সৌরভ ভট্টাচার্য
6 March 2017
লোকটা চোখ বুজে হাঁটত। বাইরের পৃথিবীটার ওপর তার ভীষণ ঈর্ষা। বেশি হাঁটতও না। দক্ষিণে, পুবে ও পশ্চিমে দশ পা, দশ পা করে হাঁটত। উত্তরে একটা কিছুতে সে বাধা পেত, কিসে পেত সে বুঝত না, তবে পাঁচ পা হাঁটলেই কিছুতে একটা ঠেকত। খুব রেগে যেত। করত কি, হাতড়ে যা কিছু ইঁট-পাটকেল পেত, তাই ছুঁড়ে মারত। রোজ, দুবেলা।
এভাবে বেশ কিছু বছর গেল। একদিন লোকটার কি হল, ভীষণ অধৈর্য্য হয়ে উঠল। ভোরের বেলা যখন কেউ ঘুম থেকে জাগেনি, সে চোখ মেলল। দেখল দক্ষিণে, পুবে, পশ্চিমে পথ গেছে এঁকেবেঁকে। পথের রেখাগুলো দিগন্তে গেছে মিলিয়ে। তার উত্তর দিকে প্রকাণ্ড একটা প্রাচীর। তার মাথায় আগুন জ্বলে গেল সেটা দেখে। একটা মই এনে চড়তে শুরু করল। যত উঠতে লাগল তত তার শীত করতে লাগল, ভয় করতে লাগল। মনে হল এই বুঝি আকাশটা মাথায় ভেঙে পড়ে, এই বুঝি বাতাসে তাকে দূরে কোনো অচেনা শহরে নিয়ে গিয়ে ফেলে। একবার ভাবল চোখ বুজে ফেলে আবার, নীচে নেমে যায়। তারপর ভাবল, না, এই পাঁচিলের এতবড় দেমাক! সে তার শেষ দেখেই ছাড়বে।
যখন সে পাঁচিলের ঊর্দ্ধসীমানায় পৌঁছালো তখন সূর্য অনেকটা উঠে গেছে। হুহু করে বাতাস বইছে, যেন ঝড়! তার চোখকে সইয়ে নিতে খানিক সময় লাগল। যখন তাকালো, সে পুরো হতবাক! দেখল তার সামনে বিশাল বড় বাগান। অজস্র ফুল। কি তাদের রং, কি তাদের সৌরভ! কত রকমের প্রজাপতি, পশুপাখি। কত মানুষ কি পরিশ্রম করে চলেছে সে বাগানে। কেউ মাটি কোপাচ্ছে, কেউ জল আনছে, কেউ বীজ বুনছে, আরো কত কি ...তার দেখতে দেখতে কেমন ঘোর লাগতে শুরু করল। মনের মধ্যে একটা উদারতা এসে তার অতীতের অন্ধকারটাতে একটা আঘাত যেন হানল। সে মুগ্ধ হয়ে একটা একটা ফুল দেখছে, রঙে মোহিত হতে হতে আরেকটা ফুলের দিকে চোখ ফেরাচ্ছে...হঠাৎ দেখল একি! একটা কোণায় ইঁট-পাটকেল স্তূপাকার করে রাখা! কি বেমানান, কি বিশ্রী!
হঠাৎ তার মনে হল, তবে কি তাই? এগুলো তারই ছোঁড়া ইঁট-পাটকেলের স্তূপ? মনে হতেই তার মনের মধ্যে আবার মেঘ জমতে শুরু করল। মনে হল তারই ছোড়া ইঁট-পাটকেলের স্তূপ তাকেই যেন ব্যঙ্গ করছে। সে তাড়াতাড়ি নামতে লাগল, চীৎকার করে গাল পাড়তে লাগল ওই বাগানের সব কিছুকে...কিছু অন্ধপ্রাণী তারও সমর্থকে জুটে গেল। তারা ঠিক করল চীৎকারে, ইঁট-পাটকেলের আক্রমণে সে বাগানকে তারা তাদের জায়গার মত করে ফেলবেই। সে আর কিছু চোখওয়ালা মানুষ চোখ বন্ধ করে হাঁটা শুরু করল, তাদের পথ দেখাতে লাগল জন্মান্ধের দল।