সৌরভ ভট্টাচার্য
29 January 2019
চারজন পুরুষ মেয়েটার শরীরে তার অনিচ্ছায় প্রবেশাধিকার পাওয়ার পর মেয়েটা বুঝল সত্যিই তার বাবা অনটনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে।
মেয়েটা তখন তেইশ। স্কুল অনেকদিন ভাঙা স্বপ্ন। ইচ্ছানুযায়ী পোশাক, খাওয়া অবাস্তব। বিয়ে হবে না। বাবা চায় না। চলবে কি করে?
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু হল না। মেয়েটার মৃত মায়ের বাবার কিছু সম্পত্তি তার মামারা ভাগ্নীর মুখ চেয়ে দিল। সব জেনেই দিল। দিতে এসে তাদের বাড়িতে এক কাপ চা-ও খায়নি যদিও। তার মামারা দশটা সিঙ্গাড়া, এক প্যাকেট বিরিয়ানী, সন্দেশ তিন রকমের এনে যখন ঘরে রাখল, মেয়েটা সারা ঘরে খাবারের গন্ধে কেমন আচ্ছন্ন হয়ে গেল। মামারা তার বাবাকে যখন দলিলের কাগজ বোঝাচ্ছিল, মেয়েটা জিভের জল দুই ঠোঁটের চাপে আটকে রাখতে চেষ্টা করছিল।
তার বাবার এখন চায়ের দোকান। মেয়েটার বয়েস এখন তিরিশ। বিয়ে করেনি বা বিয়ে হয়নি। কিন্তু সেদিনের পর থেকে একজন পুরুষও তার ভিতরে প্রবেশাধিকার পায়নি। মেয়েটা সন্ধ্যেবেলায় বাবার চায়ের দোকানে আড্ডা মারে, নয়ত রিকশা স্ট্যাণ্ডে। সঙ্গী বলতে পাড়ার ছেলেরা।
রাতের বেলায় তার বাবা যখন ঘরে অন্য মেয়ে নিয়ে এসে ঘরে ঢোকে, সে নিজের ঘরে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনে। ভিডিও দেখে। কার্টুন দেখে বেশি। কিছু ছেলে হোয়াটস অ্যাপে তার খারাপ ছবি দেখতে চায়, পাঠায় না, শুধু একজনকে ছাড়া। তাকে সে রক্তমাংসে দেখেনি।কথা হয়নি, মেয়েটা চায় না বলেই হয়নি। তবু সব জানিয়ে ফেলেছে তাকে।
সকালবেলা মেয়েটা বাজারে ঘুরে বেড়ায়। সব্জীওয়ালা, মাছওয়ালা, চায়ের দোকানী, মুদি - কত গল্প তার। তার গলার আওয়াজটা এখন অনেকটা পুরুষ মানুষের মত শোনায়। একটা জিন্সের প্যাণ্ট আর পাঞ্জাবি গায়ে ঘুরে বেড়ায়। শীতে একটা লেদারের জ্যাকেট। লম্বা প্রায় সাড়ে পাঁচফুট তো হবেই। চোখদুটো সব সময় আগুনের মত গনগন করছে। যেন কেউ উনুনে আঁচ ধরিয়ে রান্না চাপাতে ভুলে গেছে।
বাজারে ঘুরতে ঘুরতে বাজারও করে। নিজেই রাঁধে। নিজেরা দু'জনে খায়, আর খায় নেড়ি কুকুর একটা। তাদের বাগানেই জন্মেছিল। তার আর ভাইবোনগুলো মরেছে, এইটা ছাড়া। দুপুরটা সিনেমা দেখতে যায়, নইলে কোনো বন্ধুর বাড়ি, নিজের বাড়িতে থাকতে চায় না। ছায়া দেখে অমানুষের। নিজেকে অচেনা লাগে। গায়ে কাঁটা দেয়। মাঝে মাঝেই একা একা সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। পুকুরে ঢিল ছুঁড়ে ঢেউ তোলে। ঢেউ মিলিয়ে গেল মন খারাপ হয়, আবার ঢিল খোঁজে। খুব আনচান করলে নিজেই ঝাঁপ দেয়। সাঁতার কাটে। সারা পুকুরে ঢেউ তোলে।
