Skip to main content

দূরত্ব মাপো তুমি। আমিও মাপি। একটা নদীও যেন বাঁশডোবা জল পেল না। চরায় ঠেকে যাওয়ার ভয় দাঁড় বাইতে বাইতে ক্লান্ত মাঝি ঘুমিয়ে পড়ে। জ্যোৎস্নায় শরীর ভেসে যায়। জানতে পারে না। ঘুমের মধ্যেও ডোবা চরের আতঙ্ক।

জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে কে ও? যেন শতাব্দী আগে দাঁড়িয়ে ছিল এখানে। অবচেতন মনে পূর্বজন্মের হাজারও জিজ্ঞাসার ভিড়। জিজ্ঞাসা করলাম, আমায় চেনো? উত্তর দিল না। মিলিয়ে গেল। এখন জঙ্গলজুড়ে পাখির ডাক। ঘুমন্ত মাঝি। জ্যোৎস্নায় ভাসা নদী।

আমার দুটো পা কাদায় ডোবা। আটকে আছে। কে বলল, গত পূর্ণিমায় বানের তোড়ে ভেসে গেছে তার ঘর। নদীর পাড় ভেঙেছে। দোষ কি তবে বানের? বান ভেঙেছে পাড়। সে তার প্রাপ্য। সে তার অধিকার। সেই পাড়ে বাসা বেঁধেছিল মানুষ। কেন বেঁধেছিল?

তবু সময়ের তীরে তীরে ঘর বাঁধে মানুষ। নইলে কোথায় বাঁধবে? জমি কই? মহাকালের তোড়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সময়ের বাঁধ যায় ভেঙে। তোড়ে ভেসে যায় মানুষ। কান্না উপচানো জলে জ্যোৎস্নার আলো টলমল করে ওঠে। অমাবস্যায় তারারা চেয়ে থাকে উদাসীন। ছেঁড়া কাপড়ের মত মানুষের কান্না ভেসে যায়।

কোনদিকে দাঁড়াব বলতে পারো? এখনও কাদায় পা আটকে। মাঝি ঘুমিয়ে এখনও। ভোর হতে আর কত বাকি মাঝি? জঙ্গলের পাখিটা থেমে গেছে। আসন্ন সকাল শাড়ির ভাঁজটা গুছিয়ে নিচ্ছে, আসবে সে। আসছে সে। শুকতারা একা হয়ে গেল দেখতে দেখতে। পুবের আকাশ উজ্জ্বল হল। মাঝির নৌকায় জলের ছলাৎছলাৎ। মাঝি উঠে বসেছে। উদাসীন চোখে তাকিয়ে মোহনার দিকে। ওদিকে নৌকা নিয়ে যেতে নেই। পূর্বপুরুষদের নিষেধ। কিন্তু চরে ঠেকে যাওয়া নৌকার নিয়তি টানছে ওদিকেই। মোহনার উপর মায়াবী আলো পড়েছে সূর্যের। মাঝি জানে আলোর মায়া। আলোর ধাঁধা।

মাঝি নৌকা ছাড়ল। মাঝি নৌকা বাইছে মোহনার দিকে। আমার দুটো পা আটকে কাদায়। আমি টান মেরে পা দুটো তুলতেই পারি। চীৎকার করে ডাকতেই পারি মাঝিকে। বলতেই পারি, আমিও যাব মোহনায়….

আমি বললাম না। মাঝি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল মোহনায়। যেন আলোর পর্দা পেরিয়ে চলে গেল অন্যদিকে। আমি কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করলাম, ডুবে যাওয়া নৌকার মাঝির আর্তনাদ। পেলাম না। সমুদ্রের নোনা বাতাসে ডানা ভেজানো কয়েকটা পাখি উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। আমার কাদায় আটাকানো পা দুটো ঢেকে নিতে চাইলাম লজ্জায়। অনেকগুলো মরা শামুকের খোল জড়ো করে রেখেছি। ওগুলো ভাসিয়ে দিয়ে জোয়ারের স্রোতের দিক মাপব। তারপর ভেসে যাব। কোথায়? জানি না।

মানুষের সুখ সহ্য করে না মহাকাল। বারবার সব সুখ গুঁড়িয়ে দিয়ে মোহনার দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। মানুষ আবার ফিরে আসে গুটিগুটি পায়। সাঁতার কাটা শেখে। ডুব সাঁতার। এখানে ওখানে গর্ত খুঁজে সুখের বাসা বানায়। অল্প ঢেউয়ে পাল তুলে দেয় নৌকায়। বলে এই তো আমি, এই তো আমার সুখ। এই তো আমার যা কিছু, এই যে মুঠোয়। ভুলে যায় সুখের সঙ্গে মহাকালের অনাদি কালের শত্রুতা। ভুলে যায় সময়ের পাড়ে বাঁধা ঘর শুধু ক্ষণকালের। সব পরিচিতি মুহূর্তে অপরিচিতে যাবে মিলিয়ে। মহাকাল প্রসন্ন হয় কিসে? মানুষের হাজার বছরের প্রশ্ন এড়িয়ে, ভক্তি গুঁড়িয়ে, মহাকাল বলে, তোমার সুখের আত্মসমর্পণে। এসো, এসো, এসো। মিলিয়ে দাও নিজেকে।

আমি দেখছি, আমায় নিতে মাঝি আসছে নৌকা বেয়ে। মাঝি কই? এতো শূন্য নৌকা। আমায় নিয়ে নৌকা হবে পূর্ণ। তারপর আমরা যাব মোহনায়। তারপর? উত্তর জানে নোনা হাওয়ায় ডোবা হংসবলাকা!