Skip to main content


গাড়ির কলকব্জা সব ঠিকঠাক। চালক দক্ষ। পথ নিয়ে ভাবনা নেই যাত্রীদের।
তবু গাড়ি মাঝপথে রইল থেমে।
যাত্রীরা গাড়ি থেকে নেমে চালককে জিজ্ঞাসা করল, কি সমস্যা?
চালক বলল, পথ ভুলেছি।
যাত্রীদের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল পথ নিয়ে। কেউ বলে পাহাড় পেরিয়ে উত্তরে, কেউ বলে সাগর ডানে রেখে দক্ষিণে, কেউ বলে জঙ্গলের সোজাসুজি পুবে, কেউ বলে মরুদ্যানের দিকে পশ্চিমে।
গোলযোগ শুরু হল তুমুল। গাড়ির মধ্যে ধুন্ধুমার কাণ্ড। চালক বিভ্রান্ত। গাড়ির কলকব্জা তার নখ দর্পণে, সেই নিয়ে কোনো সংশয় নেই, কিন্তু পথ?
সূর্য ডুবল। যাত্রীরা ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল। কেউ কেউ মধ্যরাতে যতদূর পায়ে হেঁটে যাওয়া যায় হেঁটে, বিফল হয়ে এল ফিরে, আবার গাড়িতে।
ভোর হল। চালক গাড়ির থেকে নেমে একটা টিলার উপর বসে। কেউ বলল ধ্যানমগ্ন, কেউ বলল চিন্তামগ্ন, কেউ বলল বিষাদগ্রস্ত, কেউ বলল লজ্জিত, কেউ বলল বিভ্রান্ত।
গাড়ি স্থির দাঁড়িয়ে। যাত্রীরা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছোটো-ছোটো দল করে বসে। ধুধু চারদিক, কোনো জনপ্রাণী নেই।
হঠাৎ দেখা গেল দূর থেকে কেউ একজন গরুর গাড়ি চালিয়ে আসছে। সব্বাই ধেয়ে গেল, এই নিশ্চয় জানে পথের দিশা। সবাই তাকে ঘিরে এমন হইহই করে উঠল, সে গেল ভড়কে। সে বলল, আপনারা একে একে বলুন কে কোথায় যেতে চান।
সবাই একে একে নিজের গন্তব্য বলল। কারোর সাথে কারোর মেলে না। গরুর গাড়ির চালক বলল, ওই যে টিলার উপর বসে, ওই কি তোমাদের চালক?
তারা সমস্বরে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ।
গরুর গাড়ির চালক তাদেরকে নীচে অপেক্ষা করতে বলে তরতরিয়ে উঠে গেল টিলায়, গাড়ির চালকের সামনে বসল।
"এদের গন্তব্য তো আলাদা, তুমি নিয়ে যাবে কি করে?"
গাড়ির চালক নিরুত্তর।
"গরুর গাড়ির চালক বলল, সবাইকে যদি একে একে চালকের আসনে বসাও, যে যার মত করে নিয়ে যাবে তার গন্তব্যে?", গরুর গাড়ির চালক বলল।
গাড়ির চালক মাথা নাড়ল।
"হুম, বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে" চিন্তিত মুখে বলল গরুর গাড়ির চালক। পরক্ষণেই বলল, "আচ্ছা এমন যদি হয়, কোনো একটা জায়গাকেই স্থির বলে তুমি চালালে, নিয়ে গেলে। যারা সেদিকের যাত্রী তারা পৌঁছালো, বাকিদের তুমি হয় সেখানে বন্দী করে রাখলে, কিম্বা নিজেদের দায়িত্বে পাঠিয়ে দিলেই হয় না?"
গাড়ির চালক কথা বলল না। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো।
ততক্ষণে নীচে একটা হইচই পড়ে গেছে। যাত্রীরা অস্থির।
এমন সময় কোত্থেকে এক বাউল এল। হাতে একতারা। গলায় সাত সুরের চমক। তার গানে কিছুক্ষণের জন্যে যাত্রীরা ভুলেই গেল তাদের যেন কোথাও যাওয়ার ছিল। সে পরপর তিনটে গান শুনিয়ে বলল, তা তোমরা এমন মাঝরাস্তায় বসে কেন গা?
তারা সব বলল।
বাউল সব শুনে বলল, এই কথা! তা গাড়ি কোনো একদিকে এগোলেই হল, দেখতে হবে যেন সোজা যায়, সামনের দিকে, পিছনে না যায়। এগোতে এগোতেই যার যার গন্তব্য এসে পড়বে, নেমে গেলেই হল। রাস্তা কি আর কারোর একার রে ভাই। রাস্তার ধারে ধারেই তো মানুষের গন্তব্য। গতি থাকলেই পথ তৈরি হয়। পথ কি আর গতি তৈরি করে রে ভাই! এই যেমন আমার এই এক একতারাতেই সাত সুরের আত্মীয়তা! প্রাণে সুর না জাগলে কি আর ধাতুর তারে সুর জাগে! প্রাণে সুর চাই, এক সুর না, সাত সুরের সমাহার চাই, তবেই ছুটবে প্রাণ....
সবাই চুপ করে গেল। তাই তো, এই সোজা কথাটা আগে কেন মাথায় আসে নি! গাড়ি এগোলেই হল।

বাউল গান ধরল,
"ওরে নূতন যুগের ভোরে দিস নে সময় কাটিয়ে বৃথা সময় বিচার করে"