Skip to main content

নাকছাবিটা, কানের দুলটা, হাতের বালাটা খুলে পাশের বেডের স্বপ্নাকে দিল। রাখতে। স্বপ্না বিশ্বস্ত বলে না, আর কাউকে দেওয়ার নেই বলে। স্বপ্নার দু'দিন দেরি আছে আরো। তার আজকেই সীজার হবে। আজকেই। ডাক্তার বলেছে। তার কাছে ফোন নেই। বাড়িতে ফোন করেছে, কেউ তোলেনি। কাজে আছে নিশ্চয়ই সবাই।

করিডোরের আলোগুলো একটা একটা করে চলে যাচ্ছে। আরতি চাকা লাগানো বেডে শুয়ে। চাকাটা ঘটাং ঘটাং আওয়াজ করছে। পেটটায় ধাক্কা লাগছে। কোমরটাতেও।

গয়নাগুলো আসল না। তবু ওইটুকুই তো সম্বল। গয়নাগুলো থাকবে তো?

অজ্ঞান হয়ে যাবে সে এখনই। যেমন আগে দু'বার হল। জ্ঞান ফিরতে জানল সে আবার মেয়ে জন্ম দিয়েছে। হতাশ লেগেছে। ভীষণ হতাশ।

এবারেও মেয়ে হবে কিনা জানে না। কিন্তু চিন্তা সেটা নিয়ে নয়। গয়নাগুলো নিয়ে। যদি বেরিয়ে যায়। কি নিয়ে বেরোবে। স্বপ্না কি নিয়ে নেবে? স্বপ্না কি এইটুকু সময়ের মধ্যেই মারা যেতে পারে?

যখন জ্ঞান ফিরবে, তখন গয়নাগুলো চিনতে পারবে তো? যদি বর কাজ থেকে চলে আসে? যদি তার হাতে দিয়ে দেয়? যদি.....

আরতি আর ভাবতে পারছে না। কোমরটা দিয়ে বিষ নেমে যাচ্ছে। এখনই ঘোর তৈরি হবে। নাকি পুরো অজ্ঞান হয়ে যাবে?

========

মেয়ে হয়েছে।

আরতি বাজারে অনেক গয়নার দোকান দেখেছে। অল্প অল্প করে গয়না কিনে রাখবে মেয়েগুলোর জন্য। গয়নাগুলো সঙ্গে থাকবে। আর কিছু থাকবে না। শুধু গয়নাগুলো সঙ্গে থাকবে।

আরতি গয়নাগুলো স্বপ্নার কাছ থেকে পেয়েছে। স্বপ্নার কানের, নাকের, গলার, হাতের সব গয়না খুঁটিয়ে দেখেছে। স্বপ্নার মাথার কাছে মোবাইল রাখা থাকে। চার্জে বসায়। স্বপ্না নাকি 'আঙ্গুনবাড়ি' কাজ করে। আরতি স্কুলে গেছে। ক্লাস এইট অবধি। তারপর মা ছাড়িয়ে দিয়েছে। দাদাদের মাষ্টারের অনেক খরচ। দাদারা এখন চাকরি করে। আরতিকে ওরা বিয়েতে খাঁটি গয়না দেয়নি কিছু। যা দিয়েছে শুধু বউদিদের। রাগে গা পুড়ে যায়। কাকে বলবে? তার বর কলকাতায় জন খাটে। তার শুধু ইচ্ছা গয়না ক'টা থাক। এই মেয়েদের উদ্ধার করবে কি করে?

========

ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। আরতি খায়নি আজ দুপুরে। হাস্পাতালের গন্ধ নাকে। বমি পায়। ওদের বাবা আসবে না ক'দিন। শিলিগুড়ি গেছে মালিকের সঙ্গে। মালিকের বউ অসুস্থ। বাপের বাড়ি রেখে আসতে গেছে।

আরতি চৌকিতে শুয়ে শুয়ে বৃষ্টি দেখছে। দুটো টালি ফাটা। জল নামছে রান্নাঘরের দিকে। নামুক। কাল দেখবে।

একদম ছোটোটা ঘুমাচ্ছে বুকের দুধ খেয়ে। তার আগেরটা পাশের বাড়ি টিভি দেখতে গেছে। বড়টা স্কুলে গেছে। আরতি আবার গয়নার কথা ভাবছে। যে ক'টা বাড়ি কাজ করে… যদি তার স্বভাব খারাপ হত…. এতদিনে ক'টা নাকের, কানের, আঙুলের সোনা যে এসে জমত….

আসলে সে ভীতু। এই গোনা টাকাটা সংসারে না এলে খাবে কি? ওর তো দু'মাস কাজ তো পনেরো দিনের ফুর্তি… নয় কাজ নেই……

মেয়েগুলোকে ভীতু করলে হবে না…..

বড়মেয়ে ঢুকল ভিজে। ছাতা তো দুটো। একটা হারিয়েছে। আরেকটা ওর বাবা নিয়ে গেছে।

========

আজ তাড়াতাড়ি চলে এলি?

আজ বিদ্যাসাগরের জন্মদিন… তাই হাফছুটি…..

