বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল কি? না বোধহয়। তবু কালো হয়ে গেল ভরদুপুরে চারদিক। ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। তুমি কি ঘুমালে? ঘুমের মধ্যে বৃষ্টির আওয়াজ যাচ্ছে কানে তোমার? এরকম একটা দুপুর ঘুমিয়ে কাটাবে? অবশ্য একদিক থেকে ভালো। মেঘ দিনের আলো কেড়ে নিলে, স্মৃতির আলো ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর স্মৃতি মানেই তো অকাজের কথা, বলো? তুমি ঘুমাও, জেগো না। আমি একলা জানলার ধারে বসে বৃষ্টি দেখি। বৃষ্টি শুনি।
ছাদের থেকে বৃষ্টির জল ওদের বাড়িতে সরাসরি মাটিতে পড়ছে শুনছো? কেন বলো তো? ওদের রেন পাইপটা খারাপ অনেক দিন হল। ওরা সারায় না। এত খরচ কতদিক সামলাবে বলো বউটা, বরটা তো তেমন কোনো কাজই করে না। ছেলে-মেয়েগুলোর মুখে ভাত জোগাবে, স্কুলের বই-ব্যাগ কিনবে, মাষ্টারদের টাকা গুনবে না রেন পাইপ লাগাবে বলো? কি জোরে জোরে জল পড়ছে ওদের ছাদ থেকে গলিটায়। এখনও শেওলা জমেনি জানো, আর ক'দিন এমন বৃষ্টি হলেই শেওলা জমবে। আসলে তো এটা বর্ষাকাল নয়, তাই এখনও মাটির দলা গলে গলেই ড্রেনের জলে মিশছে।
ওমা, ওরা কাপড়চোপড়গুলো ছাদ থেকে তোলেনি এখনও? আর তুলে কি হবে, সব তো ভিজে চুপচুপে অবস্থা। আর কে তুলবে বলো, বাড়ির একটা ছেলে, সে থাকে বাইরে, বুড়ো-বুড়ি আর সময়ে সময়ে কাজের লোক। কাজের লোক মেলে দিয়ে চলে গেছে। সে নিশ্চই ভাবছে, যাঃ! জামাগুলো মাসি-মেসো তুলেছে? কিম্বা সেও হয়ত তোমার মতই ঘুমিয়ে। ওর গল্পটা জানো তো? জানো না। দাঁড়াও বলছি। তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই শোনো। আগে ফ্রিজের প্লাগটা খুলে আসি, যা বাজ পড়ছে। মনে নেই গেলবার বাজে আমাদের ইনভার্টারটা গেল? ওদেরও গিয়েছিল, আরে ওই যে গো, লোকটা গেল পূজোর সময় কাকে নিয়ে একটা পালিয়ে গেল না, ওই বাড়ি। বউটা আর ইনভার্টার লাগালো না। কি করে লাগাবে। বরটা মরলে যে না চাকরিটা পেত, পালিয়ে গেল যে। তা ক'দ্দূরই বা পড়েছে বলো, শুনেছি নাকি মোটে মাধ্যমিক পাশ, বনগাঁর ওদিকে বাড়ি। লোকটার প্রথম বউটা গায়ে আগুন দিয়ে মরার পর একেই তো বিয়ে করে এনেছিল। এখন দেখো, কেমন একেও ছেড়ে চলে গেল। কি করে যে চলে বউটার?
যাক গে, যে কথা বলছিলাম। ওই মাসির বাড়ি যে কাজ করে তার কথা। আমি তো দিদি বলেই ডাকি। সে শুনেছি তার বরকে ছেড়ে আলাদা থাকে। কেন জানি না। শুনেছি তার বরের নাকি তাতে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বয়েস হয়েছে বউটার জানো, তা প্রায় পঞ্চাশের ঘরে তো হবেই। কারোর সাথে যে ভালোবাসা হয়েছে তা না। এমনি। ওর একটা মেয়ে আছে, ছেলে আছে। তাদের বিয়ে থা হয়ে গেছে অবশ্য। তবু কেন জানি ওর কেমন একটা স্বাধীনচেতা ভাব। ও বরাবরই কেমন শিরদাঁড়া উঁচু করে হাঁটে দেখোনি? আমিও ভাবতাম মেয়েমানুষের অমন শিরদাঁড়া উঁচো তো দেখিনি বাবা! তা কেমন যেন লাগে আমার ঘটনাটা। ওর স্বামীর কিছু দোষ আছে নাকি জানি না অবশ্য। তা তেমন বড় কিছু থাকলে তো অ্যাদ্দিনে সক্কলে টের পেত বলো? তা তো নয়। তবে কি? জানি না।
তুমি ঘুমাও। ভেবো না। বৃষ্টিটা ভালোই হচ্ছে জানো। এই দেখো, কি কথা ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ আকাশের দিকে তাকাইনি, কি ঘন মেঘ করে এসেছে গো! তুমি দেখো না, ভয় পাবে। তোমার আবার বাজের আওয়াজে ভয়। আমার সে ভয় নেই, না বাজের আওয়াজে, না আগুনে। মাঝরাতে কতবার ছাদে দাঁড়িয়ে থেকেছি। চারদিকে কি বাজ পড়ছে, ঝড় হচ্ছে, বৃষ্টি পড়ছে এমন যেন সাত সমুদ্রের সব জল মাথায় করে এনেছে আকাশ, আমার মাথায় ঢালবে। কেন? সে কথা থাক। আসলে তখনও আমার গায়ে শ্মশানের গন্ধ মেলায়নি। যাকে আগুনে দিয়ে ফিরলাম, সে আমার বুকের মধ্যে একটা যজ্ঞবেদী বানিয়ে রাতদিন বসে থাকে তখন। যা পায় আহুতি দিয়ে দেয়। শুধু আহুতি দিতে পারে না নিজেকে। তাই নিয়ে তার যে কি ক্ষোভ, কি রাগ, কি বলি তোমায়।
