আগন্তুক বেঞ্চে বসে বলল, আমি এই পাড়ায় ছিলাম।
কেউ শুনল না। তখন প্রচণ্ড ভিড় চায়ের দোকানে। আগন্তুক এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে ষাঁড়কে খাওয়ালো।
শীত পড়ছে। আগন্তুকের গায়ে মোটা জামা। মাথায় পাগড়ি। ধুতিটা ময়লা। গঙ্গার ধার।
দোকানে চা ফুটছে। কথা ফুটছে। হাসি ফুটছে। তর্ক ফুটছে। কুয়াশা ভেদ করে সকালের আলো ফুটছে।
আগন্তুক আবার বলল, আমি এই পাড়াতেই থাকতাম।
আবার কেউ শুনল না। আগন্তুক শিঙ্গা বার করল ঝোলা থেকে। ফুঁ দিল কাঁচাপাকা দাড়ি ঢাকা দুই গাল ফুলিয়ে। কুয়াশা কেটে গেল চড়চড় করে। গঙ্গার জল নেচে উঠল ছুটতে ছুটতে। বাতাসে ঘূর্ণি লাগল। দোকানের মাথায় ছাওয়া অশ্বত্থগাছটার ডালে বসা পাপিয়া ডেকে উঠল বিবশ হয়ে।
খদ্দেরদের কারোর টুপি উড়ে গেল। কারোর গলার মাফলারের প্যাঁচ খুলে গেল। কারোর কথার খেই হারিয়ে গেল। চোখে ধুলো ঢুকে চোখ জ্বালা করল। কেউ কাশলো। কেউ হাঁচলো। দুধটা উথলাতে উথলাতে থমকে দাঁড়িয়ে রইল পাত্রের কিনারা বরাবর। উনুনের শিখা ফিরল আগন্তুকের দিকে।
আগন্তুক দোকানের ভিড় ঠেলে বেরিয়ে গেল। দূর থেকে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে একবার বলল, আমি এসেছিলাম, এই পাড়াতেই ছিলাম।
আগন্তুক ফিরে গেল।
দোকানের পাশে বাজার বসল। অনেক মানুষ খদ্দের হয়ে এলো। গল্প করল। হাসল। ঠাট্টা করল। তর্ক করল। দরদাম তো করলই। ততক্ষণে কুয়াশা গেছে কেটে। শীত পড়ছে চড়চড়িয়ে। সবাই বুঝতে পারল, সবাই অন্যমনস্ক হয়ে আছে। তারপর আরো বুঝতে পারল সবাই সারাদিন তারা অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। শেষে বুঝল তারা যৌবন থেকেই অন্যমনস্ক।
একজন বলল, সে নাকি শিঙ্গা ফোঁকার আওয়াজ পেয়েছে।
একজন বলল, বাতাসের ঘূর্ণি দেখেছে। একজন বলল, জলের ঢেউয়ে নাচ দেখেছে।
ততক্ষণে চায়ের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের সবার মনে হল, কেউ যেন অপেক্ষা করতে বলে গেছে এই দোকানের সামনে তাদের। নইলে গোটা জীবনে সব করলে, সব পেলেও, সব ব্যর্থ হবে। সৌন্দর্য ভরা যৌবন, উষ্ণতা ভরা নিরাপত্তা, আমোদ ভরা চরাচরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে সবাই মনে মনে বলল, হয় তো আসব।