ভাত, ডাল আর ঢ্যাঁড়স সেদ্ধ। মেয়েটা একটা পেঁয়াজ আর লঙ্কা কেটে খেতে বসেছে। আরতি খাটে বসে বসে দেখছে। জোরে বাজ পড়ল একটা।

কে রে বিদ্যাসাগর?

একজন মনীষী মা। মেয়েদের শিক্ষার জন্য অনেক কিছু করেছেন… বিধবা বিবাহের জন্য……

আরতি হাসতে শুরু করল…. বলল, বিধবা বিবাহ আবার কিরে… তোর মাসিটা সেই কুড়ি বছরে বিধবা হল… মেসোকে সাপে কাটল…. তারপর? কে ঘরে তুলল? বলল, ওর কুষ্ঠিতে নাকি বেধবা হওয়াই আছে…. শুনিস নি? এখন কেমন খ্যাংড়াকাঠির মত চেহারা হয়েছে…. দেখিস না….. ওসব বইটই পড়ে….

উফ্ মা…. তোমার সঙ্গে তর্কে গিয়ে লাভ নেই…..

না নেই…. এই যে তুই বই মুখে করে রাতদিন পড়ে থাকিস… কই ফাস্টসেকেন্ড… কই কিছুই তো হোস না….

মেয়েটার ভাতের হাত থালায় আটকালো। কথাটা এখন বলা উচিৎ হয়নি…. কিন্তু বেরিয়ে যখন গেছেই কথাটা….

আমায় মাষ্টার দিলে…..

ও কিস্যু হত না…. আমার দাদার মেয়ে… দশটা মাষ্টার পোঁদে গোঁজা… উচ্চমাধ্যমিকে সেকেন্ড ডিভিসান…. কি হবে? ওই তো ছেলে খুঁজছে…. শোন মা…. মাথা থাকলে সেকালেই কি আর একালেই কি…. দাম ছিল… হ্যাঁ মাথা থাকলে একালে সুবিধা বেশি…. সুযোগ বেশি…. কিন্তু মাথা না থাকলে…. ওই পুরুষমানুষের সঙ্গে গলা ফাটিয়ে কোন্দল করে জীবন কাটাও…. আমায় দেখিস না…. তোর বাবাকে ঘরে টিকতে দিই না… কারণ ওইটুকুই তো পারি…… মাথা থাকলে আমিও কিছু করে দেখাতাম…. আমাদের সজনে পিসি…. একাই বড়ির ব্যবসা করে গ্রাম কে শহর মাত করে দিল… কি করে? মাথা ছিল….

মা চুপ করো…. ঘুমাও….

দ্যাখ মা… পুরুষদের মাথার জোর না থাকলেও পেশির জোর… সমাজের জোরে অনেক কিছু করে নেয়… তুই আমি পারব? পারতাম…. যদি সেই গুণটা দিত আমাদের ভগবান…. সে গুণে অনেক কিস্তিমাত হয়ে যায়…. পুরুষদের চোখে একটা খিদে থাকে…. কিন্তু আমরা সে চোখে পড়ি না…. না তুই, না আমি…. তোর মেজো বোনটা অবশ্য…. জানি না এটার কি হবে…… আমাদের এভাবেই বাঁচতে হবে রে…. যদি মাথা না থাকে তো…. তোর আমার মত ভাগ্য… না মাথা… না সে গুণ….. মা হয়ে তো আর অন্য রাস্তায় যেতে বলতে পারি না…… গেলেও কিছু গয়না জমাস…. এই কথাটা আমার মনে রাখিস…. পাপ বলে কিছু হয় না রে… পড়ে পড়ে মার খাওয়াটাই পাপ…. আর কিছুতেই কোনো পাপ নেই…… তোর দিদিমা-ঠাকুমার সহ্য ছিল… একে ওরা ধম্মো বলত…. এখন ওসব চলে না…. এখন….

========

সুখী ভাত ক'টা খেয়ে বাইরে এসে পাড়ার চণ্ডীমণ্ডপে বসল। মায়ের মাথাটা কি সত্যিই খারাপ হয়ে গেল? পাড়ার অনেকেই আজকাল বলে। আরতিদি বদলে গেছে। পাগল হয়ে যাচ্ছে।

লাইটের কাজ করে রতন তার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে। সাইকেল থেকে বাইক কিনেছে এই চার বছরেই। তাকে ভালোবাসে। তাকে মাঝে মাঝেই স্কুল থেকে ফেরার পথে পুকুরের ওদিকে নিয়ে যায়। তারপর যা যা হয় সব বিয়ে হওয়া ছেলেমেয়ের মধ্যে হয়। তাদের বিয়ে হয়নি ঠিক… পরে তো হবে…. রতন ওই সময়ে তো আর মিথ্যা বলতে পারে না…. ওই সময়ে কেউ-ই মিথ্যা বলতে পারে না….. মায়ের মাথাটাই খারাপ…. তার যে আজকাল একটু শরীরটা খারাপ হচ্ছে সেটাও মাকে বলতে পারে না…. রতন বলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে…. যাবে তো একদিন….