Skip to main content

        হাতের কাছে একটা পিস্তল থাকলে হয়ত ভালো হত। মোহান্ত স্নান সেরে মেঝেতে কৃষ্ণের বিগ্রহের সামনে চোখ বন্ধ করে বসে। গঙ্গার হাওয়া জানলা দিয়ে ঘরে একটা বাচ্চা ছেলের মত এলোমেলো ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মোহান্তের পিঠের উপর এলিয়ে পড়া সাদা চুলের গুচ্ছ দুলিয়ে দুলিয়ে যাচ্ছে। সারা ঘর চন্দন, ফুল আর ধূপের গন্ধে একটা স্বর্গীয় পরিমণ্ডল তৈরি করে রেখেছে। শরৎকালের শেষ। কালীপূজো হয়ে গেছে। বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডাও পড়েছে। মোহান্তের রসকলির দু'পাশে বড় বড় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। রসকলির শ্রী নষ্ট করে কপালটাকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। মোহান্তের বয়েস চুরাশি।


        মোহান্ত তখন ছোটো মোহান্ত। বয়েস চল্লিশের গোড়ায়। সদ্য সাধন-ভজন সম্পন্ন করে ঋষিকেশে বারো বছর কাটিয়ে মঠে ফিরেছেন আগরপাড়ায়। বড় মোহান্তর অত্যন্ত স্নেহের পাত্র তিনি। সবাই জানেন তিনিই মঠের পরবর্তীকালের মোহান্ত। তিনি মঠে যোগ দিলেন বড় মোহান্তর সেবক হিসাবে। তার দীর্ঘ, সুঠাম, গৌরবর্ণ শরীর অনেকের মনেই মহাপ্রভুর কথা মনে করিয়ে দিত। ছোটো মোহান্তও তা জানতেন, তিনিও তার ভক্তকূলের তার প্রতি এই মনোভাব দৃঢ় করার কোনো চেষ্টাতেই ক্ষান্তি দিতেন না। বড় মোহান্ত সব জেনেশুনেও ব্যাপারটাকে প্রশ্রয় দিয়েই আসতেন। কারণ মঠের শ্রী-বৃদ্ধি। মঠের গোশালা, ক্ষেত পরিপূর্ণ। আগে ভিক্ষার জন্য নবাগত সাধু-ব্রহ্মচারীরা এর দরজায় তার দরজায় ঘুরত, এখন সে সবের পাট চুকে গেছে। মঠের ভাঁড়ার, ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট মা লক্ষীর পূর্ণ আবাসস্থল এখন। এ সবের কারণ ছিল দু'জন, এক, ছোটো মোহান্ত আর দুই, নবনীতা।
        নবনীতার কথায় আসার আগে ছোটো মোহান্তর কথা একটু বলে নিই। ছোটো মোহান্তর পূর্বাশ্রম নদীয়ার একটা অখ্যাত গ্রামে। ছোটো মোহান্ত ওরফে দেবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়। তার গৌরকান্তি রূপের জন্যেই নাকি তার ঠাকুর্দা তার এই নাম রেখেছিল। দেবজ্যোতির বয়েস যখন চোদ্দ সে তাদেরই গ্রামের নাপিতের মেয়ে সুজাতার প্রেমে পড়ে। সুজাতারও তাকে ভালো লাগে। কোনো এক বর্ষার দিনে সুজাতা গঙ্গায় স্নান করতে যাওয়ার পথে বাজ পড়ে মাঠের আলপথে মারা যায়। দেবো বিবাগী হয়। তার ভাবুক মন আত্মহত্যার সঙ্কল্প করে। কিন্তু বিধির বিধানে তার সে সঙ্কল্পে বাধা হয়ে আসেন বড় মোহান্ত। তাকে অচৈতন্য অবস্থায় কাঁকিনাড়ার ঘাটে পান। তিনি নৌকায় তাঁর ভক্তের গৃহে রাধা-মাধব প্রতিষ্ঠার জন্য গিয়েছিলেন শান্তিপুর। দেবোর মন সংসার ছেড়ে ঈশ্বরের চিন্তায় ডোবে। তার মনে হয়েছিল ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তাতে আর ভক্তবৎসল স্বভাবের