সৌরভ ভট্টাচার্য
16 February 2019
(মৃণাল, তোমাকে মনে রেখে)
রমেশ,
আমাকে এ চিঠি লেখার সাহস জোগালো মৃণাল। তুমি জানো না। কারণ তুমি বাংলা বই পড়ো না। তোমার বাড়িতে পড়ার চল কোনোদিন ছিল না। তোমার মনে আছে নিশ্চই, বিয়ের পরের দিন আমি খবরের কাগজ খুঁজেছিলাম বলে তোমার মায়ের কাছে আমায় কথা শুনতে হয়েছিল। আসলে আমি জানতামই না জানো কোনো বাড়িতে সকালবেলা পেপার আসে না। তোমার বোনের বাংলা অনার্স ছিল। সেই বই পড়ে পড়েই আমার দু'বছর কেটে গিয়েছিল। ততদিনে কিছুটা অভ্যাসও হয়ে গেল বই ছাড়া থাকার, তাছাড়া বাবুও হল।
মৃণাল, রবীন্দ্রনাথের 'স্ত্রীর পত্র' বলে একটা ছোটোগল্প আছে, তার চরিত্র। সিনেমাও হয়েছিল। মাধবী মৃণালের পাঠটা করেছিলেন। কিন্তু তোমাদের বাড়িতে বাংলা সিনেমা দেখার চলও ছিল না। তুমি দেখতে ইংরাজী সিনেমা আর পর্ণোগ্রাফি, আর মা দেখতেন হিন্দী মারামারি বা তামিল ডাব করা সিনেমা। আমার মত একটা গ্রামের মেয়েকে বিয়ে করেই তোমরা কৃতার্থ করেছিলে, তায় তার আবার রুচি। আর সে রুচিও যদি শুধু বাংলা সাহিত্য আর সিনেমায় সীমাবদ্ধ থাকে তবে তো তাকে নিয়ে আর সোসাইটিতে মুখ দেখানো যেত না বলো? আমার ছিল সমাজ, এসে পড়লাম তোমাদের সোসাইটিতে।
তবে মানিয়েই নিয়েছিলাম বলো। মেয়েদের এই ক্ষমতাটা তো বিধাতা আলাদা করেই দিয়েছেন। যার নিজের মেরুদণ্ডে দাঁড়িয়ে সূর্যের আলো দেখার ক্ষমতা নেই, বিধাতা তাকে লতিয়ে ওঠার আশ্চর্য ক্ষমতা দিয়েছেন। এই নিয়ে আমার ক্ষোভ বলো আর অভিমান বলো বিধাতার থেকে মেয়েদের জাতটার উপরেই বেশি। বিদেশী সাহিত্য আমি তেমন পড়িনি তাই বাইরের দেশের কথা বলতে পারি না, কিন্তু আমাদের দেশের মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরেও, নিজের পরিচয়ে মাথা তোলাতে, আমি আজও হয় দ্বিধা, নয় অতিচেষ্টা দেখেছি। যেন এই বিশ্বাসটা তার মধ্যে এখনও সহজ হয়ে আসেনি। আগে ভাবতাম সমাজ এর জন্যে দায়ী, আজ বুঝি সমাজের এই দেখার ভঙ্গী আমরা নিজেরাই কায়েম করে রেখেছি।
তুমি আমার দাদাকে কোনোদিন সহ্য করতে পারতে না। আমি জানি। কারণ দাদার উন্মুক্ত চিন্তাধারা তোমার আর তোমার তথাকথিত বনেদী, সংরক্ষণশীল ভাবধারার সাথে বড্ড বেমানান লাগত, তোমাদের নির্জীব বিশ্বাসগুলো খোলা বাতাসের হাওয়ায় সাড়া দিতে না পেরে, হীনমন্যতার লজ্জা ঢাকতে, অকারণ রূঢ় হয়ে উঠত। দাদা সেটা বুঝতেন। তিনি তোমাদের মনে মনে সেইজন্য করুণাই করে এসেছেন। সেটাও তোমরা বুঝতে, তাই তোমাদের অসন্তোষ এত অসহ্য ছিল তোমাদের নিজেদের কাছেই। সে যাক, যে কথা বলতে দাদার প্রসঙ্গে এলাম। দাদাদের একটা আড্ডার গ্রুপ ছিল। তাতে সাহিত্য সঙ্গীত রাজনীতি সিনেমা ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা হত। তোমার আর তোমার মায়ের ভাষায় যা আঁতলামি ছাড়া আর কিছুই কোনোদিন ছিল না। সে যাক, আজ এতদিন পর সেই রাগ অভিমান কিছুই আমার নেই। তো যে কথা বলছিলাম, আমি সেই গ্রুপে ওদের আড্ডায় প্রায়ই বসতাম। কত কি শিখতাম, জানতাম। কিন্তু কোনো মেয়েদের আড্ডায় যেতাম না জানো। আমাদের ওখানে প্রগতিশীল মেয়েদের একটা সংগঠন ছিল। তারা কবিতা লিখত, গল্প লিখত। পত্রিকা চালাত 'দ্বিতীয় লিঙ্গ' নামে একটা। কিন্তু বেশিদিন চলল না জানো, কেন বলো তো? ঈর্ষা। আমি দেখেছি মেয়েদের আলোচনায়, সে তারা যত শিক্ষিতই হোক, অবশেষে আলোচনার শেষে মেয়েদের নিয়ে মেয়ে হয়েই ফিরেছি। কিন্তু পুরুষদের আলোচনায় একটা গোটা মানুষ হয়ে পৃথিবীর নানা বিষয়ে নিজের দায়, মানু্ষ হিসাবে দায়ের বোধ নিয়ে ফিরেছি। আর ঠিক তাই তোমার মায়ের ওই নারী সংগঠন নিয়ে আমার এত ঘেন্না ছিল। মেয়েদের মুক্তির ওই শৌখিন চর্চা যখন তোমাদের বাড়িতে বসত আমার রাগে ঘেন্নায় গা রি রি করত। কি অসম্ভব শৌখিন কথাবার্তা, চিন্তা। যে লড়াইয়ের মূলে বিদ্বেষ আর অবিশ্বাস থাকে সে লড়াইকে আমি দাসের লড়াই বলেই জেনেছি। লড়াইয়ের মূলে যদি আত্মবিশ্বাস বা আত্মত্যাগ না থাকে তবে তা হাস্যকর। সার্কাসের ট্রাপিজে জোকারদের খেলার মত। যা কিছু কসরত তাদের তা বিস্ময় না জাগিয়ে দর্শকের মনে আমোদই জাগায়। আমি কোনোদিন সেই দলে ছিলাম না। তাই তোমার মায়ের কোনোদিন ভালোবাসার মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি। আর যে মানুষ হয় পাঁচিলে লতা হয়ে নয় পাঁচিলে লাথি মেরে ছাড়া দাঁড়ানোর কথা ভাবে না তিনিও আমার শ্রদ্ধার মানুষ হতে পারেননি।
এবার আসি তোমার কথায়। মানে আমাদের কথায়। তুমি আমার উপর নির্ভরশীল ছিলে আজীবন, কিন্ত ভালোবাসতে কোনোদিনও পারোনি। আমাদের মধ্যে যা ছিল তা হল অভ্যাস। তুমি অফিস থেকে ফিরেই চাইতে কেউ তোমার জামা খুলে দিক, দিয়েছি। স্নানের জন্য গিজারটা অন্ করুক, করেছি। চা আনুক, অল্প চিনি, হালকা লিকার, দিয়েছি। প্রতিদিন কিছু না কিছু মুখোরোচক সান্ধ্য আহারের ব্যবস্থা থাকুক, রেখেছি। বিছানায় তোমার শরীর আর মনের ছন্দে তাল মিলাক, সব সময় পারিনি, চেষ্টা করেছি। কারণ করুণা হত, ওইটুকু সময়েই তুমি যা নিজের মত থাকতে, বাকিটা তো মুখোশ। এভাবে ঘুম থেকে উঠে বিছানা থেকে নামার আগেই পায়ের কাছে স্লিপার, চা, সুস্বাদু জলখাবার, স্নানের জল, কাচা জামাকাপড়, ফুল চার্জড মোবাইল ল্যাপটপ, সব জুগিয়ে গেছি। আর তুমি চূড়ান্ত