখেছিস বলেছিলি না এই বই আগে?
ভুবন বইটা হাতে নিয়ে দেখল পর্ণোগ্রাফির বই একটা। সে কয়েক পাতা উল্টিয়ে বলল, হ্যাঁ, সেইদিন বললাম তো, অনেকবার দেখেছি, আমাদের স্কুলে নিয়ে আসে।
বেলিয়া বলল, তুই মাস্টারবেট করিস? নিয়ে যেতে চাইলে নিয়ে যেতে পারিস বইটা, নিবি?
ভুবন দেখল কি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বেলিয়া তার দিকে। যেন এখনই কিছু একটা প্রমাণ করতে চাইছে সে। যেন যুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছে।
হঠাৎ বেলিয়া ভুবনের প্যান্টের উপর দিয়ে হাত দিয়ে বলল, কই দেখি...
ভুবন দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, তোমার কি হয়েছে বলো তো? এরকম কেন করছ?
বেলিয়া তখন নিজের মধ্যে নেই যেন। সে হঠাৎ করে বইটা সামনে রেখে একটা পাতা খুলে নিজেকে উলঙ্গ করে স্বমেহনে উদ্যত।
ভুবনের কান-মাথা গরম হয়ে গেছে লজ্জায়, রাগে অপ্রস্তুত সে, কেন এরকম হচ্ছে? সে উলঙ্গ বেলিয়ার ওরকম অস্থিরতার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি এই জন্যে আমায় ডেকেছিলে?
বেলিয়া তখন ছবিগুলোর দিকে উন্মাদের মত তাকিয়ে হস্তমৈথুনে ব্যস্ত, তার চোখদুটো কেমন অন্যরকম, জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে, সে কিছুটা হাঁপাতে হাঁপাতেই বলতে লাগল, জানিস আমি কতগুলোর মেয়ের সাথে শুয়েছি, তুই পারবি? হবে না, আমার বয়সে এসেও হবে না...
ভুবন সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। বেলিয়ার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু কাকে বলবে? সে সাইকেলটা নিয়ে নতুন মন্দিরের ধারে গেল, তার গঙ্গার হাওয়া চাই এখন। গা’টা গুলাচ্ছে।
বেলিয়া সন্ধ্যা অবধি শুয়ে থাকল। দোকান খুলল না। লক্ষ্মী একবার খোঁজ নিতে এসেছিল, সাড়া দিল না। সব কিছু বিষিয়ে যাচ্ছে তার। বেলিয়া বুঝে গেছে যে স্বপ্নটাকে সামনে রেখে সে এগোচ্ছিল, সে স্বপ্ন তার কাছে অধরাই থেকে যাবে। তার সে মাথা নেই যে একটা ভালো পোস্টে নিজের চেষ্টায় চাকরি পাবে। তবে? তাকে কি সারাটা জীবন এই দোকান আর মাল আনা-নেওয়া করে কাটাতে হবে? সেই গ্রামের থেকে একজনকে বিয়ে করে এনে সে কোনোদিন এই ভদ্রমানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে পারবে? না। তাকে একজন উড়ে দোকানি হয়েই থেকে যেতে হবে। কোনো সম্মান সে পাবে না। এখন তার মনে হয় সবাই তাকে করুণা করে। কেউ ভালোবাসে না। এমনকি দিদিও না। ওসব করুণা। ওদের মহত্ব দেখানোর একটা গিনিপিগ সে। আজকে দিদি আর দাদা যদি চাইত সত্যিই কি একটা ভালো পোস্টে তাকে ঢুকিয়ে দিতে পারত না? বেলিয়া যেন এখন সর্বান্তঃকরণে চায় দিদির ছেলেগুলো উচ্ছন্নে যাক। তার মতো সবাই ব্যর্থ হোক। ভুবনের ভালোমানুষি একটা মুখোশ, ভিতরে ভিতরে সে কি এসব চায় না? নইলে পালালো কেন ওরকমভাবে? আসলে একটা বোকা ছেলে, সারাদিন বই পড়লে আর বাইরের জগতটাকে কি চিনবে, শুধু একটা পড়ুয়া গবেট হবে।
বেলিয়া তার সমস্ত স্বপ্ন আশা-ভরসা নিয়ে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে, শেষ ভরসা রেলের অ্যাপ্রেন্টিসের যে ফর্ম বেরিয়েছে সেটা। বয়েস কমিয়ে সার্টিফিকেট বার করেছে পুষ্প’র কথা মত। ফিল-আপ করে দিব্যেন্দুদার হাতে দিয়েও দিয়েছে। দিব্যেন্দুকে খুব আশা নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে, হবে তো? দিব্যেন্দু বলেছে, দেখি। দিব্যেন্দুর বলার মধ্যে কোনো জোর পায়নি বেলিয়া। তাই সে রামভরণ তিওয়ারি বলে একজন বিহারী লোকের কাছে নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট প্রায় ফাঁকা করে সব টাকা থেকে তুলে আর বেশ কিছু টাকা মৃন্ময়ীর কাছ থেকে ধার করে দিয়ে এসেছে এই অ্যাপ্রেন্টিসশীপটা পাওয়ার জন্য।
এর মধ্যে পারাদ্বীপ থেকে তাগাদা আসছে বিয়ে করার জন্য। কিন্তু সে বিয়ে করবে না ওই গ্রামের অশিক্ষিত কোন মেয়েকে। জীবন মানে কি বোঝে ওরা? সে বাঙালি মেয়ে বিয়ে করবে, শিক্ষিত বাঙালি মেয়ে, এইখানেই থাকবে, শুধু একটা সরকারি চাকরি হতে যা দেরি।
বেলিয়ার এখন একটা নেশা লেগে গেছে। আজকাল পুষ্পকে ডাকতে হয় না। নিজেই যায়। লক্ষ্মী তাকে সহ্য করতে পারে না এখন। একদিন দুপুরে সে লক্ষ্মীকে ডেকেছিল। লক্ষ্মী ঘরে ঢুকেই চোয়াল শক্ত করে চৌকিতে বসল। বেলিয়া কোনো কথা না বলে যেই লক্ষ্মীর বুকে হাত ছুঁইয়েছে, লক্ষ্মী বেলিয়ার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, থাক, আমি সব জানি, তুমি বরং পুষ্প’র কাছেই যাও।
লক্ষ্মীর মুখে পুষ্প’র নামটা শুনে চমকে উঠেছিল প্রথমে বেলিয়া। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, যা যা, নিজে তো বড় সতীসাধ্বী? আমায় জ্ঞান দিতে এসেছে।
লক্ষ্মী হেসে বলল, আমি তো কোনোদিনই সতীসাধ্বী ছিলাম না বেলিয়া, কিন্তু সে তো অভাবে, তোমার তো অভাব ছিল না? তুমি নিজেকে বিকোলে লোভে, নয়? তুমি কি ভেবেছ ওই পুষ্প’র বর তোমায় চাকরি করে দেবে? কিচ্ছু হবে না। আজকাল তুমি মৃন্ময়ীদির বাড়ী যেতে চাও না তেমন, মনোরমা বৌদি কত কষ্ট পায় তোমার এই নির্লজ্জের মত নীচ ব্যবহারে তুমি বোঝো?
বেলিয়া আর শুনল না। যে কথাগুলো সে নিজের মনের মধ্যে উঠলেই গলা টিপে মেরেছে সেই কথাগুলো লক্ষ্মীর মুখ থেকে উচ্চারণ হল যখন তার মাথাটা রাগে দপদপ করতে লাগল। একটা চীৎকার করে লক্ষ্মীকে বেরিয়ে যেতে বলে সেই যে বিছানায় শুলো আর উঠলো না সারাদিন। প্রকাশ এসে দোকান খুলল। ভাত-আলুসিদ্ধ করল, বেলিয়া খেলো না, উঠল না। প্রকাশকে বলল তার ভীষণ মাথাব্যথা করছে, কেউ ডাকতে এলেও সে যেন তাকে না ডাকে।
সারারাত ঘুম এলো না বেলিয়ার। মাথার মধ্যে যেন চিন্তার মিছিল। ঠিক মিছিল না, মিছিলের তো তাও একটা শৃঙ্খলা থাকে, এ যেন বাজার। হাজার একটা চিন্তা, হাজার একটা মুখ ভেসে বেড়াচ্ছে তার মাথার মধ্যে। কিচ্ছু অনুভব করতে পারছে না। আর দুই সপ্তাহ বাদে রেজাল্ট রেলের পরীক্ষাটার, খুব খারাপ দিয়েছে পরীক্ষাটা। অন্যবার তাও আশা থাকে, এবারে কিচ্ছু নেই। যদি না পায়? না হয় যদি?
বেলিয়া তাকিয়ে তাকিয়ে সকাল হতে দেখল। সারা শরীরে ব্যথা, ক্লান্তি, মাথাটা ভার। প্রকাশ দোকান খুলে বসেছে। বেলিয়া তাকে পড়তে বসতে বলে নিজে দোকানে গিয়ে বসল, চারপাশটা বড্ড ঘোলাটে যেন।
বেলার দিকে গোপেশ্বর, মনোরমা আর হাসিকে নিয়ে একটা রিকশা দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। একি চেহারা হয়েছে হাসির? চমকে উঠে হাসির দিকে তাকিয়ে রইল বেলিয়া। হাসি তার দিকে তাকিয়ে হাসল। হাসি বিছানায় শুলে পর বেলিয়া তার মাথার কাছে এসে বসল। বলল, কিছু খাবি? নিয়ে আসব?
