- ইংলিশ নিউজপেপার হ্যায়?
- নেহি, হিন্দী মিলেগা... দৈনিক ভাস্কর, দৈনিক জাগরণ, অমর উজালা...
এ ঘটনা শুরু হল মুঘলসরাই (দীন দয়াল উপাধ্যায়) থেকে কানপুর, এলাহাবাদ হয়ে যোধপুর, জয়পুর, জয়সলমীর অবধি। কোত্থাও নেই। খুঁজতে হলে নির্দিষ্ট কয়েকটা জায়গায় যাও, যেমন স্টেশান অথবা শপিং মলে। সেখানেও পেলাম না।
অর্থাৎ পুরো যাত্রাটা কাটল হিন্দী খবরের কাগজের দিকে তাকিয়ে। গতবার কিনেছিলাম তাও দৈনিক জাগরণ, এবার কিনতেও ইচ্ছা করল না। থাক, নেটেই পড়া যাবে। ওদিকে আবার শান্তি বজায় রাখতে নেট অফ।
গ্রামের দিকে যাও, ইংরেজি নিশ্চিহ্ন। মেরতা রোড। বেশ বড় স্টেশান। যোধপুর এক্সপ্রেস এখানে এসে দু'টুকরো হয়। এক খন্ড যায় যোধপুরে, আরেক টুকরো যায় বিকানেরে। ফেরার সময় এখানে এসেই জুড়ে পুরো যোধপুর এক্সপ্রেস হয়। অর্থাৎ রীতিমতো বড় স্টেশান। সেই স্টেশানে এক বিদেশি দম্পতি নাস্তানাবুদ হচ্ছেন। কেন? না পুরুষ উচ্চশ্রেণী প্রতীক্ষালয় আর মহিলা উচ্চশ্রেণী প্রতীক্ষালয় --- দুই তো হিন্দীতে লেখা, শুধুই হিন্দীতে, তারা বুঝবেন কি করে? ভুল শৌচালয়ে ঢুকে যাচ্ছেন। চারদিকে হাসাহাসি হচ্ছে। মজা হচ্ছে। তারাও হাসছেন, সে হাসি অপ্রস্তুত হাসি। আমাদের লজ্জার। কিন্তু দলে ভারী হলে তো লজ্জাবোধ লোপ পায়। লজ্জা পেতে হলে তো একা হতে হয়, স্বতন্ত্র।
এই তো চলছে। পাকিস্তানে একজন অধ্যাপক কোরাণ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন বলে তার উপর ফাঁসির শাস্তি বরাদ্দ হয়েছে। এ আজকের খবর, বহুযুগ আগের নয়। আমাদের 'লক্ষণের শক্তিশেল' থেকে শুরু করে 'মেঘনাদবধ কাব্য' ইত্যাদি নানা গ্রন্থ আজও ছাপা হচ্ছে। রদ হয়নি। রাম যেখানে ভিলেন, হাস্যকর চরিত্র দেখানো হয়েছে। সদ্যপ্রয়াত নবনীতা দেবসেন, প্রাচীনা সুকুমারী ভট্টাচার্য ইত্যাদি হাজার হাজার হিন্দুধর্ম সমালোচনাকারী ছিলেন, ভবিষ্যতেও হবে। pk-এর মত সিনেমা হইহই করে দেখা হবে, প্রশংসা হবে, যেখানে হিন্দুধর্মের ধর্মের দুর্বলতা, হাসি তামাশা দেখিয়ে অপর ধর্মের বিষয় নীরব থাকার পক্ষপাতিত্বকে আমরা ডিপ্লোমেটিক্যালি নিয়ে নেব। বলব, ব্বাবা! কার ঘাড়ে ক'টা মাথা! এও হবে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানবাসী জানে ধর্ম নিয়ে কথা বললে কি পরিণতি হয়। এখনও আমাদের সেই দুর্দিন আসেনি। সব কিছুর একটা প্রথা আছে বলেই আসেনি। নানা মতের দ্বন্দ্ব, প্রতিষ্ঠা, বিরোধ ইত্যাদির সংমিশ্রণ এই হিন্দুধর্ম। অত সোজা নয় একজামা পরিয়ে একে একপেশে করে দাঁড় করানো।
আজ যত আন্দোলন এই মেট্রোপলিটনগুলোতে হয়ে চলেছে তার প্রভাবের কত শতাংশ সেই উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি গ্রামগুলোতে পৌঁছাচ্ছে? মেরতা রোড স্টেশানে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের এখানে ইংরাজি পেপার আসে না?
সে বলল, আগে আসত। এখন আর আসে না, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কথাটা কানে লাগল। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে!! মানে কি?
