হরেনের দোকানের চপ খাওয়ার পর প্রতিবারই কাশীরামবাবুর এই সমস্যাটা হয়। আজও হয়েছে। তিনি দিগম্বর হয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে, আর ফলতা পিছনে জলপটি দিচ্ছে। কাশীরামবাবু গভীর আবেগ নিয়ে বলতে লাগলেন, আহা জুড়িয়ে যাচ্ছে রে ফলতা... জুড়িয়ে যাচ্ছে।
বেশিক্ষণ জুড়োনো পর্ব চলল না অবশ্য। ব্রহ্মনাদীনী দেবী, মানে কাশীবাবুর স্ত্রী হুড়মুড় করে ঢুকেই বললেন, যা ভেবেছিলুম ঠিক তাই, যেই না দু'দিন বাপের বাড়িমুখো হয়েছি অমনি মিনসে ওই হরেনের দোকানে গিলতে গেছে। এই করে তোমার আলসার হল... ডাক্তার কত করে বললেন....
ফলতা কর্তার লুঙ্গিটা স্বস্থানে আটকে সরে পড়েছে। জানে এ পর্ব সহজে মেটার নয়। দূর থেকে শুনছে গিন্নীমার বাজখাঁই গলা। তা উনি বলবেন নাই বা কেন? পিছনটা কেমন লাল টকটকে হয়ে গেছে লঙ্কায়! মাগো, অমন চপ কেউ ভাজে? আচ্ছা সত্যিই তো, এতটা ঝাল দেয় কেন হরেন? ফলতা বাজারের ব্যাগটা হাতে বাগিয়ে চলল। সে এই পরিবারে এই ছাব্বিশ বছর হল আছে, মানে যতটা তার বয়েস আরকি। গিন্নীমা কালীঘাটে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। সেই দিনটাই তার জন্মদিন। কৌশিকী অমাবস্যার রাত।
হরেনের দোকান বন্ধ। এখন সে বৌয়ের সাথে বিড়ি বাঁধে, ঠোঙা বানায় আর তার দুই ছেলেমেয়ে মালবিকা আর হরতকীকে (হরতকী ছেলে) নামতা শেখায় আর ভূগোলের ম্যাপ মুখস্থ করায়। হরেনের কিছু নীতি আছে। তার ধারণা, দেশের লোক নামতা যেদিন ভুল করতে শুরু করল আর ভূগোলের ম্যাপ যেদিন ভুলল, সেদিন থেকেই তাদের দেশের অবস্থা সঙ্গীন হতে শুরু করল। নামতা হল গণিত জগতের রেলপথ। সোঁ সোঁ করে ঢুকে যাবে অঙ্কের রাজ্যে, যদি কেউ কমপক্ষে ৫০০০ ঘর অবধি নামতা মনে রাখতে পারে তো। তার ছেলেমেয়েরা ৫০০ ঘর অবধি পারে। তার বউ সলতেরাণী ২৫০০ ঘর অবধি পারে। তার বেশি শিখতে তার আবার লজ্জা লাগে।
ফলতা দূর থেকেই শুনতে পেল হরেনের ছেলেমেয়েরা ৫৬৩ ঘরের নামতা মুখস্থ করছে। ফলতার আবার বেশি সংখ্যার আওয়াজ শুনলে ছোটোবাইরে পায়। সে তাড়াতাড়ি রাস্তার ধারে ঝোপের আড়ালে হাল্কা হয়ে নিল। তারপর হরেনের দরজায় টোকা দিল, হরেন দা?
- কে?
- ফলতা... ঘোষবাড়ি থেকে....
- ও হ্যাঁ, এসো।
নামতার আওয়াজ থামল। দুজনেই হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। ফলতার ওদের মুখের দিকে তাকিয়েই আবার নামতার কথা মনে পড়ল। হিসি পাচ্ছে আবার। না, দুর্বল হলে চলবে না। সে একটা পিঁড়ির উপর জড়োসড়ো হয়ে বসল। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, ওরে বাবা, নামতা বাচ্চাদুটো এখনও তাকিয়ে। ফলতা মনে মনে দুইয়ের ঘর থেকে নামতা শুরু করল। ক্রমে তিন, চার, পাঁচ, ছয়, ভালোই এগোচ্ছিল... কিন্তু সাত নং চুয়ান্ন না ছাপ্পান্ন? আবার ইয়ে পাচ্ছে..