হাসি মাথা নাড়ল। চোখদুটোর তলায় কালি জমে। গোপেশ্বর আর মনোরমার মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেল না বেলিয়া। কিন্তু মনোরমাকে দেখে তার এই ক’দিনের সমস্ত গ্লানি মন থেকে যেন এক নিমেষে মুছে গেল। মনোরমা এসে গেছে মানে আর কোনো ভয় নেই যেন তার নিজেকে নিয়ে। রাত্রে দাদা তাকে বলল, ভেলোরেও একই কথা বলেছে। সারাটা জীবন হাসিকে ওই ওষুধের উপরই বাঁচতে হবে।
মনোরমার চোখদুটো কোটরে ঢুকে গেছে। এর মধ্যে মৃন্ময়ীর সাথে দেখা করতে গেল মনোরমা। মৃন্ময়ীর খুব জ্বর। জলধর বাইরে আছে অফিসের কাজে। মৃন্ময়ীর কাছে গিয়ে, তার বিছানায় মাথা রেখে এই প্রথম কাঁদল মনোরমা। মৃন্ময়ীর কোনো ভাষা নেই সান্ত্বনা দেওয়ার তাকে, মৃন্ময়ী শুধু বলল, আমি জানি না মনোরমা ঈশ্বর তোমার কি পরীক্ষা নিচ্ছেন, আমি প্রার্থনা করি তুমি এ পরীক্ষায় সফল হও।
মনোরমা শুধু যে হাসির জন্য কাঁদেনি সে মৃন্ময়ী জানে। মনোরমা ফিরে এসে দেখেছে, বুঝেছে বেলিয়া এখন গলা জলে। যে আশঙ্কাটাকে সে মনে মনে ঠেকিয়ে রেখেছে, কোনোমতে স্বীকার করেনি, সে তার সমস্ত সংসারে একটা কালো ছায়ার মত জাঁকিয়ে বসেছে। অন্যসময় হলে এ লড়াইয়ে পিছিয়ে যেত না মনোরমা, কিন্তু এখন সে নিজেই যে দুর্বল, দিশাহীন! এর থেকেও বেশি অসহায়তা নিজের মাতৃত্বের কাছে নিজের, মনে হয় যদি সত্যিই চাকরিটা করে দেয় পুষ্প, তবে সব অপরাধ ক্ষমা করে দেবে সে। নিজের নির্লজ্জতায় নিজেই লজ্জা পায়। কিন্তু নিরূপায় সে।
১০
মৃন্ময়ীর জ্বরটা বাড়ল। জলধর বাইরে। ভুবন খবর দিতে চাইল না জলধরকে, তার বিশ্বাস সে পেরে যাবে। বেলিয়া মৃন্ময়ীকে এমন বিছানায় শয্যাশায়ী কখনও দেখেনি, সে কিছুটা ঘাবড়িয়েই গেল। ভুবনকে বলল সে তার সাথে রাতে থেকে যাবে, স্বপনকে কোনো ভরসা নেই। কথাটা সত্যি, মৃন্ময়ীর এই অবস্থাতেও স্বপন নির্বিকার, সে তার জগতে। বরং এই অবস্থাটার সুযোগে সে বাড়ির বাইরে থাকার সময়টা আরো বাড়িয়ে দিল। রাতেও ফিরল না কয়েকদিন। ভুবন সবটা খেয়াল করছে, কিন্তু এই নিয়ে মাথা খারাপ করার মতো অবস্থা নয় তার। ক্যালকাটা ফিভার বলে একটা জ্বর খুব হচ্ছে চারদিকে। কাগজে খুব লেখালেখিও হচ্ছে, ডাক্তার কিছুটা চিন্তিত জ্বরটার হাবভাব দেখে। আর কয়েকটা দিন দেখে কয়েকটা রক্ত পরীক্ষা করতে দেবেন বলেছেন, যদি পজিটিভ হয় তবে হসপিটালে ভর্তি করতে হবে বলে গেছেন। মৃন্ময়ীকে জ্ঞানত কখনও হসপিটালে ভর্তি হতে দেখেনি ভুবন, তাই হসপিটালের নাম শুনে সে কিছুটা উদ্বিগ্নই মনে মনে, যদি সত্যি সত্যিই ভর্তি করতে হয়? সে একা পারবে সামাল দিতে? তাই বেলিয়া যখন বলল সে রাতটা এই বাড়িতেই কাটাবে, ভুবন আপত্তি করল না। মনের জোর বাড়বে।
বেলিয়া একটা গভীর শূন্যতার দিকে এগোচ্ছে যেন। বেলিয়াকে ভিতরে ভিতরে অস্থির করে দিচ্ছে হাসি। হাসির চোখ-মুখের দিকে তাকালে বুকটা শুকিয়ে যায় বেলিয়ার। এমন প্রাণবন্ত মেয়ে কেমন ঝিমিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে? বেলিয়া আস্তিক। সে মনেপ্রাণে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। সে জানে একটা মঙ্গলময় শক্তি এই বিশ্বসংসারের কেন্দ্রে অহরহ জেগে। কিন্তু কিসে মঙ্গল? নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বেলিয়ার বিশ্বাস যেন সংশয়ের চোরাবালিতে ডুবছে। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে তার। মনোরমাকে এড়িয়ে যায়। মনোরমা তার কাছে মনের জোর চায়, আশ্বাস চায় – বেলিয়া বোঝে। কিন্ত কিভাবে দেবে সে? নিজের দৈন্যকে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। তাই এড়িয়ে যায়। এমন একটা ভাণ করে চলে যেন সে ভীষণ ব্যস্ত নিজের পরীক্ষা নিয়ে। কিসের পরীক্ষা? কোনো পরীক্ষা দেওয়ার মতোই তার আর মনের অবস্থা নেই। বেলিয়া বোঝে গোপেশ্বর নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। গ্রামে সবই জানে দুই ভাই। কিন্তু তাদের উদাসীনতা পীড়া দেয় গোপেশ্বরকে, বোঝে বেলিয়া। এক-একসময় মনে হয় দাদা কেন ওদের কাছ থেকে কিছু আশা করে এখনও? দাদার উপরেই রাগ হয় তার। কিন্তু মানুষটা যায় তো যায় কোথায় যায়? দোকানের বিক্রিও তো কমে গেছে অনেক, সব জানে বেলিয়া। তার একটা চাকরির খুব দরকার এখন, যে করেই হোক একটা চাকরি।
মৃন্ময়ীর জ্বরটা কমতে শুরু করল তিনদিন পর থেকে। রিপোর্ট ভালো। মৃন্ময়ী ভীষণ দুর্বল। কাজের দিদিই দু’বেলা রান্না করে দিয়ে যাচ্ছে এসে। ভুবন কিছুটা মনের স্বস্তি ফিরে পেয়েছে। বেলিয়া তবু এখনও রোজ রাতে চলে আসে। সে বলেছে দিদি যদ্দিন না নিজে রান্নাঘরে যেতে পারছে সে আসবে। মৃন্ময়ী এর মধ্যেই হাসির খোঁজ নিয়ে চলেছে। মনোরমাও সময় করে এসে দেখে যায় মৃন্ময়ীকে, আসার সময় এটা-সেটা রেঁধেও নিয়ে আসে, আসলে ভুবনকে খুব ভালোবাসে মনোরমা। মৃন্ময়ী সেটা জানে।
একদিন রাতে ভুবন আর বেলিয়া পাশাপাশি শুয়ে। পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছে মৃন্ময়ী।
বেলিয়া বলল, হ্যাঁরে ভুবন, ঈশ্বর কি সত্যিই আছেন?
ভুবন বলল, হ্যাঁ।
বেলিয়া খাটে বসে পড়ল। বাইরের জানলাটা দিয়ে আলো আসছে, গতকাল পূর্ণিমা ছিল। জানলার বাইরে আকাশের ঠিক মাঝখানে চাঁদটা। এ দৃশ্য তো নতুন কিছু নয়, তবু আজ যেন অন্যরকম লাগল বেলিয়ার। মনটাও তার অনেক প্রসন্ন যেন, বহুদিন পর। সে ভুবনের মুখের দিকে তাকালো। ভুবন চোখটা বন্ধ করে টানটান হয়ে শুয়ে আছে, ঘুমাচ্ছে না। কিছু একটা ভাবছে। বেলিয়া বলল, কি করে জানিস?
শুধুই জানা দিয়ে মামা, প্রমাণ দিয়ে নয়, ভুবন বলল।
ভুবন চোখ মেলে বেলিয়ার দিকে তাকালো। বেলিয়ার মুখের ওপর চাঁদের আলো এসে পড়েছে। কি স্নিগ্ধ শান্ত লাগছে বেলিয়াকে আজ, যেন তার মনের মধ্যে কোনো গ্লানি নেই। ভুবনের নিজের মনও শান্ত, একটা আরামের বোধ মাথার মধ্যে।
বেলিয়া জানলার দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞাসা করল, অনেকটা স্বগতোক্তির মত, আমি কেন পারি না?
