সৌরভ ভট্টাচার্য
15 March 2019
দেওয়ালের দিকে ফিরে শুয়ে থাকতে থাকতে চিন্তাগুলো থেমে গেল। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করলে চিন্তারা থেমে যায়। দেওয়ালটা সাদা হতে হবে আর ফাঁকা।
আমি জানি এখন বিকাল চারটে। আমার টেবিলে চা রাখা আছে। চা’টা এখনও গরম। আমি ফিরলেই গরম চায়ের কাপে ধোঁয়ার শরীর দেখব। বেঁকে বেঁকে উড়ে যাচ্ছে বাতাসে। আমার গরম লাগছে। পাখাটা চালাতে গেলে উঠে তিন পা হাঁটতে হবে। আমাকেই হাঁটতে হবে। আমি হাঁটব না। আমার এখন ডিপ্রেশান চলছে।
আমার এখন ডিপ্রেশান চলছে। বাড়ির কেউ কিচ্ছু জানে না। আমার চাকরিটা নেই। নেই মানে জাস্ট নেই। আমি নতুন করে জীবন শুরু করার কথা ভাবতে চেষ্টা করেছি। কথাগুলো ভেজা তুবড়ির মত জ্বলতে জ্বলতে নিভে গেল। আমি বাথরুম বন্দী করেছি নিজেকে। আমার ডিপ্রেশানটাকে আমি বলি বাথরুম ফেজ। বাথরুমে নিজেকে আটকে রাখাটা ডিপ্রেশানের লক্ষণ.. ঘুলঘুলি দিয়ে আলো আসে..বাতাস আসে... তবু স্যাঁতস্যাঁতে ভাবটা কাটে না... এটা একটা ফেজ। ফেজ মানে দশা। এই শব্দটা বায়োলজিতে শিখেছিলাম, প্রফেজ, মেটাফেজ... দশা, আমাদের কোষের মধ্যে আরেকটা কোষের জন্ম হওয়ার ঘটনা। আমার শরীরে এখনও হচ্ছে। আমি যদি ওই পাখার সাথে ঝুলে পড়ি তখন থেমে যাবে। কিম্বা গায়ে আগুন দিলে। ছেলেরা সাধারণত গায়ে আগুন দেয় না। মেয়েরা দেয়। কেন? মেয়েরা বেশিরভাগ সময় আগুনের কাছে থাকে বলে? জানি না। আমি মেয়ে নই, যদি মেয়ে হতাম তবে হয়ত গায়ে আগুন দিয়ে মরার কথা ভাবতাম। আমি ছেলে। তাই মরার ভাবনাটা আসতেই আমি দড়ির কথা ভাবলাম। কিন্তু আগুনের কথা ভাবলাম না। আমার বাড়ি থেকে রেললাইন দশ মিনিট। লোকাল ট্রেনের লাইন। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না বেশিক্ষণ। তবু আমি আগুন দেওয়ার কথা ভাবছি না। আমি মেয়ে হলে ভাবতাম। মেয়ে হলে বিষের কথাও হয়ত ভাবতাম। কিন্তু আমি ছেলে।
আমি ছেলে। আমি লোক। আমি পুরুষ। এই পরিচয়ের কয়েকটা ক্রাইটেরিয়া আছে। আমি বায়োলজিকালগুলোতে ফিট। কিন্তু আমি মনের দিক থেকে ভয়ংকর পুরুষালী নই। আমি কোনোদিন কোনো মেয়েকে রাস্তায় টিজ করিনি। আমি সিনেমাহলে বান্ধবীর বুকে হাত রাখিনি। অনেকবার ফাঁকা ঘরে কাটিয়েও ঠোঁটে চুমুর বেশি আমি এগোইনি। আসলে শুধু মেয়েদের বেলায় বলে না। আমি কোনোদিকেই অ্যাগ্রেসিভ নই। কোনোদিনই নই। খেলাধুলাতেও ছিলাম না। অ্যাগ্রেসিভ হলে হয়ত এতক্ষণে আমি গলায় দড়ি দিয়ে ফেলতাম। কিন্তু আমি দিচ্ছি না। আমি তিনঘন্টা হল দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে শুয়ে। আমি ছেলে হয়ে যদি গায়ে আগুন দিই? গন্ধে সবাই ছুটে আসবে। সুইসাইডের পদ্ধতির উপর কি কোনো সাইকোলজিক্যাল অ্যানালাইসিস হয়েছে? কেমন মানুষ কেমন ধরণের পদ্ধতিতে সুইসাইড করতে পছন্দ করবে? যার চাকরি চলে গেছে, যার প্রেমিকা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, যে জুয়া খেলে সর্বস্বান্ত হয়েছে – এরা সবাই কি একই পদ্ধতিতে আত্মহত্যার কথা ভাববে? এই নিয়ে তো একটা গবেষণা হওয়া দরকার। কিন্তু আমি এইসব ভাবছি কেন? আমি তো ডিপ্রেশানে ভুগছি। আমার তো মারা যাওয়ার কথা। বাইরের দরজাটা খোলা। প্রতিবেশীর মেয়ে গান গাইছে। বিচ্ছিরি গানের গলা। ওর বাড়ির লোকের কানের পর্দা কি ফুটো? ওরা কি জানে না পৃথিবীতে বহু মানুষ ডিপ্রেশানে ভোগে। তাদের এই গান শুনলে ডিপ্রেশান বেড়ে যেতে পারে। ডিপ্রেশান বেড়ে গেলে মানুষ অনেক সময় নিজের ক্ষতি না করে অন্যের ক্ষতিও তো করতে পারে। ওদের বাড়ির সামনে