Skip to main content
 
 
       ছেলেটাকে দেখলে মনে হয় ওর জন্য যেন বিধাতা কোনো সময় রাখেনি। কাউকে রাখেনি। ও নিজের মত বড় হতে হতে হঠাৎ যেন টের পেল, একা একটা এমন জায়গায় এসে গিয়েছে যে আর ফেরার পথ নেই।
       আমার স্কুলের সহপাঠী। সে সবার সাথে কথা বলত, কিন্তু কেউ তার সাথে কথা বলত না। সে যে ক্লাসরুমে আছে, সেটাই কেউ টের পেত না। তাকে নিয়ে মজা করার কিছু ছিল না, তার কাছ থেকে কিছু আকর্ষণীয় শোনার ছিল না, কারণ সে গল্প বলতে জানত না। খেলত, পরীক্ষা দিত, পাস করত, পড়তে যেত - সব করত, কিন্তু কিছুতেই সে কিছুই ছিল না।
       তাকালে হাসত। কথা বলত না নিজের থেকে। কথা বললে আবশ্যকের চাইতে অনাবশ্যক এত কিছু বলে ফেলত যে ধৈর্য হারাতাম। মাঝে মাঝে টিফিন পিরিয়ডে দেখতাম হাই বেঞ্চে বসে, জানলার দিকে তাকিয়ে, কোলের উপর রাখা টিফিন বক্সের থেকে রুটি বা পরোটা কিছু একটা অল্প অল্প করে মুখে পুরছে। চিবোচ্ছে, কিন্তু স্বাদ পাচ্ছে বলে বোধ হচ্ছে না। এই সময় যদি কেউ হুড়মুড় করে ওর ঘাড়ে এসে পড়ে, ও বিরক্ত হবে না, বা বিরক্ত হলেও প্রকাশ করবে না। সে তাদের হইহুল্লোড়ের মধ্যে নিজেকে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে, কিছুটা পারবে, কিছুটা সে অন্যমনস্ক হবে মাঝে মাঝে।
       মাঝে ক'দিন সে স্কুলে এল না। বলাই বাহুল্য যে সে নিয়ে কারো মাথাব্যথা হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। ওদের পাড়া থেকে ওর সাথেই আসে একটা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে বলল, টাইফয়েড হয়েছে। ব্যস আর কিছু বলার দরকার নেই।
       আমার মনে হল আমার যাওয়া উচিৎ। যদিও কোনোদিন যাইনি, তবু যাই একবার। সামনে মাধ্যমিক, মাস দুই বাকি, এর মধ্যে ওরকম হলে পরীক্ষা দেবে কি করে? যদি কোনো নোটস বা কিছু লাগে। পাড়া চিনি, কিন্তু বাড়ি চিনি না। নাম তো জানি, বার করে নেব। শনিবার বিকেলবেলা সাইকেল নিয়ে বেরোলাম। লজ্জা লাগছে একটু একটু, অপরিচিত বাড়ি যেতে কেমন লাগছে একটা, কিন্তু শুধুই কি কর্তব্যের জন্য যাচ্ছি? মনে হচ্ছিল কর্তব্যটা একটা কারণ হলেও, আসল কারণ হয় তো তা নয়, সেটা অন্য কিছু। সেই 'অন্য কিছু'টা আজ মনে হয়, একটা আজব অনুভূতি, যেটা সেই বয়সেই হয়, তারপরে হারিয়ে যায়। আমরা যত বড় হই, তত কৌতুহল কমে, তত উৎসুক দৃষ্টিটা ফিকে হয়ে যায়। কিন্তু যাই হোক, নিজেকে বেশ বড় বড় লাগতে শুরু করল, এই প্রথম পরিবারের বাইরে কোনো ব্যক্তিগত কাজে যাচ্ছি, বাবার মত। ওরা হয় তো চা খেতে বলবে, বসতে বলবে। বাড়ির সবাই আমার সাথে পরিচয় করবে। ঠিক বড়দের যেমন হয়।
       বাড়ি খুঁজে বার করতে বেগ পেতে হল না। একটা একতলা বাড়ি। সবুজ কাঠের দরজা। রঙচটা। ভিতর থেকে অনেক মানুষের কথা বলার আওয়াজ। আমি সাইকেলটা স্ট্যাণ্ড করে, দরজায় ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। একটা উঠোন। কয়েকজন বয়স্ক মানুষ একটা চৌকিতে বসে চা খাচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে, না উঠেই একজন গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কাকে চাই? চাঁদা?
       কিছুক্ষণের জন্য আমার অপ্রস্তুত অবস্থা। এক ফাঁকে মনে হল, না এলেই ভালো হত। গলায় আত্মবিশ্বাস এনে বললাম, সুদীপ্ত আছে?
       ক্যা....
       আবার সেই গলা। বিচ্ছিরি বেসুরো গলা। ইতিমধ্যে একজন বয়স্কা মহিলা এসে দাঁড়িয়েছেন রঙ্গমঞ্চে। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। ভিতরে নার্ভাস, বাইরে কাষ্ঠবৎ। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, কাকে চাও ভাই?
       আবার বললাম, সুদীপ্ত....