ভুবন কিছু উত্তর করল না। তার নিজের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ববোধ, সে একটা মাধুর্যের বোধ। এই যে এই মুহূর্তের সৌন্দর্যটা, একে যদি কেউ অনুভব করতে না পারে তবে তাকে কি বোঝানো যায়? তার কি কোনো প্রমাণ হয়? তার এক বন্ধু উস্তাদ আমির খাঁ-এর গানকে বলে চীৎকার। তানকে বলে যেন কেউ এক মুখ গরম জল নিয়ে গার্গল করছে। ভুবন হেসে বাঁচে না শুনে। এও তো হয়। আমির খাঁ সাহেবের গানের মাধুর্য কি প্রমাণে বোঝা যায়? বেলিয়া তার মুখের দিকে তাকিয়ে। কি উত্তর দেবে? সে উঠে বসল। বলল, দেখো মামা, এ কোনো তত্ত্ব নয়, এ আমার একটা বিশ্বাসের আনন্দ বলতে পারো। এখানে কোনো স্বার্থ নেই, শুধু একটা আনন্দ আছে। ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি বলে আমার একটা বিশেষ কিছু হবে, সব সোজা হয়ে যাবে – এসবে আমার বিশ্বাস নেই। আমার একটা আনন্দ হয়। কিম্বা হয় তো এই একটা আনন্দকেই আমি ঈশ্বর বলে বিশ্বাস করি।
বেলিয়ার মনের মধ্যে আনন্দ শব্দটা খেলে গেল। হালকা বাতাসের মত। পুষ্প’র খোলা পিঠটা ভেসে এল। লক্ষ্মীর মুখটা মনে পড়ল। হাসির কাতর চাহনি মনে পড়ল। মনোরমার অসহায় চোখে ফুটন্ত ভাতের দিকে তাকিয়ে থাকা মনে পড়ল। এ মনে ঈশ্বর কোথায়? ভুবনের বলা আনন্দের আভাস তার মনে কই?
মৃন্ময়ী ডাকল, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, জল চাইল। ভুবন আর বেলিয়া একলাফে মৃন্ময়ীর ঘরে ঢুকল। মৃন্ময়ী বলল, আমি খুব জ্বালাচ্ছি তোদের নারে?
ভুবনের চোখে জল চলে এলো। সে বলল, জ্বরটা কি বাড়ল তোমার? এত জ্বরে ভুল বকোনি আর আর এখন...
বেলিয়া জল এনে মৃন্ময়ীর বিছানার মশারি তুলে বলল, জলটা নাও... দিলে আমার মোক্ষটা আটকে...
মৃন্ময়ী বলল, আমি?
বেলিয়া বলল, তুমি না তো কে? এইমাত্র তোমার ছেলের কাছে ঈশ্বরতত্ত্ব শুনছিলাম...
ভুবনের মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল... সে বলল, হ্যাঁ মামা, তুমি ওই বইটা এনেছ? চলো ওই বইটা পড়ি না হয় দু’জনে...
বেলিয়া ভুবনের এই গলার আওয়াজটা চেনে, তার মাথায় দুর্বুদ্ধি এখন, তাকে ফাঁসাচ্ছে... সে তাড়াতাড়ি মৃন্ময়ীর ঘরের আলো নিভিয়ে ভুবনের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, ও ঘরে চলো... খুব হয়েছে...
* * * * * *
রেলের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোল না নির্দিষ্ট সময়ে। কেউ জানে না কবে বেরোবে। দেখতে দেখতে বছর ঘুরল। বছরের সব আনন্দগুলো যেন বাইরের দরজা দিয়ে এসে ফিরে যায় এখন গোপেশ্বরের পরিবারে। গ্রাম থেকে কোনো ভাই একবারের জন্যেও দেখা করতে এল না গোপেশ্বরের সাথে। গ্রামে তাদের অবস্থা ফিরেছে এখন। তাদের ভয় গোপেশ্বর যদি টাকা চেয়ে বসে। গোপেশ্বর নিজেকে বলে, সে তো টাকা চাইত না, কিন্তু একবারের জন্যে পাশেও কি এসে দাঁড়াতে নেই? ফোনও করে না আজকাল। হাসি কলেজ যাওয়া ছেড়েই দিয়েছে একপ্রকার। সারাদিন শুয়ে থাকে। মনোরমা ইতিমধ্যে কয়েকটা গয়না বন্ধক দিয়ে টাকা জোগাড় করেছে বেশ কয়েকবার। প্রকাশের পড়াশোনাটাও চালিয়ে যেতে হবে। রেলের রেজাল্টের দিকে তাকিয়ে বসে পুরো পরিবারটা যেন, তাদের শেষ আশা। কিন্তু যা খবর আসছে তা সুখবর নয়। ভেতর থেকে নাকি লিস্ট তৈরি, পরীক্ষাটা নামমাত্র। এই কথাটা শুনে কয়েকবার বেলিয়া পুষ্প আর দিব্যেন্দুর সাথে কথা বলতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু বেশ বুঝতে পেরেছে তারা এড়িয়ে যাচ্ছে তাকে।
* * * * * *
হাসি গলায় দড়ি দিল। প্রথম চোখে পড়ল গোপেশ্বরের। গোপেশ্বর অনেক ভোরে ওঠে, পুরোনো অভ্যাস। ওর সাথে কেউ ঘুমাক হাসি পছন্দ করত না। খুব গরম হয় ঘরটা বলে গোপেশ্বর ভোরবেলা হাসির মশারিটা খুলে দিতে ওর ঘরে ঢুকেছিল। রোজই তাই করে। গোপেশ্বরের চীৎকার শুনে মনোরমা ছুটে আসে। হাসি ওর ওড়ানাটা গলায় দিয়েই পাখার সাথে ঝুলছে। পা-দুটো টানটান নীচের দিকে, যেন মাটি ছুঁতে চাইছে। হয়তো চেয়েছিল। হাসির খাটের পাশে ওষুধের প্যাকেটগুলো। পরে মনোরমার অনেকবার মনে হয়েছে, তবে কি প্যাকেটগুলো পাশে রাখাই উচিৎ হয়নি, ও দামগুলো পড়তে পারত তো! হাসি মুক্তি দিল। শেষের দিকে কয়েকবার বলেছিল যে প্রকাশের পড়াশোনার কি হবে? সে মুক্তি দিয়ে যাবে সবাইকে। তাই দিয়ে গেল।
মৃন্ময়ী মনোরমার পাশে বসে। কিছু বলার নেই। মনোরমা কাঁদছে না। সে শুধু বলে যাচ্ছে, মেয়েটা আমাদের মুক্তি দিয়ে গেল, না দিদি? মৃন্ময়ী চোয়াল দুটো শক্ত করে বলছে, ও কথা বোলো না মনোরমা, একটু কাঁদার চেষ্টা করো... মৃন্ময়ী নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না। উঠে গিয়ে বেলিয়ার ঘরে বসল, খাটে শুয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। মনোরমা ভুবনকে বলল, দিদির কাছে যা বাবু, আমি ঠিক আছি, আমি তো পাষাণ, লিঙ্গরাজের মত পাষাণ। দিদির মনটা বড্ড নরম...
লক্ষ্মীর চোখদুটো লাল, তার আর কাঁদার শক্তি নেই। সে পা ছড়িয়ে ঘরের এক কোণে বসে। যে কাজটা বহুবার সে নিজে করবে ভেবেছে, সেই কাজটা হাসি করে চলে গেল। হাসি সাহসী। কিন্তু কেন? সংসারে এত শোক আছে, মৃত্যুও তার কাছে নতুন কিছু না, আত্মহত্যাও নয়, কিন্তু এই মৃত্যুটাকে সে মেনে নিতে পারছে না। শুধু মনোরমার জন্যে। এত দুঃখ মানুষটার কপালে কেন? মনোরমা কোনো প্রশ্ন করেনি কোনোদিন লক্ষ্মীকে, শুধু ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করেছে। তাকে নিজের পাতের ভাত অবধি তুলে দিয়েছে। লক্ষ্মীর মনোরমাকে দেখেই ভালো হতে ইচ্ছা করেছে। সহ্য করতে শিখেছে। ভালোবাসার মত আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। বেলিয়া বোঝেনি সে অন্য কথা। সবাই তো মনোরমা নয়। কিন্তু এই মানুষটার কপালে এত দুঃখ কেন?
হাসির কাজের দিন গ্রাম থেকে সবাই এল। গোপেশ্বর কারোর সাথে কথা বলল না। চুপ করে থাকল। জলেশ্বরের দুই ছেলে আর ঢলেশ্বরের এক ছেলে এক মেয়ের খুব উৎসাহ এই ফাঁকে কলকাতাটা দেখে নেয়। তারা জানে এই মৃত্যুটা শান্তির, তাদের বাবা-মায়েরা আলোচনা করছিল, হাসিদি একটা বোঝা হয়ে থাকত নইলে জেঠা আর জেঠির গলায়। জলেশ্বর বড় ছেলে ভীম আর ঢলেশ্বরের বড় ছেলে কার্তিক মিলে বেলিয়াকে ধরল হাসির কাজের দু’দিন পর তাদের কলকাতা ঘুরিয়ে আনতে। বেলিয়া রাজি হল না। তখন তারা তাদের বাবা-মাকে ধরল যেন তারা একবার কলকাতাটা ঘুরিয়ে দেখায়। কিন্তু দুই ভাইয়ের কেউই রাজি হল না। কলকাতা চেনে কতটুকু তারা? শেষে বউ-বাচ্চা নিয়ে একটা বিপদ হোক আর কি।
তারা যখন বেলিয়াকে বলতে গেল তখনই অশান্তি উঠল চরমে। বেলিয়া রাগে ফেটে পড়ে মুখে যা এল তাই তার দুই দাদা-বউদিকে শুনিয়ে দিল। গোপেশ্বর একটা কথাও বলল না, মনোরমা কয়েকবার থামানোর চেষ্টা করে না পারাতে জোর করে বেলিয়াকে প্রকাশের সাথে মৃন্ময়ীর বাড়ি পাঠিয়ে দিল।
বেলিয়াকে হাতের কাছে না পেয়ে দুই ভাই মনোরমা আর গোপেশ্বরকেই ভালো করে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে গেল। এই মেয়ে যদি বেঁচে থাকত তবে পয়সার শ্রাদ্ধ, কার কাছে রেখে তারা চোখ বুজত ইত্যাদি ইত্যাদি।
মনোরমা আর গোপেশ্বর শুধু শুনেই গেল। মনোরমার মন এসব ছাড়িয়ে অনেক দূরে। আর দু’দিন বাদে যারা চলেই যাবে তাদের সাথে আর কি মুখ খারাপ করা, মেয়েটা কি আর ফিরবে তাতে? মনোরমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না আর। কোথাও চলে গেলে হত, কিন্তু কোথায় যাবে? অনেকে বলল, এমন মৃত্যু যখন, তখন কাশি গিয়ে একটা পিণ্ড দিয়ে এসো। গোপেশ্বরের মনে কথাটা ধরল, কিন্তু মনোরমা বলল, থাক, আমার বিশ্বাস হয় না।
বেলিয়া কথা বলা বন্ধ করে দিল একবারে। সে সারাদিন নিজের ঘরে থাকে। কেউ ডাকলেও আসে না। খাচ্ছেও না ঠিক করে। সারাদিন খবরের কাগজে কি খোঁজে। চাকরির বইগুলোর মধ্যে মুখ গুঁজে থাকে। সবাই বলল, একটু সময় দাও, ও ঠিক হয়ে যাবে।
একদিন ভোরে মনোরমা হঠাৎ শুনল কার যেন কথা বলার আওয়াজ। উঠে গিয়ে বাইরে এসে শোনে বেলিয়ার ঘরের দিক থেকে আওয়াজটা আসছে। তাড়াতাড়ি গোপেশ্বরকে ডাকল। গোপেশ্বর দোকান ঝাঁট দিচ্ছিল। দুজনে মিলে বাইরে থেকে অনেকবার ডাকল বেলিয়ার নাম ধরে, বেলিয়া সাড়া দিল না, কি যেন সে বলেই যাচ্ছে। পাড়ার লোক ডেকে দরজাটা ভাঙা হল। বেলিয়া উলঙ্গ হয়ে শুয়ে দেওয়ালের দিকে ফিরে কি যেন বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে...
