ভিজে বিছানায় একপাশে বসে লোকটা। উলঙ্গ। পা আর পাছা ভিজে যাচ্ছে জলে। লোকটা নির্বিকার দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বসে। পায়ের পাতার দিক থেকে একটা অসাড়তা জন্মাচ্ছে। ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠে আসছে। পায়ে কি ঝিঁ ঝিঁ ধরেছে? ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঠিক ঘুম না। একটা তন্দ্রার মত।
একটা মাকড়সার জাল ছাদের থেকে তার দিকে নামছে। তাকে ঘিরে নেবে। সে জানে সে স্বপ্ন দেখছে। তবু তার ভয় করছে। তবু চোখ মেলে সোজা তাকাতে পারছে না। তার পায়ের নীচে যেন শিকড়। মাটির সাথে তাকে জড়ের মত বেঁধে ফেলছে। তার গা বেয়ে উঠছে জলের স্রোত। মাটি থেকে। সে গাছ এখন।
জালটা তাকে জড়িয়ে নিল। ক্রমশঃ আরো জটিল থেকে জটিলতর হল জাল। লোকটার চোখে মুখে অন্ধকার। জালের অন্ধকার। সে জানে সে চাইলেই এই জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারে। তবু চাইছে না। চাইবেও না। কারণ যাওয়ার নেই কোথাও। সব দিকেই জাল জাল আর জাল। রঙীন, সাদা-কালো জাল। লোকটা এক সময় ভাবত জালের বাইরে একটা জগৎ আছে। এখন বিশ্বাস করে না। জাল আঁকড়ে, জালের ফাঁকে ফাঁকে শ্বাস নেওয়ার জায়গা খোঁজে। বেঁচে থাকা মানে শ্বাস নেওয়ার চেয়ে যেন বেশি কিছু নয় এখন তার কাছে।
লোকটা ভিজে বিছানায় উপুড় হয়ে শুলো। তার উপস্থ, উরু, হাঁটু ভিজে যাচ্ছে। জালের সাথে জালের ঘর্ষণে যেন সুর আসছে তার কানে। তার চোখের পাতায় জাল আটকে।
একটা চড়াই পাখি ঢুকল জানলা দিয়ে। লোকটা ডানার আওয়াজে বুঝল। তার হৃৎপিণ্ডের বেগ হল দ্রুত থেকে দ্রুততর। পাখিটা কি আটকে যাবে জালে? তাতে কি হয়েছে? সে তো নিজেও আটকে কত যুগ হল। এই জালেই তো সুর, এই তো ঘেরা খোপ তার। এই তো নিরাপত্তা। চারদিকে শুধু জাল জাল আর জাল। পাখি তুমি কোথায় যাবে? বরং এসো, এই জালেই আটকাও।
তার ভিতর থেকে কে যেন চীৎকার করে বলল, না না না!
লোকটা এক ঝটকায় চোখ খুলল। সব জালগুলো এক লহমায় ছিঁড়ে ফেলল। উঠে বসে দেখল ঘরের মধ্যে দুপুরের রোদ জানলা দিয়ে মেঝের উপর অজগরের মত শুয়ে আছে। পাখাটা ঘুরতে ঘুরতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে, প্রশ্ন করছে না, নজরে রাখছে। ছাদের কোনায় ঝুলগুলো কাঁপছে। ওরা জালের গোপন রহস্য জানে। বিছানার চাদর তার ঘামে ভিজে। কিন্তু পাখিটা কই?
জানলার সামনে এসে দাঁড়াল। ক্লান্ত দুপুর একটা মস্ত জাল বিছিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে। আকাশে কয়েকটা চিল। আর কটা সাদা মেঘের দ্বীপ। আকাশেও জাল পাতা। সময় আটকে সে জালে। ধীর লড়াই লড়ছে সময় আকাশের সাথে, আকাশটা ছাড়িয়ে যাবে।
কিন্তু পাখিটা কই?