Skip to main content

হরিনাভীর ভীষণ ক্ষোভ। না বউটা পোষ মানল, না কুকুরটা। তেমন দজ্জাল শাশুড়ির পাল্লায় তো পড়েনি! গ্রাম থেকে আনা হল, শালা! কপালে না থাকলে যা হয়। আর স্বামীসুখই বা কি পেলেন? তিনি তো সারাটা জীবন দেশোদ্ধারের কাজেই জীবন দিলেন। পার্টি আর পার্টি। জ্বালিয়ে খেলে গা!
        হরিনাভী বারান্দায় বসে বসে তেল মাখছিল আর নিজের মনে গজরাচ্ছিল। গতরখাগীকে দেখো, মোবাইল নিয়ে ঘুটুর ঘুটুর রাতদিন। আর ছেলেটাও হয়েছে মেনীমুখো। বাবার ধারা কিচ্ছু পায়নি গো! কেন মনে নেই, সেই যে বৈশাখে, সুলতা আর সে রাত করে যাত্রা দেখে ফিরেছিল, তারপর? উনুনের জ্বলন্ত কাঠ তার পিঠে ঠেসে ধরে নি? কত্তবড় দাগ পড়ে গেল। হাস্পাতালে নিয়ে যেতে হল না? তারপর ফেরবার পর মেলা লোক তাকে দেখতে আসত। তার গর্বে বুক ফুলে যেত, অমন বাঘের মত জাঁদরেল স্বামী ক'টা মেয়ে পায়?
        হরিনাভী পিঠের দাগটায় হাত মুড়ে, যতটা গেল দাগটা বোঝার চেষ্টা করল, তেল মাখাল। নচ্ছার মাগীটাকে দেখো, একটু পিঠটায় তেল মাখিয়ে দিয়ে যাক? তা না। শালী কুষ্ঠ হবে তোর হাতে পায়ে, এই বলে রাখলুম। আর বাবু ঢুকলেই তার ন্যাকাপনা শুরু হবে। সহ্য হয় না বাবা!
        হরিনাভীর বাতের জন্য চলতে অসুবিধা হয়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পুকুরঘাটের দিকে এগোলো। আড়চোখে বউকে দেখল আবার। তাকায়ও না, শালা হারামজাদি এই গর্ভেই তোর বরকে ধরেছিলুম রে! গোড়া কেটে আগায় জল ঢালিস! মুতে দিই তোর গতরে!
        "দিদি আজ দেরি হল যে?"
        বিমলা। পুকুরঘাটে হাঁটুর উপর কাপড় তুলে সাবান ঢলছে।
        "তোর বেহায়াপনা আর গেল না বিমলা, রাজ্যের লোক আসছে যাচ্ছে, তোর কি লজ্জাশরম কিছুই নেই, ভুবনটা মরল আর তুই সাপের পাঁচ পা দেখলি"...
        "তা তোমার দেওরের সাপের ছোবলেই তো সারা জীবন গেল দিদি... এখন অন্য সাপের ক'টা পা একটু গুণেই না হয় দেখি"..., বিমলা জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতে লাগল।
        "তোর সাথে কথা বলা... নষ্ট মেয়েছেলে"
        বিমলা শোনেনি। তবু আন্দাজ করল, বলল চীৎকার করে, "আমায় গাল পেড়ে কি করবে গো, তোমার ছেলের বউরে সামলাও, সে তো..."
        বিমলা এ প্রসঙ্গ আগেই তুলতে চেষ্টা করেছে। সে পাত্তা দেয়নি। আজ বিরক্ত লাগল। হরিনাভী ভালোই সাঁতার কাটে এখনও। জলে নামলে তার নিজেকে অন্য গ্রহের মানুষ মনে হয়। হরিনাভী গলা জলে দাঁড়িয়ে বলল, "তোর মুখে পোকা পড়বে রে হারামজাদী"...
        বিমলা সাঁতরে পাশে এসে বলল, "ন্যাকা সেজো না তো দিদি। সারা গ্রাম জানে, আর উনি... হ্যাঁ গো তোমার ছেলে কি নপুংসক...? তবে ছেলে হল কি করে?...
        "মুখে যা আসছে বলে যাচ্ছিস? তোর তো বড় বাড় বেড়েছে, নিজের ছেলে বউ সেই যে বোম্বে গেল, আর তো টিকিটাও দেখি না কত বছর হল... মরলে জল দেবে কে তার নেই ঠিক..."