মনোরমা যেন তার সব শোক, সব শূন্যতা একধাক্কায় ভুলে গেল। সে বাথরুমে গিয়ে এক বালতি জল এনে খাটে শুয়ে থাকা বেলিয়ার মাথায় ঢালতে শুরু করল। মাথায় জলটা পড়তেই বেলিয়া চমকে উঠে তার দিকে তাকিয়ে বলল, বউদি এখানে কি করছ? যাও হাসির ঘরে যাও, ও একা থাকলেই গলায় দড়ি দেবে, যাও যাও... বউদি যাও... এই প্রকাশ, নিয়ে যা বউদিকে, এক্ষুণি নিয়ে যা, নইলে হাসিকে বাঁচাতে পারবি না রে... যা... যা...
গোপেশ্বর ডুকরে কেঁদে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল। যে কান্না মনোরমা শ্মশানে কাঁদেনি, মেয়ের মুখাগ্নি নিজের চোখে দেখে কাঁদেনি, শ্রাদ্ধের ওই নিষ্ঠুর অমানবিক অনুষ্ঠানে কাঁদেনি, সেই কান্না সে বেলিয়াকে জড়িয়ে কাঁদল আকাশ ফাটানো চীৎকার করে, তার আশেপাশে দাঁড়ানো পাষণ্ডপ্রায় মানুষও সেই কান্নায় নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। লক্ষ্মী তার মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে বলে রিকশায় উঠছিল, কান্নার আওয়াজ শুনে সে দৌড়ে এসে দেখে মনোরমা বেলিয়াকে জড়িয়ে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে, আর বেলিয়া শূন্যদৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তার বউদির মুখের দিকে তাকিয়ে।
সকালবেলা মৃন্ময়ী আর ভুবন সদ্য চা নিয়ে বসেছে, জলধর খাটের এক কোণে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। প্রকাশ ঝড়ের মত ঘরে ঢুকেই বলল, পিসী তাড়াতাড়ি চলো কাকা পাগল হয়ে গেছে।
১১
পাঠক, এইবারে আমি দিশাহারা। বেলিয়ার মনের অবস্থা বর্ণনা করতে পারি এমন অন্তর্দৃষ্টি আমায় বিধাতা দেননি। তার বাইরের কিছু আচরণ শুধু বর্ণনা করার চেষ্টা করতে পারি। একজন মানুষ যখন তাকায়, সে দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা থাকে, প্রশ্ন থাকে, প্রসন্নতা থাকে, ক্ষোভ-দুঃখ-অবসাদ থাকে, কিন্তু বেলিয়ার দৃষ্টিতে শুধুই শূন্যতা। মাঝে মাঝে যেন কাকে খোঁজে, খুঁজতে খুঁজতে খেই হারিয়ে ফেলে। কিছু বলতে যায়, শব্দগুলো হাতড়ে ফেরে। শব্দগুলো জুড়ে জুড়ে যে একটা বাক্য বলবে, সেই সুতোটা কই? সব অর্থহীন ঘটনাপ্রবাহ যেন তার সামনে, কোনো মিল নেই। গতি আছে সব কিছুর, কিন্তু গন্তব্য কই?
বেলিয়া মাঝে-মাঝেই কোনো ঠাকুরের ছবির সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। যেখানেই ঠাকুরের ছবি দেখে — সে ক্যালেণ্ডারে হোক, ধূপের প্যাকেটে হোক, বইয়ের মলাটে হোক সে হাত জোড় করে কি যেন সব বলে। হাসির ঘরে গিয়ে পাখাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনোরমা খাইয়ে দিলে খায়, নইলে খেতে চায় না। অন্য কারোর কাছেই খায় না। কখনও কখনও মনোরমার কাছেও না, ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকে সারাটা দিন। মাঝে মাঝে ডুকরে কেঁদে ওঠে, আবার পরক্ষণেই স্থির হয়ে যায়।
মৃন্ময়ী মাঝে মাঝে ভুবনকে নিয়ে আসে। মৃন্ময়ীর চোখ বেলিয়ার ঘরের চৌকাঠে পা দিলেই সজল হয়ে ওঠে। ভুবন বলে, তুমি শক্ত না হলে এরা ভরসা কোথায় খুঁজবে মা? তুমি ওরকম কোরো না। মৃন্ময়ী ভুবনের মাথায় হাত রাখে, স্মিত হাসে। ছেলেমানুষ, বোঝে না, বড় হবে যখন বুঝবে আসলে শক্ত হৃদয় বলে কিছু হয় না --- জীবিত বা মৃত হয়। শোক থাকুক, আঘাত থাকুক, মানুষ কাঁদুক, কিন্তু মৃত না হোক তার হৃদয়। হৃদয়শূন্য এ জীবনের ভার অসহ্য, মৃন্ময়ী ভাবে।
ভুবন বেলিয়াকে দেখে স্তব্ধবাক, মানুষের এমন পরিণতিও হয়? মৃন্ময়ী বেলিয়ার সামনে বসে তার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করে, পারে না। বেলিয়াকে মৃন্ময়ী ডাকলে অবাধ্য হয় না কখনও, কিন্তু সবসময় যে কথা বলে তাও নয়, চুপ করেই থাকে বেশিরভাগ সময়। আবার কখনও বিহ্বল হয়ে ওঠে, অসংলগ্নভাবে কিছু কথা বলে, তারপর কেঁদে মৃন্ময়ীর কোলে মাথা গুঁজে দেয়। মৃন্ময়ী মনে মনে বলে, শান্ত হ, বেলিয়া শান্ত হ। বেলিয়া স্থির হয়। শান্ত হবে কি করে সে? তবে ক্লান্ত হয়। মন আর শরীর দুই-ই শান্ত না হোক, ক্লান্ত তো হয়ই, যত বড়ই শোক হোক না কেন, তার ভার বহন করতে করতে মানুষ ক্লান্ত হয়েই পড়ে। কেউ মোড় ফেরায়, কেউ যে কোনো ঘাটে জীবন তরীকে ভিড়িয়ে, ভাবে মুক্তি পেল বুঝি, যেমন হাসি। বেলিয়া জানে না তাকে কি করতে হবে। এখনও স্পষ্ট নয়।
পুষ্প এইসব ঘটনায় একেবারে 'থ' হয়ে গেল। জীবনে সে ভোগ-সুখের দিকটাকেই প্রধান করে দেখেছিল। তার রূপ আছে, শরীর আর হৃদয় জোড়া দেওয়ার মত সুখের প্রতিশ্রুতি আছে, যাকেই সে কামনা করুক না কেন, কিন্তু তার হৃদয়েরও অতৃপ্ত বাসনার আগ্নেয়গিরির নীচে যে একটা কান্নার ফল্গুধারা আছে, কি একটা যেন না পাওয়ার ব্যথা আছে --- সে এতদিন জানতই না। প্রথমে সে ভেবেছিল বেলিয়াকে এড়িয়েই হয়তো পরিত্রাণ পাবে। কিন্তু তা তো হল না! বেলিয়া যে শুধু তার শরীরের তাপে জড়ায়নি, তার অজান্তে কখন যে তার প্রাণের গভীরের সেই ফল্গুধারায় মিশেছে তা পুষ্প আজ বুঝল। বিধাতা সংসারে পাপকে এত বড় করে তৈরি করতে পারেননি যে তার সমস্তটা মিলেও সমগ্র মনুষ্যত্বটুকুকে গ্রাস করে ফেলতে পারে। রাহুর গ্রাসের থেকে চাঁদের নিষ্ক্রমণের পথ করেই বিধাতা রাহুকে গ্রাস করার অভিনয়টুকুর অধিকার দেয়, তা খেলামাত্র হয়ে ওঠে। দুর্বল ভয় পায়, প্রজ্ঞাবান হাসে।
বেলিয়ার মুখটা মনে পড়লেই পুষ্প অস্থির হয়ে উঠতে শুরু করল নিজের চার দেওয়ালের মধ্যে। যত দিন যেতে লাগল, মৃন্ময়ীর কাছে যত সে বেলিয়ার কথা শুনতে লাগল, তত সে যেন তার ধৈর্যের শেষ সীমানার দিকে এক পা, এক পা করে এগোতে লাগল। অবশেষে একদিন বিকালে আর থাকতে না পেরে দিব্যেন্দুকে বলল, চলো, আমায় নিয়ে বেলিয়ার বাড়ি চলো।
“আমায় নিয়ে!” --- এ শব্দবন্ধ পুষ্প’র অভিধানে কোনোদিন আছে জানত না দিব্যেন্দু। সে কিছুটা বিস্মিতই হল। কিন্তু কোনো এক সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত মেনে জীবনে চলা মানে মূর্খামি, জীবন এতটা তো শিখিয়েছেই দিব্যেন্দুকে। সে দ্বিরুক্তি না করেই বলল, চলো। কোথাও তার নিজকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্তও করতে হবে নাকি?
