Skip to main content
দীপালিদির সাথে মা ও জেঠিমা


দীপালিদির সাথে মা ও জেঠিমা


 এই লেখাটা আদতে আমি কোনোদিন লিখতে চাইনি। এ আমার মহামূল্যবান স্মৃতি। আমার বেঁচে থাকার যে কয়েকটা অমৃতোপম মুহূর্ত আছে, এই কয়েকটা মুহূর্ত সেই সময়গুলোর। কয়েকদিন আগে দেবাঞ্জলিকেও বলছিলাম কথাগুলো, যে লিখব না এ সব কথা। কিন্তু সবকিছু গুলিয়ে দিল ‘ছায়ানট’। দীপালিদির গাওয়া – উতলা পবনে।
        আমার বাড়ি গানের বাড়ি নয়। কিন্তু বাবা ও মা দু'জনেই খুব উঁচুদরের শ্রোতা ছিলেন। বাবার রবীন্দ্রসংগীত আর মায়ের অতুল-দ্বিজেন্দ্র-কান্তকবির গান। এরা আমার ছোটোবেলায় আমাকে অভিভাবকের মত ঘিরে রেখেছিল। কিন্তু সে অর্থে উচ্চাঙ্গসংগীতের কোনোরকম শ্রোতা বাড়িতে কেউ ছিলেন না। আমায় উচ্চাঙ্গসংগীতের দোরগোড়ায় আনলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের গানের সুরের গভীরে ডুবতে ডুবতে কখন যে মার্গসঙ্গীতের সাগরে এসে পৌঁছেছি বুঝিনি।
        ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসের রাত, এফ এম রেডিওতে রেনবো চ্যানেলে বাজল দীপালি নাগের ‘জয়-জয়ন্তী’। তখন রাত সাড়ে বারোটা। আমার ঘুম ছুটে গেল। এইভাবে, মস্তিষ্ক আর আবেগের এমন সামঞ্জস্য সৃষ্টি করা যায়! প্রতিটা তান, বোল মাথার শিরায় উপশিরায় ঘুরে বেড়াতে লাগল। পরেরদিন কাঁচরাপাড়ার সমস্ত ক্যাসেটের দোকান তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেললাম, পেলাম না। শিয়ালদহ, ধর্মতলার সিম্ফোনি, কোত্থাও নেই।
        এরপর নানা কাজের সূত্রে এখানে ওখানে, কিন্তু মাঝেমাঝেই চলছে ওনার ক্যাসেট খোঁজা। এরপরের ঘটনা যে কোনো জনপ্রিয় আষাঢ়ে বাংলা সিনেমার স্ক্রিপ্টকেও হার মানায়। জীবিকার সূত্রে পার্কস্ট্রিট গেছি, মিটিং নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ। হাতে আচমকাই খানিকটা সময়। কি করি কি করি... তখন হঠাৎ মনে হল, পার্কস্ট্রিটের মোড়ে তো মিউজিক ওয়ার্ল্ড খুলেছে, ওখানে একবার ঘুরে আসি। গেলাম। একে তাকে জিজ্ঞাসা করছি দীপালিদির কোনো ক্যাসেট আছে কিনা। 'না' বলল ওরা। হঠাৎ একজন অল্পবয়েসী মেয়ে, যে কি না ওইখানকারই কর্মী, আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, আপনি কি ওনার ছাত্র? বললাম, না। কেন? উনি বললেন, না আপনি যে ক্রেজের সাথে ওনার সিডি খুঁজছেন... তাই মনে হল... আমি ওনার ছাত্রী ছিলাম। আপনি যদি চান আমি ওনার নাম্বার আপনাকে দিতে পারি। নাম্বার দিলেন। আমি কাগজে নিলাম। কিন্তু রাতে বাড়ি ফিরে দেখি নাম্বার হারিয়ে ফেলেছি। এদিকে কয়েকদিন আমায় বাইরে যেতে হবে, অগত্যা ফের যাওয়ার উপায় নেই। হপ্তাখানেক বাদে ফিরেই মিউজিক ওয়ার্ল্ডে ফোন। মেয়েটার নাম মনে ছিল, অনুরোধ করলাম ডেকে দিতে। তার বান্ধবী জানালেন, তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সে আর আসবে না। কাকুতিমিনতি করে তার বাড়ির নাম্বার নিলাম। তিনি ফোন ধরলেন। সবটা শুনে হাসলেন। নাম্বার দিলেন আবার।