জন্য সে সুজাতাকে ইহলোকে না হোক, পরলোকে অবশ্যই পাবে। সে সাধনায়, তীব্র আকাঙ্ক্ষা আর আকুলতায় আত্মমগ্ন হয়। তার ঐকান্তিকতা দেখে বড় মোহান্ত তাকে ঋষিকেশের মঠে সাধনার জন্য পাঠান। তিনি নিজেও মধ্যে মধ্যে গিয়ে তাকে সদুপদেশ, গুহ্যতত্ত্ব ইত্যাদি শিক্ষার মাধ্যমে তাকে যোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেন সব দিক থেকে। দেবোর মন সুজাতার কথা ভুলে ঈশ্বরের কল্পলোকে আর মহৎসাধক হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় জুয়াড়ীর মত একগুঁয়ে আর অবিবেচক হতে শুরু করে। লোকে বলে, ভাবান্তর।
        তারপরের ঘটনা আমরা শুরুতেই শুনলাম। আগরপাড়ার মঠে ছোট মোহান্তের ফেরার ঘটনা। এবার আসি নবনীতার কথায়। নবনীতা শ্যামবাজারের এক বর্ধিষ্ণু পরিবারের পরমাসুন্দরী মেয়ে। তার পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হয় রাণাঘাটের বনেদী ব্যবসায়ী রাখালরাজ সামন্তের একমাত্র পুত্র অনির্বাণের সাথে। রাখালরাজ ছিলেন বিপত্নীক। একান্ত গুরু অন্তপ্রাণ। তার গুরু ছিলেন আমাদের গল্পের আগরপাড়া মঠের বড় মোহান্ত। নবনীতা বিয়ের দিন রাতেই বুঝেছিল অনির্বাণ কাপুরুষ। তার লিঙ্গোত্থান হয় না। নিন্দুকেরা বলে নারীতে হয় না, পুরুষে হয়। অনির্বাণ সমকামী। নবনীতা বুঝেছিল, অনির্বাণের কিছু কিছু আচরণে। তবে গুরুত্ব দেয়নি। তার শ্বশুর মশায় বলেছিলেন তার ছেলের নাকি গোপীভাবে সাধন। তাই সে ওরকম মেয়েদের মত সাজতে ভালোবাসে মাঝে মাঝে। আসলে ওটা সাধনার উচ্চাবস্থা।
        রাখালরাজ ছেলের এই অস্বাভাবিক আচরণ তার কিশোর বয়েসেই খেয়াল করেন। তাদের বাড়িতে ফাইফরমাশ যে খাটত সেই বেনুর সাথে তাকে যৌনক্রীড়ায় দেখে ফেলেন তিনি নিজে তার শোয়ার ঘরে। তিনি কাউকে কিছু না বলে আগরপাড়ায় গুরুর চরণে সব জানিয়ে সাশ্রুনয়নে এর প্রতিকার চান। গুরু বলেন, যত তাড়াতাড়ি পারিস বিয়ে দে। 
        এই হল বিয়ের ইতিহাস। বিয়ের দু'বছরের মাথায় রাখালরাজ মারা যায়। মঠের সাথে এ বাড়ির যাতায়াত কমে। বড় মোহান্ত চিন্তায় পড়েন। মঠ চলবে কি করে? তখনই ছোটো মোহান্তের আগমন। ছোটো মোহান্ত মঠে আসার কিছু বছর পরে কি এক কারণে অনির্বাণ সস্ত্রীক মঠে আসে। ছোটো মোহান্ত নবনীতাকে দেখেন, তার বুকে সুজাতা জেগে ওঠে। 
        যেন তপ্ত মাটিতে সুপ্ত বীজ বর্ষার অপেক্ষায় ছিল। মাসাধিক কাল অতিবাহিত হতে না হতেই নবোর মঠে যাতায়াত বাড়তে শুরু করে। পূর্ণিমা, অমাবস্যা, একাদশী তো আছেই, তার সাথে নানা পাঁজিভূত ও পাঁজিবহির্ভূত তিথিও উৎসবে পরিণত হয় মঠে। রাশি রাশি উপঢৌকন আসে নবোর বাড়ি থেকে। নবো দীক্ষা নেয় ছোটো মোহান্তর কাছে।
