Skip to main content

 

তখন আমাদের বাড়ি হয়নি। রেলকলোনিতেই থাকি। এরকম মেঘলা দিন একটা। মায়ের সঙ্গে বসে গল্প হচ্ছে। বিষয়, কেমন বাড়ি মা চাইছেন, কোথায় চাইছেন ইত্যাদি।

কথাপ্রসঙ্গে মা বললেন, জানিস আমার এতদিনের জীবনে কোনোদিন কারোর কিছু দেখে তেমন লোভ হয়নি, দুদিন আগে হল। তোর অঙ্কের স্যারের বাড়ি গিয়েছিলাম, ওদের বাড়ির পিছনে সে কুয়োতলাটা আছে না, ওটা দেখে মনে হল, ইস, আমার বাড়িতে যদি অমন একটা কুয়ো হত।

রেলের থেকে রিট্যায়ারের পর সবাই মোটামুটি ফ্ল্যাট বা বাড়ি করে এদিক ওদিক চলে যায়, এই রীতি, কিন্তু কুয়ো এখন আর কে বানায়?

আমি ভাবলাম মায়ের ইচ্ছাটা হয় তো অধরাই থেকে যাবে। কিন্তু তা হল না, হালিশহরে যে জমিটা আমরা পেলাম, সে জমিতে আগে থেকেই একটা কুয়ো ছিল।

মায়ের ইচ্ছা পূর্ণ হল। কিন্তু মায়ের কথাটা আমার কানে আজও বাজে। "সারাটা জীবন আমার কারোর কিছু দেখে কোনোদিন লোভ হয়নি।" এ কথাটা সত্যি। মাকে কোনোদিনই কিছু পাওয়ার জন্য উতলা হতে দেখিনি কোনোদিন, না তো বিমর্ষ হতে।

উপনিষদের একটা কথা আছে, অন্যের ধনে লোভ কোরো না। মা কোনোদিন ঈশোপনিষদ পড়েননি। আমি জানি। কিন্তু নিজের মনকে সন্তুষ্ট রাখতে জানতেন।

আমার মনে হয়, আসলে আমরা কারোর কোনো জিনিসের উপর যে লোভ করি তা ঠিক নয়, আমাদের মধ্যে একটা পূর্ণ হওয়ার বাসনা আছে। আমাদের মনে হয় অমুক ওটা পেয়ে নিশ্চয়ই ওর মধ্যে পূর্ণত্বের অনুভব হয়ে গেছে। একটা কমপ্লিটনেস ফিলিংস চলে এসেছে নিশ্চয়ই। আমি যদি পাই, আমারও হবে অমন অনুভব। নিজেকে রাজা করতে চাই সব পেয়ে। কারণ আমরা জানি রাজা মানেই যার মধ্যে অভাববোধ নেই। যে সব সময় পূর্ণত্বের বোধে মগ্ন। আমরা এই কমপ্লিটনেস ফিলিংসটাকে ঈর্ষা করি। সেলিব্রিটিদের দেখলে মনে হয়, ওরা নিশ্চয়ই কমপ্লিটনেস ফিলিংস এ বাঁচে। যার যা নেই, তার অন্যের কাছে সেটা দেখলে মনে হয়, ওটা পেলেই সে ধন্য হয়ে যাবে, কৃতকৃত্য হয়ে যাবে।

লকডাউন যখন শুরু হল, কি অচলাবস্থা রে বাবা, আমার যেমন প্রথমে মনে হল প্রাইম ভিডিও নিলেই হবে। হল না। তারপর নেটফ্লিক্স। তারপর হটস্টার। আসলে কিছুতেই কিছু হয় না, এটা বুঝতে কিছু কিছু মানুষকে অনেক কিছু পেতেই হয়। আবার কেউ কেউ শুরুতেই খেলাটা বুঝে যায়। কিছু পেয়ে, কিছু হয়ে, কোথাও গিয়ে, কাউকে তাড়িয়ে, কাউকে ডেকে - কিছুতেই কমপ্লিটনেস ফিলিংসটা স্থায়ী হওয়ার নয়। দুদিন পরে আবার যে-ই কে সেই। এ এক অদ্ভুত ধাঁধা।

মা এটা অনেক আগে বুঝে গিয়েছিলেন। আজ যদি এ লেখাটা আমি মাকে পড়ে শোনাতাম, মা কি আদৌ প্রশংসা করতেন? বলতেন, ওসব তত্ত্বকথা রেখে, টবের গাছগুলোয় মাটি দেগে যা, আর নয় তো বইগুলো যা করে রেখেছিস ওগুলো গোছা....

এই হয়। যে পূর্ণত্বের পিছনে দৌড়ায় না, সে আনন্দেই কাজের মধ্যে ডুবে থাকে। আর যে পূর্ণত্বের আনন্দের খোঁজে ঘুরে বেড়ায় বিষাদের প্যাকেজ আর তাকে ছাড়ে না। কি আয়রনি না?