ওই ইকোপার্কে নাকি শীতকালে হেব্বি ভিড় হয়…. কত টাকা ঢুকতে নেয়?
বোকেনের ঠাণ্ডা লাগে খুব। পা'টা টাটায়। কোমরটা মনে হয় হিড়হিড় করে কেউ পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। দু'কাপ চা হয়ে গেছে। তাও উঠতে ইচ্ছা করছে না। এখন স্টেশানের দিকে গেলে অন্তত চারটে খেপ তো মারাই যায়। কিন্তু ইচ্ছা করছে না। রিকশাটার সিটের উপর একটা কুকুর শুয়ে। পিঠটা পুড়ে গিয়েছিল ওর। গরম জল পড়ে। ভাতের হোটেলের বাইরে শুয়ে ছিল। নবীনের মা খেয়াল করেনি, এক গামলা গরম জল দিয়েছে ঢেলে। বোকেন ভাত খাচ্ছিল ভিতরে। উফ্..., কি চীৎকার শুরু করল কুকুরটা। নবীনের মা কেঁদেই অস্থির…. এ আমি কি করলাম…. কুকুরটাও নবীনের মায়ের কাছেই দাঁড়িয়ে চীৎকার করছিল। কুকুরও বোঝে, কে মারতে চায়, আর কে ভুল করে মেরে বসে। মানুষ বোঝে না। যা হোক, কুকুরটা সেরে উঠল। কিন্তু নবীনের মা করোনায় চলে গেল।
বোকেনের বয়েস আটান্ন। করোনা তারও হয়েছিল। এখন টের পায়। স্টেশানের পরে উঁচু চড়াইটা বেয়ে উঠতে গেলে বুকে বাতাস ঢোকে না। গুরুর মুখটা মনে করে। ডাকে, দয়াল উতরে দাও।
চায়ের দোকানে কয়েকজন ইকো পার্ক নিয়ে কথা বলছে। বোকেনের ইচ্ছা হয় জগার মা-কে নিয়ে যায়। জগা কেরলে কাজ করে। এখানে দিনে সাড়ে তিনশো দেয়। ওখানে সাড়ে সাতশো দিনেই। জগা'র মা আর বোকেন থাকে দুটো ঘর নিয়ে বানানো বাড়িতে। মন বসে না। ছেলে টানে। নাতি টানে। কিন্তু টাকায় এঁটে ওঠা যায় না। জগা'র মা টিভি দেখে। বোকেন মোবাইলে ইউটিউব দেখে। ওখানেই ইকোপার্ক দেখেছে। তাজমহল আছে। নকল নাকি। হলেই বা। এই যে রোজ দু'বেলা পাথরের কালীকে প্রণাম করছে সব, সেকি আসল কালী? আসল কালী তো রামকৃষ্ণ ঠাকুর দেখেছে। দক্ষিণেশ্বর বার কয়েক গেছে বোকেন। কি কচুরি বানায়! আহা! তো সেই নকল তাজমহলই দেখবে। ছবি তুলবে সামনে দাঁড়িয়ে। সেল্ফি। জগা'র মাকে দেখতে ভালো। পরিষ্কার রং। নাক-চোখ এই বয়সেও….
“দাদা যাবেন?”
দু'জন মেয়েছেলে। চেনে। বিউটি পার্লারে কাজ করে। কি সাজ! নষ্ট মেয়ে হবে। কয়েকবার ফুচকা খেতে দেখেছে। হাঁ করে ফুচকা খায়… এই অ্যাতো বড়…. ছি!
দু'জনেই শাড়ি পরে। কি সেজেছে! তাও এই এত রাতে! ক'টা হবে এখন? দোকানের ঘড়ি দেখল…. সাড়ে আটটা।
মঙ্গল চা ছাঁকতে ছাঁকতে জিজ্ঞাসা করল, কি বিয়ে বাড়ি নাকি?
আরে হ্যাঁ… দুটো পার্টি ধরেছি। একটা হয়ে গেছে…. আরেকটা আমাদেরই চেনা…. আরে ওই ফুচকার দোকান স্টেশানের পাশে…. কার্তিকদা…. ওর মেয়ের বিয়ে…. খুব করে বলেছে আজকে একবার যেতে… দেখো না কত রাত হল…. যেটা সাল্টে এলাম সেই পার্টিটার খুব নক্সা…. টাকা দিচ্ছে বলে যেন কিনে নিয়েছে…. এটা করো…. সেটা করো…. মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্তত আরো আটজন সাজলো…. আচ্ছা বলো….. টাকা দেবে কিন্তু সময় বলে তো আছে কিছু একটা…..
