দেওয়াল জুড়িয়া দুইখানি টিকটিকি ঘুরিয়া ফিরিয়া বেড়ায়। ঝগড়া, ভালোবাসা লইয়া উহাদের সংসার। সারাদিন কয়েকটি পতঙ্গের খোঁজ পাইলে তাহাদের আমোদে-প্রমোদে দিন কাটিয়া যায়। আমার ঘর ভর্তি এত এত মূল্যবান বই, এত গভীর আলোচনা, কিছুতেই তাহাদের কোনো আগ্রহ দেখি না। তাহারা সুখে শান্তিতে আছে বলিয়াই বোধ হয়।
এ যাবৎকাল উহাদের তুচ্ছ করিয়া আসিয়াছি। একটি টিকটিকি, অভিব্যাক্তির পথে যে অনেক পিছাইয়া, তাহাকে তুচ্ছ কেন করিব ইহা বিশদে বলিবার কোনো কারণ দেখি না। কিন্তু আজ তাহাদের দেখিয়া মনে ক্ষোভ ও ঈর্ষার যুগপৎ ভাব জন্মিল দেখিয়া নিজেই বিস্মিত হইলাম। সেই কথাটি লিখিব বলিয়াই বসা।
অহর্নিশি ছাপা অক্ষরে, বৈদ্যুতিক মাধ্যমে আসন্ন নির্বাচন লইয়া জনসেবাকাঙ্ক্ষী প্রার্থীগণের ভাষা আর সহ্য হইতেছে না। তাহাদের আচরণেও যারপরনাই হতাশা জন্মিয়াছে। তাহার উপর এই অতিমারী, ও তাহার ভ্যাক্সিন লইয়া নানা তর্কবিতর্ক। তাহার উপরে মায়ানমারের বর্বরতার লীলা। প্রতিবেশী দেশগুলিতে নানা অশান্তি। সব মিলিয়া মনটি বিষণ্ণ হইয়াছে। আপনাকে মনুষ্য বলিতে স্বভাগ্যেরই লজ্জাবোধ হইতেছে। তারকাখচিত আকাশ, বসন্তের সমীরণ, প্রভাতের সূর্য, দোল পূর্ণিমার পূর্ণশশী - এত আয়োজন সকলই বৃথা যাইতেছে। এতদিন নাস্তিকের যুক্তি শুনিয়া আসিতেছি, মঙ্গলময় ঈশ্বরের জগতে এত অমঙ্গল রহে কি করিয়া?
প্রশ্নটি সংগত লাগিয়াছে। উত্তর পাই নাই। আজ তাহাদের প্রশ্ন করিতে ইচ্ছা করিতেছে, এত শিক্ষায়তন, এত আইন-আদালত, এত পুলিশ প্রহরা, এত নিয়মকানুন থাকিতেও সারা পৃথিবী জুড়িয়া এত বিশৃঙ্খলা কেন? এত নির্বোধ আচরণ কেন?
কোনো উত্তর নাই। আমাদের কাহারও নিকট কোনো উত্তর নাই। আমি টিকটিকি দুটির প্রণয়লীলা দেখিতে দেখিতে উহাই ভাবিতেছিলাম, অহো কি ভাগ্য সরীসৃপ তোমাদিগের। তোমাদিগের ধর্ম নাই, শাস্ত্র নাই, দেশ নাই, রাজনীতি নাই, সমাজ নাই। তোমাদের বিজ্ঞান নাই বলিতে পারি না। যতটুকু বৈজ্ঞানিক জ্ঞান থাকিলে জীবন নির্বাহ হইয়া যায় তাহা তোমাদিগের পর্যাপ্ত রহিয়াছে। তোমরা চন্দ্রমার কক্ষপথের পরিমাপ না জানিতে পার, কিন্তু আপনার শিশুকে কোথায় জন্ম দিলে নিরাপদে সে বাড়িতে পারে তাহা জান। কোথায় লুক্কায়িত রহিলে জীবন বিপন্ন হয় না তাহাও তোমাদের অজ্ঞাত নহে। তোমরা সুখী। তোমরা পূর্ণ। আমরা কেবল খাদই কাটিয়া যাইতেছি, তাহাতে সাগর বানাইব না গগনচুম্বী অট্টালিকা বানাইব তাহা নিজেরাও জানি না। কেবল নামিতেছি, নামিতেছি আর নামিতেছি।
ওহে সরীসৃপ, আজ আমি তোমাদিগের লীলা দেখিয়া সুখও পাইতেছি। মস্তিষ্ককে মনুষ্যলোক হইতে দূরে সরাইয়া শীতল বাতাসের অপেক্ষা করিতেছি। শান্তি চাই। এমনকি ঈশ্বরকে মনুষ্য ভাবিতে সাধ হইতেছে না। তিনি যেন এক বিশালাকায় সরীসৃপ হইয়া আমাদের কর্মকাণ্ড দেখিয়া শীতঘুমে যাইয়াছেন। ক্ষণে ক্ষণে তাহার নাসিকা গর্জনে কেহ কেহ চমকিয়া উঠিয়া বলিতেছে, তবে তো তিনি আছেন। কিন্তু তিনি সাড়া দিতেছেন না। এত হিংসা, এত ক্ষুদ্রবুদ্ধির নিকট তিনি ধরা দেবেন না বলিয়াই এই ছল করিয়া নিদ্রা গিয়াছেন।
হে সরীসৃপ, আমার মনুষ্য জীবনের গ্লানি, এই তপ্ত চৈত্রের সন্ধ্যায় তোমাদিগের জানাইলাম। জানি আমার ভাষা তোমরা বুঝিবে না। তবু আমার গ্লানি জানাইয়া রাখিলাম। কাহাকে জানাইব আর? চৈত্রের এই তপ্ত হাওয়ায় প্রাণের গভীরে যে বেদনা জন্মাইয়াছে তাহা কোন অমৃতে জুড়াইবে জানি না। কিন্তু তোমাদিগের এই নিষ্কপট, সরল জীবন দেখিয়া মনে হইল যেন অমৃতের স্পর্শ পাইলাম। বাতাসের তাপ কিঞ্চিৎ কম বোধ হইতেছে। মনের ভার কমিয়াছে। তোমরা সুখে থাক। একদিন যদি মনুষ্য তাহার গৌরব ভুলিয়া আপনি আপনাকে বিনাশ করিয়া ফেলে, তবে সম্ভব হইলে তাহাদের ক্লিষ্ট তপ্ত ব্যর্থ আত্মার জন্য শান্তি কামনা করিও তোমরা। হয় তো তোমাদের সুখ আরো দীর্ঘ গভীর হইবে সেদিন। আমি থাকিব না। তবু সেই দিনের জন্য শুভেচ্ছা রাখিয়া যাইলাম। সুখে মঙ্গলে কুশলে দিনযাপন করিও। ইতি এক হতভাগ্য মনুষ্য।