Skip to main content

তুমি যা বলছ সে অতীতের কথা। অতীতের স্মৃতিগুলো আঁকড়ে তো বেঁচে থাকা যায় না, এটা আমরা দু'জনেই বুঝতে পারছি, না কি? খারাপ দু'জনেরই লাগছে। ভবিষ্যতেও লাগবে। কিন্তু অতীতটা অতীতই, তাকে জাগিয়ে রেখে বর্তমান চলে না, এটা কি সত্যি নয়? 
 
    যতীন ব্যাগ গুছাচ্ছে। রাতের ট্রেন। চেন্নাই মেল। একা যাবে। দু'বছরের জন্য যাবে। স্বেচ্ছা নির্বাসন। সদ্য ফুরিয়ে যাওয়া শূন্য চায়ের কাপটার দিকে তাকিয়ে বসে অত্রী। কষ্ট হচ্ছে না। ভয় করছে। ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু অভ্যাস? অভ্যাস তো ফুরায় না। তাকে অপঘাতে না মারলে মুক্তি নেই। যতীন যা বলছে একদম ঠিক। এটাই। বেরিয়ে আসতে হবে দু'জনকেই। তবু ভয় করছে। যেন প্রথমবার বোর্ডের পরীক্ষা দিতে অন্য স্কুলে ঢুকছে। একা। বাড়ির লোক বাইরে দাঁড়িয়ে। চলে যাবে একটু পরেই। সব অচেনা। কিন্তু এটাই সত্যি।

     অত্রী উঠল না। একবার ভাবল বিকেলের পড়ন্ত রোদটা ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে। না। সেই অভ্যাস। মানুষ অভ্যাসের দাস। কত পুরোনো কথা। কিন্তু কি সত্যি। যতীনের দিকে তাকালো। তার দিকে পিছন ফিরে ব্যাগ গোছাচ্ছে। একটা শর্টস পরে আছে, খালি গা। সেই এক শরীর। এক গন্ধ। একই ভাঁজ পেশীর। কিন্তু সেই আকর্ষণটা নেই। উন্মাদনাটা নেই। যেন দুটো অন্য মানুষের গল্প ছিল সেটা। যেটা ছিল আগেকার। তারা অন্য উপন্যাসের চরিত্র। ভুল হল। এতটা ভুল হয়? নাকি মানুষ পরিবর্তন মেনে নিতে পারে না বলে "ভুল ভুল" বলে চীৎকার করে মরে। 

    যতীন টয়লেটে গেল। সেভিং সেটটা আনতে। অত্রীর কান্না পাচ্ছে না। ক্লান্ত লাগছে। ঘুম পাচ্ছে। যেন এই সোফায় শুলেই ঘুমিয়ে পড়বে। চোখের কোলটা ভারী হয়ে আসছে। এ সব কি হচ্ছে? 

    শুরুটা এমন ছিল না। আট বছরের জীবনের হঠাৎ পরিণতি নয় এটা। অনেক আগেই ঘটে এটা গিয়েছিল। এখন শুধু কস্টিউমস পরে স্টেজে এসেছে এই যা। চিত্রনাট্য আরো তিন বছর আগের। 

    না, কোনো সমস্যা নেই। শুধু একটা উপলব্ধি - এভাবে একসঙ্গে চলা যাচ্ছে না। কারোর জীবনেই অন্য কেউ নেই। শুধু একটা উপলব্ধি জন্মালো। যতীনকে ফিল করতে পারে না অত্রী। অত্রীকেও যতীন বুঝতে পারে না। একটা বিরক্তি জন্মায় সব সময়। কথায়। চোখের চাহনিতে। যৌথভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে। একটা বিরক্তি শুধু। ইংরাজিতে বললে আরো ভালো লাগে, একটা ইরিটেশান। যদি আরেকটা r যোগ করে বলে তবে আরো ভালো লাগে বলতে, ইররিটেশান। সব অনুভূতি যেন ওই দুটো r -এর মধ্যেই বলা হয়ে যায়। যতীনের কাছে অত্রী একটা ইররিটেশান। চাপতে চাইলেও চাপা যায় না। একদিন যার কাছে নিজের ভালোবাসার অনুভব চাপতে চায়নি, আজ তার কাছে নিজের সাফোকেশানের অনুভবটাও চাপতে চায় না যতীন। একজন মানুষ শুধু একা একা সাফোকেশানে যায় না। যাকে নিয়ে সাফোকেশান সেও ভোগে। একজন জানলা খুলতে চায়, পারে না। আরেকজন পালিয়ে যেতে চায় পারে না। সাফোকেশান দু'জনেরই।  

    অত্রী অবুঝ নয়। অত্রী বদলে গেছে। যতীন অনেকবার অত্রীর শরীরের দিকে তাকিয়েছে নিজের সাফোকেশান দূর করতে। যৌনতায় ডুবে পরশপাথর খুঁজতে চেয়েছে সম্পর্ক টিকিয়ে দেওয়ার। হয়নি। পরশপাথর না, কাদা তুলে এনেছে। পাঁক উঠে এসেছে। এত বছর ধরে দু'জনের অলক্ষ্যে জন্মেছে যা ধীরে ধীরে। 