সে এড়িয়ে গেল। হ্যাঁ, বন্ধই করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের চীৎকার, চেঁচামেচি, হইহট্টগোল যাই হোক না কেন, সে কাদের নিয়ে? কতটুকু আয়ু তার? কতটা তার প্রভাব? গ্রামগুলোতে কারা যাবে? তাদের নিয়ে আন্দোলন কারা করবে? তাদের জোর করে অন্ধকারে রাখা হচ্ছে - কে বোঝাবে?
খুব কঠিন কাজ। কারণ সেখানে সংস্কারের শিকড় অনেক গভীরে। সেখানে কুসংস্কারের পাঁচিল আরো মজবুত। অন্ধবিশ্বাসের আশ্বাস আরো ধারালো। তবে? তাদের ভাষায় কথা বলার মানুষ কই? তাদের মত হয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তারা যে শোষিত হচ্ছে বোঝানোর মানুষ কই?
নেই। একদিন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন এমনই মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক, শিক্ষিত সমাজকেন্দ্রিক, সংজ্ঞা, তত্ত্ব, পরিকল্পনা, আলোচনা ইত্যাদি কেন্দ্রিক ছিল। আয়োজন ছিল প্রচুর, বাক্যস্ফুলিঙ্গ, তোড়জোড় ছিল প্রচুর, প্রাণ ছিল না। হয় বড্ড বুদ্ধিগত, নয় আবেগগত ছিল। সেদিন মহাত্মা এসে এই সমস্যাটা বুঝেছিলেন। চম্পারণ থেকে যে ইতিহাস গড়া শুরু হয়েছিল, সে বিশ্বের ভাবনার পথ ঘুরিয়েছিল। এ বিষয়ে অসামান্য আলোকপাত রবীন্দ্রনাথের মহাত্মাকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধাবলী। আজ সে দিশায় হাঁটার মানুষ কই? সেখানে তো অন্ধই অন্ধকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে।
সদ্য উত্তর, পশ্চিম ভারতের গ্রামগুলোতে ঘুরে এসে, আজ চারদিকে তাকিয়ে কোথাও কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে। ভারতবর্ষ বলতে যতটুকু বুঝেছি তাই কি ভারতবর্ষ? সে কি শুধু কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয় আর কিছু মিছিল? আর কয়েকটা ধারালো বক্তৃতা? বাকি সিংহভাগ ভারত কোথায়? সে তো যেই তিমিরে সেই তিমিরেই। আমার ইন্টারনেট ইত্যাদি নানা প্রযুক্তি তাদের কাছে আমায় পৌঁছানোযোগ্য, মানে অ্যাকসেসেবল করে দিচ্ছে, কিন্তু আমাকে তাদের মানুষ করে তুলছে কি? না করছে না। তাই এমন চোখে লাগার মত পার্থক্য। বেয়াড়া অসাম্য।
হিন্দী ভাষার বিরোধী আমি কোনো কালেই নই। যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আমার আছে ভাষাটির প্রতি। কিন্তু যে লোহাতে সেতু বানানো যায়, সেই লোহাতেই শিকলও বানানো যায় - এই কথাটা মনে রাখতে হবে। কয়েকজন মুক্তচিন্তক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, বুদ্ধিজীবীতে কি কাজ হবে? সমস্যাটা যেখানে গভীর, যেখানে বুকের হৃৎপিণ্ডটাকে পর্যন্ত রুদ্ধ রেখে, অচল রেখে নিজের অন্ধকারের সাম্রাজ্য বিস্তার করে রেখেছে, সেই দুনিয়ার নেতা কে হবে? নাকি যেখানে সুবিধা শুধু সেখানেই জলঘোলা হবে? শোনা যাচ্ছে, উত্তর প্রদেশের গণ্ডগোলের মূলে প্রতিবেশী দেশের ধর্মীয় সংগঠনকে দায়ী করা হচ্ছে। সে কতটা সত্যি জানি না কেউই। কিন্তু সে যাই হোক, আমাদের অনুপস্থিতিই যে অন্যের উপস্থিতির গল্প হোক বাস্তব হোক তার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিচ্ছে সে বিষয়ে কিসের সন্দেহ আর! ইণ্ডিয়া বনাম ভারত বহু পুরোনো সমস্যা। এখন সেই সমস্যার ঝোপে বিষফল ফলতে শুরু করেছে কেবল। এখনই না উৎপাটনের ব্যবস্থা করলে ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয় সে শিশুও বোঝে। কিন্তু আমাদের সব কিছুতেই "এখনই-টাটকা-ব্রেকিং নিউজ" -এর মোহ না ছাড়লে তা সম্ভব কি? এ যে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের পথ। কৌশলে হবে না। শর্টকাট নেই। সোজা দীর্ঘ, শ্রমসাধ্য পথ। হাঁটবে কে?