        মঠে সমালোচনা হয়। নিন্দা হয়। কয়েকজন সরলপ্রাণ সাধক ব্রহ্মচারী মঠ ছেড়ে চলে যায়। স্বার্থলোভী আর যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তারা মঠেই থেকে যায়। অবশ্যই তাদের সংখ্যা বেশি। ফলে রটে যায় যারা মঠ ছেড়ে গেল তারা আসলে ছোটো মোহান্তর প্রতি ঈর্ষাতেই গেল। মঠের তিনতলায় একটা সাধন কক্ষ তৈরি হয় ছোটো মোহান্তর। সেখানে নির্দিষ্ট কয়েকজন সাধক আর নবনীতা ছাড়া কারোর প্রবেশাধিকার ছিল না।
        ছোটো মোহান্তর মনে তখন একটা গভীর টানাপোড়েন। সুজাতা, ঈশ্বর আর নবনীতার। নবনীতা বলে, দেখো দেবো, নিজেকে ঠকানো কোন শাস্ত্রে লিখেছে? তোমার মধ্যে যে অতৃপ্ত জ্বালা, আমারও সেই। আর তুমি আমার জীবনে প্রথম নও। আরো আগে এসেছে। তাদের যৌবনের রূপে আমার শরীর সাড়া দিয়েছে, আত্মা না। তুমি আমার আত্মাকে জাগালে। আর কি জানো মোহান্ত, প্রেম কখনও সোজা সরল পথে আসে না, তার পথ চিরটাকালই বাঁকা, তোমার ইষ্টও তো সেই বাঁকাবিহারী, কি বলো? আর পাপ? ওসবের ভয় আমার নেই। আমার পাপের বিচার করবে যে ঈশ্বর তাকেই রাখিনি আমার বিশ্বাসের ঘরে, তবে আর পাপ কি বলো?
        মোহান্ত বলে, তুমি তোমার প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দিতে কত নীচে নেমেছ জানো? সাথে আমাকেও টানছ? 
        নবনীতা ফোঁস করে ওঠে, আমি নামাচ্ছি? তুমি দুর্বল হওনি?
        - সে আমার দুর্বলতা, কন্ঠে একটা কৃত্রিম দৃঢ়তা আনতে চেষ্টা করে মোহান্ত। 
        - সে দুর্বলতা কি তুমি নও? কেন ঠকাচ্ছ নিজেকে দেবো?
        ছোটো মোহান্ত চুপ করে থাকে। দুর্বলতাই কি শুধু? ভালোবাসা নেই? সে জড়িয়ে নবোকে চুম্বন করে। 
        নবো বলে, ঈশ্বরকে ত্যাগ করো, সে-ও মোহ। পাপের ভয় আর থাকবে না। আলো না থাকলে অন্ধকারে ভয় কি বলো?

        বড় মোহান্ত ক্রমে এই আগরপাড়া মঠে থাকা কমিয়ে দেন। তিনি বেশিরভাগ সময়েই ঋষিকেশে থাকেন এখন। ভক্তেরা বলে, সাধনের শেষ সীমানায় এখন তিনি; নিন্দুকে বলে, পালানোর ছল। কয়েক বছর পর মারা যান বড় মোহান্ত। ছোটো মোহান্ত হন মঠের অধ্যক্ষ। ততদিনে নবো আগরপাড়াতে একটা বাড়ি বানিয়ে নিয়ে চলে এসেছে। মঠের প্রধান সেবায়েৎ সেই। ঘটনাটা ঘটল আরো কয়েক বছর পর। নবো সন্তানসম্ভবা হল। এতদিন যা চলে আসছিল তা অনির্বাণের নজর না এড়ালেও সে কোথাও একটা কোনো একটা বিশাল দায় আর অপরাধবোধ থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিল। কিন্তু তা ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে, লোকশ্রুতির আড়ালে না হলেও। কিন্তু নবোর শরীরে যখন গর্ভসঞ্চারের লক্ষণ দেখা দিল তখন আর মাথা ঠিক রাখতে পারল না অনির্বাণ। সে তাকে গর্ভপাত করতে কলকাতার বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। নবো প্রথমে 'হ্যাঁ' বলেও পরে বেঁকে বসল। সে মোহান্তর কাছে কান্নাকাটি করল, বলল, তারা বাইরে কোথাও চলে যাবে, দেশের বাইরে। সেখানে সংসার পাতবে তারা। এই কথাটা শুনেই মোহান্তর যেন যুগান্তরের ঘোর ভাঙল। তার স্মৃতিতে তাদের গ্রামের বাড়ি, দারিদ্র্য, সুজাতা একে একে ভীড় করে এলো। তার মুখের স্বাদ তিতো হতে শুরু করল। ঘুম ছাড়া গঙ্গার ঢেউ গুনে রাত কাটতে শুরু করল।
