Skip to main content

সেদিন যে মৃত্যুগুলো একের পর এক ঘটে যাচ্ছিল, চুপ করে ছিলাম। রেললাইনে ছিন্নভিন্ন শরীরে রুটির টুকরো পড়ে এদিকে ওদিকে। চুপ করে ছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে, ফিরতে ফিরতে যখন অনেক মানুষ রাস্তায় অনাহারে, ডিহাইড্রেশানে, দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছিল চুপ করে ছিলাম। সারা পৃথিবী জুড়ে এত মানুষের মৃত্যুমিছিল, এমন একটা দুঃসময়, মনে হচ্ছিল এও যেন তার আরেকটা নির্মম দিক। কি করা উচিৎ, কি সমাধান হওয়া উচিৎ দিশা পাচ্ছিলাম না।

       কিন্তু যখন জানলাম যে অতগুলো মৃত মানুষের কোনো পরিসংখ্যান নেই কারোর কাছে, তখন নিজের কাছে নিজেরই লজ্জায় মুখ দেখানোর জো রইল না। বুঝলাম দেশের পক্ষে তারা উদ্বৃত্ত। দেশের কারোর কাছেই এতদিন ধরে কোনো পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে ছিল না, এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে কতজন মানুষ কাজে যান। কোনো দলের কাছে না। কি আশ্চর্য!

       আমাদের সংবহনতন্ত্রে অনেক সময় ব্যাধির কারণে কিছু পথ রুদ্ধ হয়ে থাকে, সাধারণ দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় হয়তো তা কোনো অসুবিধা করে না, কিন্তু সেই মানুষটা যখন হঠাৎ করে দৌড়াতে যান তখন সেই অবরুদ্ধ পথে রক্ত চলাচল বাধা পেয়ে মানুষটা অসুস্থ হয়ে পড়েন, বা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আমাদের আজ সেই দশা। আজ এই দুর্দিন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আমাদের রাজতন্ত্র নানা সরকার, দল নির্বিশেষে কি উদাসীন ছিল এক বৃহৎ শ্রেণীর উপর। হঠাৎ যখন বন্যা এল, তখন ঘরের এত ছিদ্র দিয়ে জল প্রবেশ করতে শুরু করল যে এখন আমরা অবাক হওয়ার ভান করছি, সত্যিই তো এত ছিদ্র ছিল?

       হঠাৎ করে যখন পথে-ঘাটে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে শুরু হল, তখন শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চালু হল। সে দায়ের দায়িত্ব, সহমর্মিতার নয়। ঠিক তাই আজ এত মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাটাও অর্থহীন চালকের কাছে। জানি না সেই ট্রেনে ফেরা মানুষগুলোর সঠিক সংখ্যাও বা আছে কিনা।

       দারিদ্রের সঙ্গে 'অপমান' শব্দটা সঙ্কীর্ণ সামাজিক অভ্যাস, মানবিক না। এমনকি ভারতের যে দল সব সময় সেই গরীব মানুষের পাশে থাকাটাকেই উপজীব্য করে রাজনীতির ময়দানে নেমেছে, তাদের সক্রিয় ভূমিকাও তেমনভাবে চোখে পড়ল কই? রাস্তায় কেউ নামল না। যে কুমারের কণ্ঠস্বরে বামপন্থা রাজনীতি আগামী ভবিষ্যৎ দেখছিল, সেই কুমারের অনুপস্থিতিও চোখে পড়ার মত। বঙ্গের বামপন্থা বাণপ্রস্থের পথে, সে নিয়ে কোনো আশাই দেখছি না। তারা প্রত্যেকেই সে পরিসংখ্যান রাখার দায়িত্ব শাসককূলের হাতে তুলে নিশ্চিত ছিল। যেন বিরোধীর স্থানে এসে দাঁড়ালে দেশের গরীব মানুষগুলোর উপর মমতা ও দায়িত্ব --- দুই-ই শিথিল হয়ে পড়ে। শুধু আঙুল তোলা আর অভিযোগ জানানোতেই সমস্ত দায়সারা। দেশকে জানতে যেন শুধু শাসকের গদিই লাগে, পথের অধিকার না। পথের অধিকার কেউ কোনোদিন কাড়েনি, কাড়তেও পারে না। পথের অধিকার থেকেই জন্মায় জনতার চিত্তে প্রবেশের অধিকার। সেই থেকে সে হয় রাজ। কিন্তু পথে নেমে হাঁটার মানসিকতা অনেকদিনই জ্বালাময়ী বক্তৃতা আর অন্যের ছিদ্রান্বেষণের তাগিদ কেড়ে নিয়েছে। কেউ হাঁটে না।

       দরদ – শব্দটা যদি শাসক বা বিরোধীদের অভিধানে না থাকে, তবে দেশের প্রযুক্তিগত উন্নতি, আধুনিকতম উন্নতি বলতে শুধুমাত্র উন্নতমানের বিলাস বোঝায়, জীবনযাত্রা বোঝায় না। বিলাসের মান আর জীবনের মানের মধ্যে পার্থক্য আছে। আজ এই লকডাউনের পরিস্থিতিতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু দেশ বলতে কি শুধু প্রযুক্তি? শুধু ধর্মীয় ভাবাবেগ? শুধু সীমারেখা আর নাগরিকত্বের প্রশ্ন? যে শাসককূল এত এত মৃত মানুষের পরিসংখ্যান জানে না, যে শাসককূল পরিযায়ী শ্রমিকের পরিসংখ্যান জানে না, সে দেশের সঠিক নাগরিকের পরিচয়, সংখ্যা জানতে একদিন গোটা দেশে ত্রাসের সঞ্চার করেছিল। ভাবতে লজ্জা হয়।