        দুরুদুরু বুকে ফোন করলাম। কয়েকবার রিং হতেই ওপার থেকে ফোন ধরলেন স্বয়ং দীপালি নাগ। গলাটা শুনে আমার মাথা থেকে পা অবধি শিহরণ খেলে গেল। বললাম, আমি কি একটু দীপালিদির সাথে কথা বলতে পারি? উনি বললেন, বলছি বলুন...
        আমি বললাম, দেখুন আমি নিতান্ত নিরুপায় হয়ে আপনাকে কল করছি, বেশ কয়েকদিন ধরে আপনার ক্যাসেট খুঁজে চলেছি, পাচ্ছি না... তাই...
        উনি বললেন, তোমার বয়েস কত? বললাম। শুনে বললেন, আমি তোমার ঠাকুমার থেকেও হয়ত বেশি বয়েসী, তবে তুমি আমায় দিদি বলে ডাকতে পারো। তুমি অমুকদিন SRA (Sangeet research academy) -তে চলে এসো টালিগঞ্জে, কথা হবে।
        দু'দিন পর গেলাম। একে তাকে জিজ্ঞাসা করে ওনার চেম্বারের সামনে এসে শুনলাম চেম্বার মেরামত হচ্ছে বলে উনি একটা বড় রুমে বসছেন ক'দিন। সেদিকে গেলাম। দরজা ঠেলতেই ওনাকে দেখতে পেলাম, মাথা নীচু করে কিছু একটা লিখছেন। সংকোচের সাথে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু ডাকার সাহস পেলাম না। উনি মাথা তুলেই আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বললেন, সৌরভ, চিনলে কি করে আমায়?
        এই প্রশ্নটার জন্য আমি তৈরি ছিলাম না। হতবাক হয়ে উনি না বলতেও চেয়ারে বসে পড়লাম। বললাম, এ প্রশ্ন তো আমার করার কথা ছিল। উনি হাসলেন। ঘড়ি দেখে বললেন, ঠিক সময়েই এসেছ। আমি পাঞ্চুয়ালিটি পছন্দ করি। দেরি হলে মানুষের ফোন করে জানানো উচিৎ, আজকাল অনেকে সেটাও করে না। তবে তুমি কিন্তু আমার সাথে লাঞ্চ করে যাবে। ওনাকে যারা চিনতেন তারা ওনার এই পাঞ্চুয়ালিটির সাথে সম্যক পরিচিত ছিলেন। উনি যে সব অনুষ্ঠানের চিফগেস্ট থাকতেন সেই সব অনুষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সব সময় মনে রাখতে হত দীপালিদির ছ'টা মানে কিন্তু ছ'টাই।
        আমি বুঝতেই পারছিলাম না এসব হচ্ছেটা কি? এত স্বাভাবিকভাবে কথা বলে চলেছেন যেন কতদিনের পরিচিত আমরা। মজা হচ্ছিল যেই আমি ওনার গানের প্রসঙ্গ তুলতে যাচ্ছিলাম, উনি বারবার এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, আর খুব নম্রতার সাথে বলছিলেন, আসলে তখন বাংলা রাগপ্রধানে অত কেউ গাইতে আসেননি তো, তাছাড়া আমি ছিলাম প্রবাসী বাঙালী (ওনার জন্ম পড়াশোনা সব আগ্রাতে। সেই সূত্রে আগ্রা ঘরানার যুগপুরুষ ফৈয়াজ খাঁ-এর কাছে তালিম পেয়েছিলেন), তখন মেয়েরা অত গাইতে আসত না প্রকাশ্যে আর আমিও তাই ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছিলাম।
