"মা কেউ কারো ন্যানোতে মুখ দেয়? বাপি যে ভিডিওটা দেখছিল একটা আঙ্কেল তাতে একটা আন্টির...”
শ্বেতা রান্নাঘরে মাছগুলো ধুচ্ছিল। বাকি কথাটা বান্টি বলার আগেই চীৎকার করে বলল, তুমি এখনও বাড়িতে কেন? সানডেতে তোমার ড্রয়িং ক্লাস থাকে ভুলে গেছো? আর কতবার বলেছি তুমি বাপির ঘর নক করে ঢুকবে? যাও এখনি প্রদ্যুত আঙ্কেলের বাড়ি...
শ্বেতা বলল না, শ্বেতার গলা বলল। শ্বেতা জানে। শ্বেতা এখন অন্যমনস্ক। বান্টি ক্লাস থ্রি'তে পড়ে। নয়ডাতে ওদের পাঁচ বছর হল। শ্বেতাদের ফ্ল্যাটের রান্নাঘরের জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে অনেকটা সবুজ মাঠ, গাছপালা দেখা যায়। শ্বেতার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। অরিণের এই স্বভাবটা বাড়ছে দিন দিন। শনিবার রবিবার মানেই সকাল থেকে মদে চুর, দুপুরে ডেটিং। ডেটিংটা রোজ নয়। মাঝে মাঝে। সেটা শ্বেতাকে বলেই, ইন্ডিরেকটলি। মানে ফোন করে ডিস্টার্ব কোরো না।
শ্বেতা জানলার বাইরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। বাচ্চাদের খেলার আওয়াজ আসছে। শরৎকালের মত রোদ বাইরেটা। শ্বেতা মাছগুলোর দিকে তাকালো। হলুদ মাখানো, কয়েকটা মৃতদেহ। একটা মাছ তুলে নাকের কাছে ধরল। আঁশটে গন্ধ। একটু গা'টা পাক দিল। সহ্য করল। তারপর আরেকটা মাছ তুলে আবার একই জিনিস করল। সেও কি সাইকো হয়ে যাচ্ছে? রান্নাঘরের বাইরে এসে ডাইনিং-এর পাখাটা ফুল স্পিডে চালিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। সামনের দরজার সামনে বালকনিটায় রোদের রিফ্ল্যেক্সান হচ্ছে। অরিণ একেবারে কোণের দিকের একটা রুমে। শ্বেতা এখানে বসেই দেখতে পাচ্ছে, অরিণ মেরুন রঙের শর্টসটা পরে আধশোয়া হয়ে আছে, ঘরের ভিতর ধোঁয়ায় ধোঁয়া, আর ল্যাপটপে চলছে পর্ণ।
বান্টি হয়ে যাওয়ার পর তাদের মধ্যে সম্পর্কটা আগের মত নেই। কেন নেই সেটা অনেকবার বুঝতে চেষ্টা করেছে, পারেনি। অরিণ প্রশ্ন এড়িয়ে যায়। অনেকে বলল, ম্যারেজ কাউন্সিলার দেখাতে, দেখিয়েছে, কোনো ফল হয় নি। শ্বেতা নিজেকেও নানারকমভাবে প্রশ্ন করেছে, হাজারবার পরীক্ষা করেছে নিজেকে। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। শ্বেতা জগ থেকে গ্লাসে জল গড়ালো। গলাটা ভিজিয়ে আবার উঠে দাঁড়ালো। ফ্যানের সুইচটা অফ্ করে রান্নাঘরে গিয়ে একটা টুলের উপর বসল।
এই রান্নাঘরটা তার কেন জানি খুব সেফ লাগে। মনে হয় যেন এইটা তার নিজের ক্ষেত্র। এখানে ঢুকলে অনেকে যেন হেরে যায় তার কাছে। রান্নাটা এখন একটা অবসেসান হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্যাসটা দুবার অন্ করে অফ্ করে দিল। তেলের জায়গাটা পাশেই রাখা। ইচ্ছা করছে না। রান্নাঘরের টাইলসে নিজের অবয়বটা চোখে পড়ল। বাইরে এলো আবার। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের মুখটা দেখল। সেই তিনটে পাকা চুল। একটাও বাড়েনি আর। চোখেমুখে জল দিল। ওঘর থেকে ইংরাজী গানের সুর ভেসে আসছে। মানে পর্ণের পর্ব কমপ্লিট। একটা স্কুল থেকেও কল আসছে না। অনেকগুলোতে সিভি ছাড়া আছে। বাইরের বালকনিতে আবার চোখ গেল, রোদটা এখনো দাঁড়িয়ে। মা এরকম রোদে আচার শুকাতে দিতেন। আচ্ছা অরিণ আচার খায়? খেত তো?
