সৌরভ ভট্টাচার্য
12 April 2019
তারপর?
তারপর প্রচণ্ড মেঘ করল
তারপর?
তারপর ভীষণ ঝড় উঠল, বৃষ্টি হল
তারপর?
মেঘেরা উড়ে গেল। মেয়েটা বারান্দায় এলো। বারান্দাটা বৃষ্টির জলে ভিজে। মেয়েটা খালি পায়ে বৃষ্টির জলে ভিজল। মেয়েটা যেন আকাশকে ছুঁলো। গ্রিলের ফাঁকে জমে থাকা জলের বিন্দুগুলোতে আকাশের প্রতিচ্ছবি দেখে প্রচণ্ড খুশী হল। জলের কয়েকটা বিন্দু আঙুলের মাথায় নিল। টলটলে জলে তার মুখের ছবি। জিভে দিল। ঠাণ্ডা জল। শিল পড়েনি। সকালবেলা বৃষ্টি হলে কেন জানি শিল পড়ে না। মেয়েটা সন্ধ্যেবেলার শিল দেখেনি কোনোদিন। তখন তার গানের মাস্টার। অঙ্কের মাস্টার। বিজ্ঞানের মাস্টারের। কবিতার দাদা। আঁকার কাকা। রবিবারে যোগ ব্যায়ামের ক্লাস, বাড়িতেই। তিন তলায় ফ্ল্যাট তো তাদের। লিফট নেই। হুইল চেয়ার নামাবে কে? রত্নামাসিই দেখাশোনা করে। বাবা মায়ের চাকরি। সামনের বছর উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার কথা তার। দেবে কিনা ডাক্তার বলবে। মাথার মধ্যে নিউরন ছিঁড়ে যাওয়ার শব্দ পায় সে, মাঝরাতে। তখন খাটে উঠে বসে। জানলা বন্ধ। এসির আওয়াজ। তার মনে হয় পুরো আকাশটা একটা বুড়োর মত সব তারাগুলো পিঠের ঝোলায় ভরে একা একা হাঁটছে। সে চলে গেলেই দিন। জানলা খুলবে। এসি বন্ধ হবে।
মেয়েটা খাটের উপর রাখা অ্যাটলাসের ম্যাপটা খুলল। রত্না মাসি স্নানে গেছে। তার এই সময়টা খুব ভালো লাগে। কেউ চোখে চোখে রাখে না। চোখের সামনে থাকতে কেমন যেন লাগে। যদিও সে জেলে যায়নি কখনও, টিভিতে দেখেছে, সেরকম লাগে। বদ্ধ বদ্ধ। কষ্ট কষ্ট। ম্যাপে সে দেশ দেখে না, পাহাড় পর্বত নদী দেখে। দেখতে দেখতে অমলের কথা মনে পড়ে। কিন্তু অমল তো ফ্ল্যাটে থাকত না। তার তিনতলার জানলায় কে আসবে? পাখিও বসে না। মাঝে মাঝে প্রজাপতি বসত। এখন তাও বসে না। মা ফুলগাছ লাগায় কই আর? অমলের মত ভাগ্য নয় তার। তার জানলায় শুধুই আকাশ। তাও যদি মেঘ হয়, মনে হয় কেউ তো এলো! বৃষ্টিগুলো যেন আকাশের গিফট।
রত্নামাসি গান গাইছে। পুরোনো বাংলা সিনেমার গান। আজকাল খুব ফোন আসে রত্না মাসির। ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে। মাঝে মাঝে নীচে নেমে যায়। মেয়েটা বোঝে, দেখা করতে যায় কারোর সাথে। রত্নামাসি বিধবা। মেয়ে আছে, নাইনে পড়ে। বর বিষ মদ খেয়ে মারা গিয়েছিল। রত্না মাসি মায়ের সাজের জিনিসে হাত দেয়। মেয়েটা কিছু বলে না। না দেখতে পাওয়ার মত করে। করুক, তবু তো নীচে নামতে পারে। তার তো স্কুলে যাওয়াও বারণ। গেলেও দুতিন মাসে একবার।
অমলের আরেকটা সুবিধা ছিল, সে মেয়ে ছিল না। বাইরের কেউ এলেই মা সাবধান করে দেয়। রত্নামাসিকে বলে ঢোলাঢালা পোশাক পরাতে, সে নাকি বয়েসের চাইতে বেশি ডেভলপড। ডাক্তারকে বলেছে মা, ডাক্তার বলেছে ওষুধের জন্য। একদিন রত্নামাসির বয়ফ্রেন্ড এলো উপরে। মনে হল রত্নামাসির থেকে ছোটো। রোগা মতন, জিনসের প্যান্ট আর চেকচেক জামা পরে এসে সোফায় বসল। তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, তুমিই মুনিয়া?
লোকটার দৃষ্টি ভালো না। রত্নামাসি যে কেন তাকে সেদিন ঢোলাঢালা পোশাক পরায়নি! তারপর থেকে মাঝে মাঝেই এলো লোকটা, নাম জীবন। ওরা মা বাবার ঘরটায় গিয়ে দরজা বন্ধ করে গল্প করতে শুরু করল। মেয়েটা তাকে আঙ্কেল বলে ডাকে। আজকাল সে কেমন একটা বিচ্ছিরি ব্যবহার করে। তাকে চুমু খেল একদিন ফট করে, রত্নামাসি যখন চা বানাতে গেছে। দুপুরে বমি হল মেয়েটার। তবু সে কাউকে কিচ্ছু বলল না। যদি কিছু হয়, সে দৌড়াবে কি করে? তাকে তো একাই থাকতে হবে সোম থেকে শনি। একবার ভাবল রত্নামাসিকে বলবে। বলল না। তার আগেই....
রত্নামাসি খুব কাঁদল। মায়ের কাছেই কাঁদল। লোকটা রত্নামাসির মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। মেয়েটার খুব কষ্ট হল। আচ্ছা রত্নামাসির মেয়েটারই বা কিরকম বুদ্ধি, পা থাকলেই কি সব জায়গায় যেতে হয়? সে কি যায়? যেমন নীচে নামার সিঁড়ির কাছে গেলেই তো চাকা উলটে পড়ে যাবে সে, এ বুঝতে কি এমন বুদ্ধি লাগে। তবু....
রত্নামাসির মেয়েটাকে পাওয়া গেল, ওরা বিয়ে করেছে। মা বলল পুলিশে খবর দিতে। বাবা বলল তাই করো রত্না। রত্নামাসি শুনল না।
এখন রত্নামাসি কথা কম বলে। স্নান করতে গান গায় না। সে আর রত্নামাসি চুপ করে বারান্দায় বসে থাকে। আকাশ দেখে। রত্নামাসি বলেছে ফুলগাছ লাগাবে। প্রজাপতি আসবে। গ্রিলে বসবে। মেয়েটার তবু মনটা খচখচ করে, তার মনে হয় রত্নামাসি যেন অন্য কেউ হয়ে গেছে। মেয়েটা এখন প্রজাপতি বা বৃষ্টির অপেক্ষা করে না, সে চায় রত্নামাসির মেয়েটা ফিরে আসুক। রত্নামাসি আবার কথা বলুক, আবার গান গাক, মায়ের সাজের জিনিস নিক, সাজুক। তখন সে নিশ্চিন্তে আকাশ দেখবে।