আরেকজন বলল, তুই করতে গেলি কেন? আমি তো বারণই করেছিলাম…..
আগেরজনের মুখটা বদলে গেল, কি জানো তো দাদা ছেলেটার একটা বুট লাগবে…. খেলার জন্য… একা সবটাই তো আমার…. তাই ভাবলাম…..
বোকেন তাকালো সোজাসুজি। বলল, ওই কার্তিকের মেয়ে একবার পালিয়েছিল না কার সঙ্গে জানি….
প্রথমজন বলল, সে দাদা শুনেছি…. কিন্তু কেন বলো তো…. পালিয়েছিল বলে আর বিয়ে করতে নেই…
পাশেরজন বলল, থাম না…. সব শালা ধোয়া তুলসীপাতা…..
যা বলেছিস…. কেন দাদা আপনার এত জ্বলছে কেন…. হ্যাঁ পালিয়েছিল…. বয়েস অল্প ছিল… ভুল করেছিল…. তো? এই করে মঙ্গলদা মেয়েটার বিয়েই হচ্ছিল না…. কেউ না কেউ মেয়েটার বিয়েতে ভাঙচি দেবেই…. শালা হারামজাদা…
মঙ্গল চায়ের বাটি মাজতে মাজতে বলল, হেই… মুখ খারাপ করিসনি….. বাদ দে….
দ্বিতীয়জন বলল, বাদ দিয়ে দিয়েই তো এই জায়গায় এসেছি দাদা….. কারা যে এদেরকে সবতাতে মাতব্বরির দায় দেয়…. শেষে সোদপুরের একটা ছেলে…. মেয়েটার সঙ্গে ট্রেনে পরিচয়…ছেলেটার ওষুধ সাপ্লায়ের ব্যবসা…. তার পছন্দ হল আরতিকে…..
প্রথমজন বলল, কলকাতার কাজটাও মেয়েটা এখান থেকে পালাবে বলেই নিয়েছিল…. আর তোমরা শালা খানকির বাচ্চারা বসে বসে এর ওর চরিত্রের কুয়োরা করবে….
বোকেন এইবার রীতিমতো থতমত খেল। এত কথা আছে জানত না তো। আসলে তলিয়ে দেখেছে কোথায়…. কিন্তু এখন কান মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে…. আরতিকে দেখেছে…. পাপের নজরে দেখেছে….. যে মেয়ে একবার পালায় সে তো বারোয়ারি…. সস্তা…. বোকেন মাথাটা নীচু করে আছে….আগে হলে হল্লা করে পাড়া মাথায় করত…. এখন বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জানে সত্যিটা কেউ দেখিয়ে দিলে চুপ করে যাওয়াই ভালো…..
বোকেন উঠে রিকশা থেকে কুকুরটা নামালো। একটু জোরেই “হ্যাট হ্যাট” করল… জড়তা কাটানোর জন্যেই…..
মেয়েদুটো রিকশায় বসল….. বোকেন একটাও কথা না বলে কার্তিকের বাড়ির সামনে এনে দাঁড় করালো রিকশা। কার্তিকের বাড়ির সামনে সানাই বাজছে। কি সাধারণ একটা প্যাণ্ডেল! মেয়েদুটোকে দেখে কেউ ভিতরে খবর দিতেই ভিতর থেকে কার্তিক আর কার্তিকের বউ দৌড়ে বাইরে এলো….
“উফ্ বাঁচালে গো…. মেয়েটা তো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিল….”
কার্তিকের বউ প্রথমজনের হাতটা ধরে টানছে। দ্বিতীয়জন বোকেনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করছে…. কত দেব….. কার্তিক বোকেনের হাতটা ধরে বলছে, এসেই যখন পড়েছ দাদা দুটো খেয়ে যাও…. মেয়েটার মঙ্গল হবে….. আমি গরীব সবাইকে বলতে পারিনি…
সানাই বাজছে…. বোকেনের চোখ ফেটে জল আসছে…. কার্তিক বোকেনের হাতটা ধরে বিয়ে বাড়ি ঢুকছে….. বোকেনের গাল গড়িয়ে জল নামছে….. ক্ষমা করিস মা…. সুখী হ… সবার সুখী হওয়ার অধিকার আছে…. সবার…. হঠাৎ মনে হল আজ একটা বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে যাবে….. কুকুরটার জন্য….. হাতে করে খাওয়াবে…..