১
---
কোর্টে আজ রায় বেরোবার দিন। থিকথিক করছে ভিড়। আসামী একজন মহিলা। বিবাহিতা। বয়েস ৩৩।
অপরাধ - অসুস্থ স্বামীকে রেললাইনে ধাক্কা মেরে চলন্ত ট্রেনের সামনে ফেলে দেওয়া। দিনেরবেলা, সবার সামনে।
যে ক'দিন আদালতে মামলা চলছিল মেয়েটা একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। যতবার জানতে চাওয়া হয়েছে এর পিছনে কারণ কি? সে নির্বাক থেকেছে।
মেয়েটার বাপের বাড়ির অবস্থা খুব স্বচ্ছল না হলেও তার ভায়েরা কোর্টে কেস করেছে, যে তার বোনকে ফাঁসানো হচ্ছে। দিবাকর, মানে কৃষ্ণার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে রোগে ভোগার জন্য অবসাদগ্রস্ত ছিল। সে নিজে থেকেই ঝাঁপ দিতে চাইছিল, কৃষ্ণা তাকে বাঁচাতে চাইছিল প্রাণপণ।
হল না। কৃষ্ণা চুপ করেই থাকল।
সময় হল। বিচারক তাঁর চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগে কৃষ্ণাকে শেষবারের মত প্রশ্ন করলেন, "আপনার কিছু বলার আছে কৃষ্ণাদেবী? বলার থাকলে এই আপনার শেষ সুযোগ। অন্তত মেয়েটার মুখের দিকে তাকান, আমিই আনতে বলেছিলাম আজ কোর্টে ওকে। ওই দেখুন।"
কৃষ্ণার মধ্যে কিছুটা চাঞ্চল্য দেখা গেল। সে মুখ ফিরিয়ে দেখল সামনের সারিতে কাকলি।
বিচারক বললেন, "ওই বছর সাতেকের মেয়েটার কি দোষ? ও কি সারাজীবন ধরে জেনে যাবে ওর মা ওর বাবার খুনী? সত্যিটা কি কৃষ্ণাদেবী বলুন, আমাদের সবার জানা দরকার।"
কৃষ্ণার চোখের জল ততক্ষণে চোখ ছাপিয়ে গাল গড়িয়ে পড়ছে, নিঃশব্দে। কাকলি ওর মামার কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর বলছে, মামা মা'কে বাড়ি নিয়ে চলো, বাড়ি নিয়ে চলো।
কৃষ্ণা মুখ খুলল। সামনের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বলতে যন্ত্রের মত আবেগহীনভাবে বলে যেতে লাগল...
২
---
তখন আমার বাইশ বছর বয়েস। দিবাকরের সাথে বিয়ে হল। ওর বয়েস তখন বত্রিশ। বিয়ে হওয়ার আগে যে দিবাকরের কথা শুনেছিলাম, বিয়ের পর এসে বুঝলাম, এ সে না। সবটাই মিথ্যা ছিল, সাজানো। আমার শ্বশুর শাশুড়ি আমার স্বামী ছোটো থাকতেই মারা গিয়েছিলেন। সংসার বলতে আমার ভাশুর, বড় জা, আর তাদের একটা দু'বছরের ছেলে, পল্টু।
বিয়ের পর জানলাম আমার স্বামীর সুগার। ওদের দু'ভায়ের একটা সব্জীর দোকান আছে বাজারে। সেইতেই সংসার চলত। মোটামুটি চলেই যেত। বিয়ের দু'দিন পর জানলাম দিবাকরের এমন কোনো নেশা নেই যা বাকি আছে। রোজ রাতে মদ খেয়ে বাড়ি আসা। রোজ মারধর। আমার আশ্রয় বলতে আমার জা। তাও তিনি ভাশুরের ভয়ে কিছু বলে ওঠার সাহস করতেন না।
কৃষ্ণা বলতে বলতে চারদিকে আবার তাকাল। কাকে যেন খুঁজছিল। জা'কে হয়ত বা।
সে বলতে লাগল, আমি মুখ বুজে মার খেতাম। সকালবেলা আবার সব ঠিক। এত কিছুর পরও ভালোই বেসেছিলাম ওকে। ভাবতাম, বাপ মা মরা ছেলে তো। খুব অবহেলায় মানুষ। ভালোবাসা স্নেহ কোনোদিন পায়নি। যদি আমি সে ভালোবাসাটা দিতে পারি, তা হলে হয়তো শুধরে যাবে।
ভুল ভেবেছিলাম। কিছু পাল্টানো না। এইভাবে চলতে চলতে কাকলি এল। ও শুধরালো না। বরং অনিয়মে ওর সুগার লাগামছাড়া বাড়তে লাগল। জীবনীশক্তি কমল। আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্কটাতে ছেদ পড়ল। ও আর পারত না। সেই ক্ষোভে অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে গেল।