        এ কথা ওনারই বলা সাজে। যখন ফিরছি উনি সামনের সপ্তাহেই ওনার বাড়ি যেতে বললেন। বললেন, আমার বাড়ি চেনা কঠিন কিছু নয়, সৌরভ গাঙ্গুলীর বাড়ি, ডোনা গাঙ্গুলীর বাড়ি তার পাশেই আমার বাড়ি। চলে এসো।
        গিয়ে পৌঁছালাম নির্দিষ্ট দিনে, নির্ধারিত সময়ে। কথা ছিল দুপুরে ওনার ওখানে গিয়ে খেতে হবে। ওনার বাড়ি পৌঁছে আরেক দিকপালের মুখোমুখি হলাম, ওনার স্বামী – বরেণ্য বিজ্ঞানী বাসন্তীদুলাল নাগচৌধুরী ওরফে বি ডি নাগচৌধুরী। ওনার সম্বন্ধে উইকিপিডিয়ায় পেজ আছে তাই বেশি কথা লিখলাম না; শুধু এইটুকু বলি, আমাদের নিউক্লিয়ার অস্ত্র পরীক্ষা ও নির্মাণের একজন পুরোধা ছিলেন উনি। মাটির মানুষ। আমি হালিশহর থেকে আসছি শুনে উনি বললেন, বঙ্কিমবাবুর বাড়ি তো আপানদের বাড়ির কাছেই, তা রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকঠাক হচ্ছে? একটা ঘটনা মনে এলো। একজন নজরুলগীতির শিল্পীও ওনার বাড়িতে এসেছেন, তিনি রিসার্চও করেন। খাওয়ার টেবিলে হঠাৎ উনি বিডি নাগচৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি বোমা বানাতেন না? আমার হাসিও পেল, রাগও ধরল, এ কী প্রশ্নরে ভাই! বিডি নাগমহাশয় আমতা আমতা করছেন, দীপালিদি বললেন, তুমি একটা মাছ নেবে? ব্যস, প্রসঙ্গ ঘুরে গেল।
        দীপালিদির সাথে খেতে বসলাম। খাবার কি আর গলা দিয়ে নামে? ওনাকে দেখছি 'হাঁ' করে। ইতিমধ্যে দূরদর্শনে ওনার উপর নির্মিত একটা তথ্যচিত্র দেখা হয়ে গেছে, ফলস্বরূপ আমার অবস্থা আরো সঙ্গীন। খাওয়ার পর উনি বললেন, চলো আমার গানের ঘরে। মেঝেতে মুখোমুখি বসলাম। উনি কথা বলছেন, আমি ওনার কথা শুনব কি, কণ্ঠস্বরের মাদকতায় মজে যাচ্ছি। এত শ্রুতিমধুর একজনের কণ্ঠস্বর হতে পারে?
        বললেন, জানো আমার বাবা আমার মাথার উপর আপেল রেখে হাঁটা প্র্যাক্টিস করাতেন, যাতে হাঁটার সময় মেরুদণ্ড সোজা থাকে। ওনার বাবা অধ্যাপক ছিলেন সম্ভবত। রবীন্দ্রনাথের সাথে ওনার সাক্ষাৎকারের গল্প, মহাত্মাকে ভজন শোনানোর গল্প, নজরুলের সাথে দেখা হওয়ার গল্প। নজরুলের হাতের লেখা খাতা দেখালেন, 'মেঘমৃদুল বরষায়', রাগ সেই জয়জয়ন্তী, যে গান ওনার কণ্ঠে অমর হয়ে আছে আজও।
বাড়ি ফিরে এলাম এক ঘোর নিয়ে। ক'দিনের মধ্যেই ওনাকে কিছু ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেট দিতে হবে, উনি ওনার সব গানগুলোকে আমায় রেকর্ড করে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন তাতে। গেলাম কয়েকদিন পর। এরপর আমার অভ্যাসই হয়ে গেল ওনার বাড়ি মাসে একবার অন্তত যেতেই হবে। না গেলে উনি অভিমান করতেন আর আমার সঙ্কোচ বাড়ত অসীম। উনি ভুলতে পারেন উনি কোন স্তরের মানুষ, আমি কি করে ভুলি?