বেলিয়া শুয়ে ছিল চৌকির একধারে, দেওয়ালের দিকে। পুষ্প ঢুকতেই সে জড়সড় হয়ে নিজেকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসল। পুষ্প’র দুই চোখ ছাপিয়ে জল, সে কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে বলল, কেমন আছো বেলিয়া?
দিব্যেন্দু পুষ্প’র এই রূপ কোনোদিন দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। সে বিস্মিত হয়ে পুষ্প’র দিকে তাকিয়ে থাকল। কিসে এ অবস্থা করল পুষ্প’র? তার দম্ভের প্রাচীর ভাসিয়ে এমনভাবে কে তাকে দাঁড় করালো --- তার অপরাধবোধ না ভালোবাসা? দিব্যেন্দু বুঝল না। পাপ মানুষকে কাঁদায় না, কাঁদায় পাপস্খালনকারী ভালোবাসা। মানুষ একমাত্র শুদ্ধ হয় ভালোবাসায়। দিব্যেন্দুর সামনে পুষ্প এখন তার স্ত্রী নয়, তার কোনো অধিকার নেই যেন পুষ্প’র উপর, পুষ্প কাঁদুক। শুদ্ধ হোক। পুষ্প জানল না তার দিকে অপলক সিক্তচোখে তাকিয়ে দিব্যেন্দু, খেয়াল করার অবস্থায় নেই এখন সে। তার মনের মধ্যে তুমুল ওথাল-পাথাল। দিব্যেন্দুর মনে হল পুষ্পকে একটু আলাদা সময় দেওয়া উচিৎ বেলিয়ার সাথে। সে উঠে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে গোপেশ্বরের কাছে দোকানেই বসল। মনোরমা তাদের জন্য চায়ের জল চাপিয়েছে।
পুষ্প হাতজোড় করে বেলিয়ার দিকে তাকিয়ে, ক্ষমা চাইতে চাইছে, কিন্তু কিভাবে, কি ভাষায়? সে ভাষা খুঁজতে গিয়ে নিজের ভিতরের সব ভালোবাসাটুকুকে ঘেঁটেও পেল না পুষ্প, বেলিয়া শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে তার সামনে বসে। নিজেকে এমন অসহায় যেন কোনোদিন বোধ করেনি পুষ্প।
পুষ্প ধীরে ধীরে উঠে এসে মনোরমার পাশে বসল, মেঝেতে। তার চোখের জল বাঁধ মানছে না। মনোরমা বলল, আমরা কাল পারাদ্বীপ যাচ্ছি। যদি ওর মাথাটা ঠিক হয় সেখানে গেলে।
কথাটা সত্যি। মনোরমা বা গোপেশ্বর কারোরই মনের অবস্থা এমন নয় যে বেলিয়াকে এ ডাক্তার সে ডাক্তারের কাছে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে। তবু একজন ডাক্তারকে দেখানো হয়েছিল। কয়েকদিন ঘুমের ওষুধে ঝিমিয়ে ছিল বেলিয়া। কিন্তু সে সুস্থ হয় কই? মৃন্ময়ীই বলেছিল শেষে একদিন এসে, তুমি ওকে ছোটোবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যাও মনোরমা, দেখ যদি ও ঠিক হয়ে ফেরে। মনোরমা আবার লিঙ্গরাজের কাছে মানত করল, যদি সে তাকে সুস্থ করে নিয়ে ফিরতে পারে তো ফিরবে, নইলে এই তার শেষ যাওয়া।
পুষ্প ফিরে যাওয়ার সময় আর বেলিয়ার ঘরে গেল না। এই প্রথম সে মনোরমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, আমায় কিছু লাগলেই বোলো দিদি... আমি...
কথাটা শেষ করতে পারল না, এক দমকা কান্নায় কথা হারিয়ে মনোরমাকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। দিব্যেন্দু বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। মনোরমা পুষ্প'র মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, মানুষের জীবন অনেক ওঠাপড়া দিয়ে যায় গো, তুমি কিছু ধরে বসে থেকো না, ভালো করে মেয়েটাকে মানুষ করো, আমায় দেখলে তো... আমার মেয়েটা...
মৃন্ময়ী ঢুকছে, সাথে ভুবন আর লক্ষ্মী। মনোরমা চুপ করে গেল। কাল পারাদ্বীপ যাবে মনোরমা। আর কি ফিরবে? সন্ধ্যে হয়ে গেছে। এ বাড়ি, সে বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ আসছে। লক্ষ্মী, মনোরমা, মৃন্ময়ী, পুষ্প --- সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে। ভুবন বুঝতে পারছে না সে কোনদিকে যাবে। সবার চোখে জল। এ শোকের কোনো নির্দিষ্ট অবয়ব নেই ভুবনের মনে হল। সে নিমগাছের নীচে এসে দাঁড়ালো। সন্ধ্যাতারাটা জ্বলজ্বল করছে। কোথায় শোক? এ তো জীবন। এই তো জীবন – অধ্রুব, অনিশ্চিত, দুঃখময় – বুদ্ধ বলেছেন; গীতায় আছে – ভুবন পড়েছে।
দীর্ঘ এতগুলো বছর পরে যখন বেলিয়া আর প্রকাশকে নিয়ে বাস থেকে নামল মনোরমা তখন সত্যিই সে চিনতে পারেনি তার নতুন বউ হয়ে প্রথম হাঁটা এই স্বপ্নলোকের রাস্তাটাকে। সব কত বদলে গেছে। কিছুটা বদলিয়েছে মানুষ, কিছুটা বদলিয়েছে প্রকৃতি। গতবছর একটা বিশাল ঘূর্ণীঝড় বয়ে যায় পারাদ্বীপের ওপর দিয়ে, তার শ্বশুরের ভিটেরও খুব করুণ অবস্থা হয়েছিল সে শুনেছে। নিজের চোখে দেখে সত্যিই মনে হল যে ঝড় তার পরিবারের ওপর দিয়ে যাচ্ছে সে ঝড় যেন তার শ্বশুরের ভিটেকেও রেয়াত করেনি। মনের মধ্যে একটা গভীর দোলাচাল মনোরমার মনে। পারবে তো সে বেলিয়াকে নিয়ে ওদের সাথে থাকতে? নিন্দা-অপমানের ভয় আর নেই মনোরমার, এ সব কিছুর ঊর্ধ্বে তার মন এখন। তার একমাত্র লক্ষ্য বেলিয়াকে সুস্থ করে তোলা। যেভাবেই হোক, যে মূল্যেই হোক। তবু মনোরমা একবার ভেবেছিল শেষ অশান্তিটার কথা। যদি এরা আবার কোনো অশান্তি করে! কিন্তু দেখল তা নয়, ভাঙাবাড়ির একদিক মেরামত করে তার আর বেলিয়ার জন্য দুটো ঘর তৈরি করে রাখা। বেলিয়াকে নিয়ে তাদের কৌতুহল যে নেই তা নয়, কিন্তু দুঃখও যে নেই তাও নয়।
প্রথম প্রথম নানা জনে নানা কবিরাজ-ডাক্তারের খবর দিতে লাগল। কার কোন আত্মীয় বদ্ধ পাগল অবস্থা থেকে কোন ডাক্তার, কোন কবিরাজের চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সুস্থ এখন তার হাজার একটা উদাহরণ রোজ শুনতে হচ্ছে। কেউ বলছে শিবের মন্দিরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে; কেউ বলছে বেলিয়াকে হাসির আত্মা ধরেছে, হাসির নামে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গয়ায় গিয়ে পিণ্ডি দিয়ে আসতে। মনোরমা সব শোনে, মন সাড়া দেয় না। তার শুধু মনে হয় বেলিয়াকে সব কিছু থেকে আলাদা করে রাখতে হবে। বেলিয়া সমুদ্র ভালোবাসে, তাই বেলিয়াকে নিয়ে কেউ না কেউ প্রতিদিন সমুদ্রের ধারে যায়, বিশেষ করে বিকালটা। বেলিয়া কথা বলে না। চুপ করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। মাঝে মাঝে ডুকরে কেঁদে উঠে চুপ করে যায়। শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার বাবা-মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন বলে মনে মনে। বাড়ির বাচ্চাগুলোও বুঝতে শুরু করেছে তাদের কাকার অসুখটা অন্যরকম। তারা মনোরমার কাছে জিজ্ঞাসা করে কাকা ভালো হবে কি না, মনোরমা জোরের সাথে বলে, হবে হবে।
মাস ছয়-সাত পর থেকে বেলিয়ার মনের মধ্যেকার অস্থির ভাবটা কমতে শুরু করল। একটু একটু কথায় সাড়া দিত, কথা বলত অল্প অল্প। প্রকাশ আর গোপেশ্বর তাদের দোকান আর সংসার সামলাতে লাগল। ফোনে যোগাযোগটুকু হত, মাঝে মাঝে খবর আসত বেলিয়া অল্প অল্প কথা বলছে।
পাঠক, আমরা বেলিয়ার এই সুস্থ হয়ে ওঠার গল্পটাকে পারাদ্বীপের সমুদ্রের তীরে রেখে আবার সালকিয়ায় ফিরি। বছর দুই ঘুরে গেল। মৃন্ময়ীর সংসারে একটা বড় পরিবর্তন হয়ে গেছে। মৃন্ময়ীর ভাশুর হঠাৎ সেরিব্রাল অ্যাটাকে মারা গেল, বয়েস হয়েছিল বাহান্ন। শশধরের এই মৃত্যু জলধরের অন্তরের শান্তি আর সাম্যকে একেবারে তছনছ করে দিল। যে বেগে সে জীবনের গতিতে পাড়ি জমিয়েছিল, হঠাৎ সব কিছু ছেড়ে যেন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর কোথাও যাওয়ার নেই যেন, আর কিছু করার নেই তার। মৃন্ময়ী পড়ল ভীষণ বিপদে। ইতিমধ্যে লিলুয়ায় সেই জমিতে বাড়ির কাজ শুরু হয়েছে। দেখাশোনা মৃন্ময়ী আর জলধরই করত। এখন ভার এসে পড়ল ভুবনের উপর। ভুবনের পড়াশোনার চাপ যথেষ্ট এখন, সে যতটা সময় দিতে পারে চেষ্টা করে, মৃন্ময়ীকেই দৌড়াতে হয় বেশি। এই অবস্থায় স্বপন হয়ে উঠতে লাগল লাগামছাড়া। তার সমস্ত বদভ্যাস তাকে ক্রমশ এমন একটা দিকে নিয়ে যেতে শুরু করেছে যে তার নাগাল না জলধর পেল, না মৃন্ময়ী। কোনো বারণ, কারোর কথা শোনার মত অবস্থায় স্বপন কোথায়? জলধরের মধ্যে এখন শ্মশান-বৈরাগ্য। কোনো বিষয়েই সে নিজেকে জড়াতে চায় না। মৃন্ময়ী কোনো খেই পায় না। তার কথা বলার মতো মানুষ কই?