- কি গো ফলতা ঠাকুরপো, বলো দুধ চা না লাল চা দেব?
ফলতা গলা কাঁপিয়েই বলল, দুধ... দুধ...
হরেন হুঙ্কার দিয়ে উঠল... তোরা থামলি কেন রে?
নামতা শুরু হল। ফলতার ওই হুঙ্কার শুনে পড়ে যায় আর কি, কোনো ক্রমে সামলে বলল, আচ্ছা হরেনদা, একটা প্রশ্ন ছিল, করব?
হরেন ঠোঙা বানাতে বানাতেই বলল,
- বলো।
- তুমি চপে অত ঝাল দাও কেন?
হরেন একটা ঠোঙায় গাম ঘষছিল। থামাল। বলল, মানে?
- মানে আর কি অত ঝাল দেওয়া কি ঠিক?
- অ, চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনো জ্ঞানই নাই দেখছি। ধরো তোমার পেটের মধ্যে, কি পাছার মধ্যে কোনো চেরা আছে। তুমি বুঝবে কি করে? এই ঝাল চপ তখন ঝাল অন্তর্যামী বটিকার কাজ করবে। আমার পূর্বপুরুষ কারা ছিলেন জানো? কবিরাজ। আমার দাদুর শখ ছিল চপ ভাজার। তিনিই এই চপের আবিষ্কর্তা। বড় লাটের শালা এই চপ খেয়ে সেই লণ্ডনে সেঁধিয়েছিল, আর এ মুখো হয়নি বুঝলে বাছাধন? কই গো চা হল?
চা এলো। হরেন আবার বলতে শুরু করল,
- এই যেমন ধরো, আমাদের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বলে একটা জিনিস আছে। বই পড়ে দেখো, সেটাও এই উত্তেজক লঙ্কায় ক্রমে বেড়ে ওঠে।
ফলতা বলল, কিন্তু আমার কত্তাবাবার যে আলসার হয়ে গেসল এই চপ খেয়ে হরেনদা?
হরেন এ সব প্রশ্নে রাগে না। মানুষজনের অজ্ঞতায় করুণা আসে। সে হেসে চোখ বন্ধ করে বলল, আগেই ছিল, গুপ্তভাবে। এই চপ সেটাকে বাইরে এনে ঘোষমশায়ের প্রাণ বাঁচালে।
ফলতা কিরকম ঘাবড়ে গেল। সে চা টা তাড়াতাড়ি শেষ করেই বাজারের পথ ধরল। আজ ঝোলভাত হবে শুধু। সেরকম কিছু তরিতরকারি কিনেই বাড়ি ফিরতে হবে। ওদিকে দক্ষযজ্ঞ কদ্দূর গড়ালো আবার কে জানে।
- ও ফলতা? ফলতা?
নিধুকাকা। সেলুন ফাঁকা বসে আছে। ফলতাকে খুব স্নেহ করেন। ঘোষদের কেমন লতায়পাতায় আত্মীয়ও হয়। বলল, ও বাড়ির খবর কি রে?
ফলতা বাড়ির কথা বাইরের লোককে বলা পছন্দ করে না। সে বলল, ভালো।
- ভালো? কি যে বলিস? বাড়িতেই থাকিস এদিকে বাড়ির কোনো খোঁজই রাখিস না। ওদিকে তো ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে গেছে। তোর কত্তা মা আবার বাপের বাড়ি চলে গেছে, আর দাদাকেও দেখলাম পরের রিকশায় বেরিয়ে গেলেন।
- অ্যাঁ! রিকশায়? বসলেন কি করে? ফলতার মুখ থেকে নিজের অজান্তেই কথাগুলো বেরিয়ে এলো।
ওদিকে আচমকা খদ্দের এসে পড়ায় নিধুকাকা ব্যস্ত হয়ে গেছে। ফলতা হনহন করে বাড়ির পথ ধরল।
ফিরে এসে দেখে বাইরে থেকে সত্যিই তালা দেওয়া। যা! রাগের মাথায় তার কথা কারোরই মনে নেই? ফলতার খুব অভিমান হল, কান্না পেল। কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে এমন আদদামড়া ছেলের কান্নাটা একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার। সে পকেটে হাত দিয়ে দেখল দেড়শ টাকা আছে। ওর মধ্যে একশো তো ঘোষকত্তার! নিলে চুরি হবে যে!
