সৌরভ ভট্টাচার্য
11 January 2019
ঠিক মাথা খারাপ বলতে যা বোঝায় ভোম্বল তা নয়। আগে লেবারের কাজ করত, এখন মাঝে মাঝে ভিক্ষা করে, মাঝে মাঝে পাগলামি। প্রথমটার থেকে দ্বিতীয়টাতেই তার খ্যাতি বেশি। বিয়ে করেছিল কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিতে দিতেই। সে বিয়ের ফলও ফলেছে, বাড়িতে দুই জোয়ান মেয়ে। সংসার চলে বড় মেয়ে আর বউয়ের 'ঝি'-গিরির কাজের টাকায়। সংসার চলে শুধু বললে মিথ্যা কথা বলা হয়, গাঁজা-মদ কি না চলে তাতে। বড় মেয়েটার বিয়ে হয়েছিল, বর ছেড়ে পালিয়েছে। 'ভাগ্যে ভগবান বাচ্চা দেয়নি' - কাকলি বলে, কাকলি হল ভোম্বলের স্ত্রী। যদিও ভগবানের মনে কি ছিল বলতে পারি না, তবে বাচ্চার চেষ্টা একেবারে যে হয়নি তা নয়, কিন্তু দোষটা মেয়েতে না জামাইতে সেটা জানার সুযোগ জামাই দেয়নি, তার আগেই সে পগারপার।
ভোম্বলের মেজাজটা আজ সকাল থেকেই বেশ ভালো। পেটে ভাতও নেই, মদও নেই, তবু ভালো। সকালে উঠে উঠোনে দুটো ডিগবাজি খেয়েছে। কাগজের নৌকা বানিয়েছে আঠারোটা, বড় ড্রেনে ভাসিয়ে এসেছে। বউ মুড়ি দিয়েছিল, পাড়ার লালু নামক তার সাগরেদ সারমেয়কে খাইয়ে এসেছে। তার মেজাজটা চটকালো হঠাৎ তার বাড়ির দরজায় মিত্তির মশাইকে দেখে। এখানকার মিউনিসিপালটিতে চাকরি করেন। তাকে কাজ দেবেন বলে তিন বছর ফাইফরমাস খাটিয়ে একরকম তাড়িয়েই দিয়েছেন, একেবারে খালি হাতে না যদিও, দেড় হাজার টাকা একটা অফিসের ফেলে দেওয়া খামে ভরে হাতে দিয়ে বলেছিলেন, অন্য লোক নেওয়া হয়ে গেছে ভোম্বল, কি করব বলো, সবই ঠাকুরের ইচ্ছা।
যা হোক সেই ঠাকুরের ইচ্ছাতেই পাগল হওয়া ভোম্বল মিত্তির মশাইকে দেখে কিছুটা খিঁচ খেয়ে গেল। দরজায় দাঁড়ানো মিত্তির মশাইকে বলল, বাড়িতে কেউ নেই, কি দরকার?
মিত্তির মশায় রাসভারি মানুষ। রিটায়ার করেছেন চার বছর হল। এখন অবসর সময় বাড়ি আর একটা ধর্মীয় সঙ্ঘের সাথে কাটান। লোকে বলে, তিনি সারাজীবন বহু মানুষকে ঠকিয়েছেন, ঘুষ নিয়েছেন, কিন্তু তিনি জানেন ওগুলো সংস্কারে ছিল তাঁর; কথামৃতে পড়েছেন, একটা পাতাও ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া নড়ে না, আর এতগুলো মানুষ, এত এত টাকা এমনি এমনি তার দরজায় এসে উপস্থিত হত? ঠাকুর বলেননি, মায়ার রাজ্যে কোনটার পর কি হয় কোনো ঠিক আছে? তা ছাড়া নিজের আত্মার ইচ্ছাকে অতৃপ্ত রেখে কি আর দেশের সেবা হয়? তাই তার কোনো গ্লানি নেই। এখানে সঙ্ঘ করেন। মাসে একবার করে সস্ত্রীক বেলুড়, দক্ষিণেশ্বর ঘুরে আসেন, নিয়মিত ধ্যানজপ করেন, দীক্ষা নেওয়া, পাপ থাকলেই হল?
তিনি হেসে বললেন, ওরে কাল বিবেকানন্দের জন্মদিন, আমরা কম্বল, শাড়ি দিচ্ছি এবার প্রত্যেককে, মানে তোদের মত যারা গরীব, আসিস বুঝলি? আমায় আবার অনেক বাড়ি যেতে হবে, চললাম।
ভোম্বল বিবেকানন্দের নাম জানে, ছবিও দেখেছে, একটা মূর্তিও আছে হাইরোডের ধারে। ভালো লোক তো নিশ্চয় ছিল, নইলে লোকে মালা দেবে কেন গলায়, অবশ্য মারা গেলে সবার গলাতেই মালা দেয়। এই তো হারু নস্কর, খুনও নাকি করেছে, কিন্তু খুব কুকুর ভালোবাসত, সেও যখন মারা গেল কত বড় করে লোক খাওয়ানো হল। বড় ছবি টাঙানো এখনও পার্টির অফিসে। তবে এইসব কথা বললেই কাকলি ঝাঁটা নিয়ে তেড়ে আসে, এসব নাকি বলতে নেই। আগে মনে হত বলতে নেই, এখন ভোম্বলের সবই বলতে ইচ্ছা করে, কিন্তু বলতে গিয়ে আগেরটা পরে আর পরেরটা আগে হয়ে যায়, খেই থাকে না। লোকে হাসে, সে বোঝে না বলেই হাসে। আসলে এত কথা জমে, সে বলবেই বা কখন আর শুনবেই বা কে!
মিত্তির মশায় চলে যাওয়ার পর ভোম্বল প্রথমে ভাবল খবরটা বলবে না কাকলিকে। তারপর ভাবল, কম্বল দুটো পেলে ভালোই হয়, ছেঁড়া চাদরে শীত মানাচ্ছে না এ বছর, যা জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে!
কিন্তু দেখা গেল ভোম্বল বলুক চাই না বলুক, কাকলি আগে থেকেই শুনেছে। তাদের নামও নাকি টুকে নিয়ে গেছে।
সারারাত ভোম্বলের ঘুম হল না। বউ বলল, খিচুড়ি খেয়ে পেট গরম হয়ে গেছে, কিন্তু ভোম্বলের মনে হল অন্য কারণ। নইলে সারারাত সে বিবেকানন্দের স্বপ্ন দেখবে কেন? বিবেকানন্দ একটা উঁচু স্টেজে বসে, যারাই কাছে যাচ্ছে তাদের জিজ্ঞাসা করছে, "ভোম্বলকে দেখেছ? একটু ভোম্বলকে ডেকে দেবে? ওর অনেক কথা বলার আছে আমায়।" কিন্তু কেউ ডেকে দিচ্ছে না। সবাই বলছে, আরে ও তো একটা বদ্ধ উন্মাদ! কি করবেন ওর কথা শুনে? মিত্তির মশাই, হারু নস্কর, কিপটে যোগেন মাষ্টার, মেয়েছেলের ব্যবসা করা নকুড় সামন্ত, জেল খাটা নেতা পরিমল জোয়ারদার --- এরা সব বিবেকানন্দের আশেপাশে মাছির মত ভনভন করছে, আর বিবেকানন্দ মাথার পাগড়ি খুলে তাদের তাড়াচ্ছে, হুস হুস করে।
সপরিবারে ভোম্বল হরিসভায় গেল। একটা বড় মতন সিংহাসন রাখা স্টেজে। তার পিছনে বড় বড় ছবি তিনটে। এদিকে নীচে সার দিয়ে তার মত মানুষের ভিড়। গরীব-বড়লোক, পরিস্কার জামা-নোংরা জামা, বই পড়া-বই না পড়া, খুব চালাক-বোকা চালাক... এক্ষুণি যেন একটা দড়ি টানাটানি খেলা হবে। হঠাৎ ভোম্বল 'হুররে...' বলে চিৎকার করে উঠল। কাকলি লাইনে দাঁড়িয়ে চোখ পাকাল। কাকলিকে ভয় করে ভোম্বল। সে স্টেজে তাকিয়ে দেখল রমার মা'কে, স্টেশনে ভিক্ষা করে যে, সেই রমার মা'কে ওই বউভাতের দিনের লাল সিংহাসনে বসিয়ে তার কপালে চন্দনের টিপ দিচ্ছে একটা লোক। একজন গলায় মালা পরালো। গাঁদার মালা। একজন একটা কম্বল তার হাতে দিয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। রমার মা ছেঁড়া ব্লাউজ শাড়িতে ঢাকতে ঢাকতে কঁকিয়ে উঠে বলছে, কি কোচ্ছেন... কি কোচ্ছেন...
ভোম্বল চুপ। চারদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে, ওই তো হরিদা, ওর ছেলে পড়তে পেলো না টাকার অভাবে; ওই বক্সী, ওর মেয়েটাকে নষ্ট করল কিছু বড়লোকের ছেলেরা, সে গলায় দড়ি দিয়েছে গেলবার পুজোয়। ভোম্বলের স্টেজে চড়ার পালা... তার সামনে এরা কেমন মানুষ আজ... একজন তাকে বলছে, "বুঝলি ভোম্বল স্বামীজী বলেছেন, যে দান দেবে সে বসবে নীচে, যে নেবে সে বসবে উপরে, তাই এই সিংহাসন"... মিত্তির মশায় বললেন, "ছি বলাইদা দান না... বলুন পুজো, দরিদ্র নারায়ণের পুজো।"
ভোম্বল 'ভ্যাঁ' করে কেঁদে ফেলল। তাকে চন্দন পরানো হল, মালা পরানো হল, কম্বল আর মিষ্টি দেওয়া হল, পা ছুঁয়ে কারা কারা প্রণাম করল, কারা কারা হাতজোড় করে প্রণাম করল। ভোম্বল শুধু কাঁদল। সে বাড়ি এসে কারোর সাথে কথা বলল না। খেলো না। কাঁদল। বিকালে মিত্তির মশায়ের বাড়ি গেল। বাড়ি থেকে বলল, উনি তো অনুষ্ঠানেই আছেন, মহারাজরা আসবেন বক্তৃতা দিতে!
মহারাজ! ভোম্বল অনুষ্ঠানে গেল। অনেক বড় বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে। একটা বড় সাদা গাড়ি থেকে দু'জন গেরুয়া পরা, টাক মাথা মানুষ নামল। সবাই ওদেরকে 'মহারাজ, মহারাজ' বলে সেই স্টেজে নিয়ে গেল। তাকে ভিতরে যেতে দিল না কিছু ছেলে। সে যাবেই বা কি করে, কত পড়াশোনা জানা ভদ্রলোকেরা বসে। কি দামি দামি জামা সবার। মহারাজরা কি বলছে সে বুঝল না, কিন্তু তার আবার কান্না পেল। বক্তৃতা শেষ হল। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। সবাই প্রণাম করতে ঠেলাঠেলি করছে। ভোম্বল যেতে গেল, আবার আটকে দিল। একটা ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে আরেকজনকে বলল, পিৎজা এসেছে? দেখ মহারাজেরা পিৎজা খাবেন বলেছিলেন... ভোম্বল এই খাবারটার নাম টিভিতে শুনেছে, কিন্তু কাকলি বানাতে পারে না।
ভোম্বল বাড়ি ফিরে গেল। সারারাত ঘুমালো না। আজ সবার ব্যবহারে সে বড্ড ঘাবড়ে গেছে। তার সাথে সাথে কি সবার মাথা খারাপ হল? সে পরেরদিন মিত্তির মশায়ের বাড়ি গেল। বাড়ির লোক বলল, এখন উনি পুজোয় বসেছেন, বেলায় আসতে। ভোম্বল আবার বেলায় গেল। মিত্তির মশায় তাকে দেখেই সেই আগের মত মুখ করে বললেন, কি চাই...?
ভোম্বলের মনটা খুশিতে ভরে গেল... না, এই তো সব ঠিক আছে... কেউ পাগল হয়নি... পাগল সে একাই... সে হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে বলল, জয় বিবেকানন্দ, কালকের পোনামডা ফিরে দিয়ে গেলাম, হজম হয়নি...
মিত্তির মশায় বললেন, যা সবই ঠাকুরের ইচ্ছা...