তাড়া নেই কোথাও যাওয়ার। তবু হাঁটছি। সোজা রাস্তা। সন্ধ্যে ইতস্তত করছে পুরোপুরি চাদরে মুড়তে দিনের অবশিষ্ট আলোটুকুকে। ডানদিকের আকাশে ঈষৎ রক্তিম পূর্ণচন্দ্র।
মনে ভার নেই। না আবেগের, না চিন্তার। মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে দুটো একটা সাইকেল দাঁড় করানো, পিঠে পড়ার ব্যাগ, কিশোর কিশোরী। আলসে দোকানীর মন্থর গতিতে দিনের দ্বিতীয়ভাগের সূচনা। সাইকেলে শিস দিতে দিতে ফেরা মধ্যবয়সী যুবক। বৈকালিক ভ্রমণ সেরে ফেরা বৃদ্ধদের ধীর পদক্ষেপ। সবই চেনা ছবি। অকারণেই মনের মেজাজ বেশ প্রসন্ন।
হঠাৎ নাকে আসল তীব্র ফুলের গন্ধ, সাথে কোন উগ্র সুগন্ধীর ঘ্রাণ। কিছুটা অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিলাম বোধহয়। পুরোদস্তুর সন্ধ্যে নেমে গেছে। পিছনে দ্রুতপায়ের শব্দে ফিরে তাকিয়ে দেখি দু'জন সদ্য যৌবনোত্তীর্ণা। সর্বাঙ্গ প্রসাধনে, আভরণে, মূল্যবান আবরনে ঢাকা। এ বিয়েবাড়ীর সাজ না হয়ে যায় না - মনে মনে বললুম। আমায় অতিক্রম করতে করতেই একজন আরেকজনকে বলল, তাড়াতাড়ি পা চালা, বরের গাড়ী রেডি!
বেশ খানিক সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে এগিয়ে গেল সামনে। সুন্দর গন্ধের একটা যাদু আছে। সে খুব সহজে মনের রঙ বদলাতে পারে, অনেকদিনের না খোলা দরজা খুলতে পারে। হলও তাই। দখিনা বাতাস? হয়তো বা।
কিছুটা এগিয়েই কানে এলো সানাইয়ের শব্দ। রাগ হংসধ্বনি। চলন বিলম্বিত। আরো কিছুটা এগিয়ে চোখে পড়ল আলোকসজ্জা। বাইরে সুসজ্জিত নারী পুরুষ। খুব ব্যস্ততা। বুঝলাম বরযাত্রীর তাড়া। বাচ্চাদের অস্থিরতাটা বেশি উপভোগ্য। একে নতুন পোশাক, তায় এমন অভিযান! কি উত্তেজনা তাদের চোখেমুখে।
রাস্তার অন্যদিকে চোখ পড়ল। একজন মাঝবয়সী মহিলা উল্টোদিক থেকে ধীরগতিতে এদিকে এগিয়ে আসছেন। চিনি ওনাকে। সুজাতা পিসি। রমেন পিসেমশায়ের চাকরীটা করেন। পিসেমশায় বছর ছয় হল লাঙ ক্যানসারে মারা গেছেন। পাড়ার সূত্রেই পরিচয়।
বিয়েবাড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে আসছেন। তার শীর্ণ শরীর ঘিরে একটা সাধারণ শাড়ির মোড়ক। কাঁধে চামড়ার ব্যাগ।
- এই ফিরছেন দিদি?
বিয়েবাড়ির থেকে কেউ জিজ্ঞাসা করল। প্রশ্নকর্ত্রীকে দেখলাম। মাঝবয়সী। বরযাত্রী হওয়ার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
একটু ইতস্তত করে পিসি বললেন, হ্যাঁ গো।
এ ইতস্ততার কারণ বুঝি। শুভ অনুষ্ঠানে তারা বড় বালাই। আপ্যায়ন না করলে আধুনিকতার বিপরীতাচরণ হয় আবার সবক্ষেত্রে এরা উপস্থিত থাকলে বুকের ভিতরটা দুরুদুরু করে, কে জানে আবার কি অমঙ্গল হয়!
প্রাচীন সংস্কার যত প্রাচীন হয় তার কালো ছায়াও যেন তত গাঢ় হয়। মনের উপরের স্তরে যুক্তির ছোঁয়া লাগলেও, ভিতরের স্তর অবধি তার পৌঁছানো অনেকাংশেই দুরূহ এখনো।
বিয়েবাড়ির আলোকসজ্জা, উচ্ছ্বাস, হইহুল্লোড় দাঁড়িয়ে রইল রাস্তার একধারে আর বৈধব্যের বিষণ্ণতা, একাকীত্ব, উদাসীনতা... আরেক ধারে মুখোমুখি।
আমি শারীরিক গতিতে এগোলাম। মনটা দাঁড়িয়ে রইল স্থবির হয়ে রাস্তার দুইধারের মাঝখানে। রাস্তার একধারটা একদিন অন্যদিকে ছিল তো? সেদিন ওদিকেও তো বেজেছিল সানাই, এসেছিল আত্মীয়স্বজন, আলো, উচ্ছ্বাস, বেণারসী.....
কানে হংসধ্বনির সুর মিলিয়ে গেল। রিকশার আওয়াজ, হইচই বেসুরো হল। রাস্তা আর সোজা লাগছে না এখন। এবড়োখেবড়ো। মাথার উপর উঠে আসা চাঁদে কলঙ্ক। রাস্তার ধারে ফুলের গন্ধ শুধু না, ময়লার গন্ধ, নর্দমার গন্ধ।
এরকমই হয়। রাস্তার দু'ধারে দু'জনকে রেখেই জীবন চলে। তবে কোনদিকে কখন কাকে দাঁড়াতে হবে, সেটা কেউ জানে না। সময় নিষ্ঠুর উদাসীন ধারায় বয়ে চলে। অসহায় আমরা পুতুলের মত আজ একরূপে, কাল আরেকরূপে সেজে নিত্যনতুন ভূমিকা পালন করে যাই।