       ভারতবর্ষ তবে কার? ভারতের মানুষ কি শুধুই এক নায়কের মৃত্যুর রহস্যের কিনারা করতে বসে থাকে? এই ভাবমূর্তি তৈরি করছে কারা? আমি তো শুনিনি গলিতে গলিতে, বাড়িতে বাড়িতে, মোড়ে মোড়ে সবাই সুশান্তের মৃত্যুর সমাধান খোঁজার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে? আমি তো শুনিনি রিয়ার চরিত্র জানার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমেছে? না। এই ছবি, এই ভাবনার পটভূমি এঁকে দিচ্ছে কারা? সমস্ত মিডিয়া। এ ভাবমূর্তি চাপানো হচ্ছে। সুকৌশলে গেলানো হচ্ছে। যেমন কেউ যখন বলেন, চা না কফি নেবেন? অর্থাৎ, আমার যেন অপশান বলতে শরবৎ বা জলের গেলাস নেই। এও তেমন। মিডিয়ার সার্কাস।

       আপনারা যারা মিডিয়া, আপনাদের কাছে আছে তথ্য নেই, ঠিক সত্যিকারের কতগুলো মানুষ মারা গিয়েছিল ওইরকমভাবে রাস্তায় পড়ে? আপনারা নিজের দায়িত্বে সুশান্ত আর রিয়ার তথ্য খুঁজতে, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যেভাবে তদন্ত চালিয়েছেন, সেখানে মনে হয় না আপনাদের অগম্য স্থান বলে কিছু আছে। আপনাদের কাছে তথ্য নেই? আপনারা সেই সংখ্যাটা দেশবাসীকে জানালেন না কেন? সেদিন সারাটা রাত পরিযায়ী শ্রমিকদের সাথে বারবার রাস্তায় হাঁটতে দেখেছি বরখা দত্ -কে, পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে, প্রশ্ন করতে, সঠিক ছবিটা তুলে ধরতে ঠিক কি ঘটছে। জানি না তাদের কাছে কোনো সঠিক সংখ্যা আছে কিনা।

       ক্ষমতা অর্থের হয়, ক্ষমতা শাসকের হয়। আর অনুকম্পা? মানুষের সব চাইতে বড় শক্তি না তো অর্থে, না তো রাজার আসনে। মানুষের সব চাইতে বড় শক্তি তার সহমর্মিতায়। আমরা যে রামরাজ্যের কথা শুনে আসছি কয়েক বছর হল, সে রাজ্য অর্থবলে বা দণ্ডবলে তৈরি হয়নি। সে রামরাজ্য চলেছিল দরদে, অনুকম্পায়, সহমর্মিতায়। অন্তত বাল্মীকি ও তুলসীদাস সেই ছবিই এঁকেছিলেন। রামচন্দ্রের যে ছবি আঁকা হয়েছিল তা প্রজাবাৎসল্যের ছবি। “পরপীড়নসম নেহি অধমায়ী”, পরের পীড়নের সমান অধম কিছু নেই, এই ছিল সে ধর্মের মূল নীতি। সত্য, অনুকম্পা আর উদারতা – কবি এই রঙেই সেদিন রামরাজ্যের ছবি এঁকেছিলেন। যে ভালোবাসে সে আড়ম্বর চায় না, হৃদয়ের গভীরে ভালোবাসার সঞ্জীবনী চায়। ভরতের তাই রামের পাদুকাই শ্রেষ্ঠ অবলম্বন ছিল রামের অনুপস্থিতিতে দেশকে চালানোর জন্য, অট্টালিকা নয়। মহাত্মা গান্ধী'র রাম তাই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিলেন শুধু চিত্তের সত্যের উপর ভর করে।

       কোনো বাড়ির শিক্ষা-চরিত্র নির্ধারিত হয় সেই বাড়ির গরীব মানুষটা কি ব্যবহার পায় তা দিয়ে, না তো সেই বাড়ির মানুষের বিলাসিতার মানদণ্ডে। সে বাহ্যিক। নিতান্তই বাহ্যিক। মনুষ্যত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে, অবহেলায় পিছনের আসনে বসিয়ে, শুধু কিছু মানুষের চাটুকারিতা আর কিছু মানুষের সুবিধার পথ প্রশস্ত করে দিয়ে মানুষের সভ্যতা দাঁড়ায় না বেশিদিন, ইতিহাস সাক্ষী।

       মানুষের সমস্ত নীতি, মনুষ্যত্বের ভূমিই হল সহমর্মিতা। যার দরদ নেই, তার জগতও নেই, সে নিজেই এ পৃথিবীতে পরিযায়ী। সহমর্মিতার দায় শুধু শাসকের না। সে দায় সবার। তাই যে অবহেলা, যে অপমান নিয়ে মৃত্যুগুলো ঘটেছে, সে মৃত্যুর প্রতি এই দায়সারা ভাবের পাপ আমাদের সবার। জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রতিটি মৃতদের নাম যদি পাওয়া গিয়ে থাকে, তবে আজ এই স্বাধীন দেশে এ অবহেলা কেন? কাদের উপর? গগনভেদীস্বরে ভারতের মাটির সন্তানেরা আবার বলছে, শুনতে পাচ্ছ – “সে মন্দিরে দেব নাই”!