Skip to main content
        যেমন তেমন নয়, আস্ত একটা সূয্যি গিলে দিনটা দিল চম্পট। অমনি তিরপল ফেলে হুস্ করে হল অন্ধকার। কেউ কোত্থাও নেই। ইয়াব্বড় আম বাগান। ইদিকে গাছ, উদিকে গাছ। বোলের ম ম গন্ধ। কোন দিকে যাই? ঝাপসা রাস্তা দেখা যাচ্ছে এঁকে বেঁকে। মাটির রাস্তা। হঠাৎ আওয়াজ - কেঁউ... কেঁউ... বাচ্চা কুকুর। পিছু নিয়েছে। ঘুটঘুইট্টা অন্ধকার বাড়ছে। ওডা কে?
        সেই আমবাগানের মধ্যে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর। তার মধ্যে চরকা কাটছে, কে বলো তো? আরে চাঁদের বুড়ি!
        ভাবলুম দরজায় বুঝি থাকবে হুড়কো দেওয়া। ওমা! যেই না হুড়কো ঠেলা, অমনি হুস্ করে পাঁচশোটা চামচিকি 'কিচমিচ কিচমিচ' করতে করতে বেরিয়ে গেল। দরজাটা হা-পাট্টা খুলে গেল। দেখি ঘরের মাঝে একটা মাটির পিদ্দিম। তার দিকে ফিরে চরকা কাটছে বুড়ি। সাদা শাড়ি। দুধেল সাদা। ঘরে ঢুকব কি ঢুকব না ভাবছি, বুড়ি ফস্ করে একটা সূতো হুস্ করে ছাদ অবধি তুলে, ফুস্ করে আবার নামিয়ে এনে বলল, ঘরে আয়, কি চাই?
        ঘরে ঢোকার আগে টুক্ করে একবার আকাশপানে চাইলাম। না চাঁদটা ওঠেনি এখনও। গুটিগুটি পায়ে ভিতরে গেলাম। চাঁদের বুড়ি, হেসে বলল, বোস, কি চাই?
        কিছু বললাম না।
 
        বুড়ি বলল, আমি চাঁদের নইরে বাছা, ওই দেখ ওদিকে আমার বড় ছাওয়ালের ঘর। বাজারে ঘুনির দোকানের পাশে ওর সাইকেলের দোকান।
        বললাম, ঘুনি কে?
        আরে ঘুনি রে ঘুনি, সেই যে যাত্রাপালায় রাধা সাজে, বর্ষাকালে মাঠ চষে, বসন্তকালে বাড়ির ছাওনি দেয়, সেই ঘুনি।
        চিনলাম না। তবু বললাম, অ।
 
        আমার ছেলের সাইকেলের দোকানে গেছিস? ওই দেখ, গেল পূর্ণিমায় ও ওই সাইকেলটা বানিয়েছে।
        দেখি পিছনের দরজার বাইরে একটা সাইকেল রাখা। গোলাপি রঙ। চাকার রঙ সাদা। মেয়েদের সাইকেল।
        বললাম, মেয়েদের কেন?
        বলল, আমার নাতনির জন্য।
 
        বললাম, সে কই?
        বুড়ি আঙুল দিয়ে আবার বাইরের দরজাটা দেখালো।
 
        বললাম, এত রাতে সে বাইরে কি করে? 
        বুড়ি চরকা থামিয়ে বলল, ওকে তো গোর দেওয়া ওখানে। ও ভিতরে আসবে ক্যামনে। তবে ও স্বপ্ন দেসে ওর বাবারে, "আব্বাজান তুমি একখান সাইকেল বানাইয়া ওই বাগানের কাছে থুয়ো, আমি প্রতি জ্যোৎস্না রাতে চালাবখনে"।
        আমি বললুম, আজ তো পূর্ণিমা!
 
        বাইরেটা তখন দুধেল সাদা জ্যোৎস্না। সব কিছু সাদা। আমের বোলগুলোতে চাঁদের আলো লেগে ফুটফুট করছে। ঘরের মধ্যেও বাস আসছে তার।
        আমি বললাম, তোমার নাতনির বয়েস কত?
        বুড়ি বলল, ছয়।
        বললাম, আমি ওর সাইকেলটা চালাব?
        বুড়ি বলল, তোমার বয়েস কত?
        আমি বললাম, তেরো।
        বুড়ি বলল, পড়ে যাও যদি?
        আমি বললাম, পড়ব না। রাতের আগেই ওকে সাইকেল দিয়ে দেব।
        বুড়ি বলল, আটটা কুড়ির আগেই কিন্তু।
 
        এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা। সাইকেল চালাচ্ছি তো চালাচ্ছি। আঃ কি আরাম। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে।
        হঠাৎ সাইকেলটা লিক্ হয়ে গেল। কি করি? আমি যে অনেক দূর এসে পড়েছি! ঘড়ি দেখলাম, সাতটা।
        হাঁটতে লাগলাম জোর কদমে। হাঁটতে হাঁটতে ঘামতে শুরু করেছি। পৌঁছাব কি করে? বুড়ির নাতনি যদি বেরিয়ে আসে এক্ষুণি। ভাবতে ভাবতেই একটা বাচ্চা মেয়ে দেখি দৌড়াতে দৌড়াতে আমার দিকে আসছে।
        আমার তো ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা। এই বুঝি বকা খাই। ভুতে আমার ভয় নাই। কিন্তু ভুতের বকা খুব অপমানের।
        মেয়েটা আসতেই আমি বললুম, সাইকেল লিক্ হয়ে গেছে। তুমি এখনই নিতে পারো তোমার সাইকেল।
        বলেই আমি সাইকেলটা ফেলে পিছনে হাঁটতে যাব, সে খপ্ করে আমার হাত ধরে বললে, কে বলেছে রেখে যেতে? আমার বোন এখনও ঘুমাচ্ছে। আজ বোল উৎসব যে। নানা দেশের ভুতেরা আসবে এই মাঠে একটু পর। কত নাচ হবে, গান হবে, খাওয়াদাওয়া হবে। তুমি বরং থেকে যাও।
        আমি বললাম, তুমি কে?
        সে বলল, আমি ওর বন্ধু। আমার কবর ওর পাশেই। আমরা একই সাথে...
বললুম, থাক্ থাক্... আমি বরং আসি। অত ভূত একসাথে দেখলে আমার মাথা ব্যাথা করে। তাছাড়া দেখছ না আমার চোখে চশমা। ডাক্তার বলেছে বেশি ভুত দেখবে না, চোখের পাওয়ার বেড়ে যাবে।
        মেয়েটা হেসেই লুটোপুটি খেল। তারপর বলল, বেশ ওর বাবার কাছে যাও, সাইকেল সারিয়ে দেবে।
        আমি বললাম, আমার যে পয়সা নেই।
        মেয়েটা খানিকক্ষণ চুপ্ করে কি ভাবল। তারপর হুস্ করে কোথা থেকে দুটো কয়েন বার করে বলল, নাও।
        আমি হাতে নিয়ে বললাম, আরে! এ যে সোনার!
        মেয়েটা বলল, সে তোমাদের কাছে। এখন যাও সাইকেলটা...
        পুরোটা শেষ হয়নি, একটা ষণ্ডামার্কা লোক যেন মাটি ফুঁড়ে এসে দাঁড়ালো। বলল, কাউকে কোত্থাও যেতে হবে না। আমি এখানেই সারিয়ে দেব। তুমি খোকা বরং বাড়ি যাও। রাত হল।
        আমি ভালোমানুষের মত ফিরছি। হঠাৎ টুক্ করে কে একটা আমায় ঢিল ছুঁড়ে মারল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি গাছের উপর একটা হনুমান। আমি তার দিকে তাকাতেই সে মাথা নাড়ল। তারপর ইশারা করে সামনের দিকে দেখালো।
        দেখি একটা অল্পবয়েসী বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে। তার পায়ের নীচটা যেন হাওয়ায় ভাসছে।
        আমি বললুম, ভুতের সাথে আমার কোনো কথা নেই।
        মেয়েটা কিচ্ছু বলল না।
        আমি হাঁটতে গিয়েও দাঁড়ালাম। বললাম, কি?
        মেয়েটা বলল, তুমি আমড়াখামড়া স্কুলে পড়ো না?
        আমি বললুম, হ্যাঁ।
        মেয়েটা বলল, আমার একটা কাজ করে দেবে, তোমাদের স্কুলে ভামিনী পড়ে না, তোমার ক্লাসে? ওকে বলবে, আমার জন্য যেন ও আর না কাঁদে। আমি ভাল আছি।
আমি বললাম, ভামিনী কেন কাঁদে তোমার জন্য?
        মেয়েটা বলল, সে অনেক কথা। মোদ্দা কথা ও ভাবে ওর জন্যেই আমার এরকম হল। কিন্তু ও কি করে জানবে বলো যে আমার হার্টে একটা ফুটো আছে। তাহলে আমরা কেন গাছে উঠে ওরকম দোল খাব?
        আমি চমকে উঠলাম। বললাম, তুমিই কি সেই বাকুলি?
        সে বলল, হ্যাঁ তো।
        তবে যে তোমার ঠাকুমা...
        ভুল বয়েস বলেছে। আমি তোরই সাথে পড়তাম রে বুদ্ধু...
 
        আমি ভোরে যখন বাড়ি ফিরেছি তখন পাড়ার সব লোক আমাদের বাড়িতে। সবাই বলল, ছিলি কোথায় এতক্ষণ? এ কাঁদল, সে বকল। আমি তাদের বলতেই পারতাম, তাও তো বাকুলি'র মত হারাই নি! বললাম না। থোড়িই বুঝবে।