বাগান। সে বাগানে টবে নানা দামি দামি ফুলগাছ। আমার ইচ্ছা করছে চারটে টব নিয়ে গিয়ে হাইরোডে রেখে আসি। ট্রাকে চাপা পড়ে থেঁতলে যাক। আর বাকি চারটে টব নিয়ে গিয়ে গরু খাইয়ে দিই। আমাদের বাড়ির সামনে একটা মাঠ আছে। সেখানে একটা সাদা গরু ঘাস খেতে আসে। আমার ওকে ভালো লাগে। ওকে চারটে গাঁদাফুলের গাছ খাওয়ালে ও তৃপ্তি পাবে। গরুকে কেউ কোনোদিন ডেকে গাঁদাফুলের গাছ খাওয়ায় না। আমি খাওয়াব। যদি আমি এর মধ্যে আত্মহত্যা না করে ফেলি তবে আমি গিয়ে ওর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে সব কটা গাঁদা গাছ খাইয়ে আসব।
মেয়েটা এখনও গাইছে। ওর গানের শিক্ষক এসেছে। ওর শিক্ষক হয়ত গে। গে হওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু গে দেখলে আমার ডিপ্রেশান আরো বেড়ে যায়। আমার মন খারাপ লাগে। কারণ আমি ওদের বুঝতে পারি না। আমি যেমন বুঝতে পারি গরুর গাঁদা গাছ খেলে ভালো লাগবে আমি ওদের তেমন বুঝতে পারি না। মানুষ সব সময় বুঝতে চায়। আমি সব বুঝতে চাই। মানুষকে না বুঝতে পারলে আমার রাগ লাগে। অভিমান হয়। আমার এক অবিবাহিত পিসি ছিল। মারা গেছে। আমার কোনো বন্ধু এলে সে কেমন করে একটা তাকাতো। গায়ে হাত দিত। ইচ্ছা করে দিত। বান্ধবীদের দিত না। আমি বুঝতাম না। মা বুঝত। বাপি বুঝত। কেউ কিচ্ছু বলত না। পিসির চোখদুটো দেখে মনে হত একজন ক্ষুধার্ত মানুষ। আসলে পিসিকে খুব বাজে দেখতে ছিল। আমার ঠাকুর্দার টাকা ছিল না যে বিয়ে দেবে। বাপিও অনেক দেরি করে ভালো চাকরি পায়। আমি যখন সিক্সে পড়ি তখন বাপি চাকরিটা পায়, তার আগে টিউশান পড়াতো। মাকেও পড়াতে গিয়েই ... সে যাক, ডিপ্রেশানের সময় প্রেমের কথা ভাবতে নেই, অস্থিরতা বাড়ে। পিসিকে আমি বুঝতে পারতাম না। যখন তখন রেগে যেত। অল্প কথাতেই কাঁদত। সবাই বলত বিয়ে দিলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হয় না। একবার বিয়ের কথা হল। পিসি হঠাৎ পালিয়ে গেল। ফিরল প্রায় পনেরো দিন পরে। একটা ছেঁড়া শাড়ি পরে, সারামুখ কালো, রোগা প্যাঁকাটির হয়ে গেছে, সারা নাক সর্দি... কি বীভৎস দেখাচ্ছিল পিসিকে। তার কয়েকদিন বাদেই মারা গেল। পাড়ায় রটে গেল এইডস। আসলে তা নয়, কিছু একটা ইনফেকশান হয়ে গিয়েছিল পিসির।
এইবার আমায় উঠতে হবে। হাতের তলা, পায়ের তলা জ্বালা জ্বালা করছে। আজ বাড়িতে বলে দেব, আমার চাকরিটা নেই। কি হবে? ভাবতে গেলে একটা শূন্য মাঠ কল্পনায় আসছে। আমি একা দৌড়াচ্ছি। আমার মাথার উপর তারা... তারা... আর তারা। চাঁদ ওঠেনি। দূরে অন্ধকারটা ঘন। আমি সেদিকেই দৌড়াচ্ছি। কিন্তু কেন? জানি না। আমি বুঝতে পারছি না কেন দৌড়াচ্ছি... শুধু জানি আমি থামতে পারছি না। আমি লোভী নই, আমি উচ্চাকাঙ্ক্ষী নই, আমি ভীতু... আমি সুখী... নিরাপত্তাভিলাষী... তবু থামতে পারছি না... ওই জঙ্গলটা কি... ওকি সুখ... ওকি নিরাপত্তা...
আসলে আমি ভীতু... ভীতু... আমার চারদিকে ভয়, শিক্ষিতের ভয়... শিক্ষিতের ভয় আসলে অবসাদ... শিক্ষার অন্ধকারে অবসাদ... শিক্ষা মানে জ্ঞান না... শর্ত... শর্তের মধ্যে বাঁচা... আমার চারদিকে শর্তরা ছারপোকার মত কিলবিল করছে..... আমি মরব না... আমি লড়বও না... আমি হাঁটব... কাউকেই কোনো কৈফিয়ত না দিয়েই হাঁটব... একদিন যদি হাঁটতে হাঁটতে পিসির সাথে দেখা হয়... বলব... এসো হাঁটি পিসি... মোরো না... মরে লাভ নেই... তুমিও কাউকে কৈফিয়ত দিতে যেয়ো না... সমাজকে, পরিবারকে তো নয়ই... নিজের শরীর মনে চাপানো নারীত্বকেও না... এগুলো মিথ্যা.. শুধু হাঁটো... হাঁটো...