ফলতা বাড়ির পিছনের দিকের সিঁড়িঘরের জানলাটায় চাড় দিল। একটু ফাঁক হতেই একশো টাকাটা ভিতরে ফেলে দিল। যাক চুরির দায়ে তো আর পড়বে না সে নিজের কাছে!
কিন্তু কোথায় যাবে সে এখন? ফলতা চূর্ণী নদীর ধারেই যাবে ঠিক করল। হেঁটে আধঘণ্টা। যদিও ভাদ্রমাসের গরম, তবু সে সেখানেই যাবে।
এটাসেটা ভাবতে ভাবতে এগোতে লাগল সে। মাঝে যতগুলো মন্দির পড়ল সবক'টা মন্দিরে সে শপথ করল, আর ও বাড়ি সে ফিরবে না। গরীব সে বটেই, তা বলে এতবড় অপমান!
ভাবতে ভাবতে কখন চূর্ণীর ধারে এসে পৌঁছিয়েছে। এদিকটায় বেশ ফাঁকা ফাঁকা। সে তার চটিটা জড়ো করে তার উপর বসল। বসতেই দেখে আরে ওটা কে, কত্তাবাবা না? আরে তাই তো!
গিন্নীমা একটা ছড়ি নিয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে কি বলছেন, আর কত্তাবাবা বুকজলে দাঁড়িয়ে একটা একটা করে ডুব দিচ্ছেন।
ফলতা নিজেকে আর সামলাতে পারল না। দৌড়ে গিয়ে উপস্থিত হল ঘটনাস্থলে। কি হল দাদা?
- আর কি হল রে ভাই, তোর জলপটিতেও এবার আর কমল না রে। তখন তোর বউদি বলল, আমি চললাম চূর্ণী নদীর ধারে, তুমি পিছনে পিছনে এসে দূরে দাঁড়াও। একটা ফাঁকা জায়গা খুঁজে ডাকব তোমায়, তুমি সব জামাকাপড় খুলে...
- আরে অ্যাই.... অ্যাই... আরে এখানে না....., কত্তা মা চীৎকার করছেন। ওদিকে একজন গোয়ালা তার দশবারোটা মোষ নিয়ে এদিকেই জলে নামিয়ে দিয়েছে। কত্তাবাবা উলঙ্গ হয়েই জলের থেকে উঠে দে ছুট। পিছনে পিছনে ফলতা, ও কত্তাবাবা ভিতরের প্যান্টটা পরেন অন্ততঃ...
আসলে ঘোষবাবুকে দুবার গুঁতিয়েছে, একবার মোষে, আরেকবার ষাঁড়ে। সেই থেকে ঘোষবাবু ওই দুটো জীব দেখলেই রুদ্ধশ্বাসে ছোটেন। ঘোষগিন্নী অবশ্য ছুটলেন না। তিনি বসে বসে মোষেদের স্নান করা দেখলেন। গোয়ালার সাথে কথা বলে বেশ সস্তায় চারপো করে দুধের ব্যবস্থা করে ফেললেন বাড়ির জন্য। তারপর ধীরেসুস্থে বাড়ি ফিরলেন কত্তার জামাপ্যান্ট ঝোলায় ভরে। রাস্তায় কারোর সাথে কথা বললেন না। জানেন সবার প্রশ্ন কি।
কথিত আছে এরপর হরেন চপের দোকান তুলে কবিরাজি জড়িবুটি দোকান দিয়েছে। কাশীবাবু শান্ত এখন। আর একবারই জলপটি লেগেছিল, তবে পিছনে না, কপালেই লেগেছিল। সেই ভাদ্রের দুপুরে রোদে ঘুরে প্রচণ্ড জ্বর এসেছিল।