        বিমলা কিছুক্ষণের জন্য অপ্রতিভ হল। তারপর বলল, "দেখো দিদি, তোমায় ভালোবাসি তাই বলছি। আমার ভাগ্যের কথা কেন টানো? আমি তো যমের অরুচি। ভগবান সবই নিলেন, কিন্তু আয়ু না ফুরোলে তো আর জ্যান্ত চিতায় চড়ে বসতে পারি না গো..."
        "চুপ কর পোড়ারমুখী, যা মুখে আসে গলা জলে দাঁড়িয়ে এ ভরদুপুরে তাই বলবি হতচ্ছাড়ি?" হরিনাভীর গলা বুজে এলো... বড় অভাগা মেয়েটা...
        পুকুরের জলের সাথে কার চোখের জল কতটা মিশল সে হিসাব বিধাতাই জানেন। বিমলা একমুখ জল নিয়ে কুলকুচা করে পুকুরেই ফেলে বলল, "যমের সাথে একবার শুয়ে দেখার সাধ দিদি।"
        হরিনাভী, "তুই মর মুখপুড়ী", বলে হাসতে হাসতে জলে দুটো ডুব দিয়ে পাড়ে উঠল। শুকনো কাপড়টা জড়িয়ে দাঁতে চেপে, ভিজে কাপড়টা ছাড়তে ছাড়তে বলল,  "গ্রামে সবাই জানে, না রে?"
        বিমলা জল থেকে উঠে গামছা দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বলল, "দোলের ওই ঘটনাটার পর সবাই বুঝে গেছে।"
        হরিনাভী বলল, "তোর এখনও কি চুল রে বিমলা।"
        বিমলা হেসে বলল, "যমের সাথে সোহাগ করব যে গো... তাই যম সব নিলেও চুলটা নিল না, শালা পুরুষ মাত্রেই ছুঁকছুঁকে স্বার্থপরের জাত দিদি, তুমি যাই বলো... কেন তোমার কত্তার আর আমার কত্তার কেচ্ছা কারোর জানতে বাকি ছিল?... নেহাত পুরুষ মানুষ তাই..."
        হরিনাভীর শাড়ি পরা হয়ে গেছে। সে অন্যমনস্ক হয়ে কি একটা ভাবছিল। হঠাৎ বিমলা তার গায়ে একটা টোকা দিয়ে বলল, "কেন অজিত মাষ্টার তোমায় লাইক করত না? তুমি কি মুখ ঝামটাই না তাকে দিয়েছিলে... কিন্তু তুমি শপথ করে বলো দিদি, ওর ভালোবাসা তোমার মন ভেজায়নি?"
        অন্যদিন হলে হরিনাভী এই কথাটা শুনলে কি করত সে বোধকরি নিজেও জানে না, আজ চুপ করে শুনল। তার পিঠের দাগটাও যেন সুলসুল করল। সেদিনে যাত্রার রাতে অজিতদাই তো টিকিট কেটে এনেছিল।
        "অজিতদা কেমন আছে রে?"
        বিমলা চমকে তাকালো। বলল, "খুব অসুস্থ। ডাক্তার বলেছে আর পাঁচমাস, যাবে দিদি দেখতে, চলো না, তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে, সে তো চায়নি দিদি তোমায়, শুধুই ভালোবেসেছিল, ভালোবাসা কি পাপ দিদি?"
        হরিনাভী বিমলার দিকে তাকালো। বিমলা চোখ নামিয়ে বলল, "জানি তুমি কি ভাবছ। তোমার বউকে নিয়ে কেন বলছিলাম তো?... তা দিদি আমাদের সংসারে মেয়েদের মুখের কথা আর মনের কথা কবে এক হল... তবে যে পুরুষ বিধাতার এতবড় সংসারটাই টিকত না গো... আমার স্বামী আমায় বলত না, শাস্ত্রে নাকি লেখে নারী নরকের দ্বার... দ্বারই তো বটে দিদি, স্বর্গটা যে পুরুষদের; সেখানে রম্ভা, মেনকা হয়ে থাকার চাইতে নরকই ভালো... কি বলো দিদি?"
        হরিনাভী হেসে বলল, "চল"।
        "তুমি সত্যিই যাবে দিদি?" বিমলার চোখে এক ছলকে এক কলসী জল। সে হরিনাভীর হাত ধরে বলল, "চলো"।