বছর তিন কাটল। একদিন রাত্রে ও সব সীমা ছাড়িয়ে গেল। ওর দু'জন বন্ধু নিয়ে আমার ঘরে ঢুকল।
কৃষ্ণার সারা শরীর কাঁপছে। সে কোনোরকমে বলল, জল।
৩
---
আমি সেই রাত্রে এক কাপড়ে বাপের বাড়ি চলে আসলাম কাকলিকে নিয়ে। দাদারা একটা চাকরী জোগাড় করে দিল। খুব অল্প মাইনে। ভাবলাম যাই হোক, কষ্ট করে মেয়েটাকে বড় করতেই হবে। যে করেই হোক।
দিন চলে যাচ্ছিল কোনোরকমে। সব মানিয়েই নিচ্ছিলাম। শুনতে পেতাম ও দিন দিন আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মনটা শক্ত করে লড়ে যাচ্ছিলাম তবু।
দেখতে দেখতে কয়েকটা বছর কেটে গেল। আমি যেন ওকে ভুলতেই বসেছিলাম। অন্তত তাই আমার মনে হয়েছিল। ভুলটা ভাঙল সেদিন স্টেশানে।
আমি ওভারব্রিজ দিয়ে নেমে হেঁটে আসছি.... বিশ্বাস করুন আমি ওকে চিনতেই পারিনি! শতচ্ছিন্ন পোশাক। বেঞ্চের এক কোণায় একতাল মাংসের মত পড়ে রয়েছে। বুকটা ধড়াস করে উঠল। প্রথমে মনে হল, যাব না। তারপর কি এক টানে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ও চিনতে পারল না আমায়। আরো কাছে গিয়ে দাঁড়াতে বুঝলাম ও চোখে দেখতে পায় না আর। সুগারে চোখটা খেয়েছে।
ওকে ডাকলাম। প্রথমে বুঝতে পারল না। তারপর চিনল। আমার নাম ধরে ডাকল, উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। ওর মুখ দেখে বুঝলাম ও আমায় আপ্রাণ দেখতে চেষ্টা করছে।
কৃষ্ণার গলা বুজে আসল। কোর্টের মধ্যে চূড়ান্ত নিঃশব্দতা। শুধু পাখার আওয়াজ।
কৃষ্ণা আবার বলতে শুরু করল। শুনলাম, দাদারা ওকে এখন দেখে না আর। চিকিৎসাও বন্ধ। মুখের গন্ধে বুঝলাম, নেশাটা ছাড়েনি। আবার বিরক্তিটা মাথা চাড়া দিল আমার। উঠে আসছিলাম। ও কি করে বুঝতে পেরে, হঠাৎ আমার হাত ধরে কেঁদে উঠল। টাকা চাইল। আমি জানতাম ও টাকা পেলেই আবার ওই ছাইভস্মগুলো গিলবে গিয়ে।
আমার মনটা যেন কেমন হয়ে গেল হঠাৎ। মনে হল ও কার পাপে এ কষ্ট পাচ্ছে? আমি ছেড়ে এলাম বলে? না নিজের স্বভাবে? আমি দুর্বল হয়ে পড়লাম। মনে হল একবার ওকে আমার সাথে নিয়ে আসি। পরক্ষণেই মনে হল, কি লাভ? ও তো সেই একই রয়ে গেছে।
ইতিমধ্যে ট্রেনের অ্যানাউন্স হল। আমার মাথায় বিদ্যুতের মত কি একটা চমকে গেল। ভাবলাম ওকে মুক্তি দিয়ে যাই আমি। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে না থাকা ঢের ভাল। এরপর আরো অসুস্থ হবে। কে দেখবে ওকে? ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে সব শেষ হয়ে যাক একেবারে। ওকে মুক্তি দিতেই হবে। আর এ অধিকার আমারই আছে এ সংসারে। আমিও যেতাম ওর সাথে স্যার, যদি কাকলি না থাকত।
ওকে বললাম, চলো তোমায় আমাদের বাড়ি পৌঁছে দিই। ও বলল, না দাদা এখানে বসিয়ে গেছে কি একটা কাজে, আসবে খানিক বাদেই। আমি শুনলাম না। ওকে জোর করে প্লাটফর্মের ধারে নিয়ে এলাম। তারপর যেই ট্রেনের মাথাটা দেখতে পেলাম......
কৃষ্ণা বসে পড়ল। সাথে সাথে দু'একজন দৌড়ে এসে ওকে ধরাধরি করে একটা বেঞ্চে শুইয়ে দিল।
কাকলি কখন ওর মামার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিল কাঁদতে কাঁদতে। সে ধড়মড়িয়ে উঠে বলল, মা কই? মায়ের কাছে যাব!