মা কালীর মন্দিরের সামনে বিশাল লাইন। বিপত্তারিণী পুজো। বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য ভক্তেরা সব লাইনে দাঁড়িয়ে। ইনসিওরেন্স কোম্পানির অফিসার জনার্দন মিত্র। তার পিছনে ডাক্তার জগদানন্দ ব্রহ্মচারী। তার পিছনে উকিল চৈতী সামন্ত। তার পিছনে সাব ইনস্পেকটর বল্লভনাথ মল্লিক। তার পিছনে দমকল অফিসের অফিসার জ্যোতির্ময় মুখার্জি। আরো অনেকে অনেকে।
হঠাৎ মা বাইরে বেরিয়ে এলেন মন্দিরের। পুরোহিত হরিবল্লভ ভটচায একটা পিঁড়ি পেতে দিলেন। মা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, তোমরা বাছা ভেবেচিন্তে লাইনে দাঁড়িয়েছ তো সবাই…. দিই তুলে সব বিপদ…. কী করে খাবি তোরা তবে?
সবাই নিজেদের দিকে তাকাতাকি করল। হঠাৎ করে চৈতী বলল, তা মা, গোটাগুটি বিপদ তুলে নিলে তোমারও তো বিপদ….. এই পুজোটুজো পাবা? তার চাইতে একটা রফা করলে হয় না? আমরা কিছু সামলালাম…. কিছু তুমিও…..
পেঁচো মস্তান দাঁড়িয়ে ছিল মন্দিরের পিছনে, (নিন্দুকে বলবে, লুকিয়ে। কিন্তু আসলে তা নয়। আসলে কী সে অবশ্য কেউ জানে না।) সে বেরিয়ে এসে বলল, মা, হ্যাঁ সেই ভালো, একটা সিণ্ডিকেট তৈরি করলে হয় না?
পুরোহিত ধমকে বলল, এই পেঁচো…. কী যা তা বলছিস মাকে…..
পেঁচো বলল, তা মা যেমন বুদ্ধি দিয়েছে তেমনই তো বলব নাকি? সবই মায়ের ইচ্ছা।
মা বললেন, সেই অনুভব হয়ে গেলে আর কী মস্তানি করে বেড়াতিস আপদ…. দেব গলায় ঝুলিয়ে একদিন….
পুরোহিত বলল, প্রসন্ন হ মা…. প্রসন্ন…. আজ ভয় দেখাসনি…..
চৈতী উকিল বলল, বিপদের দুইদিক আছে। আসামীর দিক আর ফরিয়াদীর দিক। তুমি আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলবে। ওতেই আমাদের বাড়িগাড়ি, ব্যাঙ্কব্যালেন্স যা হওয়ার যাবে।
মহাদেব এতক্ষণ ধরে উপুড় হয়ে শুয়ে সব শুনছিলেন। এবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে এলেন। বললেন, কী সব হচ্ছে এদিকে…. গিন্নী তুমি ঘরে যাও… আমি দেখছি…..
মা কড়া নজরে তাকালেন। মহাদেব বললেন, বেশ বেশ… না ইচ্ছা হলে যেও না।
মহাদেব বললেন, চৈতী বিচার করো…..
চৈতী বলল, জ্বি হুজুর।
ইনি তো মা….
জ্বি….
জগতে যা হচ্ছে এনার ইচ্ছাতেই তো….
জ্বি..
মা কখনও সন্তানকে বিপদে ফেলে?
পেঁচো মস্তান বলল, বিলক্ষণ ফেলে… আমার মা আমাকে দিদার বাড়ি রেখে পালিয়ে গিয়েছিল… আমার তখন দু বছর বয়েস…. .বাবা তার আগেই পালিয়েছিল….. দিদা মরে গেল…. আমি বকে গেলাম….
মহাদেব মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল… কী লীলা তোমার…..
মা বললেন, সব আমার ইচ্ছায় চালালে হবে? ওদের নিজেদের দায়িত্ব নিতে হবে না? তাই একটু ছাড় দিই। কিন্তু এমন ছড়িয়ে রাখে….. ওদের ইচ্ছা আর আমার ইচ্ছার আন্দোলনেই তো মানবলীলা…. জানো না যেন…..
মহাদেব বললেন বেশ বেশ। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, শোনো ইচ্ছা যতক্ষণ জীবন ততক্ষণ…. জীবন যতক্ষণ বিপদ ততক্ষণ…. তারপর তো খেলা শেষ হলে আমি আর মা আছিই…. .তোমরা পুজো দিয়ে যে যার বাড়ি যাও…. ইচ্ছাময়ী তোমাদের ইচ্ছায় থাকুন… তোমাদের ইচ্ছা ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছাকে খুঁজে বেড়াক….. এইতেই জীবন কেটে যাবে…. আনন্দে থাকো…..
মহাদেব মায়ের হাত ধরে মন্দিরে গর্ভগৃহের দিকে এগোলেন। গান গাইতে গাইতে। সুর শুনে মন হল নিধুবাবুর টপ্পা।
আবার সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল। এতক্ষণ কী হল কারোর কিছু মনেই থাকল না। সবই ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছালীলা। শুধু সবার মনে হল আজ জবার লালরঙটা যেন বেশি লাল।