Skip to main content
 
 
 
দাদাঠাকুর এসে দাঁড়ালেন, আর ফকির। মুখে মাস্ক। কাছে গেলেই বললেন একগাল হেসে, নিকট হতে চাইলে কাছেই আসতে হয় বুঝি? যাও যাও দূরে দাঁড়াও। গান কথা ওই অবধিও পৌঁছাবে। আমাদের হাসিও।
 
বললাম, ভয় করছে দাদাঠাকুর।
 
ফকির অমনি পাশ থেকে হেসে বললেন, ধৈর্য ধর বাবা।
 
বলতাম, আরো কদ্দিন?
 
ফকির বললেন, এ তো অধৈর্য্যের প্রশ্ন হল। আবার দিন গোনা কেন?
 
বললাম, অমল যে না হয় ছিল কোয়ারেন্টাইনে। তার না হয় রাজার অপেক্ষা ছিল। আমাদের কি হবে? আমাদের যে রাজার অপেক্ষা নেই।
 
তোমাদের তবে কিসের অপেক্ষা? ফকির জিজ্ঞাসা করলেন।
 
দাদাঠাকুর পাশ থেকে বললেন, নিশ্চিন্ত মনে বাঁচার, তাই তো হে?
 
বললাম, তাই। রাজার চিঠি আসুক না আসুক দাদাঠাকুর, এ রোগের টিকা যে বের হতেই হবে।
 
ফকির বললেন, হুম, সে কথা তো ঠিক।
 
দাদাঠাকুর বললেন, সে আজ না হয় কাল ধরো বেরোবে। সে কদিন না হয় অমলের মত কাটালে সবাই।
 
বললাম, সে আমি না হয় কাটালাম, কিন্তু যাদের ঘরে ক্ষুধার অন্ন নেই?
 
ফকির বললেন, সেই তো, আমাকেই ধরো না কেন? চিত্তের ক্ষুধা গান নিয়ে বাইরে বার করেই ছাড়লে, আর এ তো পেটের ক্ষুধার কথা..
 
দাদাঠাকুর বললেন, কাজ ছাড়া চলেই বা কি করে?
 
বললাম, উৎপাদন কমেছে শুধু না দাদাঠাকুর, ক্রয়ও কমেছে। কেউ কেউ অবশ্য ঘরে বসে কাজ করছে, 'কাজ করো ঘরে থেকে' স্লোগানে।
 
ফকির বললেন, চাষী চাষ করবে না, জেলে মাছ ধরবে না তবে? তাই হয়? শ্রমিক, দিন মজুর ছাড়া চাকা ঘুরবে না। চাকা না ঘুরলে বিপদ কমবে। কিন্তু বিপদে পড়ার মানুষও তো হবে হাপিস! সেই 'জগন্নাথের রশি' টানতে এক সাধককে আনার কথা হয়েছিল মনে আছে? যে তপস্যার ভারে আর দীর্ঘদিনের অনশনের ভারে দাঁড়াতেই পারছিল না? তা গোটা সমাজ তেমন হবে নাকি গো?
দাদাঠাকুর বললেন, তাই তো ভাববার কথা।
 
বললাম, তবে উপায় কি গো?
 
দাদাঠাকুর গাইলেন, ওরে চলার বেগেই পথ কেটে যায়......করিস নে আর দেরি...
ভাই পথ আজ না হয় কাল বেরোবে। এ এক পরীক্ষা। অমৃতকলস আছে লুকানো। কেউ না কেউ তার সন্ধান পাবেই।
 
কিন্তু মরি যে আমরা দাদাঠাকুর...আর্তনাদ করে উঠলাম.....
 
ফকির বললেন, বাড়ি যা ভাই...ওনার 'পৃথিবী' কবিতাটা পড়। পারলে মুখস্থ রাখ। শিরায় শিরায় ছুটিয়ে দে শব্দগুলোকে, বল পাবি। "আমি ভয় করব না, ভয় করব না...দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না..."
 
ফকির আর দাদঠাকুর 'পৃথিবী' কবিতার কয়েকটা নির্বাচিত লাইন আবৃত্তি করতে করতে এগিয়ে গেলেন....মিলিয়ে গেলেন.....
 
আজ আমার প্রণতি গ্রহন করো, পৃথিবী,
শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদিতলে।।
মহাবীর্যবতী তুমি বীরভোগ্যা,
বিপরীত তুমি ললিতে কঠোরে,
মিশ্রিত তোমার প্রকৃতি পুরুষে নারীতে,
মানুষের জীবন দোলায়িত কর তুমি দু:সহ দ্বন্দ্বে।
ডান হাতে পূর্ণ কর সুধা,
বাম হাতে চুর্ণ কর পাত্র,
তোমার লীলাক্ষেত্র মুখরিত কর অট্টবিদ্রূপে;
দু:সাধ্য কর বীরের জীবনকে মহৎ জীবনে যার অধিকার।
শ্রেয়কে কর দুর্মূল্য, কৃপা কর না কৃপাপাত্রকে।...
.......তবু সেই আদিম বর্বর আঁকড়ে রইল তোমার ইতিহাস।
ব্যবস্থার মধ্যে সে হঠাৎ আনে বিশৃঙ্খলতা-
তোমার স্বভাবের কালো গর্ত থেকে
হঠাৎ বেরিয়ে আসে এঁকেবেঁকে!
তোমার নাড়ীতে লেগে আছে তার পাগলামি।
দেবতার মন্ত্র উঠেছে আকাশে বাতাসে অরণ্যে
দিনে রাত্রে উদাত্ত অনুদাত্ত মন্দ্রস্বরে।
তবু তোমার বক্ষের পাতাল থেকে আধপোষা নাগদানব
ক্ষণে ক্ষণে উঠেছে ফণা তুলে-
তার তাড়নায় তোমার আপন জীবকে করেছ আঘাত,
ছারখার করছ আপন সৃষ্টিকে।।
শুভে-অশুভে স্থাপিত তোমার পাদপীঠে
তোমার প্রচন্ড সুন্দর মহিমার উদ্দেশে
আজ রেখে যাব আমার ক্ষতচিহ্নলাঞ্ছিত জীবনের প্রণতি।....