Skip to main content
htd

শীতকাল। তিনি ছাদে বসে। স্নান সেরে রোদে এসে বসেছেন। বাড়ির সামনে জমে জল। সদ্য পেরিয়েছে বর্ষা। জল নামেনি এখনও। সাদা শাড়িটায় এসে পড়েছে শরতের আলো। দূরে কোথাও চণ্ডীপাঠ হচ্ছে, দুর্গাপুজোর প্যাণ্ডেলে। তাঁর দুটো চোখ বন্ধ। এই সময়টায় তিনি নিজেকে কিছুক্ষণ বিচ্ছিন্ন করে নেন আশপাশ থেকে। স্মরণ করেন শ্রীগুরুচরণ। জীবনের গভীরে ডুব দেন। ডুব দিতে সাহস লাগে। নিজেকে স্থির রাখতে সাহস লাগে।

======

অশক্ত শরীরটা গুছিয়ে নিয়ে বসে আছেন ঝুলবারান্দায়। পাশে চায়ের কাপ। শীতের আলো এসে পড়েছে গায়ে। সামনে উত্তাল পুরীর সমুদ্র। ঢেউয়ের পর ঢেউ ভাঙার শব্দ আসছে। এত ভাঙার শব্দেও সমুদ্র তার সমুদ্রত্ব হারায় না। সমুদ্রের সামনে বসে উদাস হয় ঘোরতম সংসারী মানুষ অবধি। ভাঙা বুক জুড়ে দেয় সমুদ্র। উদারতায়। গভীরতায়।

তিনি নামতে পারেন না। সময় বয়ে গিয়েছে নিষ্ঠুরভাবে শরীরের উপর দিয়ে। মন সময়কে তার বকেয়া নিঃসঙ্কোচে চুকিয়ে দিয়ে বলেছে, এতটুকুই, এর বেশিতে নেই তোমার অধিকার।

এতগুলো বছর, মানুষের, সমাজের এত এত পরিবর্তন, সমুদ্র মনে রাখে? পরিবর্তন মানে জীবন। এত সহজ কথাটাকে বাধা দিতে গিয়েই মানুষের যত অবাস্তব লড়াই। কেন যে বোঝে না মানুষ!

জগন্নাথ দর্শনে যাবেন না। শরীরকে বয়ে নিয়ে যাওয়া এক ধকল। চেন্নাইতেও মন্দিরের সামনে চূড়ার দিকে বসে তাকিয়েছেন গাড়িতে। কিন্তু মন? মনের গতি আটকাবে কে? মন সিঁড়ির পর সিঁড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে ঢোকে গর্ভগৃহে। বলে, এলাম আমি। দেবতা স্মিত হেসে বলেন, তুমি তো এসেই আছ!

=======

স্বামী চলে গেছেন মাঝবয়সে। সন্তানের ডান হাতের পাঁচটা আঙুলে ভরেছেন নিজের ডান হাতের পাঁচটা আঙুল। তৈরি হয়েছে সেতু। মা'তে মেয়েতে কোনো শৃঙ্খল তৈরি করেনি। বানিয়েছে সেতু। বন্ধুত্বের সেতু। সে সেতু বেয়ে বয়েছে সুখ-দুঃখ, মান-অভিমানের বর্ণমালা। হৃদয় তো দশপ্রহরণধারিনী।

=======

তবু সব গল্পের মত, এই গল্পেও এলো আইসিইউ, এলো রক্তচাপের ওঠানামা, স্মৃতির আত্মবিস্মরণ। আত্মা মানে কি শুধুই আমি? ওই যে আইসিইউ এর বাইরে উদ্বিগ্ন দুটো চোখ… নিঃশব্দ কান্না…. উদ্বিগ্ন অন্তিম সমঝোতা... ও কি আত্মা নয়…. আমরা মিলেই তো ছিলাম আমি….. নির্বাক চোখের কোণ বেয়ে গড়ায় জল। চলে যাওয়া মানে কি ছেড়ে যাওয়া?

======

ছিলাম। সব রয়ে গেল। আলমারি ভর্তি শাড়ি। এমনকি এবারের কেনা পুজোর শাড়িটাও। পায়ের আদুরে চটি। থালা, গেলাস। বিছানার এক দিকে দীর্ঘদিন শুতে শুতে দেবে যাওয়া বিছানা। হাজার একটা ওষুধ। আর সর্বোপরি সারাঘর জুড়ে আমার থাকার গন্ধ!

শোক, তুমি মৃত্যুর চেয়েও ঘাতক। শোক, তুমি মহাকাশের চেয়েও বিস্তীর্ণ। শূন্যতার কোনো আত্মীয় হয় না। শূন্যতার কোনো দরজা, জানলা হয় না। একটাই দায়, বেঁচে থাকা। নৈতিক দায়।

======

সময় বয়ে যাবে। স্মৃতি নক্ষত্রের মত চেতনার আকাশে স্থির হয়ে দাঁড়াবে। যে চলে গেল, আর যে থেকে গেল, এক অদৃশ্য সম্পর্ক আবার গড়ে উঠবে। আবার কথা হবে, আবার সেতু গড়ে উঠবে। আবার হার মানবে সময়, মৃত্যু, শোক। যেমন হেরে আসছে যুগ যুগ ধরে। এই মাটির বুকেই আবার একটা হৃদয় খুঁজে পাবে অমরলোকের পথ। মানুষ তো তটস্থ। তার বুকের মধ্যে অনবরত ঢেউ ভাঙার সমুদ্র। ঢেউ অনন্ত। ভাঙনের সুর অনন্ত। তবু সমুদ্র থেকে যায়। সমুদ্রই সত্য হয়। কেউ বলে না সমুদ্র মানে ভাঙন। বলে সমুদ্র মানে গভীরতা। সমুদ্র মানে অসীম।

মেয়ে তাকায় শূন্যতার দিগন্তের দিকে। খুঁজে পায় না। তবু মনের মধ্যে এক অপেক্ষার অঙ্কুর জাগে। যেমনভাবে অপেক্ষা করি আমরা সবাই, আবার দেখা হবে বলে। একেবারে ছেড়ে যাওয়া বলে হয় নাকি কিছু! আত্মা মানে কি শুধুই আমি? আমাতে তোমাতে মিলেই তো হই আত্মা, আমি। হৃদয় জানে অপেক্ষার সুর। হৃদয় তো দশপ্রহরণধারিণী। মা, ভালো থেকো। অপেক্ষা কোরো।

 

(ছবিঃ Debasish Bose)