Mejhete khete Bosa

মেঝেতে খেতে বসা
       

কয়েকটা ঘটনা বলি। ওনার সাথে SRA-তে ঢুকছি, উনি সোজা গটগট করে হেঁটে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন, একজন পৃথুলা বয়স্কা মহিলা কুটনো কুটছিলেন, তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ রে তোর মেয়ে কেমন আছে আজ, জ্বর আসে্নি তো আর?

        এটাই উনি, যে যে স্তরের কাজ করুক, দীপালিদির কাছে তার প্রথম আর শেষ পরিচয় হল সে মানুষ। একজন অতিথি ওনার ঘরে আলোচনার মধ্যে কার একটা সমালোচনা করছিলেন। উনি পুরোটা শুনে বললেন, দেখুন আমার যদি ওরকম অভাব থাকত, তবে আমি রাস্তায় পড়া টাকার থলি নিয়ে নিতাম কি না কি করে বলি বলুন?
আমি আশ্চর্য হয়ে যেতাম শুনে, এরকম ঘটনার সাক্ষী তো একবার নয়, বহুবার হয়েছি। ভাবতাম, যে মানুষটার সাথে সখ্যতা ইন্দিরা গান্ধী, রবিশঙ্কর, আলি আকবেরর সাথে... যার বিচরণক্ষেত্র ট্রিনিটী থেকে সঙ্গীত রিসার্চ অবধি, তার এমন সাবলীল জীবন দর্শন হয় কি করে? আমায় বলতেন, সৌরভ, ভণ্ড হবে না কখনও, যা তুমি নিজে নও তা সাজবে না, মেরুদণ্ড যেন সব সময় সোজা থাকে।
        ওনারা ব্রাহ্ম ছিলেন। একবার ওনার এক নিকটাত্মীয়ের শোকসভায় আমায় ডাকলেন। বললেন, তুমি ব্রাহ্মদের অনুষ্ঠানে একবার এসে দেখো। গাড়িতে যেতে যেতে বললেন, দেখো অনেকে শোকের দিন কালো পোশাক পরেন, আমি পছন্দ করি না। শোক জানানোর বস্তু কি? বরং কিছু চকোলেট নেওয়া যাক, অনেকগুলো বাচ্চা থাকবে ওখানে।
        প্রতিদিন ভোর চারটেতে ওনার দিন শুরু হত। আমি যখন গেছি ওনার বয়েস আশির কোঠায় প্রায়। সারাদিন কর্মব্যস্ত। এমনকি এমনও হয়েছে দূরদর্শন থেকে ওনার একটা সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে, উনি ভুলেই গেছেন। রাতে আমায় ফোন করে কি হাসি ওনার, বললেন, সৌরভ এটা 'জোক্স অব দ্য ইয়ার' হোলো, কি বলো?
        এই হাসি নিয়ে একটা কথা মনে পড়ল। প্রচুর জোক্স শুনতে ভালোবাসতেন। একবার খুশবন্ত সিং-এর একটা জোক্স বলি, বেশ বড়ো। উনি তো হেসে লুটোপুটি। দু'দিন পর হঠাৎ সকালবেলায় ওনার ফোন, বললেন, সৌরভ ওই গপ্পোটা আরেকবার বলো তো, আমি একটা জায়গায় মনে করতে পারছি না। এমনই সাবলীল ছিল ওনার অত বয়েসেও প্রাণোচ্ছ্বলতা।
        ওনার জন্মদিনে গেছি। প্রচুর লোকজন, ওনার ছাত্রছাত্রী অসংখ্য। আমি খুবই কুণ্ঠিত বোধ করছি। আমার সংকোচটা বুঝলেন। উনি এগিয়ে এসে নিজে একটা থালায় কিছু খাবার বেড়ে নিয়ে এলেন, বললেন, আমার কিন্তু নজর এড়ানোর চেষ্টা করিস না, হুম। চোখে জল এলো। সারাদিন কত গান, সে যে কি আনন্দ বলে বোঝানো দায়।
বছরের পর বছর ঘুরছে। খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লে ওনার সাথে গল্প করার সময়টা ছিল অভিনব। উনি প্রায়ই দিল্লী যেতেন, আমায় বলতেন, চলে এসো আমরা একসাথে গপ্পো করতে করতে বেহালা থেকে হাওড়া স্টেশান যাব, উনি বরাবরই রাজধানীতে যেতেন। বড় বড় দুটো অপারেশন হয়েছিল ওনার। কিন্তু ওনার প্রাণশক্তির কাছে তা তুচ্ছ হয়ে যেত। বলতেন, I can’t afford the luxury of sickness, my oasis. আমায় ওই নামেই ডাকতেন আর আমায় পরিচিত করাতেন সবার সাথে, my youngest friend বলে।

