Skip to main content
হিসেবী


---
রোহিনীর মনে হল যেন একটা দমকা হাওয়ায় বইয়ের পঞ্চাশটা পাতা এক্কেবারে উড়ে গেল। এই তো খানিক আগেও সব ঠিক ছিল। সুনন্দের কাছ থেকে আজ দীপান্বিতা ম্যাডামের নোটটা নিতে এসেছিল। রোহিনী ফিলজফিতে মাষ্টার্স করছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এটাই প্রথম বর্ষ। সকাল থেকে শরীরটা ভালো ছিল না। মনে হয়েছিল হয়তো জ্বর আসবে। এলো না। প্রত্যেকবার এই সিজন চেঞ্জের সময় তার এরকম হয়।
অক্টোবর মাসের শেষের দিক। অল্প অল্প ঠান্ডা ঠাণ্ডা পড়েছে। পূজোটা মাসের শুরুর দিকেই হয়ে গেছে। একটা পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে সে ফিরছিল তাদের বাড়ির দিকে। পনেরো মিনিটের হাঁটা পথ। সব বদলে দিল।
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা মতন হবে। সুনন্দদের বাড়ির বাঁকটা ঘুরতেই ছেলেটা বাইক নিয়ে তার মুখোমুখি। দাঁড়ায়নি। সে তাকিয়েছিল তার চোখের দিকে। রোহিনীও তাকিয়েছিল। ওটা তাকানো? ওতো বুক পেতে শরবিদ্ধ হওয়া! এভাবে তাকায় কেউ? মনে হল তার অতীত জীবনে দেখা হারিয়ে যাওয়া দুটো চোখ। এক নিমেষেই এতদিনের চেনা চারপাশটা অচেনা হয়ে গেল। অন্যমনস্ক হল? না তো! এতদিন অন্যমনস্ক ছিল যেন। আজ ঘুম ভাঙল। একটা নীল জিন্সের জ্যাকেট পরেছিল মনে হল ছেলেটা। স্ট্রিট লাইটের আলোয় যতদূর দেখা যায় তার চাইতেও যেন গভীরে গিয়ে দেখেছে সে। কে ও? কি নাম? কোথায় থাকে? কি করে? পড়াশোনা না চাকরি?
বাড়ি ফিরল রোহিনী। যে রোহিনী বেরিয়েছিল সে অবশ্য নয়। বাড়ি ফিরল অন্য একজন। একই শরীর, অন্য মন।
জামা ছাড়ল। নাইটি একটা পরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। একটা ক্লীপ ডান হাতে দাঁতে চেপে ফাঁক করে, বাঁ হাতে চুলের গোছটা ধরে আটকাতে আটাকাতে মনে হল, এ কাজটা যেন অন্য কেউ করছে যন্ত্রের মত, সে দেখছে। সে নিজেকে নিজের থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে দেখছে। হঠাৎ এমন একা, অচেনা হয়ে গেল কেন সে নিজের কাছে? সব কিছু যেন থমকে গেছে কোথাও তার চারদিকে। তাকে ঘিরে শুধু দু'জোড়া চোখ।
রোহিনীর আচমকাই খুব কান্না পেতে লাগল। সে ছেলেটার চোখদুটোকে যত দূরে সরাতে চেষ্টা করল, তত তার বুকের ওপর চেপে ধরে বসতে লাগল। রান্নাঘরে গেল। রোহিনীর মা বিশাখা রুটি করছিলেন। ওকে অসময়ে রান্নাঘরে দেখে একটু অবাক হয়ে বললেন, কিরে খিদে পেয়েছে?
রোহিনীর খুব অপ্রস্তুত লাগল নিজেকে। যেন একটা ঘোর কেটে গেল হঠাৎ-ই। বলল, না এমনি, বাবা কখন আসবে কিছু বলেছে?
রোহিনীদের বাড়ি নৈহাটি। ওর বাবা পরমেশ কলকাতায় একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে। ফিরতে রাত হয় মাঝে মাঝে। ম্যানেজিং পোস্টে আছেন।
বিশাখা কিছু একটা উত্তর করছিলেন, রোহিনী না শুনেই নিজের ঘরে ফিরে এলো। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। কে ও?