        ধর্মের স্থানে অধর্মের অভাব হয় না। তাই পয়লা জানুয়ারীর ভোরে যখন নবনীতার গলাকাটা দেহ কোন্ননগর গঙ্গার তীরে পাওয়া গেল সারা মঠবাসী, ভক্তকূল চমকে উঠলেও, মোহান্ত স্থির দৃষ্টিতে তার উপাস্যের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। শুধু বললেন, সবই নিয়তি। পুলিশ গ্রেফতার করল অনির্বাণকে। বিচারে তার যাবজ্জীবন জেল হল। মঠের অনেকেই সাক্ষ্য দিল ইদানীং সে তার স্ত্রী'র সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করত। গায়ে হাত তুলত। এমনকি একদিন মোহান্তর গায়েও হাত তুলতে গিয়েছিল মদ্যপ অবস্থায়।


        গঙ্গা দিয়ে বহু জল গেল। মোহান্তর স্মৃতিতে সুজাতা, ঈশ্বর, নবো কেউ বেঁচে নেই আর। আছে শুধু মঠের প্রসার আর প্রচারের লক্ষ। তার অনেক শিষ্য এখন। প্রচুর বাণীর বই তার। দেশবিদেশে শান্তির দূত হিসাবে যেতে হয় প্রায়ই। তবু গতকাল সন্ধ্যের সময় ভক্তদের প্রণামের লাইনে অনির্বাণকে চিনতে ভুল হয়নি তার। কি করে বেরোলো সে! কি চেহারা হয়েছে! রুক্ষ, রুগ্ন, যেন বাজে খাওয়া গাছ একটা। কিন্তু তার চোখের মধ্যে একটা দগদগে প্রতিশোধের আগুন মোহান্ত দেখে। আর ঠোঁটের আগায় একটা হাসি। পাপ পাপের পায়ের আওয়াজ বহু আগে থাকতে শুনতে পায়। মোহান্তও পেলেন। তাই তার রসকলি ঘর্মসিক্ত আজ। সারাদিন পায়চারি করলেন। ভাবলেন, কয়েকজন বিশ্বস্ত সেবককে দিয়ে তার ব্যবস্থাও করিয়ে দেওয়া যাক। কিন্তু করলেন না। অনেকবার রিসিভার হাতে নিয়েও খাটে এসে বসলেন। ইষ্টমূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনুভব করলেন কোথাও যেন একটা মুক্তি চাইছেন তিনি? কিসের থেকে মুক্তি? পাপবোধ তো তার আজন্ম নেই। ঈশ্বর তো বহুকাল হল মৃত তার কাছে, তাই এত গল্প তাকে নিয়ে তিনি বানিয়ে চলেন। তবে কি তার মধ্যে তার অবাধ্য কোনো সত্তা আছে? কে সে ? পাপ? না পাপের যন্ত্রণা? বহুকাল পরে মোহান্তর চিদাকাশে ঈশ্বর এসে দাঁড়ালেন। তিনি হাতজোড় করে রইলেন কোন অদেখা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে – যে পাপের যন্ত্রণা।
        পরেরদিন একাদশী। প্রণামের বিরাট লাইন। মোহান্ত অন্যমনস্ক, কাকে যেন খুঁজছেন। তার মুখের জ্যোতি, লাবণ্য গ্রহণে ঢাকা যেন আজ। হঠাৎ তার দৃষ্টি স্থির হল লাইনের বিশেষ এক ব্যক্তির উপর - অনির্বাণ। মোহান্ত উঠতে চেয়েও উঠতে পারলেন না। বসে পড়লেন। দরদর করে ঘামছে শরীর। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সামনে দাঁড়িয়ে অনির্বাণ। 
        প্রথম গুলিটা বিঁধল তার বুকে। পরেরটা মাথায়। তারপরেরগুলো এলোপাথাড়ি। রক্তাক্ত প্রণাম বেদীতে লুটিয়ে নিথর হল মোহান্ত। অনির্বাণ পালালো। হাওড়া ব্রীজের তলায় পাওয়া গেল তার ফুলে ওঠা পচা দেহ। ভক্তেরা বলল, পাপের শাস্তি।