দুপুরবেলা। সবাই ঘুমাচ্ছে। তার বয়েস কত হবে? হয় তো দশ কি এগারো। তার মনে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন। তার ঠাকুমা, ঠাকুর্দা, দাদু, দিদিমা, মা, বাবা --- এরা সবাই ঠাকুরের সামনে বসে কি ভাষায় যেন কথা বলে। ওটা নাকি সংস্কৃত। এমনকি স্কুলে সরস্বতী পুজোর সময়, সেখানেও পুরোহিত ঠাকুর, মানে তার স্কুলের ভূগোলের স্যার সংস্কৃত বলে বলে পুষ্পাঞ্জলি দিতে বলেন। কেন ঠাকুর কি বাংলা, ইংরাজি, হিন্দি বোঝেন না? সে তো সবক'টা ভাষাই বলতে পারে, বুঝতে পারে। ঠাকুর যখন ছোটো ছিল তখন কি তবে কার্টুন সব সংস্কৃতে হত? তবে ঠাকুর বড় হয়ে বাকি ভাষাগুলো শেখেননি কেন?
মেয়েটা চুপিচুপি গিয়ে ঢুকল ঠাকুরঘরে। এর একটা উত্তর তো পেতেই হবে। সিংহাসনের মাথায় রাখা গীতা, চণ্ডী বার করল। এ বাবা, সত্যিই তো সংস্কৃতে লেখা! নীচে বাংলা করে দেওয়া। লক্ষ্মীর পাঁচালি, এটা বাংলায় লেখা। মানে লক্ষ্মী ঠাকুর শুধু বাংলা বোঝেন? সরস্বতী ঠাকুর এত পড়াশোনা ভালোবাসেন তবু বাংলা বোঝেন না? কি মুশকিল! আরো বই খুঁজে দেখল, সবই সংস্কৃতে লেখা। কি হবে?
দুষ্টু জানলার দিকে পা করে বসল। তাদের বাড়িটা দোতলা। ঠাকুরঘরটা ছাদের উপর। এখানে এখন কেউ আসবে না। ঠাকুরের দিকে পা করে বসতে নেই। সে অবশ্য বড়দের সামনেই পা দিয়ে বসতে নেই। ওতে অসম্মান করা হয়। কিন্তু সে না হয় হল, আচ্ছা ওই যে ছবিটা, দাদু বলেন ওনার নাম রামকৃষ্ণ ঠাকুর, উনি তো মানুষের মত দেখতে, উনিও কি সংস্কৃত ছাড়া বোঝেন না? তা কি করে হয়? দুষ্টু তো ওনার খাট-বিছানা দেখে এসেছে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে, সংস্কৃত বই তো ছিল না। যদিও সবচাইতে ভালো লেগেছে হনুমানগুলোকে দেখতে। তা ইনিও কি শুধু সংস্কৃতে কথা বলতেন? তা তো নয়। দিদার সঙ্গে সিরিয়ালে দেখেছে উনি তো পড়াশোনাই করেননি। তবে? তবে কালী ঠাকুর ওনার কথা শুনত কি করে?
দুষ্টু চুপিচুপি গিয়ে রামকৃষ্ণ ঠাকুরের ছবিটা সিংহাসন থেকে তুলে নিল। তারপর নিজের কোলে বসিয়ে বলল, আচ্ছা তুমি কি সংস্কৃত ভাষায় কালী ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলতে? সে কি বাংলা বোঝে না?
হঠাৎ দুষ্টু শুনল জানলার পাশে ঝুপ্ করে একটা আওয়াজ। কি হয়েছে দেখতে যাবে, এমন সময় একটা বড় হনুমান হুপ্ করে এসে জানলার পাশে বসল। বসেই বলল, এই আমায় ওই ঘটের উপর রাখা কলাটা দে না….
দুষ্টু দেখল সত্যিই তো লক্ষ্মীর ঘটের উপর একটা কলা রাখা আছে। কিন্তু তাতে সিঁদুর মাখানো। সে হনুমানকে বলল, না না, ওটা লক্ষ্মী ঠাকুর খায়। তাছাড়া সিঁদুর মাখানো আছে, তোমার খেলে পেট ছাড়বে।
হনুমান বলল, আরে লক্ষ্মী ঠাকুর খেলে কি ওটা থাকত ওখানে? আর তুই জলে ধুয়ে দিয়ে দে, কিচ্ছু হবে না।
দুষ্টু একটু ভাবল। তারপর ঠাকুরের ছবিটা পাশে রেখে কলাটা ধুয়ে হনুমানকে দিল। আবার ছবিটা কোলে নিয়ে বসে বলল, তুমি এখন যাও, আমি খুব শক্ত সমস্যায় পড়েছি একটা।
হনুমান বলল, জানি, কি সমস্যা। সেই জন্যেই তো এলাম। তোমার কোলে যে দাদুটার ছবি, আমার দাদুর দাদুর দাদু... সেখানে থাকত, ওই দাদুটা যেখানে থাকত। আমি জানি তুমি কি ভাবছ। আমার দাদু তাই আমায় পাঠালো।
দুষ্টু উত্তেজিত হয়ে বলল, তোমার দাদু আমায় চেনে? কি আশ্চর্য, আমি তো চিনি না!