শ্বেতা দ্রুতপায়ে রান্নাঘরে ঢুকল। গাউনের পকেট থেকে মোবাইলটা বার করল। নেটটা অফ্ করা। তার বুকের মধ্যে ধুকধুক আওয়াজটা দ্রুত হচ্ছে। সারা শরীরে একটা উত্তেজনা। ইউটিউব অন্ করল। লিখল, how to prepare Indian pickle'... enter মারল। টুলে বসল। মাথার মধ্যে কাদের যেন মুখ ভাসছে। কারা যেন হেরে হেরে যাচ্ছে তার কাছে।
গ্যাসটা অন্ করে চায়ের জল চাপালো। কাপবোর্ডটা খুলে টি-ব্যাগের প্যাকেট আর ঘুমের ওষুধের শিশি বার করল। এছাড়া এসময় উপায় থাকে না। ফেসবুকটা অন্ করল। প্রদ্যুতের কবিতা নোটিফিকেশানে। ভীষণ ভালো লিখছে ছেলেটা। কয়েকটা নারীবাদী পোস্ট। ওই পেজগুলোতে ওর লাইক করা। সেজেগুজে, কিম্বা বিকট বেমানান সাজা হাই প্রোফাইল মহিলাদের মুখ। জ্বালাময়ী... তেজময়ী... বেকার... কয়েকটা লাইক দিয়ে সে আবার কবিতাটা বার করল। একহাতে ঘুমের ওষুধের শিশিটা নিয়ে একটা চায়ের কাপে ঢালতে গিয়ে কি হল, হুড়মুড় করে পুরো শিশিটার ওষুধ গিয়ে পড়ল। ওটা অরিণের কাপ। বেশি চিনি দেওয়া। শ্বেতা সুগার ফ্রি খায়। বাচ্চাগুলো প্রচণ্ড চ্যাঁচাচ্ছে। খেলা নিয়ে কোনো গোলমাল হয়েছে বোধহয়। প্রায়ই হয়। শ্বেতা বাইরের দিকে তাকালো জানলা দিয়ে। ওই জঙ্গলটা পেরিয়েই হাইওয়ে। গাড়িগুলো সাঁই সাঁই করে ছুটছে।
শ্বেতা ফোনটা হাতে নিয়ে প্রদ্যুতকে ফোন করল।
"হ্যাঁ গো বান্টি পৌঁছেছে?”
"হ্যাঁ দিদি”
"কি ভালো লিখেছো গো কবিতাটা। কি করে লেখো বলো তো... তোমার কাছে শিখতে হবে...”
দুটো চায়ের কাপ নিয়ে শ্বেতা ধীরে ধীরে অরিণের ঘরের দিকে যাচ্ছে। বারান্দায় রোদটা তার দিকে তাকালো। দেওয়ালগুলো তাকালো। দরজাটা যেন নিজেই খুলে গেল। আচারের রেসিপিটা যেন কি?... কবিতাটার শেষ লাইনে যেন কি... "তোমার আচ্ছন্ন যৌবন আমায় মাতাল করেছে যুগান্তরের টানে"... আচ্ছন্ন যৌবন না প্রচ্ছন্ন... অরিণের দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে...