Skip to main content

করোনার বছর দুই আগের ঘটনা হবে। দার্জিলিঙে একটা অফিশিয়াল কাজে গেছি। দুদিনের ট্যুর। প্রায়ই যেতে হয়। কিন্তু এবারে একটা সমস্যা হয়েছে। যে হোটেলে প্রতিবার উঠি, সেটা পেলাম না। কালীপুজোর ছুটির জন্য এত ট্যুরিস্ট এসেছে যে ওরা নাকি ভাড়া তিনগুণ করে দিয়েছে। আমার অফিস অতটা দেবে না। যা হোক, ছোটোখাটো হোটেলেই বুকিং পেলাম। একরকমের হোমস্টেই বলা চলে। তবে যেটা শুনে খুব ভালো লাগল, ওয়েদার ভালো থাকলে নাকি জানলা থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাবে।

রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছি। কাজ বাকি কিছুটা। সে সব সারতে সারতে প্রায় একটা দশ হল। বাইরে ভালো বৃষ্টি হচ্ছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা ভাগ্যে নেই বুঝলাম। কাল সকাল অবধি এ ক্লিয়ার হবে নাকি? ইম্পসিবল!

টয়েলেট সেরে দরজা দিয়ে বিছানায় এলাম। আঃ!! পিঠটা জুড়িয়ে গেল। রুমের আলোর সুইচটা পাশেই ছিল। সেটা নিভিয়ে যেই বাঁদিক ফিরেছি, জানলার দিকে, হঠাৎ ডানদিক থেকে কেউ বলল, দাদা প্লিজ আলোটা জ্বালাবেন, আমি টয়লেটে যাব। ভয় করছে।

আমি চমকে ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। কে মশকরা করেছে এত রাতে! ওমা! পাশ থেকে বলল, ও দাদা, আমি না বেরোনো অবধি আলোটা নেভাবেন না প্লিজ। আমার হেব্বি ভয় লাগে।

আমি তো হাঁ হয়ে গেছি। আমার ভয় পাওয়া উচিৎ, কিন্তু এত নরম গলার আওয়াজ যে ভয়টাই পেতে পারছি না। গলাটা পুরুষের। আমার চোখের সামনে টয়েলেটের দরজাটা খুলে গেল। আলো জ্বাললো। দরজা বন্ধ হল। খানিক বাদে জল দেওয়ার আওয়াজ হল। আবার টয়েলেটের দরজাটা খুলে গিয়ে, আলো নিভিয়ে, দরজাটা বন্ধ হল।

আমার পাশে আবার সেই গলার আওয়াজ। আপনি শুয়ে পড়ুন। শুধু জলের বোতলটা আমি নিলাম। এই সবুজটা। আপনি নীলটা নিন। আলোটা নিভিয়ে দিন। আমি এই চেয়ারে বসেই কাটিয়ে দেব। আসলে এটা একটা রিচুয়াল তো, আজকের দিনে আসতেই হয়। আমাকে এই ঘরেই খুন করেছিল আমার বউ আর তার প্রেমিক। ওরা এখন কালিপঙে থাকে। আমি যাই না। আমার লজ্জা লাগে। আসলে ডিভোর্স হয়নি তো। এখনও তাই নিজের বউ ভাবটা আছে। তাই ওসব আদর-টাদর দেখতে লজ্জা লাগে। কি বলেন!

আমি ভাবছি আমার খাবারে কি কিছু নেশার জিনিস মেশালো।

নিন নিন, ঘুমান। কাল আবার অফিসে যাবেন। আমার আবার বেশি রাত জাগলেই টয়লেট পায়। আবার আপনাকে আলো জ্বালতে হবে। নিন নিভিয়ে নিন আলো।

আমি বললাম, ও মশায়, কি ইয়ার্কি হচ্ছে, এমন একজন আস্ত জ্যান্ত ভূতের সঙ্গে একই ঘরে রাতে ঘুমানো যায় নাকি? প্লিজ… বাইরে গিয়ে বসুন না….

পাগল! বললাম না আমার ভীষণ ভয়! আসুন আপনার মাথায় বিলি কেটে দিই… ঘুম চলে আসবে….

আমি বললাম, দেখছেন আমার মাথায় চুল নেই…. কি মশকরা হচ্ছে….

ওহ সরি! আসলে কান নেই তো… তাই চশমাটা পরতে পারি না… চোখেও কম দেখি…. পা টিপে দিই?

বলতে বলতে হঠাৎ দেখি আমার দুই পায়ে হিম ঠাণ্ডা দুটো হাতের চাপ।

কিন্তু মানুষের শরীরে তো। কেউ এমন করে পা টিপেও দেয় না কোনোদিন। কি বলব, আমার দুই চোখ বেয়ে ঘুমের ধ্বস নেমে গেল। ভুলেই গেলাম হাতটা মানুষের… না….

ঘুম ভাঙল সাড়ে ছটায়। হা ঈশ্বর! চোখের সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা! আহা! আহা!

দরজায় টোকা পড়ল। চা দিয়ে গেল।

চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে মনে পড়ল, হাই যা… কাল রাতের তিনি কোথায়?

কোনো চিহ্নই নেই তার।

আমি সারাদিন অফিসের কাজ সেরে, বিকেলে ফিরে, রেডি হয়ে নিলাম। রাতেই শিলিগুড়ি পৌঁছাব। কাল ভোরে ট্রেন।

হোমস্টের মালিকের থেকে বিদায় নিয়ে বেরোবো। বাইরের ঘরে বসে সে। আমি যেতেই একগাল হেসে বলল, চঞ্চল আপনাকে বেশি জ্বালায়নি তো…. খুব ভালো লোক ছিল….

আমি বললাম, মানে আপনি জানতেন?

সে বলল, জানতাম। তবে এও জানতাম আপনি খুব ভালো মানুষ, ওকে বুঝবেন।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, বুঝলাম। কিন্তু ও ভয় কিসের পায় এত?

সে একটু চোখটা নামিয়ে বলল, মানুষকে। বড্ড সরল ছিল তো!

আমি বাসস্ট্যান্ডে এলাম। এবার বাসে উঠব। হঠাৎ দেখি দৌড়াতে দৌড়াতে হোমস্টের মালিক আসছে। আমি ভাবলাম, কিছু ভুলে এলাম? সঙ্গে সঙ্গে পকেটে হাত দিলাম। না, মোবাইল তো আছে। তবে? আমার কাছে এসে সে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দেখাই হত না আপনার সঙ্গে আরেকটু হলে…. আবার আসবেন….

আমার মাথাটা বোঁ বোঁ করছে…. আমি বললাম, আচ্ছা।

বাস ঘুরপথে নামছে। অন্ধকার ঘনাচ্ছে। মনে করার চেষ্টা করলাম… হাতটা কি ঠাণ্ডা ছিল… আগের শেক করা হাতটা?