মেয়েটা সন্ধ্যেবেলা রিকশা স্ট্যাণ্ডে বসে ছেলেগুলোর সাথে আড্ডা দিচ্ছে। শীতকাল। লেদারের জ্যাকেট, জিন্সের প্যান্ট আর একটা পাঞ্জাবী গায়ে, হাতে একটা সিগারেট নিয়ে কথা বলছিল, বলতে বলতে হঠাৎ উঠে গেল। ওর সাথে যে চারজন ছেলে ছিল তারা তাকালো, কিছু না বলে আড়চোখে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করার ভান করল। তাদের মনে হল সামনের মোড়ে কেউ যেন দাঁড়িয়েছে এসে। মেয়েটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
তার বাবা মহরমের দিন রাতে স্ট্রোকে মারা গেল। তার সাথে সেদিন রাতে যে মহিলা ছিল, সে ক্লাবে খবর দিয়ে চলে যাচ্ছিল। মহিলার ব্যাগের মধ্যে ছ'হাজার টাকা, যা সে মেয়েটার বাবার বিছানার তলায় পেয়েছিল, একটা hmt দম দেওয়া ঘড়ি যা মেয়েটার বাবা তাকে চুমু খাওয়ার আগে খুলে মাথার বালিশের পাশে রেখেছিল। ক্লাবের একটা ছেলে মাঝরাস্তায় ছিনতাই করে সে সব কেড়ে নেয় মহিলার কাছ থেকে চড়থাপ্পড় মেরে।
চায়ের দোকানটা আজ নেই। তাদের বাড়িটা আর দোকানটা নিয়ে ফ্ল্যাট উঠে গেছে। রিকশা স্ট্যাণ্ডটা টোটো স্ট্যাণ্ড হয়েছে। পাড়ার ছেলেরা কেউ প্রায় নেই। কাজের সূত্রে বাইরে। এখন নতুন ছেলেরা আড্ডা দেয় টোটো স্ট্যাণ্ডে।
খুব বৃষ্টি পড়ছে। সন্ধ্যেবেলা। একজন মহিলা দুটো বাচ্চা নিয়ে টোটো স্ট্যাণ্ডে দাঁড়াল। রোগা রোগা তিনটে শরীর একটা ছাতার তলায় বৃষ্টির সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে। একটা চায়ের দোকান আর মনসাতলার বাইশ নম্বর বাড়িটার খোঁজ করল, গলার আওয়াজটা পুরুষের মত। ছেলেরা প্রথমে উত্তর দিল না। কিন্তু মহিলা অনড়। বাধ্য হয়ে একটা ছেলে পাড়ার বড়দের ডাকে। বড়দের একজনের হাতে একটা hmt ঘড়ি। সে চীৎকার করে বলল, ভদ্রপাড়ায় এইরকম চরিত্রের মেয়েরা থাকে না। কেউ অবাক হল না। মজা পেল। মনে হল যেন সত্যিই সিরিয়াল। এ মানুষটার প্রোমোটারিতেই যত ফ্ল্যাট এই পাড়ায়।
এ পাড়ায় অনেক নতুন লোক। ভদ্রলোক। মহিলা ছাতা সামলে, বৃষ্টি সামলে, বাচ্চা সামলে হাঁটতে শুরু করল, ঝাপসা বৃষ্টিতে মিলিয়ে গেল। খানিকবাদে সেই ঘড়িপরা মানুষটা বেরিয়ে গেল, আধঘন্টা বাদে ফিরে এল। হাতটা ফাঁকা, hmt টা নেই। মেয়েটার সাথে বাবার একটা স্মৃতি তো থাক।