ঘটনা আরো খারাপের দিকে গেল, স্বপন প্রায়ই বাড়ি আসে না। স্বপনের মুখ থেকে অনেকবার রাতে মদের গন্ধ পেয়েছে মৃন্ময়ী। ভুবনকে বলেছে বাধ্য হয়ে। ভুবন স্বপনের সাথে কথা বলতেও চেষ্টা করেছে। সে শুনবে না। উচ্চমাধ্যমিকের পর তার পড়াশোনা করার আর ইচ্ছে নেই বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছে। ভুবন বুঝল বাড়ির যা অবস্থা তাকে যে করেই হোক আগে একটা কাজ জোটাতে হবে। প্রাইভেটে এটা-সেটা ইন্টারভিউ দিতে দিতে একটা চাকরি জুটেও গেল। কিন্তু বাইরে ট্রেনিং-এর জন্যে থাকতে হবে বেশ কিছুদিন। তাই হল। মৃন্ময়ী আরো একা হল। স্বপন ক্রমে অন্ধকার জগতে আরো কয়েক ধাপ এমন নেমে গেল, যেখানে ভালো করে চোখই যায় না, ফেরানোর কথা তো দূর।
এরই মধ্যে একদিন সালকিয়ার বাড়ির পর্ব শেষ করে লিলুয়ার বাড়িতে গিয়ে উঠল মৃন্ময়ী আর জলধর, ভুবন বাইরে, স্বপনের গতিবিধি কেউ জানে না। ছোটো করে একটা গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠান হল। গোপেশ্বর আর প্রকাশ সারাদিন থাকল দোকান বন্ধ করে। মৃন্ময়ী ইচ্ছা করেই যেন বেলিয়ার প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল। গোপেশ্বর একবার খালি যাওয়ার সময় বলল, বেলিয়া থাকলে দিদি তোমায় আজ আর এত ভাবতেই হত না।
মৃন্ময়ীর দুটো চোখ জলে ভরে এল। শুধু মাথাটা নেড়ে বলল, হুম।
অনেক রাতে ফোন করল মৃন্ময়ী মনোরমাকে। কয়েকটা কথার পর বলল বেলিয়াকে ফোন দিতে। মাঝে মাঝে দু-একটা কথা বলে বেলিয়া এখন। বেলিয়া ফোন ধরে বলল, প্রণাম দিদি।
মৃন্ময়ীর গলা বুজে এল ওর গলাটা শুনেই। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ঘুমিয়ে পড়েছিলি বেলিয়া?
বেলিয়া বলল, না দিদি, বমি হল একটু আগে। মাঝে মাঝেই হয়।
মৃন্ময়ী বলল, অনেকরকম ওষুধ খেলি কিনা বল এতগুলো দিন, ওই জন্যেই হচ্ছে, ঠিক হয়ে যাবে।
বেলিয়া বলল, এখানের ডাক্তারও তাই বলল... তোমার আজ গৃহপ্রবেশ ছিল না দিদি...
মৃন্ময়ীর চোখের থেকে জল গাল গড়িয়ে তার সদ্য আজকেই ভাঙা শাড়ির উপর পড়তে শুরু করল, মৃন্ময়ী কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে আয় বেলিয়া... আমি ভীষণ একা হয়ে গেছি রে বাবু...
তুমি কাঁদছ?... বেলিয়া ধরা গলায় বলল... আমি খুব দুর্বল হয়ে গেছি দিদি নইলে আমি ঠিক আসতাম জানো...
মৃন্ময়ী বলল, আয় বাবু... তাড়াতাড়ি ফের, তোর জন্যেও একটা ঘর রাখা আছে... আয় তুই...
১২
বেলিয়া মারা গেল মৃন্ময়ীর গৃহপ্রবেশের মাস ছয়েক পর।
একদিন হঠাৎ খাওয়ার পর ভীষণ বমি শুরু হল। সাথে অসম্ভব পেটে ব্যথা। এই ব্যথাটার কথা মাঝে মাঝেই বলত বেলিয়া। স্থানীয় ডাক্তার একজনকে দেখিয়ে বেশ কিছুদিন চিকিৎসাও হয়েছে। তার খাবার হজম হত না, খিদে হত না, ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছিল, চোখ-মুখ বসে যাচ্ছিল। একদিন কিছুটা জোর করেই মনোরমা বেলিয়াকে নিয়ে সদর হাস্পাতালে গেল। বেশ কিছুদিন এই টেস্ট, সেই টেস্ট হওয়ার পর ধরা পড়ল লিভার ক্যান্সার। রোগটা ছড়িয়ে গেছে। আর বড় জোর এক বছর আয়ু।
মনোরমা বাড়িতে এসে কাউকে কিছু বলল না। গোপেশ্বরকে ফোন করে বলল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে বেলিয়াকে নিয়ে হাওড়ায় ফিরছে। বেলিয়া অসুস্থ, এসে কথা হবে।
বাড়িতে সবার প্রশ্নের উত্তরে এটা-সেটা বলে মনোরমা একাই বেরিয়ে পড়ল বেলিয়াকে নিয়ে। দুই দেওর সাথে আসতে চেয়েছিল, মনোরমা কিছুটা রূঢ়ভাবেই বলে দিল - না। মনোরমা নিজেকে বুঝতে পারছে না, কেন সে এরকম অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে সবার উপরে আজ, কিন্তু আজ যেন তার কারোর দিকে তাকাবার অবসর নেই। বেলিয়াও জেনে গেছে ডাক্তার বলেছে তার আয়ু আর এক বছর, তার শরীরে মারণরোগ।
স্টেশানে বেলিয়া আর মনোরমা বসে। রাতের ট্রেন, লেট আছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। মনোরমা জিজ্ঞাসা করল, কিছু খাবে বেলিয়া? বেলিয়া মাথা নেড়ে হাসল। তার মুখটা কত সরু হয়ে গেছে। চোখদুটো কোটরে ঢুকে গেছে। মনোরমা এক কাপ চা নিয়ে বেলিয়ার পাশে এসে বসল। দুপুরে ভাতগুলো গলা দিয়ে নামেনি। এখন অল্প অল্প খিদে পাচ্ছে। বেলিয়া কিচ্ছু দাঁতে কাটেনি।
বেলিয়া ঘাড়টা নীচু করে, চোখটা বুজে বসে। তার প্রথম পারাদ্বীপ ছেড়ে কলকাতায় যাওয়ার দিনটা মনে পড়ছে। সেদিন সে জানত না কলকাতা আর হাওড়া দুটো আলাদা জায়গা। সে তো বুঝতে পারছে সে আর কোনোদিন ফিরবে না পারাদ্বীপে, কিন্তু তার তেমন কষ্ট কই হচ্ছে? এক মুহূর্তের জন্য অবশ্য হয়েছিল, যখন গাড়িতে উঠছিল একবার ভেবেছিল বলে সে মনোরমাকে, ‘বৌদি আমায় এই সমুদ্রের ধারে রেখে যাও, আমি এখানেই মরি’, বলেনি, কারণ কে তার ঝক্কি সইবে এক মনোরমা ছাড়া? তাছাড়া মৃন্ময়ীকেও একবার শেষবারের মতো দেখতে ইচ্ছা করছিল তার। ইদানীং রাতে ভালো ঘুম হত না। সারারাত ধরে সমুদ্রের গর্জন শুনত। ঘুমাতে ভয় করত, যদি আর ঘুম না ভাঙে?
