যন্তোন্নাবাবু চিন্তায় পড়েছেন। লামা সাধু বলেছেন বুদ্ধ বলেন, আত্মা আছে, এই ভ্রান্ত বোধকে বলে অবিদ্যা। আর স্বামী চমকপ্রদানন্দ বলেছেন আত্মাকে না জানাই হল অবিদ্যা। এখন উনি কী করেন?
এই দার্জিলিং ঘুরতে এসেই যত গোল হল। মনাস্ট্রিতে শুনে এলেন আত্মা নাই। আর ওদিকে মহাকালের মন্দিরে বসে শুনলেন দিব্যি আছে আত্মা। তবে?
তবে আর কী? এদিকে দার্জিলিঙে এসে দার্জিলিং চা যে কোথায় পাওয়া যায় সেও পরম রহস্য। তো তিনি ম্যালে বসে বসে অ-দার্জিলিং চা খেতে খেতে ভাবছেন, খেস্টান হবেন, নাকি মোচোলমান। নাকি নাস্তিক। নাস্তিক হতে মনে সাধ যায় না। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে বুকের ভেতরটা। কী যেন নেই। বাতাস নেই যেন। ঘরে চেয়ারটেবিল, আলোপাখা সব দেখা যায়, কিন্তু ঘরময় বাতাসকেই দেখা যায় না। অথচ সেটা না থাকলে ঘরে এক মুহূর্ত প্রাণ টিকিয়ে রাখা যায় না। তেমনই আরকি। বিশ্বাস মানে সে বাতাস।
========
ও মশায়….মশায়….উঠুন না…..
ধড়ফড় করে উঠে বসলেন যন্তোন্নাবাবু। হোটেল রুমে আলো জ্বলছে। সামনে ছেঁড়া জ্যাকেট আর মুখে মাফলার জড়ানো একটা লোক দাঁড়িয়ে।
যন্তোন্নাবাবু বললেন, জাগালেন কেন? জানেন আমি এইমাত্র সুইজ্যারল্যাণ্ডে ল্যাণ্ড করলাম। হাতে এককাপ গরম কফি খেতে খেতে দেখছি আরাবল্লী পর্বত বেয়ে নেপোলিয়ন নেমে আসছেন। উফ! দিলেন সব চটকে!
আজ্ঞে সরি…বলছি আপনার টয়লেটে সাবান নেই কেন…..ফ্ল্যাশ করার পর থেকে ওটাই তো খুঁজছি…নইলে কখন আপনার ল্যাপটপ, মোবাইল, সানগ্লাস আর ওয়ালেট নিয়ে চলে যেতাম। আপনার সঙ্গে দেখাও হত না আমার। কিন্তু আমায় মনে করতেন আজীবন। ঈশ্বরের মত।
যন্তোন্নাবাবু খানিকক্ষণ লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, পাসওয়ার্ড জানতেন কী করে?
লোকটা বলল, ধুর মশায়, ওই সব করে এই নোংরা হাতে দাঁড়িয়ে আছি…আপনার কি ঘেন্নাপিত্তি নেই নাকি মশায়….বলুন না সাবান কোথায় আছে…..
যন্তোন্নাবাবু বালিশের নীচ থেকে একটা শ্যাম্পুর প্যাকেট ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, যান সেরে আসুন, আমি চায়ের জলটা গরম করি….
=====
চা নিয়ে মুখোমুখি বসলেন যন্তোন্নাবাবু আর খাঁজকাটা।
খাঁজকাটার বুকে নাকি ছুরির খাঁজকাটা দাগে ভর্তি। তাই ওই নাম। যন্তোন্নাবাবু বললেন, ইস, আপনি যদি চোর না হয়ে ভূত হতেন আমার যে কী সুবিধা হত। আমি জেনে যেতাম আত্মা আছে কি নেই।
খাঁজকাটা বলল, ধুর মশায়, অপঘাতে মরলে তবে না হয়। অ্যাত্তাড়াতাড়ির কী আছে? আপনি শ্যাম্পু বালিশের নীচে নিয়ে শোন কেন?