        ইতিমধ্যে আমরা রেলের কোয়াটার্স ছেড়ে কাঁচরাপাড়া থেকে হালিশহর চলে এসেছি বাড়ি করে। উনি একদিন কথায় কথায় বললেন, আমি তোমার বাড়ি দেখতে যাব। আমার তো মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা, হায় হায়, আমি সে আতিথেয়তা করব কি করে? ওনাকে লজ্জায় সে কথা বলে নিরস্ত করার চেষ্টা করলাম। হল না। এলেন একদিন। গাড়ি থেকে নেমেই যেই দেখলেন সবুজ মাঠ চারদিকে, দু'হাত প্রসারিত করে বললেন, এই দেখো কি সুন্দর একটা সবুজ গালিচা পেতেছ তুমি আমার জন্য। লোকে তো লাল গালিচাই পাতে বলো? তুমি কি অপূর্ব গালিচা পেতে দিলে! বাড়িতে ঢুকে আমাদের জড়তা কাটিয়ে বললেন, আমি কিন্তু এক পেয়ালা চা খাবো আগে। সব জড়তা কাটিয়ে দিলেন। বললেন, খাবার টেবিলে না, আমরা মেঝেতে বসেই খাবো। তাই হল।
        তখন বিভিন্ন রিয়েলিটী শো, তারা মিউজিক, রেনবো'র টকশোতে উনি প্রায়ই আসছেন। ফলে লোকের কাছে ওনার মুখটা আবার পরিচিত হতে লাগল। কিন্তু কি স্বচ্ছন্দে উনি সব কিছু পরিস্থিতি পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতেন। হাওড়া স্টেশানে হাঁটুগেড়ে বসে জিনিস কেনা... যে কথা বলতে চায় তাকে সময় দেওয়া... বিডি নাগচৌধুরীর জীবনাবসানের পর নিজেকে সামলে অতি সত্ত্বর জীবনের পূর্বছন্দে ফেরা। কি করে পারতেন এত কিছু? আমার একটাই উত্তর, এক মহাসমুদ্র ভালোবাসা বুকে নিয়ে বাঁচার ক্ষমতা ছিল ওনার। বলতেন, প্রচুর কষ্ট পেয়েছি সৌরভ, কিন্তু তোমার দীপালিদির ধরিত্রীর মত সহ্যক্ষমতা। ওই বয়েসেই 'ডমরু' বলে একটা পত্রিকা বার করলেন কয়েকজন সঙ্গীতশিল্পী মিলে। কি যে তার ভালোবাসা ছিল ওই পত্রিকাটার উপর। ধ্রুপদী সংগীত আর নৃত্যের উপর বোধহয় ওটাই প্রথম পত্রিকা, জানি না এখনও সেটা আছে কিনা।
        একটা কথা মনে পড়ল। একজন মেয়ে ওনার অতিথি হয়ে এসেছেন কিছু গবেষণার ব্যাপারে। আমি পৌঁছাতেই উনি ভীষণ রাগারাগি করতে লাগালেন আমার উপর। বললেন, তোমাদের জেনারেশান কিছু পড়ো না... আমি তো বুঝতে পারছি না আমি কি করলাম। পরে বুঝলাম ওই মেয়েটি আসা ইস্তক নাকি ওনার লাইব্রেরীতে একবারের জন্যও ঢোকেনি। ব্যস, উনি তাতেই চটে আছেন ভীষণ। এই লাইব্রেরী বলতে আরেকটা কথা মাথায় এলো। উনি বাংলা, ইংরাজি, হিন্দী, ঊর্দু সবক'টাই সাবলীল বলতেন। বিভিন্ন কনফারেন্সে নিয়ে যেতেন সাথে করে। নানা আলোচনা সভায় ওনাকেই যোগসূত্রের কাজটি করতে দেখেছি। অজয় চক্রবর্তী, রশিদ খাঁ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (সরোদবাদক) তো আছেনই, তাছাড়াও ভারতের অন্যান্য শিল্পীরাও কি অসম্ভব শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন নিজের চোখে দেখেছি। যশরাজজি কথা বলছেন দীপালিদির হাতটা নিজের বুকের সাথে ধরে রেখে। একবার বেশ রাত হল, উনি বললেন, থেকে যা আমার কাছে। আমি ইতস্তত করছি দেখে বললেন, আরে আমার লাইব্রেরীটাও তো সাজানো হয়নি অনেকদিন, তুই আর আমি সাজাবো। বুঝলাম, হঠাৎ কেন লাইব্রেরী সাজানোর দরকার হল আজ। যা ভেবেছিলাম তাই, গল্প হল, গানের নানা মানসতীর্থভ্রমণ হল, লাইব্রেরীর একটা বইতেও হাত পড়ল না। বলতেন, জানিস আমাদের লোকে দু'ভাবে চেনে, এক, দীপালি নাগের বর বাসন্তীদুলাল (বলতেন, আমার বরের নামটা নিয়ে আমার প্রথম প্রথম আপত্তি ছিল, ছেলের নাম কি করে বাসন্তী হয়; তারপর দেখলুম, বাহ্‌ এতো দারুন পার্সোনালিটি, তখন 'হ্যাঁ' বললুম) আর কেউ কেউ চেনে, বাসন্তীদুলালের স্ত্রী দীপালি নাগ।