    অত্রীর শরীরের তাপে শরীর সাড়া দিয়েছে। কিন্তু সে খেলা। যতীন খেলেছে গোলকিপারের মত। যেন বলটুকু আটকাবার দায় শুধু তার। নিজের আত্মসম্মান বাঁচাতে হবে। সবটাই প্রতিক্রিয়া। পৌরুষের গর্ব। নগ্ন অত্রীর উপর নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে অনেক বেশি মনোযোগ লেগেছে। এতটা মনোযোগ লাগে যৌনতায়? একটা জাপানী উপন্যাসে পড়েছিল বৈবাহিক জীবনে একটা সময়ের পর যৌনতা মানে যেন আনপেড প্রস্টিটিউশান, মজুরীহীন বেশ্যাবৃত্তি? বাংলা অনুবাদটা মনে মনে করে, নিজেকে দশে এক দিয়েছিল, মনে আছে। 

    এ উপলব্ধিটা জন্মালো কেন? কারণ স্পষ্ট নয়। সব কারণ কি জানে মানুষ? নিজের বদলে যাওয়া অনুভব করা যায় কই? অন্যেরটা যায়। কে বেশি বদলে গেল? সে? না যতীন? 

    সবার একটা গণ্ডী থাকে। তার বাইরে বেরোতে গেলে রাবণে ধরে। উপমাটা সেকেলে হলেও এটাই সত্যি। যতীনের জন্য নিজেকে বদলাতে চায়নি। নাকি সে নিজেই বদলে গেছে বলে মনে হচ্ছে যতীন বদলে গেছে? ছুটন্ত ট্রেনের যাত্রী যেমন দেখে এক ঝাঁক সার দেওয়া লোক নিয়ে দৌড়ে গেল শুধু প্ল্যাটফর্ম। মানুষের নিজেকে নিয়ে স্মৃতি ভীষণ কপট। মিথ্যা। অত্রী বিশ্বাস করে না। শুধু এইটুকুই সত্যি হয়ে রইল, আর থাকা যাচ্ছে না। এ কথা দু'জনেই মেনে নিয়েছে। অচেতনে মেনে নিয়েছে। মানুষ সব চাইতে অসহায় নিজের অচেতন মনের কাছে। সে যেন রক্তের গ্রুপ। বদলানো যায় না। 

    যতীন নেমে যাচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে। জিন্সটা আর টিশার্টটা অত্রীরই কেনা। যাওয়ার মুহূর্তে কোনো নাটকীয়তার দরকার হল না। তারা দু'জনেই কোনোদিন নাটকীয়তা পছন্দ করেনি। আজও করে না। সব বদলায় না। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। ব্যাণ্ডেল থেকে হাওড়া যেতে সময় লাগবে। জ্যাম থাকে রাস্তায় এই সময়। 

    অত্রী দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে সোফায় এসে বসল আবার। খাওয়া চায়ের কাপ দুটো তোলা হয়নি। দাগ হয়ে যাবে। হোক। 

    অত্রীর ফাঁকা লাগছে না। বুকের ভিতর থেকে একটা বোঝা নেমে গেল মনে হচ্ছে। আর কোনো আশঙ্কা নেই। আশঙ্কার ভার ভাঙনের ভার থেকে হালকা। এটা আগে বোঝেনি কেন? কতদিন পর আবার মনে হল যতীনকে সে স্পষ্ট করে দেখছে চোখের সামনে। তার যতীন না। একজন মানুষ। সম্পূর্ণ স্বাধীন মানুষ। সৎ, কর্মঠ, দায়িত্ববান মানুষ একজন। কোনো অভিযোগ নেই তার যতীনের উপর। বদলে যাওয়া কি অপরাধ? নয় তো। ভয় করছে না। কান্না পাচ্ছে। আনন্দের কান্না। 

    ক্যাবের মধ্যে গান চলছে। তুম আগেও হো নুর আগেয়া হ্যায়। শান্তি লাগছে। কষ্ট লাগলেও শান্তি লাগছে। অত্রী ভালো মানুষ। তাদের জীবনে মৌসুমী বায়ুর আসার সময় বদলে গেছে। কেউ রুক্ষ নয়। অসম্পূর্ণ নয়। ভালোবাসা সম্পূর্ণ করে না। ভালোবাসা একের মধ্যে থাকা সম্পূর্ণতাকে আরেকজন অনুভব করায়। তারা পারেনি। সেটা অপরাধ না। অন্যায় না। অন্যায় হল একে অন্যকে প্রতি মুহূর্তে অসম্পূর্ণ ফিল করানোতে। 

    হালকা লাগছে। ভালো লাগছে গানটা। অত্রীকে লিখতে যাবে, ভালো থেকো, একটা মেসেজ ঢুকল, হ্যাপি জার্নি। অত্রী লিখেছে। কোনো ইমোজি দেয়নি। তারা বদলে গেছে।