হনুমান কলাটা ছাড়িয়ে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বলল, আমার দাদু সবাইকে চেনে।
দুষ্টু বলল, তবে তোমার দাদু কি গুগুল চালায় গো?
হনুমান বলল, আমার যে দাদু দক্ষিণেশ্বরে থাকত সেই সময়ে, সে গুগুল-টুগুল চালাতে পারত না.. কিন্তু যা কলা চালাতো না…. আরে ওই রাসমণি ঠাকুমা যখন মন্দির বানালো, কত ফল… কত ফল... ওই লোভেই না আমার ঠাকুর্দা বনগাঁ থেকে দক্ষিণেশ্বর সংসার নিয়ে গেল! তো সে তুমি ভাবতেই পারবে না। এক কাঁদি কলা এই দিলে... ব্যস... ফুরিয়ে গেল... আবার দিলে.. হুস্... শেষ….. হো হো হো…
দুষ্টু বলল, বেশ তোমার সেই পেটুক দাদুর কথা থাক... তুমি বলো আমায় কি বলতে এসেছিলে….
হনুমান বলল, ঠাকুর কোনো ভাষাই বোঝে না…
দুষ্টু আঁতকে উঠে বলল, তবে?
হনুমান বলল, এই যে তুমি ডগি'র সঙ্গে কথা বলো, ম্যাও -এর সঙ্গে কথা বলো। কি ভাষায় বলো? ওদের কথাই বা বোঝো কি করে?
দুষ্টু বলল, এমনি এমনিই…. কিন্তু ঠাকুর তবে কোনো ভাষাই বুঝতে পারে না?
হনুমান পিঠটা চুলকাতে চুলকাতে বলল, মানে মুখের কোনো কথাই বোঝে না, যদি না সেটা মনের কথা হয়। এই যেমন ধরো, তুমি ভাবছ, আমি পড়ব না আজ। কিন্তু যেই ঠাম্মি জিজ্ঞাসা করল, কিরে দুষ্টু পড়বি না আজ? অমনি তুমি যদি বলো, এই তো পড়ব এখন…. তবে সেকি তোমার মনের কথা হল?
না তো। কিন্তু সেটা না বললে আমায় বকবে তো!
মানে বকার ভয়ে তুমি মনের কথাটা বা বলে বানানো কথা বলে দিলে... মানে চালাক বুদ্ধির কথা শুনলে…. কেন? না তোমার সাহস নেই তুমি যেটা ভাবছ সেটা বলার…
দুষ্টু ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, কিন্তু ধরো, আমার যে বন্ধু পামেলা। সে কি বিচ্ছিরি রঙের সব নেলপালিশ পরে। আমার ভালো লাগে না যদিও। কিন্তু ওর খারাপ লাগবে ভেবে বলি, ভালো দেখাচ্ছে... সেই বেলা?
হনুমান বলল, সেটা ভাবার কথা বটে। তবে দেখো মনের ইচ্ছাটা কি, ওকে দুঃখ না দেওয়ার। তাই এই কথাটা মিথ্যা হল না। কাউকে দুঃখ দেওয়া অকারণে খুব বাজে। যদি সেই কথাটা বললে তার কোনো উপকার হয়, তবে সেটা বলা ভালো, কিন্তু অকারণে দুঃখ দেওয়া ভালো না। এই যেমন তুমি যদি আমায় কলাটা না দিতে, আমি দুঃখ পেতাম না?
দুষ্টু উত্তর করল না। সে খুব ভাবনায় পড়ে গেল। একটু পর বলল, আচ্ছা তবে আমি বুঝব কি করে কোনটা বলব আর কোনটা বলব না?
হনুমান বলল, তোমার মাথায় দুটো বুদ্ধি আছে। এক ছটফটে বুদ্ধি আর একটা শান্ত বুদ্ধি। শান্ত বুদ্ধিই বলে দেবে তোমায় কি করতে হবে।
তাই কি পুজোর পর দাদু শান্তির জল মাথায় ছেটায়, ওই বুদ্ধিটা বাড়বে বলে?
হনুমান বলল, তা ঠিক। তবে ওসব মিছিমিছি।
দুষ্টু বলল, ঠিক। জল দিলে কি আর বুদ্ধি বাড়ে? ওসব মিছিমিছি।
হনুমান বলল, আমি আসি। এক পাড়ায় অনেকগুলো ভালো ভালো পেয়ারা গাছের খোঁজ পেয়েছি বুঝলে। যাই। তুমিও নীচে যাও, একটু পরেই ঝড় আসবে। জানলাগুলো বন্ধ করে দিও বুঝলে?
দুষ্টু জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, তোমার দাদু কোথায় থাকে?... কিন্তু তার আগেই হনুমান হুস্ করে লাফ দিয়ে চলে গেল।
দুষ্টু ছবিটা জায়গায় রেখে, ছাদে এসে দেখল সত্যিই ঝুনঝুন কাকিমার বাড়ির দিকটায় কি মেঘ করে এসেছে!