যন্তোন্নাবাবু বললেন, আসলে আমি তো সাবানটাবান ইউজ করি না। ওই শ্যাম্পু দিয়েই সব। এই আপনি যেটা এখন করলেন সেটাও। আসলে ছোটোবেলায় আমার বড়দা আমার শ্যাম্পুর প্যাকেট নিয়ে নিত। সেই থেকেই আমার এই অভ্যাস। সে মরে গেল, কিন্তু আমার তার শ্যাম্পু চুরির ভয় গেল না।… তা আপনি চুরির রাস্তায় কী করে এলেন?
খাঁজকাটা বলল, আপনি এটাকে চুরি বলেন? আমি বলি গুপ্ত পুঁজিবাদী আমরা। মানে কোন দিক দিয়ে যে আমরা পুঁজি জোগাড় করি সে কেউ জানতে পারে না। আমার কতবড় দোকান শিলিগুড়িতে। এটা আমার একটা নেশা বুঝলেন।
যন্তোন্নাবাবু বললেন, কান্ট থাকলে আপনার কান মুলে দিতেন।
খাঁজকাটা বলল, ছি ছি অসভ্য কথা বলেন কেন…..কান্টের আবার কান কী?
যন্তোন্নাবাবু বললেন, আরে ধুর মশায়….বানান আলাদা…এ হল কে কে…ইংরেজির কে…..
খাঁজকাটা বলল, আরে মশায় বানান যাই হোক….ভারী অসভ্য লোক মশায়….
যন্তোন্নাবাবু বললেন, এই আপনি এত বোকা কেন….কান্ট একজন বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক। তিনি বলেছেন যে কাজটা বিশ্বজনীন হওয়ার যোগ্য না, তা অন্যায়। মানে চুরি করে তো আর সবাই পুঁজি বাড়াতে পারে না। তবে তো আর সমাজ থাকবে না…..
খাঁজকাটা বলল, যত্তসব উলফাল কথা….সবার এমন মুরোদ আছে?.... আর সবাই সব করে কি? এই যে আপনি যেমন শ্যাম্পু নিয়ে হেগো হাত ধোন…..কতজনকে জানেন এমন করে?
যন্তোন্নাবাবু বললেন, যাক….আপনি বলুন তো আত্মা আছে? না নেই?
খাঁজকাটা বলল, আছে, আবার নেইও। আপনি বলুন তো এই জগতে ন্যায়বিচার আছে, না নেই?
যন্তোন্নাবাবু বললেন, জানি না।
দীর্ঘশ্বাস পড়ল। উত্তরটা জানেন হয় তো। কিন্তু ব্যাখ্যা পান না। ঈশ্বর আর এত পাপ কী করে এক হৃদয়ে থাকে?
======
খাঁজকাটা রফির গলায় একটার পর একটা গান গাইছে। দারুণ গায় তো লোকটা। যন্তোন্নাবাবু আধশোয়া হয়ে শুনছেন। “অ্যায় দুনিয়া কে রাখওয়ালে” গাইতে গাইতে কেঁদে ফেলল লোকটা! তখন ভোর হচ্ছে।
যন্তোন্নাবাবু জানলার দিকে তাকিয়ে। চোখটা টাটাচ্ছে। গান গেয়ে কাঁদলে জিজ্ঞাসা করা যায় না কেন কাঁদছে। কিন্তু সব কান্নাই তো আসলে ব্যক্তিগত। যন্তোন্নাবাবু হঠাৎ বললেন, চলুন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে আসি। যাবেন?
=======
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ম্যাল বাঁ দিকে রেখে ফাঁকা রাস্তাটায় নেমে পড়লেন। একটু দূর এগোতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেল। উফ! কী ঐশ্বর্য! কী অসামান্য সুন্দর! ভাষা হারিয়ে গেছে।
খাঁজকাটা বলল, এই নিন।
যন্তোন্নাবাবুর হাতঘড়ি। নিলেন হাত পেতে। বললেন, এখন কী করবেন?