       আচ্ছা রন্টু... ওর তো টাইফয়েড.... আচ্ছা এসো....
       একটা অল্প আলোর ডুম জ্বলছে। সুদীপ্ত একটা ফুল ফুল আঁকা শাড়ির ওয়াড়ের মোটা লেপের মত কিছু মাথা অবধি ঢেকে শুয়ে। আমায় ওর পাশে রাখা একটা টুলে বসতে বলে বেরিয়ে গেলেন বয়স্কা মানুষটা, যিনি সুদীপ্ত'র ঠাকুমা, পরে জেনেছিলাম।
       সুদীপ্ত কি ঘুমাচ্ছে? ঘরের একদিকে ডাঁই করা জামাকাপড়। একটা ড্রেসিং টেবিল, আয়নাটা ঝাপসা। বাইরে হইহট্টগোল। একটা বাড়িতে কত মানুষ থাকে? সবাই আত্মীয়? আমি সুদীপ্ত'র গায়ে হাত দিয়ে ডাকলাম, এই সুদীপ্ত...
       মাথা থেকে ঢাকাটা সরিয়ে, আমার দিকে তাকাল, ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, তুই?
       চোখদুটো গর্তে বসা। মুখটা শুকিয়ে গেছে।
       বললাম, অর্ঘ্য বলল তোর টাইফয়েড হয়েছে...
       সুদীপ্ত একবার উঠতে চেষ্টা করল, আমি বারণ করলাম। বারণ করার দরকার ছিল না, ও এমনিতেই উঠতে পারছিল না। কিন্তু লজ্জা পাচ্ছিল খুব। আমিও পাচ্ছিলাম। স্কুলে তেমন কথা তো হত না। কি বলি? স্কুলের কথা কিছু হল। ওর ঠাকুমা একবার এসে জিজ্ঞাসা করল আমি চা খাই কি না। যদিও আমি খাই, কিন্তু বললাম, না। কেন না বললাম? ওরা গরীব বলে? চারদিকে অপরিষ্কার বলে? নাকি এমনিই ইচ্ছা হচ্ছে না বলে।
       ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোর মা নেই বাড়িতে?
       ও ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল, নেই। বাবাও নেই। ট্রেনে কাটা পড়ে... আমি তখন অনেক ছোটো... মালদাতে...
       আমার ভাষা হারিয়ে গেল। ওর মুখে কোনো পরিবর্তন নেই। আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। ও ওর মাথার কাছে একটা ছবি দেখিয়ে বলল, ওই যে।
       মায়ের মুখটা সুদীপ্তর মত। বাবার মুখটা অন্যরকম, রাগী রাগী। ওর বাবা কি মদ খেত? আমার মাথায় হঠাৎ এই কথাটা এল, কারণ ক'দিন আগেই কাঁচরাপাড়ায় একজন মদ খেয়ে লাইনের উপর দিয়ে যেতে গিয়ে বউ সমেত কাটা পড়েছিল।
       আমি আর কথা বাড়ালাম না। উঠে এলাম। সন্ধ্যে হয়ে গেল বাড়ি ফিরতে ফিরতে। এখন নিজেকে বড় মনে হচ্ছে না আর। বড় হতেও চাইছি না। আমার একটু জ্বর হলেই মা যা করেন... আর সুদীপ্ত....!!!
       বাড়ি ফিরে পড়ায় মন বসছে না। বারবার রান্নাঘরে এ ছুতো সে ছুতো করে যাচ্ছি। মা জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু বলবি? বলতে গিয়ে কান্না পেয়ে যাচ্ছে। কি বলব তাই বুঝতে পারছি না। মা একটু পর আমার ঘরে দু'কাপ চা নিয়ে এসে বসলেন। এই সময়টা আমার জন্য চা বরাদ্দ নয় যদিও। আমি বুঝলাম মা ইজি করার চেষ্টা করছেন আমায়। আমি বললাম, সবটাই বললাম। আমার চোখ দিয়ে বড় বড় দু'ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। সুদীপ্তর জন্য না, সুদীপ্ত'র মায়ের অভাবের জন্য।
       মা সবটা শুনে বললেন, বেশ, আমি আর তুই কাল ওদের বাড়ি যাব। বলাইকে বলে রাখছি ও রিকশা নিয়ে আসবে। তুই সকালে একটা হরলিক্স কিনে আনিস। আমি কৃতজ্ঞ মুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, আচ্ছা। মনে মনে এইটাই চাইছিলাম, পরে বুঝলাম।
       মা-কে নিয়ে আমাকে যেতে হয়নি অবশ্য। পরেরদিন শুনলাম ওকে হাস্পাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভুল ট্রিটমেন্ট হচ্ছিল। ওর নাকি জণ্ডিসও ছিল সাথে। সুদীপ্ত মারা গেল দু'দিন পর। মা কাঁদলেন, আমিও, লুকিয়ে।
       এরপর বেশিদিন সুদীপ্তকে নিয়ে কথা হয়নি, তবে টিফিনের সময়টায় হাইবেঞ্চে জানলা থেকে এসে পড়া আলো, আমায় বহুবার ওর কথা মনে পড়িয়েছে। বহুবার...