---
রাত দুটো। ঘুম আসছে না। মোবাইলটা অন করল। কারোর কোনো ম্যাসেজ নেই। কল-লিস্টের এ মাথা ও মাথা গেল। উঠে কম্পিউটারটা অন করল। অরকুট খুলল। ওর সব কলেজের বন্ধুদের প্রোফাইল ঘাঁটল। 'নৈহাটি' নামে একটা গ্রুপ আছে অরকুটে। তন্নতন্ন করে খুঁজল ছেলেটাকে। নেই। সাড়ে তিনটে বাজে। চোখটা জ্বালা করছে। শুতে গেল।
চিন্তাটা এবার যেন জড়িয়ে ধরল তাকে। চোখটা নিস্পলক তার দিকে তাকিয়ে। সে বাধা দিচ্ছে না। কিরকম অদ্ভুত সব প্রশ্ন আসছে তার মাথায়। কিরকম গন্ধ ওর গায়ের? নিশ্চই ডিও মাখে। উগ্র গন্ধের কি? স্মোক করে? ড্রিঙ্ক করে?
না না... আর ভাববে না, পাগল হয়ে যাবে! চুপ চুপ চুপ। কি দেখতে চাইছে সে... একেই কি বখে যাওয়া বলে...
তার স্কুলের কলেজের কিছু মুখ মনে পড়ল যারা তাদের প্রেমের গল্প বলত। সে বিরক্ত হত। ন্যাকামি মনে হত। স্বর্ণালীকে সে ঘেন্না করত। উচ্চমাধ্যমিক হতে না হতেই পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল। অসহ্য লাগত ওকে দেখে। অরকুটে ফ্রেণ্ড রিক্যুয়েস্ট পাঠিয়েছিল। রোহিনী নেয়নি।
আজ তার কি হল? এখন যেন সে বুঝতে পারছে। এত অসহায় হয়ে যায় মানুষ! নিজের মন এত শত্রুতা করে নিজেরই সাথে? এত ভালোও লাগে বখে যেতে...
রোহিনী খেয়াল করল ঘুলঘুলি দিয়ে ভোরের আলো আসছে হাল্কা। উঠে পড়ল। কম্পিউটার অন করল। স্বর্ণালীকে বন্ধুত্বের রিকোয়েস্ট পাঠাবে।


রোহিনী এই কথাগুলো ভাবছিল টুবানকে পড়াতে দিতে এসে। যার কাছে পড়াতে এনেছে তার নাম অন্তু, তার সেই হৃদয়ে বাণ ডাকা পুরুষ। চাকরি-টাকরি পায়নি। টিউশান পড়ায় বাচ্চাদের ইংলিশ মিডিয়ামে। আর গাড়ি ভাড়া খাটায়।
রোহিনীর সাথে বিয়ে হয়েছে কল্যাণের। চার্টাড অ্যাকাউন্টান্ট। রোহিনীর কি ভয় করে এখন এক এক সময় সেই দিনটার কথা ভাবলে। সেদিন কেন, কয়েক সপ্তাহ। অন্তুকে খুঁজেও পেয়েছিল। বলতে পারেনি লজ্জায়। পরে অবশ্য শুনেছিল ওর প্রেম কাকলীর সাথে। সে চিনত কাকলীকে, তাদের থেকে দু'বছর জুনিয়ার, সায়েন্সের ছিল। বখাটে, কিন্তু ভীষণ সুন্দরী। ও একটা নাচের ক্লাস চালায়।
"আরে কতক্ষণ এসেছো রোহিণীদি? চলো ঘরে চলো। বাইরে মশা খুব।"
রোহিণী হেসে বলল, "নারে, থাক, এই তো হয়ে গেছে অন্তুদার।" রোহিনী কিছুতেই অন্তুকে কাকলীর স্বামী বলে মানতে পারে না কেন যেন। ওদের ঘরে ঢুকলেও ওর মনের মধ্যে একটা বিষণ্ণতা আসে। অথচ সুখের তো কিছু অভাব রাখেনি কল্যাণ ওর। তবে কেন? কিসের অভাব?
হয় তো কাকলীর মুখের মধ্যে এমন একটা লাবণ্য সে দেখতে পায়... না না লাবণ্য না... গর্ব, অহংকার... তার রাগ হচ্ছে আবার। এইটাও তার মাঝে মাঝেই হয়। কেন হয়? কি নেই তার? বরং এরাই তো... যাক গে...
রাস্তায় এলো। একটা টোটো নিল। বসেই ফেসবুকটা অন করল। অন্তুর ছবিগুলো দেখল, টুবানকে আড়াল করে। হঠাৎই বলে উঠল, টুবান বিরিয়ানী খাবে? তারপর তোমায় একটা নতুন ভিডিও গেম কিনে দেব আবার। আগেরটা তো পুরোনো হয়ে গেছে, ছ'মাস হল না?
টুবানের বিরিয়ানী পছন্দ না। তার ভিডিও গেমটাও কেনা হয়েছে তিনমাস আগে। সে থ্রীতে পড়ে। তবু জানে মায়ের এই গলার আওয়াজটা স্বাভাবিক নয়, এখন 'না' বললেই মা ভীষণ রেগে যাবে, তারপর ফোন করে বাবাকে খারাপ খারাপ কথা বলবে। সে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
রোহিনী এক ঝটকায় অন্তুর ছবিটা সরিয়ে টোটোয়ালাকে বলল, "অ্যাই... কাজীর দোকানে চলো তো....টিউশান পড়িয়ে আর গাড়ি খাটিয়ে কটা টাকাই বা হয়!...একটা বাচ্চা হোক বুঝবে"....শেষের কথাগুলো সে কাকে বলল সে নিজেও বুঝল না...তার মনের মধ্যে দুটো ভাগ হয়ে গেল আবার। এই গলার আওয়াজটা তো তার না... এই মানুষটা কোন রোহিনী?...