নির্ভরশীলতায় আমার সাথে জড়িয়ে গেছ আষ্টেপৃষ্ঠে। তাকে লোকে ভালোবাসা বলে ভুল করত, তুমিও করতে। তুমি অসুস্থ হলে বাচ্চাদের মত হয়ে যেতে। সব সময় আমার উপস্থিতি চাইতে। থাকতাম। তুমি আমায় হারাতে ভয় পেতে, কারণ আমি তোমার একান্ত অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলাম, ভালোবাসা বলে তুমি তা বোঝাতে চাইতে, দেখাতে চাইতে। আমার যেবার টাইফয়েড আর জণ্ডিস একসাথে হল, তুমি অফিস ছুটি নিয়ে কি সেবাই আমার করেছিলে। আমি সেরে ওঠার পর বলেছিলে তোমার ওজন কমে গেছে চার কেজি, আর তুমি নাকি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলে। আমি দুটো কথাই বিশ্বাস করেছিলাম। কারণ দুটোই সত্যি। শুধু ওটা ভালোবাসা নয়, এই সত্যিটা তুমি জানলেও মানতে না। ওটা নির্ভরশীলতার অভ্যাস।
তুমি সুখ সন্ধানী মানুষ ছিলে। তোমাদের পরিবারে একটা সুখের প্রতি দাসত্ব ছিল। তুমিও তাই ছিলে। সুখ সন্ধানী মানুষ কথা দেয় যত সহজে ভাঙেও ততটাই সহজে। তুমি যখন পারমিতার সাথে জড়িয়ে পড়লে, তোমার অফিস, তোমাদের সোসাইটিতে জানাজানি হয়ে গেল, সবাই কত কত উত্তেজিত হয়েছিল। বেশিরভাগই মজা পেয়ে আর কেউ কেউ ভয়ে। আমি এর কোনোটার মধ্যেই ছিলাম না। আমি জানতাম তুমি ফিরে আসবে। কারণ পারমিতা তোমার সুখের গ্যারান্টি হতে পারবে না। হয়ও নি। তুমি ফিরে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলে। বোঝাতে চেয়েছিলে তুমি আমায় সত্যিই ভালোবেসে ফিরে এসেছ। আমি জানি তুমি কেন ফিরে এসেছিলে, তোমার যে সুখে থাকার অভ্যাস। সে আমি ছাড়া কেউ দিতে পারে না তোমায়, তুমি জানতে। শুধু জানতে না যে আমিও জানি।
আজ আমাদের বিয়ের তিরিশ বছর হল। আমি বাবুর কাছে পুণেতে। ওকে আমার মত করে বড় করতে চেয়েছিলাম। তোমরা দাওনি। কিন্তু তাও ও হয়েছে। ওর মামার মত হয়েছে। আমার কবিতার খাতাটা বার করেছে। ফেসবুকে আমার একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে। একটা ব্লগ বানিয়ে দিয়েছে। আমি আর কলকাতায় ফিরব না। আমি জানি তুমি পুণেতে থাকতে পছন্দ করো না। তুমি আসবে না। আমি চাইও না তুমি আসো। আমি এখন থেকে একটু আমার মত বাঁচি। গরীব বাবার মেয়ে হওয়ার দায়, তোমাদের রায় বাড়ির বউ হওয়ার দায়, তোমার স্ত্রী হওয়ার দায়, মা হওয়ার দায় - সব সাধ্যমত পুষিয়েছি। এবার আমার নিজের কিছু দায় নিজের কাছে আছে। সেই দায়গুলো পুরন করার সময় এসেছে। মিথ্যার জঞ্জাল সরিয়ে সত্যি হয়ে বাঁচার সময় এসেছে। সেই সাধনায় এবার লেগে থাকি। মৃণালের ভাষায় বলি, "এই লেগে থাকাই তো বেঁচে থাকা। আমিও বাঁচব। আমি বাঁচলুম।"
ইতি
পারুল