স্টেশানটা ফাঁকাই, রাত সাড়ে এগারোটা। সামনের সিগন্যালটা লাল। বেলিয়া অনেক সাহিত্য পড়েছে, বাংলা সাহিত্য। তারাশঙ্কর, বিভূতি, মানিক – তার মধ্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার খুব কাছের। এই বাংলা বই পড়ার অভ্যাসও মৃন্ময়ীর কাছ থেকে শেখা। দিদির বাড়ি প্রচুর বই। জলধরদা দারুণ কবিতা বলতে পারে। আজ তার সামনে জ্বলে থাকা এই লাল সিগন্যালটার দিকে তাকিয়ে বেলিয়ার কেবল মনে হচ্ছে সেই কবিতাটার কথা, জলধরদার মুখে শোনা --- যেতে নাহি দিব। রবীন্দ্রনাথের লেখা।
বেলিয়া মনোরমার দিকে ফিরে বলল, বৌদি, তুমি প্রকাশকে ঠিক করে মানুষ কোরো। আমাকে আর হাসিকে নিয়ে বেশি ভেবো না। আমরা ঠিকই থাকব, তুমি তো আসবেই একদিন না একদিন আমাদের কাছে, দেখো আমরা অপেক্ষা করব তোমার জন্য। তুমি দাদা আর প্রকাশের কাছে কাটিয়ে এসো যতদিন পারো, দাদা তোমায় ছাড়া কিচ্ছু পারবে না। তোমার কিছু হলে প্রকাশের কি হবে সে আমার থেকে আর কে বেশি জানবে বলো? মা ছাড়া ছোটোবেলাটা কাটানো খুব শক্ত, না গো? আচ্ছা বৌদি, আমি যখন যাব, আমার মা আমায় দেখে চিনতে পারবে?
মনোরমার হাতের চায়ের ভাঁড়টা শক্ত করে ধরা। ভাঁড়ের তাপে মনোরমার হাতের চামড়াটা জ্বালা জ্বালা করছে, মনোরমা সরাতে চাইছে না হাতটা, পুড়ুক, মনটা ব্যস্ত থাকবে জ্বালা সহ্য করতে, তবু চোয়াল দুটো শক্ত করে বলল, তুমি মারা যাচ্ছ না বেলিয়া, কলকাতায় অনেক বড় বড় ডাক্তার, আমরা চিকিৎসা করাব, তুমি বাঁচবে।
এর থেকে বেশি শব্দ উচ্চারণ করার ক্ষমতা মনোরমার সমস্ত প্রাণটুকু নিংড়ালেও এই মুহূর্তে আর নেই। কয়েক মাস পরে ভোরের আলোয় যখন বেলিয়াকে চন্দন পরিয়ে, মালায় সাজিয়ে দোকানের সামনে ঝাঁট দেওয়া পরিষ্কার জায়গাটায় এনে রাখা হয়েছিল, মনোরমার এই কথাগুলো আবার মনে পড়েছিল, যেন বেলিয়া তার পাশে বসে আবার সেই কথাগুলো বলে যাচ্ছে। মনে মনে মনোরমা বলেছিল, ‘তুমি যাও বেলিয়া, মা আর হাসি অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে, আমার জন্য অপেক্ষা কোরো’। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে এমন একটা আত্মীয়তার সেতু সেদিন থেকে তৈরি হয়ে গিয়েছিল মনোরমার মনে যা সারাজীবন তাকে এক অব্যক্ত শান্তি জুগিয়েছে।
চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাস্পাতালে চিকিৎসা শুরু হল।
এই তিন-চার বছরে বেলিয়ার সালকিয়ায় না থাকাতে, এখানকার অলিতে-গলিতে তার প্রাণবন্ত উপস্থিতি অনেকের মনে ফিকে হয়ে এসেছে। বেলিয়ার চেহারা দেখে অনেকে চিনতেই পারল না। এত কালো, এত রোগা, চোখদুটো কোন কোটরে ঢুকে, কে এ? এ বেলিয়া? আহা রে... বেচারা..
এর থেকে বেশি সহানুভূতি আশাও করে না মনোরমা এখন। সবার কথা চুপ করে শোনে। রাতে মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে নিমগাছটার নীচে বসে। এক আকাশ তারা আর নিমপাতার ঝালরের আওয়াজে ঘুম এসে যায়, গাছের নীচেই ঘুমিয়ে পড়ে। জগন্নাথের কাছে একটাই প্রার্থনা, প্রকাশটা মানুষ হোক। নিজের আশা করার ক্ষমতা দেখে অবাক হয়ে যায় নিজেই মাঝে মাঝে মনোরমা। এখনও তার প্রার্থনা ফুরায়নি? এখনও না? মনোরমা তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হাসিকে খোঁজে। ছোটোবেলায় মামা তাকে বলত ওই তারাদের মধ্যেই তার মরা বাবা-মা আছে। তখন বিশ্বাস করত। কত খুঁজত। মামাকে জিজ্ঞাসা করত, চিনব কি করে? মামা বলত, দেখতে দেখতেই চিনে যাবি। কোনোদিন চেনেনি। আজ মনোরমা নিজের মনকে বলে, দেখতে দেখতে চিনে যাবি। কাকে চিনবে? এত লক্ষ লক্ষ তারা যেন লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বজন হারানোর সাক্ষ্য বহন করে নিয়ে চলেছে। জগতে ব্যথা কি তার একার শুধু? মনোরমার মন উদাস হয়ে যায়, সংসারের সব সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়।
বেলিয়া আর কেমো নেবে না জানিয়ে দিল। সে বলল, আমায় আর টানা-হেঁচড়া কোরো না তোমরা, আমায় এবার তোমরা রেহাই দাও, আমায় যেতে দাও, আর যন্ত্রণা দিও না।
তাকে সমস্ত বোঝানোর চেষ্টা বিফলে গেল। সে আর যাবে না। বেলিয়া হাসি'র ঘরে শুয়ে থাকত। কেউ এলে কখনও কথা বলত, কখনও বলত না।
এর মধ্যের একদিনের ঘটনা, শীতকাল, একটা কম্বল জড়িয়ে বেলিয়াকে মাঠে রোদে মাদুর পেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ভুবন এসেছে দেখা করতে। ভুবনকে দেখে স্মিত হাসল বেলিয়া। বলল, কেমন আছিস ভাঞ্জা? ভুবন মাথা নাড়ল। যদি কেউ বলে না দিত এটা বেলিয়া সে চিনতে পারত কি? কয়েকটা হাড় শুধু বেরিয়ে আছে। গলার আওয়াজটা ক্ষীণ, সরু। দু'জনেই চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। কিছু বলার নেই, সব কথার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর বেলিয়া মাথাটা একটু তুলল। কি একটা দরকারি কথা যেন মনে পড়ে গেছে তার। ভুবন কানের কাছে মাথাটা নিয়ে গেল। বেলিয়া বলল, আমার অ্যাকাউণ্টে ক’টা টাকা আছে, দেখ তো প্রকাশের জন্য যদি একটা কম্পিউটার কেনা যায় তাই দিয়ে, ওর খুব দরকার।
ভুবনের জন্য চা নিয়ে এল লক্ষ্মী। একটা সবুজ শাড়ি গায়ে। তাকে যেন চেনাই যায় না, সব রুক্ষতা সরে গিয়ে একটা লাবণ্য এসেছে তার সারা শরীরে, তার হাঁটাচলা কথাবার্তা সব বদলে গেছে। সে হেসে বলল, ভালো আছো ভুবনদা? তোমার মা-ও এসেছেন, রান্নাঘরে আছেন। ভুবন হাসল।
লক্ষ্মী সারাটাদিন নিজেকে বেলিয়ার নানা কাজে ব্যস্ত রাখে, বেলিয়া ফেরা ইস্তক। বেলিয়ার চাওয়া-না চাওয়ায় কিছুই আসে যায় না তার এখন। বেলিয়াও কিছু বলে না লক্ষ্মীকে। লক্ষ্মীর এই আনন্দময় সত্তাটা তাকে কোথাও অনুপ্রাণিত করে রাখে। লক্ষ্মী সারাদিন এটা-সেটা গল্প করে বেলিয়াকে রোগের কথা, মৃত্যুর কথা যেন ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। লক্ষ্মী প্রতিমাসে একবার করে দক্ষিণেশ্বর যায়। বেলিয়া বলে, আরো এক মাসের আয়ু চেয়ে নিয়ে আসলে? লক্ষ্মী হাসে। লক্ষ্মী একদিন বেলিয়াকে বলেছিল, জানো বেলিয়া, আমি জানতাম না আমার জীবনে এমন কোনো মানুষ আসবে। তবু বিশ্বাস করেছিলাম।
বেলিয়া বলেছিল, জানি না সে মানুষ আমি কেন হব! তুমি একটা বিয়ে কর, আমার আর কদ্দিন জানোই তো...
লক্ষ্মী এক চোখ জলে ডুবে বলেছিল, আমি পরের জন্মে অপেক্ষা করব... শুধু তুমি দেরি কোরো না...
লক্ষ্মী এক চোখ জলে ডুবে বলেছিল, আমি পরের জন্মে অপেক্ষা করব... শুধু তুমি দেরি কোরো না...