খাঁজকাটা বলল, চা খাব। খাবেন?
যন্তোন্নাবাবু বললেন, চলুন।
=====
এত যে কাশীর মত গলি দার্জিলিঙে আছে কে জানত! বাবা রে বাবা!
একটা ঘুপচি অন্ধকার ঘরে খাঁজকাটা নিয়ে এলো। ঘরে আরো অনেক লোক। তাস খেলছে। মদ খাচ্ছে। টিভি চলছে। মোমো বানানো আছে টেবিলে, কেউ কেউ নিচ্ছে।
খাঁজকাটা বলল, এরা সব আমার মত। গুপ্ত পুঁজিবাদী। ও, ওই যে, ও তো খুনও করেছে।
যন্তোন্নাবাবু বললেন, সে কি ভালো লোক ছিল?
হেঁড়ে গলায় খুনী বলল, মাস্তান ছিল…..
======
চা দিয়ে গেল। আর এক প্লেট মোমো। আহা! প্রাণটা জুড়িয়ে গেল যন্তোন্নাবাবুর।
খাঁজকাটা বলল, কেমন লাগছে?
যন্তোন্নাবাবু বললেন, বড্ড হীনমন্যতায় ভুগছি। আজীবন আমি কোনো সাহসের কাজ করিনি জানেন? কী ইচ্ছা করছে কয়েকটা বদ লোককে খুন করতে। মনে মনে দেখছি, গলা কেটে দিলাম। আমার সামনে ছটফট করতে করতে মরে যাচ্ছে। আর আমি ওদের কানের কাছে ওদের সব কুকীর্তিগুলো বলে যাচ্ছি।
কেউ কেউ হেসে উঠল। যন্তোন্নাবাবুও হাসলেন।
=======
রাতে ঘুম আসছে না। বাইরে ফুটফুটে চাঁদের আলো। বালিশের নীচে চারটে সানসিল্কের পাতা। যন্তোন্নাবাবু খাঁজকাটার জন্য অপেক্ষা করছেন। দরজা ভেজানো। রাত দুটো।
মোবাইলে মেসেজ এলো। ঘুমিয়ে পড়ুন। আজ হচ্ছে না।
কান্না পেল যন্তোন্নাবাবুর। ঠকে গেলেন মনে হল। এতক্ষণ নিজেকে সৎ মনে হয়নি। এখন হল। ওকে এতক্ষণ চোর মনে হয়নি। এখন হল। একজন সৎ মানুষকে ও ঠকাচ্ছে, স্পর্ধা! ওর অওকাত কী? ইচ্ছে করলে কী পুলিশে খবর দিতে পারতেন না? ওই ডেরাটার খোঁজ দিয়ে দিতে পারতেন না? ইচ্ছা হল একটা থ্রেট দিয়ে দিই মেসেজে। কিন্তু লিখলেন না। লিখলেন শুধু, ওকে।
======
বেলায় উঠলেন। নিজেকে এখন আর সৎ মনে হচ্ছে না। মোবাইল চেক করলেন। সিন হয়েছে। কিন্তু আর কিছু লেখেনি।
ব্যাগ গুছিয়ে নিলেন। আজ রাতে ট্রেন।
আর কোনোদিন দেখা হয়নি খাঁজকাটার সঙ্গে যন্তোন্নাবাবুর। মেসেজ বা কলও করেননি। বছর দুই পরে একবার হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে খাঁজকাটার কথা মনে পড়ল। পরেরদিন বাইপাস অপারেশন। ফোন করলেন, সুইচ অফ। আফসোস হল, একবার হয় তো কল করা উচিত ছিল। আর কী কোনোদিন পাহাড়ে যাওয়া হবে? অপরাধী লাগল নিজেকে। নিজের সততাকে। মনে হল আত্মা বলে সত্যিই যেন কিছু নেই। থাকলে একবারও ফোন করার প্রেরণা দিত না তাকে? কিন্তু নাই বা দিল। মনে রেখেছিল কে?
[24 May 2024]