সামনের উঠোনটা পুরো জলে ভরে গেল, ঘুম থেকে উঠে দেখো। ব্যাঙগুলোর লাফ যদি দেখতে। কি বলছি এসব আমি, তুমি তো জলে পা দাওনি কখনো। তোমার কি শীত করছে, পাখাটা বন্ধ করে দেব? আমার শরীরের গন্ধ তোমার কাছে পুরোনো হয়ে গেছে বলো। কি একঘেয়ে সব এখন তোমার কাছে। এমনকি ছুটির দিনগুলোতেও তুমি অবসরের জেরে ক্লান্ত হয়ে পড়ো – বুঝি আমি। আমি আসলে গল্প বলতে পারি না জানো। আমি কবিতা পড়তে পারি, কবিতা লিখতেও পারি। না না... তোমায় কিছু বলছি না আমি, আমার কথা বলছি, তোমার বন্ধ চোখের পাতাদুটোরও কি শাসন করার ক্ষমতা না? একটা সময় আমার ছাড়া শাড়ি, ব্লাউজ, অন্তর্বাসের গন্ধও তোমায় নাকি পাগল করে দিত (পশু করে দিত), এখন আমার জলজ্যান্ত গোটা শরীরটাও কি অর্থহীন, আবেদনহীন প্রতিবেশী তোমার, তাই না গো? তোমার কত কাজ? আমারও কাজ আছে, কিন্তু কর্তব্য নয় বলো, তোমার মত, তাই সে কাজের মূল্যই বা কতটুকু।
বৃষ্টিটা ধরছে বোধহয়। বৃষ্টি থামলে আমি ভয় পাই। বৃষ্টি যেন আমার গ্রামের বাড়ির সখী। সে আসলে আমি আমার ফ্রকের গন্ধ পাই, মায়ের আদর পাই, আমার গ্রামের বাড়ির উঠোন ডোবানো জলের আবদারের উষ্ণতা পাই। তোমার মনে আছে, আমাদের বিয়ের তিন বছরের মাথায় আমার ছোটোভাইটা মারা গেল? কি একটা জ্বর হল যেন, ডাক্তারেরা ধরতে পারল না। মেঘের সাথে ও আসে আমার বাড়ি জানো? আগেও এসেছে, আমি বলিনি তোমায়, তুমি ভয় পাবে। ও আসে। আমার সাথে ঘোরে। আমার সাথে স্নানের ঘরেও যায়। লজ্জা? না গো, মানুষ মরলে কি আর পুরুষ নারী বোধ থাকে? ও একদিন আমায় পিঠের সেই কালশিটেটা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, কিরে দিদি ওটা? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানো, যদি মাকে বলে দেয়! মা কিছু করতে পারবে না জানি, তবু মা তো... কষ্ট পাওয়াও তো কিছু একটা করা বলো? শরীরের থেকে মনই তো বেশি করে, শরীর তো মনের নকল করে। সে রাগই বলো আর প্রেম।
আমার মাঝে মাঝে কি বিচ্ছিরি একটা চিন্তা হয় জানো। যদি তুমি আর কোনোদিন ঘুম থেকে না ওঠো। আগে ভয় হত। সে তবু ভালো ছিল জানো, নিজের সাথে নিজের তবু একটা সম্পর্ক ছিল, ভয়ের শিকল ছিল। এখন আর ভয় করে না। মেঘ করলে তো আরো করে না। একদিন আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার সিঁদুর মুছেও দেখেছিলাম জানো, ওঃ তুমি জানবে কি করে। কি ভয়ংকর সুন্দর দেখাচ্ছিল আমাকে। যদিও আমি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারিনি। তারপর খুব কেঁদেছিলাম জানো, সে তোমার জন্য না আমার জন্য আমি আজও বুঝিনি গো।
বৃষ্টিটা থামতে গিয়েও থামল না। সন্ধেটা দেখো চুপি চুপি কেমন আগেভাগে এসে পড়েছে। আমার ভাই এরকম মুখ করে ঘরে ফিরত জানো যেদিন মাঠে খেলা হত না। লক্ষ্মী ছেলের মত আগে এসে ঘরে বই খুলে বসে যেত। সন্ধ্যেটাকে দেখো, ঠিক সেই অবস্থা, নইলে এ সময় ওকে পায় কে...
আচ্ছা আমি যদি ভাইয়ের সাথে চলে যাই... আমার আজকাল খুব মনে হয় জানো, মা চলে যাওয়ার পর থেকে বেশি মনে হয়। খুব কি ক্ষতি হবে তোমার সংসারের? তোমার বয়েসই বা এমনকি, তুমি আবার প্রথম থেকে সব শুরু করতে পারবে...
বৃষ্টিটা আর দেখা যাচ্ছে না জানো। শব্দ শোনা যাচ্ছে খালি। ঘরটাও খুব অন্ধকার। আলো জ্বাললাম না, থাক। সন্ধ্যেও দেব না। ভগবানের কি রোজ আলো ভালো লাগে বলো, তবে এমন কালো নিকষ রাত করবে কেন?
কে? ভাই এলি? কি গো যাবো? ও এসেছে... যাবো?...
সৌরভ ভট্টাচার্য
1 June 2018