তো বোলপুর স্টেশানে যখন নামলাম তখন নেটে দেখাচ্ছে ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা। দুপুর একটা। নেমেই দেখি একটা টোটো, দুটো অটো আর একটা টাঙা দাঁড়িয়ে। সবাই ডাকছে, আসুন আসুন… এ চাঁদিফাটা গরমে এসেই যখন পড়েছেন তখন আসুন আসুন…. ওদিকে শুনি প্ল্যাটফর্মে, ট্রেন যাতায়াতের ঘোষণার মাইকে বাজছে, মধু বাতা ঋতায়তে, মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবা…. মনে হল সি শার্পে গাইছে কেউ। কি মিহি মন মাতানো গলা! তো আমি স্টেশানের এক কুলিভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই এ সব বাজছে কেন?
তিনি চোখ দুটো শিবনেত্র করে বললেন, আসলে অনেকেই এই তাপমাত্রা নিতে না পেরে…. যা হোক… ওই ট্রে-তে নাম ঠিকানা লিখে নাভিটা জমা দিয়ে গলে লীন হয়ে যায় কিনা, তাই…..
আমি তাড়াতাড়ি আমার নাভিতে একবার হাত রেখে সোজা টাঙায় চড়ে বসলাম। একবার মনে হল ঘোড়াটা আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে হাসল। বললাম, রবি ঠাকুরকে ঘর চলো…..
রোদের মধ্যে টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটছে। আমার মনে হচ্ছে আমি যেন পানিপথের চতুর্থ যুদ্ধে এসে পড়েছি, দমাদম কামানের গোলা ছুঁড়ছে প্রতিপক্ষ। টাঙাওলা বলল, মশায়ের কি আজই ফেরা হবে? তবে আমি বাইরে অপেক্ষা করতে রাজি, চার আনা বেশি নেব।
আমি ভাবলাম, বেশ। ভালোই হবে। কিন্তু চার আনা কি জি-পে করা যায়? জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই আপনার কাছে কি কিউয়ারকোড আছে?
ঘোড়া 'হি হি' করে হেসে উঠল। আমি আর কথা বাড়ালাম না।
গাড়ি রবি ঠাকুরের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি নেমেই সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। একজন পথ আটকে বলল, অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?
আমি বললাম, হ্যাঁ তো। 'কবি সাক্ষাৎকার অ্যাপ'-এ রীতিমতো রেজিস্টার করে তবেই যে না আজকের ডেট পেয়েছি!
সে বলল, আপনি দাঁড়ান। উনি এখন টক দই খাচ্ছেন। খাওয়া হলে আপনাকে ডাকা হবে। আপনি ওই কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে দাঁড়ান।
আমি গিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে মনে একটা আধুনিক রবীন্দ্রসংগীত বাজতে শুরু করল। "এই সেই কৃষ্ণচূড়া, এর তলে দাঁড়িয়ে, হাতে হাত, চোখে চোখ… (আর কোথাও কি কিছু রাখাটাখা আছে? মনে পড়ছে না)... কথা যেত হারিয়ে….
আসুন।
দেখলাম উনি বসে আছেন। একটা শ্বেতশুভ্র গোঁফে টক দই লেগে আছে। প্রসাদ পাওয়ার ইচ্ছা হল। কিম্বা মাদুলি করে গলায় ঝোলানোর। কিন্তু সে কথা লজ্জায় বলতে পারছিলাম না। আমি নাকি জন্ম থেকেই ভীষণ লাজুক। মাতৃগর্ভ থেকে বেরোতেই চাইছিলাম না। তাও যদি বা বেরোলাম, সে নাকি কান্নাকাটির নাম নেই, লজ্জায় চোখই খুলছিলাম না। অবশেষে সবাই চলে গেলে অল্প করে কেঁদেছিলাম।
যা হোক। উনি বললেন, তা যাত্রায় কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
আমি বললাম, না গুরুদেব।
উনি বেজার মুখ করে বললেন, আমায় আর গুরুদেব ডাকিসনি রে…. যা সব গুরু দেকচি চারদিকে… আর যা সব আমার শিষ্যেরা…. বল কেন এয়েচিস?
বললাম, গুরুদেব, থুড়ি, কবিনন্দন…
আহা আবার নন্দন-টন্দন কেন…সে নিয়েও তো…. যা হোক সোজা কথাটা সোজাভাবেই বল না ভাই…. ঘুমাতে যাই….
বললাম, আসলে আমি একটু লিখিটিখি। তা অনেকেই বলে বই ছাপাতে। আমার তো তেমন কাউকে চেনাজানা নেই, আপনাকেই যা চিনি সেই সহজ পাঠ থেকে… আপনার ছাপাখানা থেকে যদি আমার ক'টা লেখা একটু ছাপিয়ে দিতেন….
তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে বসে থাকলেন। তারপর বললেন, প্রস্তাবটা অভিনব বটে… কিন্তু…
আমি টাকা তেমন দিতে পারব না স্যার… যদি বিক্রি হয় আপনার না হয় আশি পার্সেন্ট…. আমার…
আহা সে সব না হয় পরে হবে…. নোবেলই গচ্চা গেল… কিন্তু তুমি 'অ আ ক খ' বলতে পারো?
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, হ্যাঁ মানে পারি তো…..
বলো।
বলতে শুরু করলাম…. অ.... আ… ই… ঈ….
লি মানে ৯ কোথায়?
তাই তো….
আবার শুরু করলাম। আবার বাদ পড়ল। ঙ-র পর মনে হল চৌরাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে। কোনদিকে যাই। আবার শুরু করলাম।
কতবার শুরু শেষ হল মনে নেই। যখন মনে চেতনা এলো দেখি আমি বোলপুর স্টেশানে শুয়ে। কৃষ্ণনগর লোকাল ঘোষণা হচ্ছে। আর ঘোড়াটা আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
কিছু বলতে যাব…. ঘোড়ার মুখ আমাদের কাজে দিদির মত হল…. ট্রেনের ঘোষণা মাঠে শীতলাদেবীর প্রসাদ বন্টনের ঘোষণা হল….
বুঝলাম পান্তাভাতের ফল। ঘেমেনেয়ে উঠেছি, শুনলাম বাইরে ঘোড়া ডেকে উঠল কোথা থেকে। বাইরে এসে দেখি সত্যিই মাঠে একটা ঘোড়া দাঁড়িয়ে। কে নাকি ভাড়া করে এনেছে। মাইরি বলছি সে আমার দিকে তাকিয়ে আবার সেই শয়তানি হাসিটা হাসল।
(ছবি Suman Das)