        কেন জানি উনি বারবার বলতেন, সৌরভ তুমি লেখো। আজ এই লেখাটা লিখতে গিয়ে সেই কথাটা খুব মনে আসছে। কিছু কিছু মানুষ একটা পদ সৃষ্টি করে যান, আর তারা চলে গেলে সেই পদটা শূন্যই থেকে যায়। যা বললাম, তাই বললাম যা বলা যায়। সব কি বলা যায়? ওনার সাথে একই গাড়িতে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের কথোপকথন... সঙ্গীতের নানান বিষয়ে ওনার আলোকপাত... কি অসম্ভব রকম পড়াশোনা... আজ এই স্মৃতির ঝাপি খুলতে গিয়ে দেখি অনেক অনেক কথা... কত বলব... ভরা শ্রাবণে ওনার ঘরে একা বসে, উনি গাইছেন দেশ-মল্লার... কি করে বোঝাবো সেই স্মৃতির যন্ত্রণা... প্রতিবার পূজোর আগে আমার জন্মদিন পড়ত বলে একটা নতুন জামা আর দেশ পূজাবার্ষিকী কিনে রাখা... 'আবার এসো' বলে গেট অবধি এগিয়ে দেওয়া... মাথার উপর হাত রেখে কিম্বা চুমু খেয়ে আশীর্বাদ জানানো... সবই স্মৃতি এখন... তবু কিছু কথা বলেই ফেলা গেলো... যেন সব লিখে শেষে লিখলাম দিদি...

ইতি তোমার ওয়েসিস...

 

Shroddheya Durga Sirer Sathe

আমার শ্রদ্ধেয় দূর্গাস্যারের সাথে। দরজার কাছে বাবা