বেলিয়া হেসেছিল। অন্যসময় হলে এই কথাটা কত নাটকের মত লাগত, কিন্তু মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোনটা মাটির ঘটনা আর কোনটা মনের - গুলিয়ে যায় বেলিয়ার। সব সত্যি মনে হয়, সবটুকু মাধুর্যময় মনে হয়, সে যেন দেরি করে ফেলল। মনে হয় কেন যে মিথ্যা কি এক অলীক স্বপ্নের পিছনে এতগুলো বছর ছুটে মরেছিলাম! জীবন যেন এক আঁজলা জল। কারোর চলকে পড়ে বড় তাড়াতাড়ি। কেন যে এত দৌড়েছিলাম? না হয়, বিন্দু বিন্দু জলের মূল্যে পূর্ণ হত জীবন, কি ক্ষতি ছিল? বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে গেল যেন।
মৃন্ময়ী আর মনোরমা দুটো চায়ের কাপ নিয়ে এসে রোদে বসল। মনোরমা জিজ্ঞাসা করল, একটু চা খাবি বেলিয়া?
বেলিয়া মাথা নাড়ল। তার দৃষ্টি সবকিছু থেকে অনেক দূরে আটকে কোথায় যেন। সে শুধু একবার অস্ফুটে বলল, সব কেমন হয়ে গেল না? কি ভেবেছিলাম আর কি হল।
মনোরমা বলল, মহাপ্রভুর লীলা দিদি, তিনি কার জীবনে বাঁশির কি সুর আনেন তিনিই জানেন, আমরা শুধু ভেবে মরি আর কেঁদেই মরি।
মৃন্ময়ীর এক মুহূর্তের জন্যে স্বপনের মুখটা মনে পড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাই। ভুবন দূরে তাকিয়ে, অন্যমনস্ক।
বেলিয়া মাথা নাড়ল। তার দৃষ্টি সবকিছু থেকে অনেক দূরে আটকে কোথায় যেন। সে শুধু একবার অস্ফুটে বলল, সব কেমন হয়ে গেল না? কি ভেবেছিলাম আর কি হল।
মনোরমা বলল, মহাপ্রভুর লীলা দিদি, তিনি কার জীবনে বাঁশির কি সুর আনেন তিনিই জানেন, আমরা শুধু ভেবে মরি আর কেঁদেই মরি।
মৃন্ময়ীর এক মুহূর্তের জন্যে স্বপনের মুখটা মনে পড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাই। ভুবন দূরে তাকিয়ে, অন্যমনস্ক।
পুষ্প খুব কম আসে। কখনও কখনও মনোরমার সাথে দেখা করে চলে যায়, বেলিয়ার সামনে আসে না।
মারা যাওয়ার দু-সপ্তাহ আগে বেলিয়াকে মৃন্ময়ী নিয়ে গেল নিজের নতুন বাড়িতে। গাড়ি থেকে নেমে প্রকাশ আর ভুবনের হাত ধরে ধরে কোনোরকমে বাইরের বসার ঘরে এসে বসল। এইটুকুতেই হাঁপিয়ে, ঘেমে শরীর অস্থির করে উঠল। চেয়ারে বসে চোখদুটো বন্ধ করে ভুবনকে বলল, আমার সামনে একটু বোস তো।
মাথার উপর পাখাটা ফুল স্পিড করে ভুবন সামনে বসল। মৃন্ময়ী সরবত করতে গেছে রান্নাঘরে। প্রকাশ ভুবনের কম্পিউটারটা অন্ করে বসে, গেম খেলবে।
একটু টেনে টেনে বেলিয়া বলল, একটা কথা কি জানিস ভুবন, আমার কিছু বলার নেই, তোর কাছে বসলে ভালো লাগে, এইটুকুই। তবু বলি, পারলে আমায় ক্ষমা করে দিস...
ভুবন চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল, বলল, তুমি এরকম কি কথা বলছ? সেই রেডিওটা এখনও দারুন চলছে জানো...
মাথার উপর পাখাটা ফুল স্পিড করে ভুবন সামনে বসল। মৃন্ময়ী সরবত করতে গেছে রান্নাঘরে। প্রকাশ ভুবনের কম্পিউটারটা অন্ করে বসে, গেম খেলবে।
একটু টেনে টেনে বেলিয়া বলল, একটা কথা কি জানিস ভুবন, আমার কিছু বলার নেই, তোর কাছে বসলে ভালো লাগে, এইটুকুই। তবু বলি, পারলে আমায় ক্ষমা করে দিস...
ভুবন চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল, বলল, তুমি এরকম কি কথা বলছ? সেই রেডিওটা এখনও দারুন চলছে জানো...
ভুবন কথা ঘোরাবার চেষ্টা করল। কথা ঘুরল, কিন্তু বেলিয়ার চোখের চাহনিটা না। মৃন্ময়ী একটা গ্লাসে সরবত আর বাড়িতে বানানো কেক নিয়ে ঢুকল।
বেলিয়া কিচ্ছু খেতে পারল না। এক ঢোক সরবত খেয়ে বলল, থাক দিদি, আবার ফিরতে হবে তো, গাড়িতেই বমি হয়ে যাবে। তুমি বরং আমার সামনে বোসো একটু।
বেলিয়া কিচ্ছু খেতে পারল না। এক ঢোক সরবত খেয়ে বলল, থাক দিদি, আবার ফিরতে হবে তো, গাড়িতেই বমি হয়ে যাবে। তুমি বরং আমার সামনে বোসো একটু।
ভুবন ছাদে চলে এলো। মা কাঁদবে এখন। জানে ভুবন। কেউ কোনো সান্ত্বনা দিতে পারবে না। ভুবন ছাদের কার্ণিশের কাছে দাঁড়িয়ে। তাদের এই নতুন বাড়ির পশ্চিম দিকে একটা জলা। তার পিছনে একটা বাঁশঝাড়। একটা বাঁশের মাথায় রোজ এই সময়ে একটা বুলবুলি এসে বসে। আজ বসেনি। সূর্যাস্ত হচ্ছে। জলার উপরটায় যেন কেউ সিঁদূর ঢেলে দিয়েছে, এমন তার রঙ। ভুবনের ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
কেন কাঁদছ ভুবন? মৃত্যু তো অবশ্যম্ভাবী, জানো না। উদাস হও। সুখ-দুঃখ, মান-অপমান সমান করে দেখতে শিখবে না? উদাস হও। দেখো তোমার মধ্যে থেকেও আমি উদাস, আমায় ভোলায় এমন কোনো মোহ নেই, দেখো, দেখো, আমার দিকে দেখো।
কেন কাঁদছ ভুবন? মৃত্যু তো অবশ্যম্ভাবী, জানো না। উদাস হও। সুখ-দুঃখ, মান-অপমান সমান করে দেখতে শিখবে না? উদাস হও। দেখো তোমার মধ্যে থেকেও আমি উদাস, আমায় ভোলায় এমন কোনো মোহ নেই, দেখো, দেখো, আমার দিকে দেখো।
নীচ থেকে মায়ের গলা, ভুবন নীচে আয়, মামা বেরোবে।
পাঠক, আমার গল্পের আর কিছু বাকি নেই। শুনেছি লক্ষ্মীর কোলে মাথা রেখেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বেলিয়া, ভোর রাতে। সেদিন ছিল বড়মার স্নানযাত্রা। এর কয়েক বছর পর গোপেশ্বর আর মনোরমা এই বাড়ি, দোকান বিক্রি করে পারাদ্বীপ চলে যায়। বয়েস হচ্ছে, আর ভালো লাগে না গোপেশ্বরের বিদেশ-বিভূঁইয়ে পড়ে থাকতে। প্রকাশ ব্যাঙ্গালোরে আছে। প্রতিদিন বিকালে মনোরমা আর গোপেশ্বর সমুদ্রের ধারে বসে থাকে। তাদের গল্প আর ফুরায় না। কত গল্প তাদের - হাসির গল্প, বেলিয়ার গল্প, মৃন্ময়ীর গল্প, পুষ্পর গল্প, ভুবনের গল্প।
ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, লক্ষ্মী তাদের সাথেই এসেছে। তার বেলিয়ার অনেক গল্প শোনার আছে - ছোটোবেলার গল্প, দুষ্টুমির গল্প, বড় হয়ে ওঠার গল্প। বেলিয়ার মা-বাবার ছবির পাশে আরো দুটো ছবি – বেলিয়ার আর হাসির। লক্ষ্মী ফুল দেয়, মালা গাঁথে। সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় তার চোখের নোনতা জলের স্বাদ মিশে যায়। সে কান পেতে শোনে জগন্নাথের বাঁশির শব্দ, সারা বিশ্বজুড়ে বেজে যাচ্ছে লোকে লোকে লোকান্তরে... সে শুধু জানে বেলিয়া তার, সে নিজে বেলিয়ার। জগন্নাথের অগুনতি সুরের মধ্যে তারা দু’জন দুটি সুর – লক্ষ্যে আর অলক্ষ্যে, বিনুনির মত বাঁধা, বেলিয়ার শরীর শুধু পুড়েছে, তার হৃদয়টুকু পোড়ায় সাধ্যি কার, লক্ষ্মী বেঁচে থাকতে? লক্ষ্মী তাকে বাঁচিয়ে রাখবে নিজের মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। মানুষের জীবন তো জগন্নাথের বাঁশির তান, সে কি মিথ্যা? শুধুই ফুরিয়ে যাওয়ার? না না না... লক্ষ্মী সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসে, বেলিয়াও বসে তার পাশে এসে। লক্ষ্মী গান গায় বেলিয়া শোনে, কখনও গুনগুন করে সুরও মেলায় সমুদ্রের ঢেউয়ের তানে।
[সমাপ্ত]
[ছবিঃ সুমন]